[পূর্ব প্রকাশের পরঃ কে আমি-১ [৩]
৩।
কমলাপুর রেল স্টেশনে নেমে বাইরে এসে ফুটপাথ থেকে ফইটক্যার জন্য একটা হাফ প্যান্ট, একটা সার্ট আর একটা গামছা কিনে ওগুলি ওর গায়ে দিয়ে ময়লা লুঙ্গিটা ফেলে দিল। একটা রিকশা নিয়ে
গেণ্ডারিয়া যাবার পথে নারিন্দার মোড়ে নাসিরকে নামিয়ে হিরণ আর ফইটক্যা চলে গেল হিরণদের সাধনার গলিতে দীননাথ সেন রোডের বাড়িতে। বাড়িতে ঢোকার পর মা, ভাবী এরা ফইটক্যাকে দেখে অবাক!
কি রে হিরণ, এ কে?
এর নাম ফটিক, ময়মনসিংহ স্টেশনে পেয়ে নিয়ে আসলাম, দোকানে খাবার আনা নেয়ার কাজে লাগবে তাছাড়া মাঝে মাঝে যখন কাজের চাপ বেশী হয় তখন দোকান বা প্রেস কিংবা মেলার কাজেও লাগবে।
মা জানতে চাইল
জোগার করে দিল কে?
কেউ না, চায়ের দোকান থেকে একরকম ধরে নিয়ে এসেছি
কোথাকার কে না কে চেনা জানা নেই তুই এমনি হুট করে নিয়ে এলি?
হুম, আনলাম দেখি কি হয়!
গ্রন্থ নীড় প্রকাশনী নামে দেশের খ্যাতনামা বই প্রকাশনীর ব্যবসা হিরণের বাবা করেছিলেন। বাংলাবাজারে বুড়িগঙ্গা নদীর তীর ঘেঁসে দোকান। বড় ছেলে তারেক হাসান ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে পড়া শুনার পাট শেষ করে দোকানে যাতায়াত করত। বাবার ইন্তেকালের পর এখন দায়িত্ব নিয়ে চালাচ্ছে। সাথে ছোট ভাইকেও নিয়ে নিয়েছে। হাসান সাহেব বাড়ির পিছন দিকে নিজেদের ছাপাখানা করেছেন, দুই ভাই আর ১০/১২ জন কর্মচারী নিয়ে প্রেস এবং দোকান চালায়। রাতে দোকান বন্ধ করে বাড়িতে এসে প্রেসের প্রডাকশন বা নতুন কাজ ম্যনেজারকে বুঝিয়ে দেয়া বা বইয়ের প্রুফ দেখার কাজগুলি বড় ভাই করে।
দুপুরে প্রেসের কর্মচারীরা বাড়িতে খায় আর দোকানের জন্য বড় টিফিন ক্যারিয়ারে করে খাবার নিয়ে যেতে হয়। এই কাজের জন্য উপযুক্ত মানুষ পাওয়াই যায় না। যাক এখন থেকে ফটিক যদি এই কাজটুকও করতে পারে তাহলেও অনেক। এই উদ্দেশ্যেই নিয়ে এসেছে।
বাড়ির সবার সাথে ফটিকের পরিচয় পর্ব চলছে
ইনি আমার মা ইনাকে নানী ডাকবি আর ইনি আমার ভাবী কাজেই ইনাকে বড় মামি বলবি, আরও একজন মামি আছে সে এখন বাড়ি নেই বিকেলে আসবে, এলে তখন চিনিয়ে দিব। চল এখন গোসল করবি।
একটা সাবান দিয়ে ফটিককে বাথরুম দেখিয়ে বলল যা গোসল করে আয় তারপরে খেয়ে নিই। এমন বাথ রুমের সাথে ফটিকের পরিচয় নেই। ভিতরে ঢুকে সাথে সাথেই আবার বের হয়ে এলো।
মামা!
কি রে?
মামা, এই ইকটু খানি ঘরে কেমনে গোসল দিমু?
