Monday, 19 November 2012

গোল্ডি সাহেব এবং স্কটিশ সুন্দরী-৪ [৫]


 Photobucket
[ছবিঃ নিউক্যাসেল ল্যাঙ্কেস্টার স্ট্রীটের পাশের রোড 'ওয়েস্ট গেট রোড', যেখানে এলিজাবেথ আমাকে নামিয়ে দিয়ে গিয়েছিল তার পাশে।]
[পূর্ব প্রকাশের পর, গোল্ডি সাহেব এবং স্কটিশ সুন্দরী-৩]

জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি, অন্ধকারের ও একটা সৌন্দর্য আছে আর তার
সাথে যদি মটর ওয়ের সোডিয়াম আলোর মাখামাখি হয় তাহলে সে সৌন্দর্য ভিন্ন একটা মাত্রা যুক্ত হয়। এ পাশের ওপাশের ৮টা লেন দিয়ে অসংখ্য গাড়ি আসছে যাচ্ছে। কেউ যাচ্ছে দিনের কাজের শেষে বাড়িতে আবার কেউ যাচ্ছে বাড়ি থেকে কাজে। একই সময়ে কত জনের কত বিচিত্র প্রয়োজন। রাস্তার দু পাশে কখনো ঘন ঝোপ আবার কখনো খোলা মাঠ, আবার তা ছাড়িয়ে কিছু দূরে ছায়া ছায়া বনের মত মনে হচ্ছে। ফাকে ফাকে লাইট পোস্ট গুলি ফুরুত করে একটা একটা করে পিছনে চলে যাচ্ছে। গত এক মাসের ফিরিস্তি মনে আসছে কি কি করেছি কোথায় কি ভাবে থেকেছি নানা কিছু। বাড়ির কথা মেয়েদের কথা মনে হল। খুকুকে ফোন করা দরকার ও জানে আমি লেস্টারে আছি, আমি যে নিউক্যাসেল যাচ্ছি তা ওকে জানান হয়নি। পকেট খুঁজে ফোন পাচ্ছি না। এই হচ্ছে ইদানীং এক নতুন সমস্যা। কোথায় কি রাখি তা মনে রাখতে পারি না। ভাগ্য ভালো দুই জনের সিটে একাই বসেছিলাম গাড়িতে যাত্রী বেশি নেই, লীডস থেকে চার/ পাঁচ জন উঠেছে আর লেস্টার থেকে মনে হল দশ বার জন উঠেছিলাম তার আবার তিন জন লীডসে নেমে গেছে।

গাড়িতে উঠেই জ্যাকেটটা খুলে সিটের পাশে হুকে ঝুলিয়ে রেখেছিলাম গাড়িতে হিটার চলছে বেশ গরম। শীতের দিনে অনেক গুলি পকেট থাকে কিন্তু কোথাও পাচ্ছি না হঠাত্ মনে হোল ও হ্যাঁ জ্যাকেটের পকেটে। জ্যাকেটের পকেট খুঁজে পেলাম। খুকুর নাম্বারে কল করলাম, যাচ্ছে না। দেখি নেট ওয়ার্ক নেই। ফোনটা হাতে নিয়ে বসে খুকুর কথা ভাবছি মেয়েটাকে কতদিন দেখতে যেতে পারছি না। গত ঈদের দিনে বাবা চাচারা সবাই এক সাথে ঈদ করলো অথচ মেয়েটা এই এত কাছে একই দেশে থেকেও আসতে পারলো না। কতটুকুই বা আর দূরে লন্ডন থেকে গ্লস্টার? মাত্র ১৭০ মাইলের মত তবুও আসতে পারেনি। ঠিক ঈদের দিনেই পরীক্ষা ছিল। এই হচ্ছে বিলাতের জীবন। শুনতে কি মধুর শোনায় ইংল্যান্ডে থাকে!! অথচ এই ইংল্যান্ডের যে কি যান্ত্রিক জীবন সে ভুক্ত ভোগী ছাড়া আর কতজনে জানে? এরা সবাই মানুষ না হয়ে যদি রোবট বা অন্য কোন মেশিন হতো তাহলে মানাত। বাবা মা সন্তান কেও কারো নয়। কি ভয়ঙ্কর জীবনে এরা অভ্যস্ত। আমরা এমন ভাবতেও পারি না অথচ তাও মেনে নিতে হচ্ছে। প্রয়োজন এমন এক দায় যার টানেই সব ছিঁড়ে কেটে টুকরা টুকরা হয়ে ভেঙ্গে চুরে ধুলোয় মিশে যাচ্ছে। মায়া মমতা স্নেহ দাবী আবদার, কিছুরই মূল্য নেই। ভাবতে ভাবতে কখন যে মিডল বোরো এসে পরেছি দেখিনি, এখানে একজন যাত্রী নামার জন্য কোচ থামলে দেখলাম। এইতো এর পর ডার্লিংটন, ডারহাম তারপরেই নিউক্যাসেল।

