(ছবিঃ তাসমিনা খালিদ, আমার ছোট মেয়ে। গত শীতে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে যাবার পথে)
বাহরাইন সিতরা ট্যাঙ্কার বার্থ থেকে বৃটিশ পতাকাবাহী ট্যাঙ্কার জাহাজ “কুইন অফ গালফ” এ ফুল লোড অর্থাৎ প্রায় ষোল হাজার টন হাই স্পিড ডিজেল নিয়ে ১৯৮২ সালের শেষ দিকে শীতের কোন এক সন্ধ্যা বেলায় আমরা ওমানের
মাস্কাট বন্দরের দিকে সেইল করেছি। মাত্র দুই দিন এক রাতের পথ। জাহাজ স্বাভাবিক গতিতে আরব্য উপসাগর দিয়ে এগিয়ে চলছে। এই সময় সাধারনত এখানে সাগর উত্তাল থাকে তবে আজ সেইল করার সময় সাগর কিছুটা শান্ত ছিল বলা যায়। কিন্তু সেইল করার পর দিন ভোর থেকেই লক্ষ্য করছি আমরা যতই এগুচ্ছি ঢেউ এর উচ্চতা আস্তে আস্তে ততই বাড়ছে।
সেই সাথে তাল মিলিয়ে জাহাজের রোলিংও বাড়ছে। জাহাজে চাকরি করার অনেক সুবিধা যেমনঃ নানা দেশ দেখা যায়, তার সাথে নানা জাতির মানুষের সাথে মেশা যায়। জানা যায় তাদের জীবন যাত্রার ব্যবস্থা। পাশাপাশি কিছু অসুবিধা বা এক কথায় বলা যায় একটা দুঃসহ যন্ত্রণা রয়েছে আর তা হচ্ছে এই রোলিং। অনেকেই রোলিং মোটেই সহ্য করতে পারে না। কাউকে এমনও বলতে শুনেছি যে, এই ভয়েজ শেষ হলেই আর আসব না। দেশে ফিরে গিয়ে পানের দোকান দেব তবুও এই রোলিং আর না। কিন্তু হলে কি হবে, সাগরের হাতছানির নেশায় যে একবার ডুবেছে তাকে যে আবার, বারবার সাগরের বুকে ফিরে আসতেই হবে। সাগরের যেন কেমন একটা মায়া রয়েছে। যে মায়াজালে সে সবাইকে আটকে ফেলে।
সাগরের বুকে গাং চিলেদের নিঃশব্দে নীলাকাশে ওড়া, মাঝে মাঝে ডলফিনের ঝাঁকের জলকেলি, খোলা নীল আকাশ, নীল আকাশের নিচে নীল সাগরের নীল ঢেউ, ঢেউ এর চূড়ায় মুক্তার মত সাদা ফেনার লুকোচুরি মানুষের মনকে উদ্ভ্রান্ত করে কোথায় যেন নিয়ে যায়। কোথায় যে সে হারিয়ে যায় সে নিজে কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। যখন নীল ঢেউ এসে জাহাজের গায়ে কিংবা সাগর পাড়ে আছড়ে পরে সে এক মায়াবী দৃশ্য। একটা মনকাড়া মোহ। এই মোহ জাল কেউ ছিঁড়ে বের হতে পারে না। এই মায়ার টানেই আবার ফিরে আসে, আসতে হয়।
