Thursday 17 July 2014

বিকেল বেলার বৃষ্টি

ছবিঃ নিউ ক্যাসেল ইউনিভার্সিটি/লেখক
১।
ক্লাস শেষ করে রবিনসন লাইবেরি থেকে কয়েকটা বই নিবে বলে রেজার সাথে বের হলো। দুই বন্ধু একসাথে ফুটপাথ দিয়ে হেঁটে  যাচ্ছিল। শীতের দুপুরে ফুটপাথের পাশে ন্যাড়া পপলার গাছের নিচে দিয়ে হাঁটতে ভালই লাগছিল। জেসমন্ড
রোডের বায়েই লাইবেরিটা। বাম দিকে ঘুরে আবার ওপাশের ফুটপাথ দিয়ে হাঁটছে, যেদিকে জেসমন্ড রোড
গেছে। কিছু দূর যাবার পর হঠাৎ কি মনে করে মাহমুদ থেমে গেল।
কিরে থামলি কেন?
তুই যা, আমি একটু সিভিক সেন্টারে যাব!
কেন?
ওখানে কাল একটা বই দেখেছি, কার্ড ছিলনা বলে নিতে পারিনি আজ নিয়ে আসছি, তুই যা।
আচ্ছা ঠিক আছে তাড়াতাড়ি আসবি, আমি অপেক্ষা করব। এক সাথে বাসায় যাব মনে রাখিস। আমাকে ফেলে আবার চলে যাবি না সেদিনের মত
ঠিক আছে তুই যা আমি বই নিয়েই চলে আসছি
আবার পিছনে ঘুরে সিগন্যালের কাছে এসে রাস্তা পাড় হবার জন্য অপেক্ষা করছে।
ডান দিকে একটু এগিয়ে গেলে ডানে হে মার্কেট আর বাম দিকে এগিয়ে নিউ ক্যাসেল রেল স্টেশনের পথ। সিভিক সেন্টারের ডানে হে মার্কেট স্কয়ার, পাশেই হে মার্কেট মেট্রো স্টেশন।
রাস্তার ওপাড়েই অনেকটা জায়গা নিয়ে সিভিক সেন্টার। পাশে মেইন রোড থেকে গেট দিয়ে ঢুকলেই হাতের বায়ে একটা দেয়ালে যারা যুদ্ধে দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছে কাল পথরে খোদাই করা তাদের বেশ কয়েক জনের ভাস্কর্য। ডানে সেন্ট থমাস গির্জা। মাঝে রাস্তার দুই পাশে দিয়ে সাইকলো গাছের সাড়ি। সমস্ত চত্বরটাই সাইকলো, পপলার, ওক, কয়েকটা পাইন এই রকম নানান গাছ গাছালিতে ভরা। গির্জার পিছনে জুনিপারের ঝোপ। শীত বলে গাছ দেখে আর গাছের মত মনে হয় না। সব পাতা ঝরে গিয়ে শুধু কতগুলি কাঠির স্তূপ দাঁড়িয়ে রয়েছে মনে হয়। তবুও দেখতে বেশ লাগে। গায়ে শীতের ভারী কাপর, নাক দিয়ে শ্বাস প্রশ্বাসের সাথে বের হওয়া জলীয় বাষ্প দেখে মনে হয় শরীরের ভিতরের যত আবর্জনা ছিল সব বের হয়ে যাচ্ছে। হাতের গ্লোভস খুলে সিগারেট টানতে গিয়ে হাত প্রায় জমে যাওয়ার অবস্থা এমন শীত।
ছবিঃ নিউ ক্যেসেল হে মার্কেট/ লেখক
২।