ও, এই কথা! এই দেখ, কল খুলে বালতি ভরে এই মগ দিয়ে মাথায় পানি ঢেলে গোসল করবি! ভাল করে সাবান দিয়ে পরিষ্কার করে গোসল করবি, গায়ের ময়লা যেন থাকে না, বুঝেছিস?
হ বুঝছি
আচ্ছা তাহলে তুই আয় আমিও গোসল করে নিই।
গোসল সেরে যখন বাইরে এলো তখন ওর চেহারা দেখে হিরণ আর ওর মা অবাক! সাবান ঘসে গায়ের কাদা দূর হওয়া ফর্সা গায়ের রঙ, কালো চুল তেল জলের অভাবে পুড়ে তামাটে হয়ে গেছে তবুও সদ্য কেনা নতুন কাপরে চেহারায় একটা চমক ফুটে উঠেছে। হিরণ ভাবছে এই কি সেই ফটিক যাকে এত দূর থেকে সাথে করে নিয়ে এসে বাথরুমে ঢুকিয়েছিলাম!
৪।
গোসল সেরে তেল পানি নিয়ে মাথা আঁচড়ে ফটিক মামার সাথে খাবার টেবিলে বসল। বড় ভাবী পাশে বসে। লাল শাক, ভাজা মেনি মাছ, টাটকিনি মাছের ঝোল, গরুর মাংস আর ডাল দিয়ে হাপুস হাপুস খাবার ভঙ্গি দেখে ভাবি আর হিরণের চোখে চোখে অনেক কথা হল কিংবা অল্প কথায় অনেক বেশী ভাব আদান প্রদান হল।
হিরণ জিজ্ঞেস করল-
কিরে ফটিক কেমন লাগছে?
মামি, খুব মজা! আপনেরা কি এমনেই খান পরতি দিন? আমি কি এই গুলা জীবনে দেখছি? কুন দিন ইকটু ডাইল, কুন দিন ইট্টূ আলু ভর্তা এই পাইলেই হাজার শোকর। কুন দিন তো দোহানে মাইনসেরে খাওয়াইয়া কিছু বাঁচলে তাই খাইতাম না বাঁচলে খালি একটা হুকনা রুটি পানি দিয়া চাবাইয়া খাইয়া হুইয়া থাকছি।
খা, তোর যা লাগে তুই যত পারিস খা। এখন থেকে এখানেই থাকবি কাজেই কোন লজ্জা করবি না, যখন ক্ষুধা লাগে আমাকে বলবি।
খাবার পর বিকেলে ফটিককে নিয়ে ঘুরে ঘুরে বাড়ির পিছনের প্রেসটা দেখাল। তারপরে নিয়ে গেল বাংলাবাজারের দোকানে। যাবার সময় ফটিক লক্ষ করল যে সূত্রাপুরের লোহার পুলে প্রতিটা রিক্সা ঠেলার জন্য আট আনা করে দিতে হয়। পুলের এ পাশে এসে মামা পকেট থেকে মানি ব্যাগ বের করে খুচরা আট আনা পয়সা বের করে যে লোকটা ঠেলছিল তার হাতে দিল। ও দেখে জিজ্ঞেস করল কিসের পয়সা দিলেন মামা? মামা বুঝিয়ে বলল।
বড় ভাই এখনও ফটিকের দেখা বা পরিচয় পায়নি বলে সে একটু জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ছোট ভাইয়ের দিকে তাকাল, কে? এখানেও আগাগোড়া সব জানাতে হল। এবার ওকে নিয়ে ভিতরে এবং দোতলার গুদাম সহ সমস্ত দোকান দেখাল। এবার নিচে এসে মজিদ ভাইয়ের হাতে দিয়ে বলল যান মজিদ ভাই একে আশে পাশের চায়ের দোকান এবং আমাদের যে সব জিনিস পত্র কিনতে হয় সেগুলি দেখিয়ে আনেন। ফেরার সময় ওর কাপড় চোপর সহ যা যা লাগে কিনে নিয়ে আসবেন। টাকা নিয়ে যান।
সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার পথে রিকশায় বসে ফটিক অবাক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল
মামা একটা কতা কমু?