সে দিন আস্তে আস্তে রোলিং বেড়েই চলেছে, সাথে বাড়ছে বাতাসের একটানা শো শো গর্জন। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এক নাগারে এমনি চলছে। স্টিয়ারিং করতে এসে ব্রীজে কেউ টিকতে পারছে না। এক এক করে তিন জন আউট। টিকবে কি করে? ওরা কেউ ব্রীজে দাঁড়াতেই পারছে না। প্রতিটা ঢেউ এসে যখন জাহাজের গায়ে আছড়ে পরছে তখনই সমস্ত জাহাজটা থরথর করে কেঁপে উঠছে। কতক্ষণ আর এ ভাবে চলা যায়? চার্টে দেখছি আমরা উপসাগরের পূর্ব পাড়ের কাছে দিয়ে যাচ্ছি। আমাদের জাহাজ থেকে প্রায় একশ মাইল দূরে কিনারা। পিছনে দুবাই এবং ডান পাশে ওমানের সীমা রেখা। সামনেই লিটল কুইন এবং লার্জ কুইন নামে ওমানের সীমানার ভিতরে সাগরের মাঝে প্রায় মাইল দুয়েক জুড়ে মাত্র মাইল খানিক দূরত্বে দুটি পাহাড় সারি অনন্ত কাল ধরে দাঁড়িয়েই আছে। আবহাওয়া যখন ভাল থাকে তখন আমরা একটু মজা করার জন্য এই দুই পাহাড়ের মাঝ দিয়ে যাতায়াত করি। তবে এই মাইল দুয়েক পথে খুব সাবধানে স্টিয়ারিং করতে হয় কারন পাহাড়ের চৌম্বক ক্ষেত্রের কারনে ওখান দিয়ে যাতায়াতে জাহাজের কম্পাস কিছুটা এলোমেলো হয়ে যায় বলে জাহাজের কোর্স ঠিক রাখা বেশ কঠিন কাজ। মোটামুটি খুব ভাল স্টিয়ারিং না করলে পাহাড়ের গায়ে যে কোন সময় ধাক্কা লেগে যেতে পারে। আর তেমন কিছু হলে এখান থেকে উদ্ধার পাওয়া দুঃসাধ্য ব্যাপার। কিন্তু আজ এটা মোটেও সম্ভব নয়। কারো তেমন মানসিকতা নেই।
সবাই রোলিং এর দাপটে অস্থির। বমি করতে করতে অসার। এই মধ্য সাগরে তো আর জাহাজ এমনি ছেড়ে দেয়া যায় না তাই যে কোন ভাবে সামনে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। এমন আবহাওয়ায় ইঞ্জিন চালু রাখতেই হবে। ইচ্ছে করলেই পাড়ে এসে লগি গেড়ে বেঁধে রাখার উপায় নেই। সন্ধ্যার একটু আগে আমাদের ক্যাপ্টেন ডেভিড ল্যাম্ব ব্রীজে এসে বলল কাসাব বে আর কত দূর? চার্ট দেখে হিসেব করে বললাম ওই ত লিটল কুইন তার পরেই কাসাব বে, তা এখান থেকে চল্লিশ নটিকাল মাইল হবে। যেতে হয়ত চার পাঁচ ঘণ্টা লেগে যাবে। লিটল কুইন ছাড়িয়ে একটু এগিয়ে ডান দিকে কাসাব বে হচ্ছে এমন একটা জায়গা যেখানে প্রায় চারদিকে ওমানের জন বসতি হীন মাইলের পর মাইল ধূ ধূ রুক্ষ পাথুরে পাহাড়ী এলাকা। শুধু সাগরের দিকে একটু খানি খোলা এবং ওই খোলা জায়গা দিয়ে ভিতরে ঢুকলেই প্রায় মাইল পাঁচেক এলাকা জুড়ে ত্রিশ মিটার গভীরতা নিয়ে একটা আশ্রয় নেওয়ার মত জায়গা। সামুদ্রিক চার্টে দেখান আছে। আমরা এর আগেও এখানে বেশ অনেকবার এসে নোঙ্গর করে থেকেছি। ক্যাপ্টেন চারদিকে দেখে বলল তাহলে ওখানে ঢুকে নোঙ্গর করে থাকি, দেখি আবহাওয়া একটু শান্ত হলে পরে যাওয়া যাবে। বললাম তাই ভাল হয়। সাথে সাথে আমাদের বাহরাইনের কোম্পানীর অফিসে কন্ট্রোল রুমের সাথে রেডিওতে যোগা যোগ করে জানিয়া দিলাম।
