Saturday, 27 October 2012

হারানো সুর

Russian pic (24)

ছবিঃ ইন্টারনেট

বিগত রমজানের ঈদের আগে এক দুর্ঘটনায় কোমরের দুইটা হাড় ফেটে গেছে তাই আমার সহধর্মিনী এবার কোরবানির ঈদে গরু কেনার জন্য আমাকে যেতে দিবেন না বলে তিনি নিজেই ঈদের কয়েকদিন আগে রিমোট কন্ট্রোলের সাহায্যে গাব তলির হাট থেকে বেশ সুন্দর নাদুস নুদুস একটা ষাঁড় গরু কিনিয়ে এনেছে। দাম শুনে অবাক হলাম। গত বছর এই গরু বেশ চড়া দামে বিক্রি হয়েছে!
বুঝলাম তাহলে এবার দেশের নানা হট্টগোল এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাবে অর্থনৈতিক দুরবস্থার জন্য গরুর দাম কম। অবশ্য শুধু গরু কেন এবার লক্ষ করেছি ঈদের বাজারও বেশ নীরব। মশলা পাতির দাম বেশি হাঁকলেও বেচাকেনা তেমন নেই। পোষাক ইত্যাদি নানা বাজারের অবস্থা প্রায় একই রকম। এমনকি ঈদে বাড়ি যাবার যাত্রীর সংখ্যাও নিতান্ত আগের ঈদ গুলোর মত স্বতঃস্ফূর্ত নয়। মনটা এমনিতেই একটু উত্তেজনাহীন নীরব ঢিলেঢালা ভাবের যাচ্ছিল। কিছুতেই আগের মত তেমন মনোযোগ দিতে পারছিলাম না। কয়েকদিন আগে থেকেই মেঝ মেয়েটা বায়না ধরেছে তার খুব শখ হয়েছে একটা ছাগল কোরবানি দেয়ার। ওর মা সেই একই কৌশলে কল্যাণপুর নতুন বাজারে যার থেকে মাংস কিনে তাকে দিয়ে একটা সুন্দর খাসি আনিয়েছে। বাজারে গিয়ে খাসির রশি ধরে হেটে চলে আসলাম। মনে হচ্ছিল খাসিটা যেন আগে থেকেই বাড়ি চিনে। আমার আগে আগে বেশ দৌড়েই বাড়ি এসে পৌঁছল। সাধারণত ছাগল আনতেই ভীষণ কষ্ট হয়। পিছে থেকে একজন ঠেলে আবার সামনে থেকে একজন রশি ধরে টেনে অনেক কসরত করে তবেই ছাগল বাড়ি আনা যায়। এই ছাগল বাড়ি এসে গেট খোলা পেয়ে সরাসরি সিঁড়ি ঘরে ঢুকে দেখলাম আরও ভিতরে যেতে চাইছে। কি ব্যাপার সামনেই রান্না ঘর, যাবি নাকি ওখানে? গিন্নি একটা রুটি আর এক বালতি লবণ গোলা পানি এনে দিতেই এক চুমুকে পানি খেয়ে রুটি খেয়ে একটু বসার জায়গা খুঁজছে বুঝতে পেরে বাড়ির পিছনে যেখানে গরুটা বাঁধা রয়েছে তার পাশে এনে বেঁধে রাখলাম। একজনকে পাঠিয়ে পাশের বাড়ি থেকে কিছু কাঁঠাল পাতা আনিয়ে ওদের দুই জনকেই কিছু কিছু দিয়ে আসলাম।

