ছবিঃ ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটির একটি মনোরম লেক/ মোর্শেদ আখতার।
ভিক্টোরিয়া কোচ স্টেশনের ডিপারচার টার্মিনালের পাশে দাঁড়ান গ্রিন লাইনের অক্সফোর্ড এক্সপ্রেসে বসার পরে পরেই কোচটা ছেড়ে বাকিংহাম প্যালেস রোড দিয়ে বেকার স্ট্রিটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মটর ওয়েতে যাবার আগে বেকার স্ট্রিটে থেমে যাত্রী ওঠাবে। মাত্র দুই ঘণ্টার পথ। সামনে পিছনে দেখে কোচের পিছন দিকে গায়ের গরম জ্যাকেটটা
পাশের হুকে ঝুলিয়ে রেখে একটা সীটে বসেছে। যাত্রী বেশি নেই।
সাথের বড় লাগেজটা নিচের লাগেজ কম্পার্টমেন্টে দিয়ে দিয়েছে। হাতে ছোট একটা ব্যাগ।
হাতের গ্লোভসটা খুলে ব্যাগে রেখে একটু গুছিয়ে বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে।
বাকিংহাম প্যালেস রোড লন্ডনের অন্যতম ব্যস্ত এলাকা। এ পাশে হাতের বায়ে ভিক্টোরিয়া
কোচ স্টেশনের অ্যারাইভ্যাল এবং ডিপারচার টার্মিনাল আবার আর একটু এগিয়ে ডানে
ভিক্টোরিয়া টিউব এবং রেল স্টেশন। মনে হয় লন্ডন শহরের ব্যস্ততা কোনদিন কোনও সময়
কমবে না। ফুট পাথ দিয়ে নানা বর্ণের নানা দেশের মানুষ হেটে যাচ্ছে আসছে। সবাই
ব্যস্ত, দেখলে মনে হবে
হাঁটছে না সবাই দৌড়চ্ছে। রাস্তায় সাইকেল সহ নানা ধরনের গাড়ি যার যার গন্তব্যের
দিকে ছুটে যাচ্ছে। হাতের গ্লোভসটা রাখার সময় ব্যাগ থেকে চৌরঙ্গী বইটা বের করেছে
কিন্তু এখনও খুলেনি হাতেই ধরে রেখেছে। জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে। লন্ডন শহরে প্রতিক্ষণেই কিছু না কিছু ঘটে, চলার পথে অনেক কিছুই দেখা যায়, তাই দেখছে কিংবা কে জানে হয়ত অতীত ভুলে
থাকার চেষ্টা করছে। মটর ওয়েতে যাবার পর যখন কিছু দেখার থাকবে না তখন বইর দিকে
মনোযোগ দিবে। ভিক্টোরিয়া কোচ স্টেশনের ডিপারচার টার্মিনালের পাশে দাঁড়ান গ্রিন লাইনের অক্সফোর্ড এক্সপ্রেসে বসার পরে পরেই কোচটা ছেড়ে বাকিংহাম প্যালেস রোড দিয়ে বেকার স্ট্রিটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মটর ওয়েতে যাবার আগে বেকার স্ট্রিটে থেমে যাত্রী ওঠাবে। মাত্র দুই ঘণ্টার পথ। সামনে পিছনে দেখে কোচের পিছন দিকে গায়ের গরম জ্যাকেটটা
দেখতে দেখতে বেকার
স্ট্রিটে টিউব স্টেশন ছাড়িয়ে কোচটা থামল। কয়েকজন যাত্রী উঠল, সবাই পুরুষ মানুষ। উঠে যার যার মত বসে পড়ল
কিন্তু সবার পরে যে ভদ্রলোক উঠেছে সে এখনও বসতে পারেনি। হয়ত তার সুবিধা মত একটা
সিট খুঁজছে। লোকটা উপমহাদেশীয়! দেখেই বোঝা
যায়। পাশে দিয়ে যাবার সময় দোলার হাতে বাংলা বই দেখে এক পলের জন্য থেমে বইটা দেখল।
বাঙালি! বাংলাদেশি, নাকি
ইন্ডিয়ান? যেই হোক!