রাত প্রায় এগারটা নাগাদ আমরা কাসাব বের ভিতরে ঢুকে নোঙ্গর করলাম। এই এতক্ষণে যেন সবাই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। যারা রোলিং শুরু হবার পর থেকে এতক্ষণ না খেয়ে শুয়ে ছিল তারা উঠে সবাই গ্যালিতে (জাহাজের কিচেন) গিয়ে যে যা পাচ্ছে তাই খেয়ে একটু সুস্থ হলো। সে রাতে আর তেমন কিছু করায় কারো মন ছিল না। কেবল মাত্র ব্রিজ ওয়াচে দুই জন ডিউটি করছিল আর বাকী সবাই যার যার বিছানায়।
পর দিন সকালে ঘুম ভেঙ্গে দেখি আবহাওয়ার তেমন কোন পরিবর্তন নেই। মনে মনে কটু খুশি হলাম যাক আজও হয়ত এখানেই থাকা যাবে। এখানে থাকার একটা বাড়তি সুবিধা আছে। বড়শী দিয়ে প্রচুর মাছ ধরা যায়। আর জায়গাটাও চমৎকার। চারদিকে বেশ উঁচু নিচু নানা সাইজের পাহাড়। কোথাও খাড়া হয়ে সমুদ্রের নিচে তলিয়ে গেছে আবার কোথাও ঢালু বালুকা বেলার মত মাঝে মাঝে কিছু কিছু ছোট বড় নানা আকারের পাথরের টুকরো দিয়ে কে যেন সাজিয়ে রেখেছে এমন মনে হতো। কোথাও কোথাও আবার এমন যে আকাশের মেঘেরা উড়ে এসে প্রায়ই এই সব কোন পাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে একটু ঘুমিয়ে নেয় নয়তো ধাক্কা দিয়ে সাথে করে উড়িয়ে নিয়ে যেতে চায়। দেখতে দারুণ লাগে। এখানে এসে যখন থাকি তখন আমাদের জাহাজে রাবারের একটা ইঞ্জিন চালিত ডিঙ্গি বোট আছে ওটায় পাম্প করে ফুলিয়ে প্রায়ই কয়েক জন মিলে জাহাজ ছেড়ে ওই সব কিনারায় চলে যেতাম। অহেতুক নিচু পাহাড়ের গা বেয়ে উপরে উঠে দেখার চেষ্টা করতাম। এখান থেকে উত্তরে এবং পশ্চিমে সাগর বা পিছনের পাহাড়ী তেপান্তর কেমন দেখায়। মনে হতো যেন মৌন পাহাড় গুলি আমাদের সাথে কত দিনের না বলা সঞ্চিত কথা বলে মনের আকুতি মেটাতে চাইছে। আমরাও নানা দেশের কয়েক জন পাহাড়ের সাথে চীৎকার করে নিজ ভাষায় কথা বলতাম। আবার কখন সাথে করে রঙের টিন আর ব্রাশ নিয়ে পাথরের গায়ে নিজেদের নাম লিখে রাখতাম। আজও হয়ত যারা ওখানে যায় তারা আমাদের নাম দেখতে পায়। মাইক, হ্যারি, কার্লো, অসীম, মহসীন, তিরু, গোল্ডি এমন আরো অনেক যা আজ এত দিনে স্মৃতির পাতা থেকে মুছে গেছে।
সে দিন সকালে নাশতা করে বসে আছি এমন সময় ক্যাপ্টেন এসে বলল
“দেখছ এখন ওয়েদার চেঞ্জ হয়নি, আজ আর যাব না গ্রে বাহরাইনকে ডেকে বলে দাও তারপরে চল মাছ ধরি”।
