১৯৭০
সালের কথা বলছি যখন আমরা করাচি শহরে থাকি তখনকার কথা। বাবা চাকরী উপলক্ষে ওখানে
থাকতেন আর আমরা কয়েক ভাই বোন স্কুলে পড়তাম। চারিদিকে ইলেকশনের ফলাফল নিয়ে নানা
ধরনের নানা কথা বার্তা। আমার স্পস্ট মনে আছে ইলেকশনের কিছু দিন আগে শেখ মুজিবুর
রহমান
করাচীতে গিয়েছিলেন। নির্বাচনী প্রচারনার উদ্দেশ্য নিয়েই। আমার খুব ইচ্ছে
হয়েছিল তাকে দেখার। বাবার সাথে দুই এক জন বাঙ্গালি প্রতিবেশী চাচাদের কথা বার্তায়
জানতে পেলাম কাছেই কোন এক পার্কে শেখ মুজিবরের ভাষনের ব্যবস্থা হয়েছে কাজেই তারা
সবাই যাবেন। আমিও বাবাকে ধরে বসলাম
“আমিও যাব”।
যাবি? আচ্ছা ঠিক আছে নিয়ে যাব।
তিন
চার দিন পরে সত্যি করে বাবা সবার সাথে আমাকে নিয়েই ওই পার্কে গেলেন। দেখলাম, শুনলাম। সে কি আগুন ঝরা কথা!
এর আগে কখন কাউকে এমন করে কথা বলতে শুনিনি। বেশ ভালই লাগল। মনযোগ দিয়েই শুনলাম।
তার এই বক্তৃতা শুনেই হোক বা নিজে বাঙ্গালি বলেই হোক কেন যেন জানি না জুলফিকার আলি
ভুট্টো সাহেবকে মনে মনে ঘৃণা করতে শুরু করলাম।
ইলেকশন
হয়ে গেল। তদানীন্তন পাকিস্তানের দুই অংশে মিলিয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে শেখ
মজিবর রহমান জয়ী হলেন। আমরা বাঙ্গালিরা খুউউব খুশি। বড়রা বলাবলি করছেন, যাক এবার তা হলে বাঙ্গালিরা
দেশ শাসন করবে, এখন থেকে আর আমাদের এত কষ্ট থাকবে না। কিন্তু
সবাই এত খুশি হলে কি হবে এই জয়ের খুশি বেশি দিন রইল না। আস্তে আস্তে চারিদিকে
কি
সব উলটা পালটা কথা বার্তা কানে আসতে লাগল। ছোট বেলা থেকেই ওই উর্দু ভাষিদের সাথে
থাকতে থাকতে ওদের সব কথা জলের মতই বুঝতে পারি বলতেও পারি। স্কুলে যাতায়াতের সময়
বাসের জন্য অপেক্ষা করতে গিয়ে বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে, বাসে বসে বা যেখানেই যাই না
কেন একটা আবোল তাবোল কথার ঢং বুঝতে পারছি। বড়রা সব কি ভেবেছিলেন আর কি হতে যাচ্ছে?
এ সব কি শুনছি? সারা দিন বাইরে যা শুনি
সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে এসে মাকে তা বলতেই তার একটা নীরব চোখ রাঙ্গানি ভাব দেখে আর
কিছু বলার সাহস পেতাম না। রাতে বাবা খুব মনযোগ দিয়ে বিবিসির খবর শুনতেন। মাঝে মাঝে
প্রতিবেশি দুই এক জন বড়রাও এসে বাবার সাথে শুনতেন।
আস্তে
আস্তে ওই পশ্চিম পাকিস্তানি খেলার সাথিরা কেমন যেন দূরে দূরে চলে যাচ্ছে। আগের মত
কেউ কাছে আসে না। তেমন করে খেলায় ডাকে না। কেমন যেন একটা থমথমে ভাব। নিজেরা মানে
যারা বাঙ্গালি তাদের সাথে যা কথা বার্তা একটু আধটু বলি আবার সন্ধ্যা হতে না হতেই
বাসায় ফিরে আসি। এমনি করেই দিন যায়। ঢাকার রাজনিতীর অবস্থা দিনে দিনে জটিল হচ্ছে