বসব?
বাংলা শুনে দোলা
চমকে উঠল। ইনি বাঙালি! একটু সরে বসল। বসুন
গায়ের জ্যাকেট খুলে
দোলার জ্যাকেটের পাশের হুকে ঝুলিয়ে রেখে বসতে বসতে বলল আমি রিজভী, ডঃ রিজভী আহমেদ
ও! আমি দোলা রায়
এই লোক নিশ্চয়
বাংলাদেশের, ওর চেয়ে পাঁচ ছয়
বছরের বেশি হবে। ভাল স্বাস্থ্য, পৌরুষদীপ্ত ব্যক্তিত্ব এবং বলিষ্ঠ চেহারা, দীর্ঘ গড়ন, চোখে চশমা, গায়ের শ্যামলা রঙের সাথে স্বাস্থ্য বেশ
মানিয়েছে। রিজভী সাহেবও লক্ষ করল পরনে সার্ট প্যান্ট হলেও দেখতে সুন্দর লাগছে, বিশেষ করে মাথার চুলগুলো হাত খোপা করে
বাঁধা শুধু একটা সুন্দর ক্লিপ দিয়ে আটকানো। খুবই ভাল লাগছে। শিরিনও এমনি করেই খোপা
বাঁধত। দেখেই বোঝা যাচ্ছে অনেক দূরের জার্নি করে এসেছে হয়ত তাই চেহারা একটু
বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে কিন্তু তার মধ্যেও অসাধারণ এক ব্যক্তিত্বের লাবণ্য ছড়িয়ে রয়েছে
যেন মাত্র ভোরের সূর্য উদয় হয়েছে। তার জীবন থেকে শিরিনের নাম মুছে যাবার পর আর কোন
নারীর মুখের দিকে এমন সরাসরি তাকায়নি। এমনকি নিজের মায়ের দিকেও না। শিরিন তার জীবন
থেকে অনেক কিছু নিয়ে গেলেও নারী জাতটার উপরে কেমন যেন একটা বিতৃষ্ণা দিয়ে গেছে।
যার কোন চাল চুলো
নেই আছে শুধু একটুখানি মেধা। মেধা দিয়ে কি হয়? মেধা দিয়ে সুখের সাজান বাড়ি তৈরি করা যায়
না, গাড়ি কেনা যায় না, স্ত্রীর গা ভরে অলংকার গড়িয়ে দেয়া যায় না, মাসে মাসে নতুন দামি শারী কেনা যায় না, চার পাশে দাস দাসী রাখতে পারে না, আপন জনকেও ধরে রাখা যায় না। এমনি এক নিম্ন
মধ্যবিত্ত ঘরের সরকারি অফিসের সামান্য এক কেরানির ছেলের জীবন থেকে শিরিনদের অনেক
দিন ধরে গড়ে ওঠা সম্পর্কের বন্ধন ছিড়ে অন্যের হাত ধরে চলে যাওয়া নতুন কিছু নয়।
ইউনিভার্সিটির সেরা ছাত্র রিজভী আহমেদের আশেপাশে অন্তত ডজন খানিক শিরিন, ডলি, জলি, রাত্রি, নিশা, নিশিতা এমনি কতজনই ঘুরে বেড়াত, শেষ পর্যন্ত হত দরিদ্র মেধা সর্বস্ব রিজভীর সাথে কেমন করে
যেন শিরিনই টিকে গিয়েছিল কিন্তু ইউনিভার্সিটিতে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হওয়া রিজভীর
হাতে শিরিনের বাবা তার মেয়ের হাত তুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত দিতে পারেনি। পাস করার পরে
ইউনিভার্সিটিতেই মাস্টারি করার একটা চাকরি পেয়েছিল।
বিয়ের জন্য চাপ