বল
এই এতক্ষণ ভইরা যা দেখলাম সব আপনেগো?
হ্যাঁ, কেন?
না এমনেই, আপনেরা কত বড় নোক তাই চিন্তা করলাম!
বাড়ি ফিরে এসে ড্রইং রুমে টেলিভিশন অন করে ফটিককে বলল দেখ টেলিভিশন দেখ, খাবার সময় হলে মামিকে বলবি।
৫।
এই ভাবেই ফটিকের জীবনের রুটিন বদলে গেল। দুপুরে নিজে খেয়ে টিফিন ক্যারিয়ারে করে দোকানের সবার খাবার নিয়ে হেটে দোকানে যাবার সময় মনে হল এখানে একটা রিকশা ঠেললেই আট আনা, বাহ! বেশতো! আমিও এটা করতে পারি। দোকানে যাবার সময় হাতে টিফিন ক্যারিয়ার থাকে বলে এটা সম্ভব নয়। ফেরার পথে চেষ্টা করতে হবে। দোকানে গিয়ে মজিদ ভাই, মামা আর অন্য যারা আছে তাদের সাথে মিশে গেল। সবার মুখে মুখে ফটিক শোন, ফটিক এটা নিয়ে আয়, ফটিক ওটা কর। এই ভাবে ধীরে ধীরে একদিন ফটিকের দোকানের সমস্ত লেখকের সমস্ত বই কোনটা কোথায় থাকে সব মুখস্থ হয়ে গেল। বই এর কভার দেখেই ও বুঝতে পারে এটা কোন লেখকের কোন বই। বড় মামা এখন শুধু বলে দেয় যা তো ফটিক গগন বাবুর ৫ টা অরণ্য নিয়ে আয়। মানে গগন বাবুর লেখা ৫ কপি অরণ্য বিলাস নামের বই নিয়ে আয়। ফটিক জানে এই লেখকের বই দোতলার কোন সেলফে থাকে। লেখাপড়া কিছু না জেনেও ঠিক লেখকের সঠিক বইটাই এনে হাজির,
নেন মামা। আর কিছু লাগব?
না
তাইলে আমি বাড়ি যাইগা?
বাড়ি যাবি? কি করবি বাড়ি গিয়ে?
মামা, কাইল দেখছি আমাগো বাড়ির পিছনে একটা স্কুল আছে, পেরেসের ওই মুরা (ওই পাশে)
হ্যাঁ আছেতো, কেন?
আমারে নিবনা ওই স্কুলে?
তুই কি ভর্তি হতে চাস?
হ, চিন্তা করলাম রাইতে আমারত কোন কাম নাই তাই দেখতাম পারি নাকি। আপনাগো বাড়ির বেবাকতে শিক্ষিত মানুষ আবার আপনেরা বই বানান বই বেচেন আর আমি যদি মুক্কু থাহি তাইলে মাইনসে কি কইব?
বেশ, তাহলে তোর ছোট মামাকে ডেকে নিয়ে আয়
আচ্ছা মামা আমি অহনই আনতাছি
দাদা, আমাকে ডাকছ?
হ্যাঁ, শোন আজ বাড়ি গিয়ে ফটিককে স্কুলে ভর্তি করে দিবি।
হ্যাঁ, আমিও তাই ভাবছিলাম কিন্তু দেই দেই করে হচ্ছিল না। ঠিক আছে আজই দিয়ে দিব।
সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরে হিরণ ফটিককে বলল যা তো দেখে আয় স্কুল খুলেছে নাকি
কথাটা ফটিকের কানে ঢোকার সাথে সাথে এক দৌড়ে বাড়ির পিছনে প্রেসের পাশের রাস্তা দিয়ে বেরিয়ে দেখে এসে জানাল
মামা খুলছে
চল, একটু দাড়া চা টা খেয়ে নিই
আচ্ছা মামা
ফটিকের বুকের ভিতর এক অজানা ঢেউ উথাল পাথাল শুরু করে দিল। আমি স্কুলে ভর্তি হমু?
