Tuesday, 4 December 2012

নক্ষত্রের গোধূলি-৪৯ [অধ্যায় ৫]

[পূর্ব প্রকাশের পরঃ নক্ষত্রের গোধূলি-৪৮]
আস্তে আস্তে ভোরের আলো ফুটতে চাইছে কিন্তু কুয়াশার জন্য পারছে না। সেই গ্লাসগো থেকেই ঘন কুয়াশা। অভিজ্ঞ ড্রাইভার গাড়ির স্পিড নিয়ন্ত্রণে রেখে চালাচ্ছে। সকাল দশটার মধ্যে পৌছার কথা থাকলেও মনে হয় কুয়াশার জন্য চালাতে পারছেনা বলে দেরি হবে। দুই পাশে
যতটুক যা দেখা যাচ্ছে তাতে ডান পাশ দিয়ে রেল লাইন চলে গেছে আর তার পরেই নদীর মত মনে হচ্ছে, ওপাড়ে কি আছে কিছুই বোঝা যায় না শুধু কুয়াশা আর কুয়াশা। বায়ে পাহাড়, এলো মেলো ভাঙ্গাচুরা, এবড়ো থেবড়ো কালচে দেখাচ্ছে। দূরে বলে কুয়াশার জন্য পরিষ্কার দেখা যাচ্ছেনা। পৌনে নয়টা বাজে, এখনো কোন লোকালয় বা শহরের মত কিছু দেখেনি তবে পিছনে কোথায় কোথায় যেন দুইবার থেমেছিল সেখানে কোন লোকালয় আছে কিনা দেখতে পারেনি। একটু তন্দ্রা ভাব এসেছিল। দেখতে দেখতে এগিয়ে যাচ্ছে। আস্তে আস্তে কুয়াশা পরিষ্কার হচ্ছে, আশে পাশের দৃশ্য আরও পরিষ্কার হচ্ছে। শীত কাল বলে গাছে কোন পাতা নেই। গাছ গুলি পায়ের উপর দাঁড়িয়ে হাজার হাজার আঙ্গুল সহ হাত বাড়িয়ে কাকে যেন ডাকছে। সুন্দর, এতো সুন্দর আগে দেখেনি। স্কটল্যান্ডের প্রকৃতির সৌন্দর্যের সুনাম আগে অনেক শুনেছে, দেখেনি। এই প্রথম। কিছু সুন্দর আছে যা মন ভরে শুধু দেখা যায়। তার বিবরণ প্রকাশ করা হয়ে উঠে না, ধরেও রাখা যায় না।

মানুষ যা ভাবে তার সব ভাষায় বলতে পারেনা, আবার যা মুখে বলতে পারে তা সব লিখতেও পারেনা। ভাষার স্বল্পতার কারণেই হোক বা যে কারণেই হোক সব কিছু প্রকাশ করা হয়ে উঠে না। মনের আবেগের কারণে ভালো করে দেখাও হয়ে উঠে না। চোখ যেখানে আটকে যায় সেখানেই স্থির হয়ে থাকতে চায়। চোখ ফেরাতে মন চায় না। শুধু অনুভব করেই মনটা ভরে উঠে। মন থেকে আহ! কি সুন্দর বলে একটা অস্ফুট শব্দ বের হয় যে শব্দ কেও শোনে না। মনে মনে অনেক কথা বলা হয় কিন্তু সে কথাও কেও শুনতে পায়না। সাথে ক্যামেরা থাকলেও ছবি তোলা হয়ে উঠে না। আর ছবি তুললেই বা কতটা তুলতে পারে? এই বিশাল পৃথিবীর কত টুকু ছবি তোলা যায়? প্রকৃতির চারিদিকে সব সৌন্দর্য আপনিই ছড়িয়ে থাকে। ক্ষণে ক্ষণে মিনিটে মিনিটে তার রূপ বদলায়। এর কতটা মানুষ ধরে রাখতে পারে? ধরে নিয়ে আরেক জনকে দেখাতে পারে? একই জায়গার ভোরের সৌন্দর্য, সকালের সৌন্দর্য, দুপুরের সৌন্দর্য, বিকেলের সৌন্দর্য, সন্ধ্যার সৌন্দর্য, রাতের সৌন্দর্য আবার জোছনার সৌন্দর্য ভিন্ন ভিন্ন রূপ ধারণ করে। দিনের বেলাও কুয়াশা, মেঘে ঢাকা সূর্য কিংবা পরিষ্কার আকাশের সূর্যের আল্ট্রা ভায়োলেট সহ সূর্যালোকের সাথে আসা নানা পদের রশ্মির কারণে প্রকৃতির রঙের হের ফের হয়, এ সেই সৌন্দর্য।