দেয়া হচ্ছিল কিন্তু এতদিন রিজভীর অবস্থার কথা ভেবে শিরিন সম্মতি দেয়নি। শুধু
বলেছিল সময় হলে আমি বলব। এতদিন বাবাকে রিজভীর কথা কিছু বলেনি ভেবেছিল রিজভীর একটা
চাকরি হলে বাবা অরাজি হবে না কিন্তু রিজভীর চাকরি হবার পর বাবাকে যখন বলল তখন বাবা
রিজভীদের বাড়ি এসে নাক সিটকিয়ে চলে গিয়েছিল। এক কাপ চা খেতেও তার প্রবৃত্তি হয়নি।
আর শিরিন! সেও তার বাবার সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে পারেনি। বাবার ব্যবসার পার্টনার
সুফিয়ান সাহেবের আমেরিকা প্রবাসী ছেলে রিয়াদের হাত ধরে পারি দিয়েছে কলম্বাসের দেশ
আমেরিকায়। ও দেশে নাকি সুখ শান্তি সমৃদ্ধির অভাব নেই পয়সা দিয়ে সব কিছু কেনা যায়।
শিরিন এখন প্রাচুর্য আর ঐশ্বর্যের মধ্যে ডুবে আছে। এদিকে বছর দুয়েক চাকরি করে
অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে স্কলারশিপ পেয়ে সেই যে এখানে এসেছে আর ঘরমুখো হয়নি।
ইচ্ছে হয়নি, কার জন্য যাবে? বিয়ের জন্য মা বাবা উভয়েই তাগিদের পর
তাগিদ দিয়ে এসেছে কিন্তু শিরিনের জায়গায় আর কাওকে স্থান দেয়ার মানসিকতা রিজভীর মনে
স্থান পায়নি। নিয়মিত মা বাবাকে টাকা পাঠিয়ে দায় শেষ করতে চেয়েছে, আর কোন ভাই বা বোন কেও নেই বলে কোন
পিছুটানও নেই।
ভদ্রলোক বসতে বসতে
জিজ্ঞেস করল, লন্ডনেই থাকেন বুঝি?
না, অক্সফোর্ডে থাকি তবে আমি এখন কলকাতা থেকে
আসছি
তাই নাকি? তাহলেতো আপনি খুবই ক্লান্ত, দেখেই মনে হচ্ছে। আপনাকে বিরক্ত করা ঠিক
হবে না আমি বরঞ্চ অন্য কোন সিটে বসি আপনি রেস্ট করুন
না না, কি বলছেন? আমি ভাবতেও পারিনি একজন বাঙ্গালির সাথে
এভাবে যেতে পারব। বলুন আপনি কথা বলু্ন, আপনি না হলেতো আমি এই যে বলে হাতের বইটা দেখাল, জার্নি যত বড়ই হোক আমি ঘুমাতে পারি না।
সেই যে কাল কলকাতা ছেড়ে আসার পর এ পর্যন্ত একটুও চোখ লাগেনি
বেশ, তাহলে বলুন কলকাতার কি খবর?
ভালই
বাড়িতে যাদের রেখে
এলেন তারা কে কেমন আছে?
ভাল, সবই ভাল এখন, বাবা মা সবাই ভাল আছে। বাবার কিডনিতে পাথর
হয়েছিল তাই অপারেশন করাতে আমি কয়েকদিনের জন্য গিয়েছিলাম। আপনি কি বাংলাদেশের?
হ্যাঁ, আমি বাংলাদেশের, আমার বাড়ি ঢাকা। অক্সফোর্ডে কোথায় থাকেন?
কুইন স্ট্রিটে, আপনি?
উইটনি। কতদিন হলো
এখানে?
এইতো বছর খানিক, উইটনিতে কোথায় থাকেন?
কোথায় থাকি মানে কি
আপনি চেনেন?
