আমরা অনেকেই ব্লগ করি। কিন্তু যদি বলি কেন করি? নিশ্চয় অনেকেই অনেক রকম কথা বলবেন। তবে আমার মনে হয় শখের বশে করি এই জবাবটাই বেশি হবে। দ্বিতীয়ত হতে পারে নিষ্কলুষ ভাবে সময় কাটানোর জন্য করি। তবে যে যে জন্যই করুন সে এক ভিন্ন বিষয় কিন্তু কেউ কি ভেবে দেখেছেন যে যাই বলি তার বাইরেও একটা সামাজিক বন্ধন তৈরী হতে পারে , হতে পারে সমাজের এক বিশাল কোন ব্যাপার যা আমার বেলায় ঘটেছিল। এখানে আমি তেমনই একটা ভিন্ন আনন্দ এবং ভিন্ন স্বাদের তৃপ্তির কথা বলছি।
আমার স্ত্রী যিনি তিনি এক জন অতি সাধারণ গৃহিনী। বিলাতে বাংলাদেশি ছাত্র ছাত্রীদের খাবার কষ্ট দেখে তার ইচ্ছে হল এমন একটা উপায় বের করতে যাতে করে এই সব ছাত্র ছাত্রীরা নিজেরা চেষ্টা করে বিলাসী খাবার না হোক অন্তত জীবন বাঁচাবার মত রান্না করে খেয়ে কম পয়সা খরচ করে যে উদ্দেশ্যে বিদেশে আসা সে উদ্দেশ্য সফল করে দেশে ফিরতে পারে।
ভাবলাম ভদ্র মহিলা খারাপ ধারনা করেনি। কিন্তু কি ভাবে তাকে আমি সাহায্য করতে পারি? তখন আমি মাত্র ব্লগিং এর সাথে পরিচিত হচ্ছি। মহাকাশের বিগ ব্রাদার গুগল সাহেবের সৌজন্যে নিজে দুইটা ব্লগ করে তাতে লেখা লেখি করি। তা হলে ওকেও এমন একটা ব্লগ খুলে দেই যাতে সে শুধু রান্না বান্না নিয়ে লেখা লেখি করবে! এক পণ্ডিতের সাথে আলাপ করলাম। সে বুদ্ধি দিল যদি সম্ভব হয় তা হলে একটা ডোমেইন কিনে গুগলের হোস্টিং ব্যবহার করে ইংরেজিতে পুরোপুরি ওয়েবসাইট করে দাও আর তার সাব ডোমেইন দিয়ে তার সাথে লিঙ্ক করে আলাদা বাংলা সাইট খুলে দাও। এতে করে আমাদের বাংলাদেশী রেসিপি ইংরেজিতে অবাঙ্গালিরা বানাতে পারবে আবার ভাবীর সোনার ছাত্র ছাত্রীরা সহজে রান্নার কৌশল খুঁজে পাবে।
বাহ! চমৎকার আইডিয়া! পণ্ডিত বন্ধুর বুদ্ধিটা আমার খুব ভাল লাগল। যেই ভাবা সেই কাজ। তার পরের দিনই গো ড্যাডি থেকে মাত্র ৩৫ পাউন্ড দিয়ে ৫ বছরের জন্য একটা ডোমেইন কিনে যা ভাবা তাই করে ফেললাম। প্রায় মাস দুয়েক সময় লেগে গেল আমার এই দুইটা সাইট সাজাতে। ওদিকে আমার পরম প্রিয় স্ত্রী মনের সুখে নানা ভর্তা থেকে শুরু করে একেবারে কাচ্চি বিরিয়ানি পর্যন্ত যা পেরেছে বা তখন চট জলদি মনে এসেছে সব লিখে ফেলেছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে উনি আবার কি বোর্ডে লিখতে পারেন না। উনি লিখেন কাগজে কলমে কালির আঁচড়ে। বেশ তাই হোক। আমি তাতেই খুশী। ও কাজটা এবং ইংরেজিতে অনুবাদটা না হয় আমি নিজেই করে নিব।
বেশ, এইতো শুরু হল পথ চলা। শখ করেই রান্না বান্না বিষয় নিয়ে এই যাত্রা শুরু। আমার স্ত্রীর সেই ওয়েব সাইট এর কন্ট্রাক্ট মি অপশনে দেয়া মেইল এড্রেসে ভারতের মুম্বাই থেকে তেলেগু ভাষী জনৈকা প্রিয়া মিত্র “Help me” বিষয়ে একটি মেইল পাঠিয়েছিলেন। সে মেইলে তিনি বলেছেন যে বাংলাদেশের এক মেয়ে ১০ বছর ধরে তার বাড়িতে কাজ করছে, এতদিন সে কিছু বুঝতে পারেনি কিন্তু বর্তমানে সময়ের সাথে সে বেড়ে উঠেছে এবং বুঝতে শিখেছে। এখন সে দেশে তার পরিবারের কাছে ফিরে আসতে চায়। মেয়েটির সাতক্ষিরার বাড়ির ঠিকানা দিয়ে তার পরিবারের বর্তমান পরিস্থিতি জানাতে ও তাকে দেশে ফিরে আসার ব্যাপারে সাহায্য চেয়েই এই মেইল পাঠিয়েছে।