আবার মনের ভাবের জন্য বা মানসিক অবস্থার কারণে সেই সৌন্দর্য একেক জনের কাছে একেক সময় একেক রূপে ধরা দেয়। শুধু স্মৃতি হয়েই থাকে মনের মধ্যে। কাউকে দেখানো যায়না। শুধু বলতে পারে খুবই সুন্দর, আহ কি সুন্দর! ব্যাস এই পর্যন্তই। কতটা সুন্দর কেমন সুন্দর তা আর বলা যায় না। বর্ণনা করতে পারেনা। সুন্দরের কোন সীমা নেই, আকার মাত্রা নেই, কোন একক নেই, বৈজ্ঞানিক কোন থিওরি নাই। শৈল্পিক ধারনা দিয়ে সামান্য কিছু বর্ণনা দেয়া যায়। যদিও যার কাছে বর্ণনা দিচ্ছে তার যদি শৈল্পিক মন থাকে কিন্তু তবুও অসম্পূর্ণ থেকে যায়। ছবি একে কিছুটা দেখানো গেলেও তাও পূর্ণতা পায়না। শুধু চোখে দেখেই যার পূর্ণতা। এ হচ্ছে সেই রকম সুন্দর। যতই এগুচ্ছেন ততই দেখছেন আর মুগ্ধ হচ্ছেন। রাশেদ সাহেব শুধু দেখে নিচ্ছেন। তার চোখ নিজের সাম্রাজ্য বিস্তার করে যা পারে দখল করে নিচ্ছে। ক্রমে ক্রমে গাড়ি উঁচু নিচু দুর্গম পাহাড়ি এলাকা পিছনে রেখে এগুচ্ছে। কখনো উঁচুতে উঠছে আবার কখনো নিচুতে নামছে। ডান পাশের দেখা সেই নদীর ওপাড়ে পাহাড় আর পাহাড়। সবুজ, ঘন সবুজ, হালকা ধূসর, ধূসর, কালো, কুয়াশা মেশানো নানান রঙ। নদীর বুকে ভেসে থাকা থরে থরে সাজানো কুয়াশার ঢেউয়ের উপর দিয়ে দূরের পাহাড়ের চুড়া মাঝে মাঝে দেখা যায় আবার হারিয়ে যায়। শিল্পীর তুলিতে এর কতটা আঁকা সম্ভব রাশেদ সাহেব জানে না। তার ছোট্ট একটা শৈল্পিক মন থাকলেও সে ছবি আঁকতে পারে না। শুধু অনুভব করতে পারে।
গাছ পালার সংখ্যা বাড়ছে। পাহাড়ের এবড়ো থেবড়ো ভাব কমে আসছে। রাস্তার সংযোগ বাড়ছে। দূরে কোথাও দুই একটা বাড়ি ঘরের মত দেখাচ্ছ। নদীটা বাঁক নিয়ে আরও ডানে অনেক দূর চলে গেছে। এই দেখে বুঝলেন শহরের কাছে এসে পরেছি।