হ্যাঁ ওখানে আমার
এক বান্ধবীর বাড়ি, মাঝে
মাঝে যাই। বাসস্ট্যান্ডের পাশে যে তাজ রেস্টুরেন্ট, তার পাশেই
ও আচ্ছা, আপনার বান্ধবীর হাজব্যান্ডের নাম কি অতীশ
দে আর বান্ধবীর নাম বিশাখা?
হ্যাঁ হ্যাঁ, আপনি চেনেন?
চিনি মানে অতীশ
আমার বন্ধু। উইটনি এই এলাকার রিটায়ার্ড ডিফেন্স অফিসারদের বসতি, অধিকাংশই এদেশের, বাঙালি খুবই কম তাই যে কয়জন আছি সবাই
সবাইকে চিনি।
ও, আচ্ছা
দেখতে দেখতে কোচ M25 মটর ওয়েতে চলে এসেছে। একভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। অক্সফোর্ডের রাস্তায় যাদের দেখা যায় তারা
সাধারণত ছাত্র নয়ত শিক্ষক। পথে যেতে কেও পথ ভুল করে ফেললে বা চিনিতে না পারলে
কাওকে জিজ্ঞেস করলে যে কথাটা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শোনা যায় তা হচ্ছে ‘সরি আমি ভিজিটর’ বা ‘নিউ কামার’। পুরো শহরটাই বলতে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়
এলাকা। এখানে এই ফ্যাকাল্টি, ওখানে ওই ডিপার্টমেন্ট সেখানে অমুক স্কুল এমনি। এক জায়গা থেকে আর এক
জায়গায় প্রায় হেঁটে যাওয়া সম্ভব নয়। তবে এদেশে বিশেষ করে এই শহরে ছাত্রছাত্রীদের
কথা ভেবে বাস সার্ভিস খুবই ভাল। অনেক দূরে দূরে একেকটা বিল্ডিং। অনেক দিনের পুরনো
শহর, দালান কোঠা, রাস্তা, দোকানপাট এসব দেখেই বোঝা যায়। ওয়েলিংটন
স্ট্রিটে ইউনিভার্সটির মুল ভবন আর আশেপাশে ছড়ানো সব শাখা প্রশাখা।
এখানে কি করছেন?
আর্থ সাইন্স নিয়ে
রিসার্চ করছি
কার সংগে আছেন?
ডঃ রিচার্ড
কোন রিচার্ড, পার্কার?
হ্যাঁ হ্যাঁ
রিচার্ড পার্কার
আপনি?
কি আর করব মাস্টারি
করি, ছেলেমেয়েদের বায়ো
মেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াই
ও! স্যার
আপনি.....................
কথা শেষ করতে না
দিয়ে বলল
নো নো, নট স্যার। স্যার বলবেন না। you are not my student! এবার বলুন আপনার
মিস্টার কোথায়?
কি করে, সঙ্গেই আছে?