এই ফটিক চল।
স্কুলে এসে ফর্ম লিখতে গিয়ে হিরণ এক বিপদে পরল। ওর নাম, বাবার নাম কি করবে? একটু ভেবে ওর নাম দিল আরিফুর রহমান। ফটিককে জিজ্ঞেস করল তোরা বাবার নাম কি রে? কি জানি মামা তা কইতারতাম না।
তোর কি কিছুই মনে নেই?
না মামা
আচ্ছা ঠিক আছে, বলে হিরন ওর নিজের বড় ভাইয়ের নাম দিয়ে দিল।
আজ থেকে ফটিকের পরিচয় নতুন নামে শুরু হল।
আরিফুর রহমান।
ফইটক্যার নতুন এক জীবন শুরু হল, বলা যায় নতুন করে জন্ম হল।
বাসায় এসে হিরন সবাইকে বলে দিল ওকে এখন থেকে সবাই আরিফ নামে ডাকবেন। বড় ভাইকে আরিফের বাবার নামের ঘটনা বলে জানিয়ে রাখল। প্রেসে এসে সবাইকে বলে দিল, কাল দোকানেও সবাইকে জানিয়ে দিতে হবে।
৬।
দুপুরে দোকানে খাবার নিয়ে যাবার পর আরিফের স্কুল খোলার আধা ঘণ্টার আগ পর্যন্ত দোকানে থাকে। বই লেখক, পাবলিশার এদের সবার নাম ধাম চিনে নেয়। কার বই, কোন ধরনের বই কোথায় থাকে সব জেনে নেয়। স্কুল খোলার আধা ঘণ্টা আগে চলে আসে। আসার সময় খালি টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে একটা রিকশা ঠেলতে কোন অসুবিধাই হয় না। বাড়ি এসে মুখ হাত ধুয়ে মাথা আঁচড়িয়ে বড় মামিকে বলে কিছু খেয়ে বই খাতা নিয়ে স্কুলে যায়। ক্লাস শেষ হলে ফিরে আসে।
রাতে ড্রইং রুমে যখন সবাই টেলিভিশন দেখে আরিফ তখন কার্পেটে বসে স্কুলের দেয়া বাড়ির কাজ রাতেই করে রাখে। একদিন ছোট মামি বলল
কিরে আরিফ তুই টেলিভিশন দেখছিস না কি করছিস?
মামি, এখনতো গান হইতেছে, গান কানে শুনতেছি, ও আর কি দেখুম? তাই অংক কয়টা কইরা রাখলাম। নাইলে কাইল স্কুলে বেঞ্চে খাড়া কইরা রাখবে।
বাড়ির সবাই লক্ষ করছে আরিফের ভাষার বেশ উন্নতি হয়েছে।
দুপুর পর্যন্ত আরিফের তেমন কোন কাজ নেই। প্রেসের কাদের ভাই কাঁচা বাজার করতে যায় তার সাথে বাজারে যায় আর ফেরার পথে ব্যাগটা নিয়ে আসে। বেশী দূরে না কাছেই বাজার। তবুও এত গুলি মানুষের বাজার একেবারে কম না। বাজার এলে রান্না রান্না হতে থাকে, এদিকে আরিফের স্কুলের পড়া শেষ করে রাখে। যখন যেটা না বুঝে ছোট মামির কাছে জেনে বুঝে নেয়। ছোট মামির কাছেই ওর যত আবদার। মামি আমার এইটা লাগব ঐটা লাগব, কাইল দোকান থিকা আসার সময় এই রহম দেখলাম, এইডারে কি কয়?