কাল ঈদ। বড় মেয়েটা দুপুরে শ্বশুর বাড়ি চলে গেল জামাইর সাথে। স্বাভাবিক আনন্দের যাত্রা। মন খারাপ করার কিছু নেই। এটাই প্রকৃতির বিধান। কয়েক বছর আগে আমিও জামাই সেজে কারো এক জনের মেয়েকে নিয়ে এসেছিলাম আজ আমার মেয়েকে নিয়েও তেমনি একজন জামাই তার মায়ের সাথে ঈদ করার জন্য চলে যাবে এটা ইতো স্বাভাবিক! দুপুরে যোহরের নামাজ পড়তে গেলাম মসজিদে। ইমাম সাহেব আগামী কাল ঈদের জামাতের সময় ঘোষণা করলেন সকাল সাড়ে সাতটা। মনটা চমকে উঠল! কাল আমি একা ওই বাড়ি থেকে ঈদের নামাজ পড়তে আসব? বিশ্বাস হতে চাইছিল না। যে বাড়িতে সূর্য ওঠার আগে আমার মা ডেকচি ভর্তি খিচুরি, মাংস, সেমাই, ক্ষীর এমনি কত কি রান্না করে টেবিলে সাজিয়ে রাখত, বাড়িতে যত বৌ এসেছে সবাই এই ধারা রপ্ত করে আজ তারা পৃথিবীর যে প্রান্তে যে আছে সবাই শাশুড়ির শেখান ধারা বহাল রেখেছে। যে বাড়ি থেকে বাবার সাথে আমরা কয়েক ভাই, জামাই, ভাতিজা ভাগ্নে সহ প্রায় এক মাইক্রো ভরে ঈদের নামাজ পড়তে যেতাম সেই বাড়ি থেকে কাল আমি একা যাব নামাজ পড়তে! কি করে বিশ্বাস করি? আমরা চার ভাই পৃথিবীর তিন দেশে, ভগ্নি পতি ঢাকার রামপুরায় ভাগ্নেও ওখানে, ভাতিজা তার বাবা মার সাথে ভিন্ন দেশে, বাবাও এবার এক ভাইয়ের কাছে রয়েছে দেশের বাইরে! ছেলেদের মধ্যে আমি একা! অন্য সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে কে কোথায় রয়েছে! এমন ইতো হবে! এইতো আধুনিক জীবন। যে জীবন আমরা অনেক চেয়ে  অনেক চেষ্টা করে এবং অনেক ত্যাগের বিনিময়ে পেয়েছি! তখন কি একটুও ভেবেছিলাম এই জীবনের পরিণতি কোথায় যাবে? কোন সুখের জন্য এই জীবন চেয়েছিলাম? নিজেকে হারিয়ে ফেলার জন্য? ফেরার পথে এই সব ভাবতে ভাবতে মনটা আরও উদাস হল। বাড়ি ফিরে এসে স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলাম,

কাল আমি একা যাব মসজিদে? পাশে বসা ছোট মেয়ে বলল

এটা আর নতুন কি? তুমিও যখন বাইরে ছিলে তখন দাদা একা যেত না?

তোমার দাদা কিছু বলেনি?

কি আর বলবে, মুখের দিকে তাকালে বোঝা যায়না? দাদা কেমন উদাসীনের মত বিষণ্ণ মনে যেত আবার নামাজ শেষে ওই ভাবে ফিরে আসত। যার এত গুলি ছেলে, জামাই নাতি সে আজ একা এই ভাবে নামাজ পড়তে যায়, এটা কার কাছে আনন্দজনক মনে হয় বল!

ঠিক বলেছ আব্বু! আমিও কি ভেবেছিলাম? আজ নিজে এমন পরিস্থিতিতে পরেছি বলে উপলব্ধি করছি অত্যন্ত কঠিন ভাবে!

বিকেলে কম্পিউটারে বসলাম পশ্চিম দেশে ঈদ উদযাপন রত বাবা এবং সব ভাইদের ঈদ মোবারক জানাতে এবং কে কিভাবে ঈদ করল জানতে। ভাতিজাকে জিজ্ঞেস করলাম

বাবা কি খেয়েছিস?