এমনিতেই বিশাল
জার্নির ধকলে মুখ শুকিয়ে ছিল তারপরে আবার প্রচণ্ড ঠাণ্ডা যদিও কোচের ভিতরে হিটার
চলছে। দোলার মুখ এই কথা শুনে আরও ফ্যাকাসে হয়ে গেল। কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে থেকে
বলল এমন কেও নেই
মাথা নিচু করেই চলে
গিয়েছিল বছর দুয়েক আগের কলকাতায়। সেই দিন আর ফিরিয়ে আনার উপায় নেই।
কলকাতার টালি
গঞ্জের অতি সাধারণ একজন স্কুল মাস্টারের মেধাবী মেয়ে দোলা কলেজে যাবার পর পাড়ার
ডাক্তারি পড়ুয়া অভিজিতের কাছে পড়ত আর সেই সময়ের সাথে একটা সুক্ষ সূত্র ধরে কখন যেন
উভয়ের অজান্তে একজন আরেকজনের সাথে একান্ত নিবিড় ভাবে মিশে গিয়েছিল। চোখের ভাষা
থেকে শুরু করে মান অভিমানের লেনদেন এবং একদিন না দেখার বিরহ যাতনার অনুভব সবই
আঁকড়ে ধরেছিল। কিন্তু দুই জনের লেখা পড়া
শেষ করে যখন অভিজিত ডাক্তারি শুরু করল তখন বাড়ি থেকে বিয়ের প্রস্তাব দিলে মাকে
দোলার কথা জানাল কিন্তু মা নিচু ঘর এবং বাঙ্গাল বলে বিয়েতে মত দেয়নি। বাবারও একই কথা।
দেখে শুনে বাবা মা অভিজিতের বিয়ে দিল কিন্তু সে বিয়ে বেশিদিন টিকেনি। ছাড়াছাড়ি হয়ে
গিয়েছিল বছর না ঘুরতেই।
এমনি অবস্থায় দোলার
মন ভেঙ্গে চুরমার হবার অবস্থা হচ্ছে জানতে পেরে প্রিয় বান্ধবী বিশাখার উদ্যোগে
অনেক খোঁজাখুঁজি করে দোলাকে এখানে রিসার্চ করার সুযোগ পাইয়ে দিল। এমন কি, এখানে আসার প্লেন ভাড়াটাও সেই দিয়েছিল।
দোলার বিলাতে আসার সংবাদ জেনে অভিজিতের মা দোলার মায়ের কাছে প্রস্তাব নিয়ে
গিয়েছিল। দোলার মা অত কিছু না জেনে মেয়েকে অভিজিতের মায়ের প্রস্তাব জানাল কিন্তু
মেয়ে তাতে সম্মতি দেয়নি। এত ভাল পাত্র, হোক না দোজবরে তাতে কি পুরুষ মানুষের এত খুত ধরতে নেই। বিশেষ করে তাদের
মত অভাবের সংসারে অমন পাত্র যেন রাজযোটক। এই পাত্র হাত ছাড়া হয়ে যাচ্ছে দেখে দোলার
মা নানা ভাবে মেয়েকে সন্দেহ করে নানা রকম কটূক্তি করতেও দ্বিধা করেনি এমনকি এত
দিনের চেনা নিজের গর্ভের শান্ত অথচ জেদী মেয়ের চরিত্রের খুঁত খুঁজে দেখতেও পিছপা
হয়নি। কেন যে মেয়েকে এত পড়ালেখা শেখালাম এই ক্ষেদ তার মনে অহর্নিশ লেগেই থাকত।
অসুস্থ বাবা সব কিছু দেখে শুনেও না দেখা না জানার ভাণ করেই পড়ে থাকত। এ ছাড়া
রিটায়ার্ড বাবার আর কিই বা করার থাকে? মায়ের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে কেমন করে বাড়ি থেকে বের হতে পারে সেই চিন্তায়
নানা ভাবে চেষ্টা তদবির করে বিলাতে আসার আগে টাটা কোম্পানিতে একটা চাকরি পেয়ে
জামসেদপুরে চলে গিয়েছিল। বাবার পেনশনের কয়েকটা টাকা ছাড়া আর কোন উপায় নেই বলে মাসে
মাসে টাকা পাঠাত কিন্তু কোন খোঁজ খবর নেয়ার মত ইচ্ছা হোত না।
বলেন কি! সময় হয়ে
উঠেনি না কি?
দোলার ফ্যাকাসে
মুখের দিকে চেয়ে, আচ্ছা থাক এসব কথা, আপনি খুবই ক্লান্ত
দোলা চমকে উঠে আবার
ফিরে এলো।
তার চেয়ে আপনার কথা
বলুন, আমার কথা শুনতে ভাল
লাগবে না তেমন কোন সুখের কথা নয়
আমার কথা আর কি বলব, আছি! খাই দাই ছেলেমেয়েদের পড়াই ব্যাস আর
কি?