মেইন রোড পার হবার আগেই ওপাড়ের সিগনালে দাঁড়িয়ে মাহমুদ দেখল একটা মেয়ে সিভিক সেন্টার থেকে বের হয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামছে। মাত্র কয়েক ধাপ সিঁড়ি। নেমে গেটের দিকে এগিয়ে আসছে। এর মধ্যে মাহমুদ রাস্তা পাড় হয়ে সিভিক সেন্টারের গেটের ভিতরে ঢুকে পরেছে।  এগিয়ে ভিতরে ঢোকার সময় মাহমুদের পা এগুচ্ছে কিন্তু চোখ দুটি দূর থেকেই থেমে গেল। সামনে এক দীর্ঘাঙ্গী এক হারা গড়নের ফর্সা এক মেয়ে। পরনে নীল জিনসের প্যান্ট, গায়ে ফুল স্লিভ লাল টি সার্টের উপরে কাল নেটের হালকা বুননের সোয়েটার। দেখে মাহমুদ অবাক হয়ে গেলএই শীতে এই পোষাকে কেন মেয়েটা? এদেশের নয় যে এই আবহাওয়ায় মানিয়ে নিয়েছে, দেখতে এশিয়ান মনে হচ্ছে, কাল চুল। কিছু কৌতূহলো, কিছু বিস্ময় এবং কিছু ঘোর নিয়ে  মেয়েটা সামনে আসার আগেই থেমে মেয়েটার দিকে এক পা এগিয়ে গ্লোভস পরা ডান হাত এগিয়ে বলল আমি নেয়ামত উল্লাহ মাহমুদ ফ্রম ইরান। মেয়েটা সামনের এই আগন্তুকের কাণ্ড আর চেহারা দেখে থমকে দাঁড়িয়েছিল। সম্বিত ফিরে পেয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে হাত না বাড়িয়ে  আস্তে করে এক পা পিছিয়ে বলল আমি সাবিহা খানম,  ফ্রম ইন্ডিয়া।
সাবিহা খানম মানে মুসলিম?
হ্যাঁ, তুমিও তো মুসলিম, মাহমুদ!
হ্যাঁ। তুমি কি এখানে নতুন এসেছ?
কেন?
আজকের আবহাওয়ার খবর তুমি জান?
কেন, কি হয়েছে?
বলছ কি! ওই দেখ,
বলে ডান দিকের মনুমেন্ট টাওয়ারের ওপাড়ে একটা বিল্ডিঙের ছাদে লাগান ওয়েদার বোর্ড দেখিয়ে বলল
দেখেছ আজকের তাপমাত্রা কত? -৫ ডিগ্রি, এখন আমরা অপেক্ষা করছি কখন স্নো পরবে আর তুমি বিদেশিনী হয়ে এই পোষাকে! জান তোমাকে এই পোষাকে দেখে আমি ভয়ে আঁতকে উঠেছিলাম!
মাহমুদের এই কথা শোনার পর গোলাপের মত মুখে অনেকগুলি পিয়ানোর পঞ্চমী সুরের ঝংকার তুলে হাসিতে ফেটে পরার উপক্রম হলো।
ওহ! এই জন্য তুমি আমাকে থামিয়েছ? কিন্তু আমি একটুও শীত বোধ করছিনা!
সাবিহা যখন এমন প্রাণ খুলে হাসছিল তখন আরও সুন্দর লাগছিল। যেন নিষ্পাপ কোন শিশুর স্বর্গীয় হাসি! এত সুন্দর! মাহমুদ চমকে যায়। ক্যামেলিয়ার মত চোখ, গোলাপের মত মুখ, প্রিমরোজের পাপড়ির মত ঠোট, বাহরাইনের মুক্তার মত দাঁত, নাক আর হালকা কোঁকড়ান কাল কুচকুচে রেশমি চুল। ইরানেও এমন অনেক সুন্দরী দেখেছে কিন্তু এ যেন তাদের সবার চেয়ে অনেক বেশী! কথা বলছে যেন সেটার বাজছে। সুন্দর হলেই কি এত সুন্দর হবে! অবাক হয়ে চেয়ে থাকে।
তুমি এখনও কিছু বুঝবেনা  কারণ তুমি সবে মাত্র সিভিক সেন্টারের হিটার থেকে বের হয়েছ! কয়েক মিনিট যেতে দাও তখন বুঝবে!
তবে আমি মাত্র গত সপ্তাহে এখানে এসেছি একথা সত্য। এখনও এদেশের কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি।
বেশ, তাহলে চল ওই হে মার্কেটের একটা কফি শপে বসে তোমার সাথে আলাপ করি!