শুনছি। বিবিসি, আকাশ বানী কলকাতা, ভয়েস অব আমেরিকা নানা দিক থেকে
খবর জানছি কিন্তু পাকিস্তানি রেডিও বা টেলিভিশন দেশবাসিকে শোনাচ্ছে ভিন্ন সংবাদ।
ধীরে ধীরে মনে মনে নিজেকে যেন অনেক বড় হয়ে গেছি ভাবতে শুরু করলাম। এখন আর এই সে
দিনের সেই আমি আর নেই। আমি এখন অনেক দায়ীত্ববান বাঙ্গালি।
চারিদিকের
এই সব ভাব যখন চলছে তখন এক দিন দেখি পাশের ফ্ল্যাটের পাঞ্জাবী ভদ্রলোক আহমেদ সাহেব
আব্বার সাথে কি যেন ফিস ফিস করে কথা বলছেন। এদের পরিবারের সাথে স্বাভাবিক ভাবেই
দীর্ঘ দিন পাশাপাশি থাকার কারনে খুবই আন্তরিক ভাব ছিল। প্রায়ই বাঙ্গালি বাড়ি থেকে
বড় মাছের তরকারির পেয়ালা ওই পাঞ্জাবী বাড়িতে যেত আবার ও বাড়ি থেকেও জগ ভর্তি
লাচ্ছি কিংবা ঘি দিয়ে রান্না করা মুগের ডাল অথবা খাশীর মাংশের পেয়ালা এই বাঙ্গালি
বাড়িতে আসত। এমনকি তারা যখন ছুটি ছাটায় পাঞ্জাব থেকে বেড়িয়ে আসতেন তার পর দিনই
দেখা যেত পাঞ্জাবের ঘি, ভুট্টার আটা বা এমন নানা কিছুর স্বাদ বাঙ্গালি বাড়ির সবাই ঘরে বসেই পেয়ে
যেত। তা সেদিন ওই পাঞ্জাবী চাচার ওমন ফিসফিসানি শুনে একটু কাছে গিয়ে দাড়ালাম। কানে
এলো চাচা বলছে আমজাদ সাহাব আপ জালদি ঢাকা চালে যাইয়ে, ইহা
কুছ খাতরা হোয়গা এয়সা মালুম হোরায়। আমার নাম ধরে বলল অন্তত ওদের সবাইকে পাঠিয়ে দিন
এখানে আর এখন নিরাপদ নয়। আপনারা এখানে সংখ্যায় কম কিছু করতে পারবেন না। আমিই বা কত
টুক করতে পারব? বাবাও তার কথা মেনে নিলেন। বললেন দেখি ছুটির
দরখাস্ত করতে হবে।
এক দিন
মা বলছেন, তোমার বাবা
ছুটি নিয়েছেন আমরা ঢাকায় যাচ্ছি। শুনে ভীষন খুশি। ঢাকা যাব মুক্তি সেনা হব,
দেশের কাজ করব, দেশ স্বাধীন করব মনে কত
স্বপ্ন। কবে যাব? এইতো কয়েক দিনের মধ্যেই। তি্ন চার দিন পর
বাবা পি আই এ থেকে করাচি-ঢাকার পাচটা টিকেট নিয়ে এলেন, বাবা
আর মা দুই জন আর আমরা তিন ভাই বোনের। আগামী ২১শে মার্চ ফ্লাইট। মা আর বাবা বাধা
ছাদা, গোছগাছ করায় ব্যস্ত। আর আমরা দুই ভাই দিন গোনায়
ব্যস্ত। ছোট বোনটার কোন বিকার নেই কারন ও তখন মায়ের কোলে বসে আরামে ফিডার খেয়ে,
ভাবনা হীন দিন যাপন করে।
হঠাত
১৭ইমার্চ এক টেলিগ্রাম দিয়ে গেল পিওন। আমি তখন ইংরেজি পড়তে পারি। তারাতারি খুলে
দেখেই মাথায় কেমন একটা ঘুর্ণির মত বোধ হলো। মাকে নিয়ে দেখালাম। পি আই এ থেকে
পাঠিয়েছে। কোন আনন্দ সংবাদ নয়। লিখেছেঃ অনির্বার্য্য কারন বশত অনির্দিস্ট কালের
জন্য আপনাদের ফ্লাইট স্থগিত করা হয়েছে। আশা আকাংখা, স্বপ্ন সব ধুলিস্যাত। বাবা
অফিস থেকে ফিরে এসে শুনে তারও মন খারাপ। কিছু করার নেই। মেনে নিতেই হবে। সাথে সাথে