উইটনিতে কি আপনার
নিজের বাড়ি? কে কে আছে ওখানে? মানে ছেলে মেয়ে
হ্যাঁ বাড়ি নিজেরই
বটে তবে আর যা বললেন তার কিছু নেই
নেই! মানে?
নেই মানে নেই।
কোনদিন ছিলও না আর হবেও না
কি আশ্চর্য, তা কেন হবে?
সে অনেক কথা। থাক
এত শুনে কি হবে?
আপত্তি না থাকলে
বলুন না!
শুনবেন? না আপত্তি নেই, তাহলে বলি
কেন যে রিজভী
সাহেবের মত ব্যক্তিত্বের অধিকারী, অমায়িক, স্মার্ট
এবং দুর্দান্ত প্রফেসর ঘর বাঁধেনি এ কথা নিয়ে আশেপাশে কানাঘুষা লেগেই আছে। তার
কিছু যে রিজভী সাহেবের কানে যায়নি সে কথা বলার উপায় নেই কিন্তু রিজভী সাহেবের কোন
মাথা ব্যাথা নেই। অনেকেরই জানার আগ্রহ থাকলেও কেও জিজ্ঞেস করার সুযোগ পায়নি তবে
একান্ত কাছের বা ঘনিষ্ঠ দুই একজন বাঙ্গালির স্বাভাবিক কৌতূহল নিবারণ করতে পারেনি
তা বলা যাবে না। তবে জানতে চেয়েও এ যাবত কেও জানতে পারেনি। কিন্তু আজ দোলাকে দেখে
তার কঠিন ব্যক্তিত্ব কোথায় যেন মিলিয়ে গেছে, বরফ গলে পানি হয়ে শিশির কণার মত টলমল
করছে। মনে যেন কিসের দোলা লেগেছে! মনে চেরি ফোটা বসন্ত এসেছে, ডেফোডিল, প্রিমরোজ, ব্লু বেল, টিউলিপের নানা রঙ ছড়িয়ে যাচ্ছে, বর্ষার প্রথম কদম ফুল ফুটেছে, বৃষ্টি ভেজা মাটির গন্ধ পাচ্ছে, জানুয়ারির স্নো মাখা নীলচে পূর্ণিমার
চাদরে দেহ মন জড়িয়ে রয়েছে। কেন যেন কথা বলতে ইচ্ছে করছে। যে কথা কাওকে কোনদিন বলা
হয়নি! দোলার ‘আপত্তি না থাকলে
বলুন না’ কথাটা শ্রাবণ ধারার
সুরের মত মনে গুনগুন করছে।
আস্তে আস্তে ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই প্রথম দেখা শিরিনের সমস্ত কাহিনী একে একে সব খুলে বলল। জানেন, শিরিন এখন ভীষণ সুখী। ওকে সুখী করতেই আমি
চেয়েছিলাম কিন্তু সে যে এভাবে সুখী হবে সে আমি কল্পনায়ও ভাবতে পারিনি। আজ আর আমার
কোন দায় নেই, আমি নির্ভার। কথা
গুলা বলতে পেরে মনটা যেন অনেক হালকা হলো, এতদিনের সঞ্চিত কষ্টের বিষ বাষ্প বের হয়ে
গেল। দারিদ্র্য জর্জরিত না পাবার বেদনা, হতাশার গ্লানি সব যেন এক নিমেষেই কোথায় কোন দূর মহাসাগরের অতলে হারিয়ে
গেল। বলা শেষ হলে দোলার দিকে তাকাল। দোলা এক মনে কথা গুলা শুনছে। মনে হলো রিজভী
সাহেবের বলা শেষ হয়নি তাই জিজ্ঞেস করল
তারপর?
তারপর আর কি, এইতো! আপনার সামনেই দেখতে পাচ্ছেন
কিন্তু এ ভাবে
কতদিন চলবে? জীবন নদী কি কখনও
একা পাড়ি দেয়া যায়? একজনে
হাল ধরে আর একজনে বেয়ে চলে
যে ভাবে চলছে চলুক
না, বেশ তো চলছে এই বেশ
না, তা হয় না, এ যে প্রকৃতির বিধান আমরা যে কেও এর বাইরে
যেতে পারি না
তাহলে আপনি আপনার
মিস্টারের কথায় অমন করে ফ্যাকাশে হয়ে গেলেন কেন?