বলেই সাবিহার মুখের দিকে তাকাল। একটু রাজী আর নিমরাজি দুয়ের ছায়াই দেখে বলল
ভয়ের কিছু নেই, আমি
পিছনে দেখিয়ে
এই নিউক্যাসেল ইউনিভার্সিটিতে চিফ মেট পরীক্ষা দিতে এসেছি। ম্যারিটাইম ডিপার্টমেন্টে। তুমি?
আমি সবে বার করার ইচ্ছা নিয়ে মাস্টার্সে এডমিশন নিয়ে এসেছি!
কোথায় থাকছ?
বাম দিকে দেখিয়ে
ওইতো ওই দিকে ওয়েস্ট গেট রোডে
কোথায়?
ওখানে একটা পিজা শপ আছে তার ওপরে
এশিয়ান পিজা শপ, হিন্দু রাম মন্দিরের বিপরীতে?
হ্যাঁ হ্যাঁ, তুমি চেন?
চিনি মানে যেতে আসতে চোখে পরে, যাইনি কখনও। চল যত দেরি হবে ঠাণ্ডা তত বাড়বে।
আবার একটু আমতা আমতা করে
বেশ চল
আবার গেট দিয়ে বের হয়ে বাম দিকে ঘুরে ফুটপাথ ধরে দুই জনে কথা বলতে বলতে এগিয়ে গেল। মার্কেটের কাছে এসে সাবিহা বল ও, ভীষণ শীত!
যাক, এতক্ষণে বুঝতে পেরেছ এই জন্য তোমাকে অনেক ধন্যবাদ!
৩।
হে মার্কেট স্কয়ার পাড় হয়ে একটা কফির দোকানে ঢুকে টেবিলের পাশে এসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে মাহমুদ ইশারায় সাবিহাকে বসতে বলল। সাবিহা বসার পর মাহমুদ জিজ্ঞেস করল কফির সাথে আর কিছু খাবে কিনা। না না শুধু কফি। মাহমুদ এগিয়ে কাউন্টারের কাছে গিয়ে দুই কাপ কফির কথা বলে এসে টেবিলের এদিকে বসে বলল
দেখেছ কি ভয়ংকর ঠাণ্ডা! এই টুক আসতেই সবকিছু কেমন জমে গেছে মনে হচ্ছে!
হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছ। আমি বুঝতেই পারিনি ঠাণ্ডা এত ভয়ংকর! তুমি কি এদেশে অনেক দিন ধরে আছ?
মোটেই না, তবে এর আগে কয়েক বার এসেছি। সেকেন্ড মেট করার সময়, তা ছাড়া অন্যান্য সময়ে জাহাজ নিয়ে এসেছি তবে নিউক্যাসেলে নয়, লন্ডন এবং ব্রিস্টলে।
তাহলে তুমি অনেকবার এসেছ?
তা বলতে পার। আমিতো সিম্যান। আমার কাজই এমন, জাহাজ যখন যেখানে যায় আমিও জাহাজের সাথে সেখানে যাই।
তুমি বললে তুমি ইরান থেকে এসেছ। ইরানের কোথায়, আই মিন, কোন শহরে?
আবাদান রিফাইনারির নাম শুনেছ?
না
ও! তা ওই আবাদানেই আমার বাড়ি। আবাদান রিফাইনারি থেকে ২/৩ মাইল উত্তরে এগিয়ে গেলেই
তোমাদের ইন্ডিয়া অনেক বড় দেশ, তুমি কোথা থেকে?
আমার বাড়ি কলকাতা
আরে আমি কলকাতা গেছি! ডায়মন্ড হারবার তাই না?
হ্যাঁ হ্যাঁ আমার বাড়ি আলিপুরে ডায়মন্ড হারবার রোডের ধারে
৪।
এর পর একে অপরের সাথে পরিচিত হতে যা আলাপ হয় তেমন অনেক কিছু।  টুকিটাকি আলাপ করে কফি শেষ করে বলল
তোমার কি কিছু গরম কাপর দরকার?