বাবা পাশের পাঞ্জাবি আহমেদ চাচাকে জানালেন। উনি ফ্লাইট কনফার্ম না হওয়া পর্যন্ত
নিরাপত্তার জন্য কিছু পরামর্শ দিলেন। আমাকে রাস্তা ঘাটে অহেতুক চলাফেরা করতে বা কারো
সাথে অপ্রয়োজনে কথা কাটাকাটি না করতে বললেন।
আসলে
এই সব রেগুলার ফ্লাইট বাতিল করে পাকিস্তান সরকার প্লেন ভরে সৈন্য পাঠাচ্ছে। ২৫শে
মার্চে চড়ম রাতের পরে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। মুক্তি বাহিনীদের হাতে পাকিস্তানিরা
জাহান্নামে যেতে শুরু করল। সেগুলিকে আবার পাকিস্তান হয়ে জাহান্নামে যেতে হবে বলে
তাদের মরদেহ নিজ নিজ আত্মীয় স্বজনদের কাছে ফিরতি ফ্লাইটে পাঠিয়ে দিচ্ছে। ওগুলি
করাচিতে পৌছের পর থেকেই করাচি শহরের চেহারা সম্পূর্ণ বদলে গেল। হবারই কথা। ওদের
যখন ইস্ট পাকিস্তানে পাঠিয়েছিল তখন উর্ধ্বতন কর্তারা বলেছিল যে ওখানে সব কাফের
রয়েছে কাজেই তোমাদের মিশন হচ্ছে এই সব কাফেরদের হত্যা করা। ওরা এসে দেখে সকাল
সন্ধ্যা সহ সারা দেশে নিয়মিত আজান হচ্ছে, সাধারন নাগরিকেরা নিয়মিত জামাতে যাচ্ছে।
কাফের কোথায়? আবার কিছু আছে যারা মনের উল্লাসে কর্তার হুকুম
তামিল করতে গিয়ে যা করেছে সে সবাই জানেন। আমিও জানি যদিও নিজ চোখে দেখিনি। যাক
এখানে ও কথা লিখছি না। এখানে যা লিখছি তা অনেকেই জানেন না। তা ওই যারা মনের
উল্লাসে কাফের মারতে এসেছিল তাদের মরদেহ পেয়ে আত্মীয় স্বজনেরা মহা আনন্দ নিয়েই
বাঙ্গালি নিধন যজ্ঞে ঝাপিয়ে পরল। নেমে এলো নির্যাতনের বিশেষ প্রক্রিয়া।
এক
দিন রাতে বাবা আমার দাদির নামে মানিওর্ডার করার জন্য কিছু টাকা দিলেন। স্কুল বন্ধ
তাই সকালে উঠে নাশাতা খেয়ে এলাকার পোস্ট অফিসে গিয়ে কিউতে দাড়ালাম। কিউ যখন
কাউন্তারের কাছে এগিয়ে গেল তখন কাউন্তার ক্লার্ক আমার মানিওর্ডার ফর্মে ইস্ট
পাকিস্তানের ঠিকানা দেখে ছুড়ে ফেলে দিয়ে একটা গালি দিল। আমিও রক্তের উষনতার জোয়ারে
কিছুক্ষণ বাদানুবাদ করলাম। দেখলাম আমার পক্ষে কয়েক জন এগিয়ে এলো। বলল কেনরে ভাই
টাকা পাঠাবেনা কেন?এতো একই দেশ। পাঠিয়ে দাও। যাই হোক শেষ পর্যন্ত টাকাটা নিয়ে একটা রশীদ দিয়ে
দিল।
কয়েক
মাস ধরে অস্ত্র সহ জিবীত সৈন্য আসে আবার মরা, আধ মরা, ভাঙ্গাচোরা
সৈন্য ফিরতি ফ্লাইটে ফেরত যায়। ভারত সরকার তার দেশের উপর দিয়ে পাকিস্তানি প্লেন
যাতায়াত নিষিদ্ধ করে দিল। এখন কলম্বোর দক্ষিণ দিয়ে ঘুরে প্লেন আসে যায়। এই ভাবে
যখন ওদের সৈন্য আনা হোল তখন জুন মাসের শেষ দিকে আবার এক টেলিগ্রামে জানাল ফ্লাইট
চালু হয়েছে তোমরা অফিসে এসে টিকেট রিকনফার্ম করে নাও। দেরি না করে বাবা টেলিগ্রাম
এবং টিকেট নিয়ে অফিসে গিয়ে জুলাই মাসের ১০ তারিখে রাত ১১টায় আমাদের ফ্লাইট কনফার্ম