বড় কাকু, ও ইতো আমাদের বাড়ির ট্র্যাডিশনাল রান্না! এক্সট্রা ছিল এগ পুডিং।

এক এক করে সবার সাথে বাড়ির সবার কথা হল পরে একটু ভাল লাগল। ওরা সবাই আমার পাশে আছে, একটু দূরে, এইতো! তবুও মনে হচ্ছিল, এত দিন ধরে যে পৃথিবী আমার মনে আসন পেতেছিল এখন থেকে তা আবার ছোট হয়ে আসবে! এর মধ্যে ভাইয়েরা একেকজন একেক দেশে চলে গেছে। বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছে। ও যাবার পর বাকি দুই মেয়ে পাশে ছিল। এক এক করে যখন ওরা সবাই চলে যাবে তখন? তখন আমার পৃথিবীতে শুধু আমি আর আমার গিন্নী এই মাত্র দুইজন! কি অবাক এই পৃথিবী! ছোট বেলায় আব্বা যখন ঈদের দিন নামাজ পরে বাসায় আসার পর ইচ্ছেমত যা খুশী তাই কেনার জন্য টাকা দিত আর সেই টাকা পেয়ে সবার আগে একটা বাঁশী কিনতাম সে বাঁশীতে যে সুর বাজত আজ কেন সেই সুর আর খুঁজে পাইনা? সে সুর কি কেউ বাজাতে পারে না! এমনি করে হারিয়ে যাবে! রাস্তায় দেখি শুনি কত ছেলেমেয়েরা কত বাঁশী বাজায় কিন্তু সেই সুর আর কেন ফিরে পাইনা? কাকে বলব এই কথা, কে ফিরিয়ে দিবে সেই সুর?

ঈদের দিন সকাল ছয়টায় উঠে গোসল করে পোষাক পরে সুগন্ধি মেখে খাবার টেবিলে এসে দেখি সেই মায়ের রেখে যাওয়া অমিয় ধারা টেবিলে অপেক্ষা করছে। গিন্নীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম অনেকক্ষণ! মনে অনেক দিনের পুরনো অনেক কথা অনেক স্মৃতি ভেসে এলো। তাগাদা পেয়ে তাড়া তাড়ি কিছু খেয়ে মসজিদে গেলাম। নামাজ শেষ হলে স্থানীয় সামাজিকতা সেরে বাড়ি ফিরে এলাম।

এত দিন নিজেই কোরবানির পশু জবাই করেছি কিন্তু এবার কোমরের সমস্যার জন্য আর সে সাহস পেলাম না। ইমাম সাহেবের অপেক্ষা। ঘণ্টা খানিক পরে মহল্লার সিরিয়াল অনুযায়ী হৈ চৈ করে এলাকার ছেলেপিলে সহ ইমাম সাহেব এসে গড়ু ছাগল জবাই করে চলে গেল। যখন সব ভাইয়েরা এখানে ছিলাম তখন সাথে দুই এক জন নিয়ে নিজেরাই গড়ু ছাগল বানিয়ে কলিজাটা ভাগ করে নিয়ম অনুযায়ী হিসাবের অংশ রান্না ঘরে মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিতাম আর মা খুব বেশি হলে সাড়ে দশটার মধ্যে রেঁধে গামলায় মুড়ি দিয়ে কলিজা ভুনা সহ আমাদের কাছে পাঠিয়ে দিতেন। সবার আগে কোরবানির মাংস খাওয়ার মধ্যে একটা চমক ছিল, আনন্দ ছিল, প্রতিযোগিতা ছিল। সবার আগে মাংস খাওয়া, তিল্লি পুড়িয়ে ভর্তা, বিকেলে শিকে গেঁথে কয়লার আগুনে মাংস পুড়িয়ে খাওয়া সে সব এখন শুধু স্মৃতি আর কল্পনা।  এখন সে সুযোগ নেই।  কিছু করার নেই। মন খারাপ করে বাড়ির পিছনে যেখানে গরু ছাগল বানান হচ্ছে জানালায় বসে ওগুলি দেখছিলাম। গিন্নী এসে সান্ত্বনা দিল, সময় যখন যেমন থাকে তাই মেনে নেয়াতেই শান্তি। হ্যাঁ গিন্নী ঠিক বলেছ! আমিও তাই ভাবছি। জোয়ার ভাটা। আমাবস্যা পূর্ণিমা। নতুন পুরাতন। এই সব নিয়েই মানুষের জীবন। এক দল যাবে আর এক দল আসবে। কারো বাঁশিতে বাজবে আবাহনী সঙ্গীত আবার কারো বাঁশিতে বিষাদ। কারো কণ্ঠে ঘুম ভাঙ্গার গান আবার কারো কণ্ঠে ঘুম পারানি গান। যে সুরে আমি উজ্জীবিত হয়েছি সেই সুর রেখে যেতে হবে আগামীর জন্য। বারবার একই সুর বাজবে, ফিরে ফিরে আসবে ভিন্ন রাগিণীতে অনন্ত কাল ধরে।

No comments:

Post a Comment

Thank you very much for your comments.