ক্যাপটেন নিজে এ কথা বললে আর ঠেকায় কে? যেই বলা সেই কাজ। সাথে সাথে ব্রিজে যে ডিউটি করছিল ওকে সু সংবাদটা দিয়ে বলে এলাম তুমি গ্রে বাহরাইনকে কল দিয়ে বলে দাও খারাপ আবহাওয়ার জন্য আমরা আজ এখান থেকে বের হতে পারছি না। সাথে সাথেই হ্যারি রেডিওর রিসিভার হাতে নিয়ে ডাকা শুরু করল ‘গ্রে বাহরাইন গ্রে বাহরাইন দিস ইজ কুইন অফ গালফ কলিং’। ওপাশ থেকে জবাব এল
‘ইয়েস কুইন ইউ আর লাউড এন্ড ক্লিয়ার’।
হাই স্টেনলি গুড মর্নিং, ডিউ টু ব্যাড ওয়েদার উই আর নট সেইলিং ফ্রম কাসাব বে টু ডে।
ওকে কুইন
এবার ধন্যবাদ জানিয়ে এবং ওভার এনড আউট বলে রিসিভার নামিয়ে রাখল আর আমি নিচে নেমে এসে মার্কিকে বললাম
চল আজ একটা নতুন এক্সপেরিয়ান্স নেয়ার চেষ্টা করি।
নতুন আবার কি, এখানে যা করার তা সবইতো করা হয়ে গেছে!
না, আজ ডাইভিং করব। দেখছ না আজ পাহাড়ের কত কাছে নোঙ্গর করা হয়েছে। এত কাছে কি সাধারণতঃ নোঙ্গর করে?এই সুযোগ কি বারবার আসে?
ইয়া, ডাইভিং! বল কি?
হ্যা তুমি যাবে না কি অন্য কাওকে বলব?
এদিকে আমাদের জাহাজে ডাইভিং সেট আছে মাত্র দুটা কাজেই এক সাথে দুই জনের বেশি যেতে পারব না।
না না আমি যাব। কখন নামবে?
যদি যাও তাহলে এখনি।
বেশ, চল। ডিঙ্গি রেডি করে ডাইভিং সেট রেডি করতে করতে আরো কয়েক জনের নজরে এলো যে আমরা আজ এখানে ডাইভ দিচ্ছি।
সবার এক কথা আমাকে বললে না কেন?
আরে এইতো বললাম। আমরা ফিরে আসি তোমরা এক এক করে সবাই যেও। কাউকে তো উপরে থাকতেই হবে। তোমরা আমাদের দেখবে ফিরে এসে আমরা তোমাদের দেখব, তাই না?
হ্যাঁ ঠিক আছে।
বেশ। আমি আর মার্কি ডাইভিং স্যুট পরে ক্রেন দিয়ে নিচে ডিঙ্গি নামিয়ে দিলাম।
এখানে পানির গভীরতা প্রায় ত্রিশ চল্লিশ মিটার হলে কি হবে জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে একেবারে সমুদ্রের তলা পর্যন্ত দেখা যায়। স্বচ্ছ কাচের মত পরিস্কার টলটলে পানি। কত রকমের কত কি পানির তলে দেখা যায় তা কাছে থেকে দেখার লোভ ছিল অনেক দিন থেকেই। আজ তা হতে যাচ্ছে বলে মনে এক ধরনের চমক বোধ করছিলাম। সিঁড়ি বেয়ে ডিঙ্গিতে নেমে এলাম। দুই জনের কোমরে রশি বেঁধে রশির এক প্রান্ত ধরে উপরে পাহারায় থাকবে দুই জন। ওদের সাথে যোগাযোগ রাখার জন্য প্রথা অনুযায়ী রশির টানের মানে নিয়ে একটু আলাপ করে নিয়েছি। [চলবে, আগামী পর্বের আমন্ত্রণ]
*** আসুন আমরা একটা শষ্য শ্যমল সবুজ সুন্দর বাংলাদেশ রেখে যাই যেখানে আমাদের পরবর্তি প্রজন্ম উকি দিবে ওই দূর নক্ষত্রের পানে!
No comments:
Post a Comment
Thank you very much for your comments.