ছোট মামি আবার বলে রহম না বল রকম, এইডা না বলবি এটা, আমরা যেমনে কথা বলি সেভাবে বলার চেষ্টা করবি।
আচ্ছা মামি করুম।
আবার করুম! বল করব।
করব।
হ্যাঁ, এইতো এমনি করে বলবি।
পড়া শেষ হলে গোসল করে খেতে আসে ওদিকে নানী বা বড় মামি দোকানের খাবার রেডি করে। আরিফের খাওয়া হলে টিফিন ক্যারিয়ারটা নিয়ে বেরিয়ে যায়। মনে একটা আগ্রহ কাজ করে, দোকানে গেলেই ফেরার পথে নগদ আট আনা পাবে! এভাবে এর মধ্যে ৭/৮ টাকা জমিয়ে ফেলেছে। মনে মনে ভাবছে দোকানের সামনে একটু এগিয়ে সদরঘাটের দিকে এগিয়ে গেলে পোস্ট অফিসের পাশে মাটির ব্যাংক দেখেছে। এক দিন নিতান্ত কৌতুহল বশে দাম জিজ্ঞেস করেছিল। মাত্র আট আনা। ওখান থেকে একটা ব্যাংক কিনতে হবে। আজ গিয়ে সবার খাওয়া হলে সব কিছু গুছিয়ে একটু বেরুতে হবে।
বিকেলের আগে আরিফ একটা ব্যাংক হাতে নিয়ে ফিরছে। হিরণের সামনে পরে গেল।
কি রে এটা দিয়ে কি করবি?
টাকা জমামু মামা!
টাকা পাবি কোথায়?
কেন, রিকসা ঠেলি রোজ
রিকশা ঠেলিস! কখন?
হিরন ভেবে পায় না
কেন মামা, বাড়ি যাইবার সময় একটা রিকশা ঠেললেইতো আট আনা
তাই নাকি?
হ মামা, আমার যা লাগে হে তো আপনেরাই দেন
ও! সেই পয়সা জমাবি? বেশ ভাল।
তাছাড়া আপনেরাও মাঝে মইধ্যে দেন হেই ট্যাহা দিয়া আমি কি করুম? তাই।
একটু হেসে হিরণ বলল
বেশ, তুই এভাবে জমা করতে থাক যেদিন তোর এই মাটির ব্যঙ্ক ভরে যাবে সেদিন আমাকে বলবি তোর নামে ব্যাঙ্কে একাউন্ট করে দিব।
আমারে ব্যাঙ্কে একাউন্ট কইরা দিবেন?
হ্যাঁ, তোর যখন অনেক টাকা হবে তখন আমাকে ধার দিবি!, কি দিবি না?
কি যে কন মামা!
৭।
এদিকে বাড়িতে এক বিরাট দুর্ঘটনা ঘটে গেল। এক কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়ে বড় মামি মারা গেল। যেদিন আরিফ এ বাড়িতে এসেছে সেই দিনই লক্ষ করেছে বড় মামির পেট একটু উঁচু। ভেবেছে অনেকের যেমন ভুঁড়ি থাকে তেমন কিছু হবে। অবশ্য ময়মনসিংহ স্টেশনে থাকতেও এমন ভুঁড়ি ওয়ালা অনেক মহিলা দেখেছে কিন্তু মহিলাদের এমন ভুঁড়ি কেন হয় তা আরিফ আগে জানত না। এক দিন খুব ভোঁরে বাড়িতে সবার হুলস্থূলের শব্দ পেয়ে ঘুম ভেঙ্গে দেখে বড় মামিকে নিয়ে বড় মামা, ছোট মামি আর নানী কোথায় যেন যাচ্ছে। আরিফ কিছু বুঝে উঠার আগে গাড়ি ছেড়ে দিল। ছোট মামাকে কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস না পেয়ে আবার শুয়ে পরল। হিরণের রুমের পাশে দিয়ে সিঁড়ি ঘরের চিলে কোঠায় আরিফের থাকার ঘর বরাদ্দ হয়েছে। আরিফ ওর নিজের মত গুছিয়ে নিয়েছে সেই ছোট্ট চিলেকোঠা।
পরের দিন জানতে পারল বড় মামি আর নেই। তার মৃত দেহ যখন বাড়িতে নিয়ে এলো তাই দেখে ফটিক বড় মামির পায়ের কাছে আছড়ে পরল। মামি আমারে থুইয়া কই গেলেন মামি! আমার নিয়া যান। ছোট মামির কাছে আবদার আহ্লাদ থাকলেও ছোট মামি বড়ই ছেলে মানুষ। বড় মামি না থাকলে পুরো বাড়িটাই যেন কেমন ফাঁকা মনে হত। কখনও আরিফ বিষণ্ণ মুখে বসে আছে আর বড় মামির সামনে পরলে সে হাত ধরে রান্না ঘরে টেনে নিয়ে যেত,
কিরে ক্ষুধা লেগেছে? কি খাবি বল!