হ্যাঁ এখানে এত শীত বুঝতে পারিনি তাই কেনা হয়নি
এখনই কিনে ফেল, চল তোমাকে কেনাকাটায় একটু হেল্প করি! এই সব কেনা কাটার জন্য সোজা প্রাইমার্কে চলে যাবে, ওদের বিশাল কালেকশন আর দামও খুবই কম। আমরা স্টুডেন্ট বলে আমাদের অত বিলাসিতা করা চলে না, তাই না?
এখন কিনতে বলছ?
নিতে হবে ব্যাস নিয়ে নাও!
কিন্তু আমি যে এখনো কিছু চিনি না
তাতে কি? বললাম না আমি হেল্প করব, চল উঠি
বের হবার সময় মাহমুদ কফির দাম দিয়ে বের হয়ে এক সাথে সোজা হে মার্কেটের ভিতরে যে প্রাইমার্কের আউট লেট রয়েছে সেখানে চলে এলো।
যা যা প্রয়োজন এক এক করে অনেক কেনা কাটা করে ফেলল। পোষাকের প্যাকেট নিয়ে বের হয়ে এলো।
 
ছবিঃ ওয়েস্ট গেট রোড/ লেখক
৫।
তুমি হেঁটে যাবে তাই না?
হ্যাঁ কাছেই
চল তোমাকে এগিয়ে দিচ্ছি, এত প্যাকেট নিয়ে একা কি করে যাবে!
তুমি এগিয়ে দিবে?
চল, আমার কোন তাড়া নেই
দুইজনে ওয়েস্ট গেট রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে ওয়েস্ট গেট রোড এবং বাম দিক থেকে ল্যাংকেস্টার রোড যেখানে মিশেছে তার  মাথায় পিজা শপের নিচে দিয়ে উঠে দোতলায় চলে এলো। সাবিহা পকেট থেকে চাবি বের করে ঘরের তালা খুলে প্রথমে নিজে ঢুকে মাহমুদকে আসতে বলল। সাবিহার বাসাটা মোটামুটি। সামনে বিশাল গোরস্তানের পাশ দিয়ে ওয়েস্ট গেট রোড পশ্চিম দিকেই চলে গেছে, গোরস্তানে অনেক বড় বড় পুরনো গাছ। ডাইনে রাম মন্দির এবং তার একটু পরেই শিখদের গুরু দিওয়ারা, বায়ে ল্যাংকেস্টার রোড দক্ষিণে চলে গেছে। বাসার নিচেই চৌরাস্তার ওপাড়ে বাস স্ট্যান্ড। হাতের প্যাকেটগুলি সোফায় নামিয়ে রেখে সাবিহা জিজ্ঞেস করল
চা খাবে?
আরে না না মাত্র কফি খেয়ে এসেছি না! এখনই চায়ের কি দরকার?
এই প্রথম আমার বাসায় কেও এসেছে তোমাকে এখন কি দিয়ে আপ্যায়ন করি তাহলে?
ফর্মালিটি করতে চাইছ?
মন্দ বলনি, শত হলেও আমি ইন্ডিয়ান। ঘরে অতিথি এলে কি খালি মুখে বিদায় দেয়া যায়?
হ্যাঁ তুমিও যেমন ইন্ডিয়ান আমিও তেমনি পারসি! এখন আমাদের পরিচয় হচ্ছে আমরা এখানে স্টুডেন্ট, কাজেই নো ঝামেলা, বুঝেছ? তারচেয়ে আমি এখন উঠি পরে আবার আসব।
প্রথম প্রথম একজন অজানা পুরুষের সংস্পর্শে সাবিহা একটু উপমহাদেশীয় দ্বিধার মধ্যেই ছিল এ কথা অস্বীকার করা যাবে না। তাই বিশেষ জোরাজুরি না করে বলল
উঠবে? তুমি কোথায় থাক যেন?
আমি থাকি সাউথ শিল্ডে, ওই যে আমরা যেখান থেকে শপিং করেছি তার একটু সামনে এগিয়ে গেলেই নিউ ক্যাসেল রেল স্টেশন থেকে মেট্রোতে যেতে হয়।
অনেক দূর?