ঘড়ি দেখলেন, সাড়ে দশটা বাজে। কিছুক্ষণের মধ্যেই শহরে ঢুকল। একটু পরেই দেখলেন জর্জ স্ট্রিট দিয়ে গাড়ি যাচ্ছে, এখানকার ঠিকানাও আবিংডনের মত জর্জ স্ট্রিট। রেস্টুরেন্টের মালিক বলেছিল রেস্টুরেন্টের সামনে দিয়েই গাড়ি যাবে। একটু সামনে এগিয়েই ওপারে পাহাড় ঘেরা একটা ক্রিকের মত দেখা গেল। এপারে জেটিতে একটা প্যাসেঞ্জার জাহাজ ভিড়ে রয়েছে। সামনে পিছনে কয়েকটা ছোট ছোট লঞ্চ। ক্রিকের জলে বয়ায় বাঁধা অনেক গুলি ইয়োট। অসংখ্য গাংচিল আর বালি হাঁস ভেসে বেড়াচ্ছে আর রাজহাঁস সাতার কাটছে। আর একটু এগিয়েই রাস্তার পাড়ে পুরনো একটা বিল্ডিং এর সামনে কোচ দাঁড়াল। ড্রাইভার মাইক দিয়ে বলে দিল আমরা ওবানে পৌঁছেছি, যাত্রী বৃন্দ, আপনারা আপনাদের মালামাল নিয়ে যাবেন এবং গাড়ির ভিতরে কিছু ফেলে যাচ্ছেন কিনা দেখে নিবেন। ধন্যবাদ। গাড়ি থেকে নেমে চারিদিকে দেখল। ছোট্ট পুরনো পাহাড়ি শহর। জেটিতে জাহাজ দেখে ভাবল সম্ভবত টুরিস্ট শহর। ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে পিছনে দেখা জর্জ স্ট্রিট ধরে এগিয়ে যাচ্ছেন। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই দেখলেন হাতের ডানে রাস্তার সাথেই চতুর্দিক খোলা বাংলো প্যাটার্নের ভারতীয় মোঘল স্টাইলে সাজানো বিশাল রেস্টুরেন্ট একা দাঁড়িয়ে আছে। এটার পাশ দিয়েই গাড়ি গেছে কিন্তু তখন চোখে পড়েনি। এগিয়ে মেইন গেটের সামনে দাঁড়ালেন। এ সময় তো রেস্টুরেন্ট বন্ধ থাকার কথা। কি করবেন ভাবছিলেন। এই শীতের মধ্যে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবেন? ব্যাগটা নামিয়ে রেখে কাঁচের দরজায় উকি দিয়ে দেখে ভিতরে একজনকে দেখা যাচ্ছে বার কাউন্টারে কি করছে। দরজায় নক করে হ্যান্ডেলে চাপ দিতেই খুলে গেল। ব্যাগ নিয়ে ভিতরে ঢুকে তার থেকে পাঁচ সাত বছর বেশি বয়সের মুখে ছোট করে ছাটা দাড়ি ওয়ালা লোকটার কাছে চলে আসলেন।
আমি রাশেদ, লন্ডন থেকে আসছি।
লোকটা সিলেটী বাংলায় বললেন
হ্যাঁ আমি আপনার জন্যেই এখানে এসেছি, এসময় তো বন্ধ থাকে কেও নেই। চলেন বাসায় চলেন। সারা রাত জার্নি করে এসেছেন একটু রেস্ট নেন দুপুরে আসবেন।
বাসা! মানে কোথায়?
এখানে আপনাদের লন্ডনের মত রেস্টুরেন্টে থাকার ব্যবস্থা নেই। থাকার জন্য এখানে আলাদা বাসা থাকে সেখানে চলেন।
ও আচ্ছা, চলেন।
বের হবার আগে এক নজরে চারিদিকে দেখে নিলেন। আগের রেস্টুরেন্টের চেয়ে সুন্দর করে সাজানো এবং অনেক বড়। বাসায় এসে বিছানা দেখিয়ে দিলেন। এখানেও দেলু আছে।
দেলুকে ডেকে পরিচয় করিয়ে দিলেন আর বলে দিলেন তুমি যাবার সময় ইনাকে নিয়ে যাবে।
ঘড়িতে বারোটা বাজার একটু আগে দেলু বলল
চলেন ভাই।
চলেন
রেস্টুরেন্টে আসলেন।
দেলুকে জিজ্ঞেস করলেন
তখন যিনি আমাকে নিয়ে গেলেন উনি কে?
উনিই মালিক।
নাম কি ময়না মিয়া?
হ্যাঁ
আচ্ছা
এই যে ব্রেড আর ওই ডিম, নাস্তা খেয়ে নেন তার পর ময়না ভাই এলে কাজ কর্ম দেখিয়ে দিবে।