মামি আমার ভুখ লাগে নাই
তাহলে কি হয়েছে বল
কইলামত কিছু হয় নাই, আমার আবার কি হইব?
এক দিন বৃষ্টির দিনে-
মামি, বিস্টির মধ্যে খিচুরি মজা লাগে না মামি?
খিচুরি খাবি? আচ্ছা রাতে করব। ঈদের মধ্যে সবার আগে আরিফের জামা, প্যন্ট জুতা কেনার জন্য বড় মামি আলাদা করে টাকা দিয়ে দিত হিরণকে, আরিফের জন্য ঈদের কাপর চোপর নিয়ে আসবি। বাড়িতে মেহমান জন এলে আরিফ দৌড়ে এসে জেনে নিত মামি কি লাগব তাড়াতাড়ি কন আইনা দিয়া যাই।
সেই মামি আরিফকে ছেড়ে এভাবে চলে গেল?
দুপুরে জানাজার পর ফরিদাবাদ গোরস্তানে নিয়ে গেল। আরিফ গেল সাথে। দাফনের কাজ শেষ করে সবার পিছনে দাঁড়িয়ে সবার সাথে হাত তুলে বলল ‘আল্লা আমার মামিরে তুমি ভেস্তের দরজা খুইলা দিও, আমার মামিরে তুমি মাটির নিচে রাইখ না, আমার মামির কষ্ট হইব। আরিফের আল্লা তার এ অনুরোধ রেখেছিল কিনা তা আমি জানি না।
সেই মামি তাকে এই ভাবে রেখে গেল! দুই তিন দিন পরে একটা ছোট্ট পরী নিয়ে এলো ছোট মামি আর নানী। বড় মামি নাকি এরে আনবার যাইয়া আল্লার কাছে চলে গেছে। সেই থেকে প্রথম দিকে একটু বাঁকা দৃষ্টিতে দেখত কিন্তু দিনের সাথে সাথে ছোট্ট পরীর হাসি কান্না শুনে কেমন একটু একটু করে মায়া এসে ভর করল অবুঝ এই কিশোরের মনে। কখনও এত ছোট বাচ্চা দেখেনি। এই ছোট্ট বাচ্চাটা কি দোষ করছে? হেয়তো কোন দোষ করে নাই। কি সুন্দর হাসে আবার কান্দে একটু আদর কইরা কোলে নিয়া কইলেই চুপ করে, দেখতেতো এক্কেবারে পরীর মত, বড় মামিও এই রকম আছিল! এই পরীর প্রায় অর্ধেক দেখাশুনার ভার আরিফ নিজেই নিয়ে নিল। ঘটা করে নিতে হয়নি। আজ এই কাপড়, কাল বিছানার কাঁথা ধোয়া থেকে শুরু করে এটা ওটা করা, ফিডার ধুয়ে আনা এবং যা যা প্রয়োজন তা করে নানী আর ছোট মামিকে সাহায্য করতে গিয়ে কখন যেন অলিখিত ভাবেই অনেক দায়িত্ব আরিফের উপরেই বর্তে গেল। দোকানে যাবার আগে নানীকে জিজ্ঞেস করে যেত
পরীজানের জন্যে কিছু লাগব নানী?
না।
যেদিন নানী কিছু লাগবে বলে দিত সেদিন সারা পথ মনে করে করে যেত নয়ত লিখে নিয়ে যেত। মামা যতক্ষণ পরীর জিনিস কিনে না আনত ততক্ষণ মামাদের অস্থির করে রাখত।
মামা পরীজানের কিন্তু এইটা লাগবই, নানী কইয়া দিছে
আচ্ছা আচ্ছা একটু সবুর কর।
[চলবে-[১-৩]]
No comments:
Post a Comment
Thank you very much for your comments.