সে অনেক কথা, থাক না
না, থাকবে কেন? আমি এতক্ষণ বকবক করলাম আর আপনি চুপ করে
শুনবেন তাই কি হয়? বলুন
শুনি
বললামতো সে কোন
সুখের কথা নয়,
শুনতে ভাল
লাগবে না
আচ্ছা আমি যে
এতক্ষণ বললাম এ কি সুখের কথা?
মোটেই না
তাহলে? আচ্ছা প্রথম আলাপেই এত কিছু বলাবলিতে আপনি
কি দ্বিধা বা কোন সংকোচ করছেন?
একটু হেসে বলল, আপনি কিন্তু নাছোড় বান্দা
দোলার হাসিটাও
শিরিনের মতই মনে হলো। মধুর ক্যান্টিনে বসে বলত দেখ শিরিন আমি এত দরিদ্র ঘরে
জন্মেছি যে তোমার কথা তোমাদের মত ঘরের কথা চিন্তাও করতে পারি না। তখন এমনি করেই
হেসে বলত আমি শুধু তোমাকেই ভালবাসি, আমিতো আর কিছু চাই না!
তাই যদি মনে করেন
তাহলে আর কথা বাড়িয়ে লাভ কি?
আচ্ছা,
বলে তার ছোট বেলা
থেকে শুরু করে এখানে আসার সমস্ত কাহিনী শোনাল। বিশাখাই আমাকে এখানে নিয়ে এসে
বাঁচার পথ দেখিয়েছে। মটর ওয়েতে চলন্ত কোচের ইঞ্জিন এবং হিটারের একটানা গুঞ্জণের
শব্দ ছাপিয়ে দোলার কণ্ঠ শোনার জন্য রিজভী সাহেব দোলার মুখের কাছে কান পেতে মনোযোগ
দিয়ে শুনেছে।
ও! মনে হচ্ছে আমরা
এক সাথে একই নদীতে দুই নৌকা ডুবিতে ডুবে গিয়েছিলাম আবার এক তীরেই ভেসে উঠেছি।
নিয়তি আমি বিশ্বাস করি না কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এ যেন নিয়তির ই খেলা। নিয়তি অনেক
কিছু পারে যা আমাদের ভাবনার সীমা রেখা থেকে অনেক দূরে।
কথা বলতে বলতে
অক্সফোর্ড গ্লস্টার গ্রিন কোচ স্টেশনে চলে এসেছে, গাড়ি পার্ক করে ড্রাইভার মাইকে জানিয়ে
দিল। রিজভী সাহেব পকেট থেকে তার কার্ড বের করে দোলার হাতে দিয়ে বলল তোমার ফোন
নম্বরটা দিবে?
কাল তোমার
সাথে দেখা করব। কোচ থেকে এক সাথে নেমে দোলার লাগেজ সহ একটা টেক্সিতে তুলে দিয়ে বলল
কাল আমি না আসা
পর্যন্ত ডিপার্টমেন্টেই অপেক্ষা করবে?
টেক্সির সিটে বসে দোলা
ব্যাগ থেকে এক টুকরো কাগজ বের করে ফোন নম্বরটা লিখে রিজভী সাহেবের হাতে দিয়ে বলল
এসো, আমি তোমার
অপেক্ষা করব
দোলার টেক্সি ছেড়ে
দিল, টেক্সির পিছনের লাল বাতি ভিড়ে মিশে যাওয়া পর্যন্ত তাকিয়ে থেকে রিজভী সাহেব আর
একটা টেক্সি নিয়ে উইটনি চলে গেল।
No comments:
Post a Comment
Thank you very much for your comments.