আবার খুকুকে কল দিলাম ওপাশ থেকে খুকুর কণ্ঠ শুনে বুকটা কেঁপে উঠলো, এতো দূরে চলে এসেছি শুনেই তো ও আঁতকে উঠবে। আব্বু কেমন আছ? হ্যাঁ আব্বু আমি নিউক্যাসেলের পথে আছি।
Newcastle City centre
ছবিঃ নিউক্যাসেল নগর কেন্দ্র, হে মার্কেটের পাশে।
যা ভেবেছি তাই।
শুনেই খুকু চিতকার করে উঠলো নিউক্যাসেল! এতো দূরে?তাও আবার এই শীতের মধ্যে?নিষেধ করতে পারলে না?না আব্বু নিষেধ করি কি করে বলে সব খুলে বললাম। সাথে আরও বললাম তোমার ছুটি হলে ন্যাশনাল এক্সপ্রেসে বা মেগা বাসের ফান ফেয়ারে কম দামে যে প্রমোশনাল টিকেট পাওয়া যায় তাই করে তুমি এসো একা ভালো না লাগলে ঝুমুর বা বর্ণাকে নিয়েই এসো। আরও কিছু কথা বলে রেখে দিলাম। এইতো টাইন নদী পার হচ্ছে। আর পাঁচ সাত মিনিট লাগবে। হুক থেকে জ্যাকেট নামিয়ে গায়ে দিলাম। গ্লোবস পরে মাথায় টুপি পরে নামার জন্য রেডি হলাম।

হঠাত্ মনে হোল এলিজাবেথ আমার জন্য এতো কষ্ট করছে ওর জন্য কি করা যায়?ভাবতে ভাবতেই নিউক্যাসেলের ছোট্ট কোচ স্টেশনে এসে কোচ দাঁড়ালো। সমাধান পাবার সময় পেলাম না। গাড়ি থেকে নেমে মালামাল বের করে এদিক ওদিক দেখলাম না কোন সুন্দরী বা জল হস্তীর দেখা নেই। এতো রাত বলে স্টেশনের ভেতরটা বন্ধ, বাইরেই দাঁড়িয়ে একটা বিড়ি বানিয়ে জ্বালালাম। শেষ হলে ফেলে দিলাম। এমন সময় দেখি সিলভার রঙের ছোট্ট একটা ফিয়াত গাড়ি এসে দাঁড়ালো। ড্রাইভিং সীট থেকে ২২ বা ২৩ বছর বয়সী এক অপরূপা সুন্দরী মেয়ে নেমে আমার দিকে তাকিয়ে,
হাই কে, সরি আমার একটু দেরি হয়ে গেল।
বুঝলাম এই হল এলিজাবেথ।
না না, তাতে এমন কি আসলো গেল? ও এসেই হাত বাড়িয়ে দিল। পরে আমার একটা ব্যাগ হাতে নিয়ে গাড়ির কাছে যেয়ে পেছনটা খুলে ব্যাগ রেখে দিল আমি ওর পিছনে যেয়ে আর একটা সুটকেস রাখলাম।
এবার চল।
কোথায় যাবে?
তোমার বাসায়।
না শোন, আমার ভীষণ ক্ষুধা লেগেছে বাসায় খাবার ব্যবস্থা নেই। এতো রাতে একমাত্র সুপার স্টোর ছাড়া আর কোথাও কিছু পাবো না আর তোমারও খাওয়া হয়নি। চল এক সাথে খেয়ে নিই তারপর বাসায় যাই।
হ্যাঁ তা করা যায়।