সাড়ে বারোটার দিকে ময়না ভাই এলেন।
আসেন এদিকে আসেন, দেখেন আপনার কাজ কর্ম দেখে নেন।
বেশ বড় রেস্টুরেন্ট, প্রায় একশো বিশ সীটের হবে। প্রথমে নিয়ে গেলেন টয়লেটে, সেখানে পরিষ্কার করার ব্যবস্থা দেখিয়ে দিল,
এই যে এখানে হ্যান্ড গ্লোভস আছে এটা পরে নিবেন
তার পর এটা ওটা দেখল। টেবিল চেয়ার ঠিকঠাক করা, ছুরি, কাটা চামচ, চামচ সেট করা, টেবিল ক্লথ বিছানো, ন্যাপকিন ভাজ করা থেকে শুরু করে মদের স্টোর, কোন মদ কোথায় থাকে। কোনটা কি ধরনের মদ, কি ভাবে কোন গ্লাসে পরিবেশন করতে হবে। কোথায় কি আছে কোনটা কি কাজে কিভাবে ব্যাবহার হয়।
হোয়াইট ওয়াইন রাখবেন ফ্রিজে, রেড ওয়াইন রাখবেন এই যে এখানে, এটা কখনো ফ্রিজে রাখবেন না। এমন কি কেও কেও বলবে রেড ওয়াইন গরম করে দিতে তখন সিংকে গরম পানি ভরে বোতলটা কিছুক্ষণ ডুবিয়ে রেখে সার্ভ করবেন।
এই ভাবে সব দেখিয়ে দিল। প্রতিদিন এসে কি করতে হবে, রেস্টুরেন্ট বন্ধ করে যাবার আগে কি করতে হবে সব বলে দিল।
আচ্ছা এবার আসেন আপনাকে ট্রেনিং দেই।
একটা ট্রেতে কয়েকটা পাইন্ট সাইজের গ্লাসে পানি ভরে সাজিয়ে বলল যান এবার ওই টেবিলে দিয়ে আসেন, মনে করেন ওখানে কাস্টমার আছে। আর এগুলি হল মদের গ্লাস। তারপর এই ট্রে নিয়ে এই পাশ থেকে ওই পাশে আসা যাওয়া করেন। এখানে এই টেপ থেকে বিয়ার ঢালেন।
মোটা মুটি ভালো ট্রেনিং দিয়ে দিলেন। প্রবীণের দেয়া ট্রেনিং বেশ কাজে লেগেছে। প্রবীণের ট্রেনিং এবং এই ট্রেনিং মিলে রাশেদ সাহেব তার সামনের কাজ বেশ ভালোই রপ্ত করে নিলেন। একটা মেনু দেখিয়ে বললেন
অবসর মতো এটা দেখে কোন খাবারের দাম কত, কোন মদের দাম কত মুখস্থ করে নিবেন, আর কোন অসুবিধা হবে না। ওহ ভালো কথা, আমাদের এখানে আপনার ইউনিফর্ম লাগবে, কালো প্যান্ট তো আছে দেখেছি শুধু শার্ট লাগবে। আপনি কাজ শেষ করে দেলুর সাথে টেসকো থেকে দুইটা শার্ট কিনে আনবেন। ও জানে কি রঙ। আপনার সাথে যাবার জন্য আমি ওকে বলে দিব।

আচ্ছা ঠিক আছে ময়না ভাই, আপনি যেভাবে বলবেন সেই ভাবে করার চেষ্টা করবো। ভুল ভ্রান্তি হলে বলবেন সংশোধন করে নিব।
দুপুরের কাজ শেষ করে বন্ধ করে কিচেনে গেল। সেখানে দেলু বলল
নয়া ভাই খেয়ে নেন তারপর চলেন টেসকোতে যাই।
যাবার পথে দেলুর সাথে আলাপ হল। বেশ ভালো মনে হল লোকটাকে, অন্তত আবিংডনের দেলুর মত না। কিছু লেখা পড়া জানে। এখানে কিচেনে কাজ করে। তন্দুরি সেফ, কিন্তু কিচেনে আর কোন লোক নেই বলে তাকে সব কাজই করতে হয়। ভালোই। দেলু আরও বলে দিল
সামনেও আর কেউ নেই আপনি একাই থাকবেন। ময়না ভাই ওখানেও কাজ করে আবার এখানে সেফের কাজও করে। খুব একটা বিজি নেই। যা আছে এই ভাবেই চলে যাবে। কথা বলতে বলতে কোচ থেকে যেখানে নেমেছিলেন তার পাশ দিয়ে আর একটু এগিয়ে টেসকোতে ঢুকে পড়ল। আবিংডনে যেমন সমারফিল্ড, এখানে তেমন টেসকো সুপার স্টোর। দুইটা হালকা আকাশী রঙের শার্ট কিনে চলে এলেন। বাসায় এসে সন্ধ্যায় সেগুলি পরে ডিউটিতে যাবার জন্য ইস্ত্রি করে রেডি করে রেখে বিছানায় একটু গড়িয়ে নিতে শুয়ে পড়ল। সারা রাত কোচে বসে কেটেছে। মাথা টন টন করছে।

শুধু আসা আর যাওয়া এর নামই চলা, তেমনি করেই চলবে আমাদের এই নক্ষত্রের গোধূলি। সাথেই থাকুন আর দেখুন রাশেদ সাহেব কোথায় কি করেন!

No comments:

Post a Comment

Thank you very much for your comments.