আমার পূর্বের চাকরীর সুবাদে অর্থাৎ কিনা বেশ অনেক বছর আমরা মংলায় থেকেছি। সেই সূত্র ধরে সাবেক সহকর্মী নির্বাহী প্রকৌশলী শরিফুল ইসলাম এবং উপ সহকারী প্রকৌশলী এবিএম মাসুদ ভাইয়ের কাছে আমি প্রিয়া মিত্রের মেইলটি ফরোয়ার্ড করে দেই এবং যে কয়জনের ফোন নম্বর আছে তাদের সাথে ফোনে আলাপ করে এ বিষয়ে সাহায্যের অনুরোধ জানাই।
পরবর্তীতে তারা ওখানে কর্মরত সাতক্ষিরার কয়েকজনের সাথে যোগাযোগ করে প্রিয়া মিত্রের দেয়া ঠিকানা ধরে ওই এলাকার চেয়ারম্যানের সাথে আলাপ করে মেয়েটির ভাই হাসান ও বোন হালিমার সন্ধান পেয়ে তাদের সাথে সরাসরি কথা বলে তাদের ফোন নম্বর নিয়ে আমাকে জানালে আমি প্রিয়া মিত্রকে মেইল পাঠাই।
এসব নিয়ে তখন বাংলাদেশ থেকে প্রচারিত বাংলা হ্যাকস ও লন্ডন থেকে প্রচারিত জিন্নাতুল হাসানের ব্লগে অনেক লেখা লেখি হয়েছে এবং অনেকেই মেয়েটিকে দেশে আসার পর তার পুনর্বাসনের ব্যবস্থার কথাও ভেবে রেখেছিল।
এর পর প্রিয়া মিত্র মুম্বাই থেকে মেয়েটির ভাই হাসানের কাছে ফোন করে মেয়েটিকে কথা বলার সুযোগ করে দিলে এক আবেগ ঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়, যা প্রিয়া মিত্র আমাদেরকে সাথে সাথেই মেইল করে জানিয়েছে। এবার সে ভারতে বাংলাদেশ হাই কমিশনের সাথে যোগাযোগ করে মেয়েটিকে তার নিজ পরিবারের কাছে নিজ দেশে পাঠাবার ব্যবস্থা নিবে বলে জানিয়েছিল।
পরবর্তিতে এইতো গত বছর যখন আমি দেশে এলাম তখন মংলায় আমার সাবেক সহকর্মীদের সাথে দেখা করতে গেলে সব কিছু বিস্তারিত জানতে পারলাম। সেই মেয়েটি এখন দেশে ফিরে এসেছে এবং অনেক দিন পর সে তার বাবা মাকে দেখতে পেয়েছে। আসলে সে এক শিশু পাচার কারির খপ্পরে পরেছিল ছোট বেলায়।
মেয়েটিকে দেখার ইচ্ছা থাকা সত্বেও সময়ের অভাবে আর সাতক্ষীরা যেতে পারিনি। আশা করি সে জন্য আপ[অনারা আমাকে মাফ করবেন।
এই সমস্ত প্রক্রিয়া সারতে মাত্র ১৬টি মেইল আদান প্রদান হয়েছে এবং কযেকটি ফোন করতে হয়েছে। আর প্রয়োজন হয়েছে একটু খানি সদিচ্ছার। আমি মনে করি ব্লগ করে এটাই আমার পরম প্রাপ্তি, হারিয়ে যাওয়া একজনকে তার পরিবারের সাথে পুনর্মিলন ঘটাতে পেরেছি। সকলকে ব্লগিং করতে উদ্বুদ্ধ করার জন্যই এই তথ্য এখানে দিয়েছি। আশা করি আমার মত সবাই বিষযটি উৎসাহিত করবেন।
এখানে একটি কথা না বললে নিজেকে অপরাধী মনে হবে, তা হচ্ছে ব্লগ করার ব্যাপারে নানা ভাবে প্রভাবিত করে, উৎসাহ উদ্দীপনা দিয়ে এবং নানা রকম কায়দা কৌশল শিখিয়ে হাতে ধরে আমাকে সাহায্য করেছে ‘বাংলা হ্যাকস’ এর নাম না জানা পরিচালিকা (সে নিজেকে আড়াল রাখতেই পছন্দ করে), এই সাফল্যের সবটুকু কৃতিত্বই তার। এ কথা স্বীকার করতে আমি গর্ব বোধ করি।
No comments:
Post a Comment
Thank you very much for your comments.