করে এলেন। বাধাছাদা প্রায় সব করাই ছিল আবার নতুন করে কিছু করে রেডি হলাম। বাবার
কাছে নগদ কিছু টাকা ছিল। এখন কথা হচ্ছে এই টাকা কি করে নেয়া যায়? যদি কাস্টমে চেক করে পায় তাহলে যদি নিতে না দেয় তো সর্বনাশ হয়ে যাবে।
একেবারে খালি হাতে দেশে ফিরতে হবে। মা বুদ্ধি করে বোনের দুধ নেয়ার জন্য যে ফ্লাস্ক
ছিল সেটা থেকে ভিতরে টিউব খুলে চতুর্দিকে টাকা পেচিয়ে আবার ভিতরে ভরে প্যাচ দিয়ে
আটকে দিলেন। মোটামুটি রক্ষা পাবে এমন একটা আশা। মার গয়না টয়না যা ছিল তা কোন রকম
লুকিয়ে নেয়া হলো।
আমরা
জুলাই মাসের ১০ তারিখে রাতে একটা টেক্সি ডেকে এত দিনের বসবাস করা অনেক চেনা করাচি
শহর ছেড়ে শুভক্ষণে করাচি এয়ারপোর্টের দিকে রওয়ানা হলাম। যে শহরে কেটেছে নিজের শৈশব, কৈশর তার প্রতি কোন টান অনুভব
করিনি। কেমন যেন পর হয়ে গেল এই এত চেনা এত সুখ দঃখের স্মৃতি, সব কিছু পিছনে ফেলে টেক্সি এগিয়ে চলেছে। আমার সে রাতের কথা আজও এত দিন পরে
স্পস্ট মনে আছে। একটি বারের জন্যেও পিছনে ফিরে তাকাইনি, আমার
মা, বাবা বা ছোট ভাই কেউ না।
এয়ারপোর্টে
টিকেট চেক ইন হলো, সিকিউরিটি চেক হলো এবার বোর্ডিং। বোর্ডিঙ্গের ঠিক আগে কোথা থেকে যেন
কাস্টম এসে সামনে দাড়াল। বাবা জিজ্ঞ্যেস করল কি ব্যাপার? আমরা
একটু চেক করব। চেকতো আগেই করেছে, এখন আবার কি? ওটা ছিল সিকিউরিটি চেক আর আমরা করব ভিন্ন চেক। আচ্ছা ঠিক আছে কর। প্রথমেই
মায়ের হাতের ব্যগ। খুলে দেখেই ঠিক ওই ফ্লাক্স। ওটা হাতে নিয়ে নারাচারা করে আর
জিজ্ঞ্যেস করে এটায় কি? মা বলল কোলে বাচ্চা দেখছনা ওর দুধ। এ
কথায় ওই কাস্টম খুশি হতে পারল না। তার পাশে দাড়ান বসের হাতে দিল। বসও একটু
নারাচারা করে এদেক ওদিক ঘুড়িয়ে দেখে মার হাতে দিয়ে দিল।
যাক
এ যাত্রা বাচা গেল। প্লেনে উঠে বসলাম। আড়াই ঘন্টার পথ ঘুড়ে কলম্বো হয়ে সাড়ে ছয়
ঘন্টায় ১৯৭১ সালের ১১ জুলাই ঢাকা এয়ারপোর্টে নামার আগে প্লেনের জানালা দিয়ে দেখি
নিচে পাকি সৈন্যরা নানান ভঙ্গিতে নানান অস্ত্র নিয়ে রানওয়ে ঘিরে রেখেছে। প্লেন
ল্যান্ড করার পর ভিতরে এসে দেখি মিলিটারি গিজ গিজ করছে। আর সব কিছুই নিরাপদে
পেরিয়ে এসে আবার সেই কাস্টম এবং সেই মায়ের ব্যাগের ফ্লাক্স। এখানেও এক নজর দেখেই
ফেরত দিয়ে চক দিয়ে লাগেজে ওকে চিহ্ন দিয়ে দিল। আমরা বের হয়ে দেখি বাইরে মেঝ মামা
অপেক্ষা করছেন। মালামাল নিয়ে মামার গাড়িতে উঠিয়ে চলে এলাম মামার ধানমন্ডির বাসায়।
ওখানে দুই তিন দিন থেকে একেবারে গ্রামের বাড়ি।
No comments:
Post a Comment
Thank you very much for your comments.