কি খাবে বল, ইটালিয়ান নাকি তোমার ইংলিশ নাকি মেক্সিকান?
তুমি কি খাবে?
আমি উপ মহাদেশীয় হলেই বেচে যাই।
তাহলে চল তোমার ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে যাই।
সরি এলিজাবেথ, আমার পূর্ব পুরুষ ইন্ডিয়ান ছিল কিন্তু আমি সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছি তোমাদের পূর্ব পুরুষদের কারণেই।
ও হ্যাঁ তুমি বাংলাদেশি তবে ও কথা মিন করে বলিনি, আমি তোমার উপ মহাদেশীয় হিসেবে বলেছি ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টের কথা।
আসলে কি জান এলিজাবেথ, এই যে তোমরা যাকে ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট বল এর শতকরা নব্বই ভাগই কিন্তু বাংলাদেশি।
তাই নাকি?
হ্যাঁ।
আচ্ছা ঠিক আছে, এখন বল কোথায় যাবে।
আমি তো সেই কবে ছিলাম এখানে, কিছু মনে নেই তার চেয়ে তুমি যেখানে চেন সে রকম কোথাও চল।
গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ঘুড়িয়ে কিছু ক্ষণের মধ্যেই সেন্ট্রাল স্টেশনের পাশে একটা রেস্টুরেন্টের সামনে এসে দাঁড়ালো। দেখলাম এটা পাঞ্জাবী রেস্টুরেন্ট। খেতে খেতে কথা হচ্ছিল।
জান কে, আমি তোমাদের বাংলাদেশে গেছি।

তাই না কি? হ্যাঁ, তবে ছোট বেলায়, আমার মার সাথে। ড্যাড তোমাদের ওখানে অনেক বড় একটা নদীর উপর কি একটা বড় ব্রিজ হয়েছে না সেখানকার ইঞ্জিনিয়ার ছিল।
বাঃ বেশ খুশি হলাম তোমার কথা শুনে, ওটা যমুনা ব্রিজ। তা কেমন লেগেছে ওখানে?
খুব গরম আর খুব বৃষ্টি হয় এই টুকু মনে আছে।
তোমার যাওয়া হয়েছিলো অসময়ে সম্ভবত জুন বা জুলাই মাসে তাই না?
হ্যাঁ হবে হয়ত, বললাম না ছোট বেলায় গেছি তো বিশেষ কিছু মনে নেই
যাক সময় হলে আবার যেয়ো। এবার গেলে ডিসেম্বর মাসে যাবে এক ভিন্ন রূপ দেখবে।
কি রকম? ডিসেম্বর মাসে ওখানে শীত থাকে তবে সে শীত যদিও তোমাদের এখানকার মত না সহনীয়, তোমরা কোন রকম একটা সোয়েটার গায়েই চালাতে পারবে।
দেখি যদি কখনো সুযোগ হয় বাবার তৈরি ব্রিজটা দেখতে যাব।
[আগামী পর্বের আমন্ত্রণ]


**** এলোমেলো মেঘগুলি উড়ে যায় দূরে

নেমে আসে ঘুম রাখালি বাঁশির সুরে।
 

No comments:

Post a Comment

Thank you very much for your comments.