না না মিনিট বিশেক লাগে, একদিন যেয়ে দেখবে। ছোট্ট শহর কিন্তু বেশ সুন্দর। এই এলাকায় কাছাকাছি পাঁচ টা শহর
তাই নাকি?
হ্যাঁ, এইতো নিউক্যাসেল, ডারহাম, সাউথ শিল্ড, সান্ডারল্যান্ড আর ডার্লিংটন তবে নিউ ক্যাসেলই সবচেয়ে বড়
সুযোগ মত সব জায়গায় যাব।
হ্যাঁ যাবে।
উঠতে উঠতে বলল দরকার হলে আমিও যাব তোমার সাথে। আচ্ছা তাহলে আমি এখন আসছি, কাল দেখা হবে।
৬।
নেয়ামত উল্লাহ মাহমুদ বেরিয়ে যাবার পর সাবিহা বাইরের পোষাক বদলে ফ্রেশ হয়ে এসে জানালার পর্দা সরিয়ে টিভি অন করে সোফায় বসল। টিভি দেখা হচ্ছে না। ভাবছে। ছেলেটা খুব ভাল। যেমন সু পুরুষ তেমনি আচার ব্যবহার। হাসি খুশি। এই টুক সময়ের মধ্যেই কেমন আপন করে নিয়েছে। মনে হচ্ছে কত চিনের চেনা। সত্যিই, এই শীতের মধ্যে উপযুক্ত পোষাক না নিয়ে মস্ত ভুল করে ফেলেছিল। আর কখনও এমন হবে না। মন চলে গেল কলকাতার আলিপুরে। নাদিম পরিষ্কার বলে দিয়েছে ওর জন্য সে অপেক্ষা করতে পারবে না। সাবিহা অনেক বোঝাবার চেষ্টা করেছে, মাত্র দুইটা বছর! কিন্তু নাদিম মানতে রাজি হয়নি। আসলে সে অন্য কিছু চেয়েছিল যা সাবিহা বিয়ের আগে দিতে রাজি হতে পারেনি।
লখনো থেকে আসা নাদিম ছাত্র হিসেবে ব্রিলিয়ান্ট। যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সেরা ছাত্র। সাবিহা কলকাতার মানুষ হলে কি হবে ওদের বাড়ির ভাষা উর্দু। বাংলা বুঝতে বা বলতে পারলেও মাতৃভাষা উর্দু। কলকাতার অন্যান্য অভিজাত মুসলমানদের যেমন। নাদিমেরও তাই।
ইংল্যান্ডে আসার আগের দিন মুষলধারে বৃষ্টির বিকেলে বেহালার এক কাফেতে বসে টেবিলে কফির পেয়ালা আর সামনের বড় রাস্তার দিকে চোখ রেখে বলেছিল
চল না আজ আমরা সেলিবরেট করি!
বৃষ্টির শব্দে প্রথমে শুনতে পায়নি বলে জিজ্ঞেস করেছিল কি বললে?
আবার একটু আমতা আমতা করে একই কথা বলেছিল
কি সেলিবরেট করব?
কেন আজকের এই বৃষ্টি ভেজা মধুর বিকেলটাকে আরও মধুর করে রাখি! একটা স্মৃতি হয়ে থাক, কি বল?
কি করে?
তুমি কি কিছুই বুঝতে পারছ না?
মনে মনে রেগে গেলেও নাদিমকে কিছু বুঝতে দেয়নি। এত দিনের সম্পর্কের এই পরিণতি চাইছে নাদিম? তাহলে এই কি তোমার আসল রূপ! অবাক হয়ে গিয়েছিল সাবিহা। সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিয়েছিল
এইতো আর মাত্র দুইটা বছর, আমি ইংল্যান্ড থেকে ফিরে আসি বিয়ের পর সবইতো পাচ্ছ কাজেই এত অস্থির হবার কি আছে? এত উতলা হলে চলে?
না উতলা হচ্ছি না, তুমি অনেকদিনের জন্য চলে যাচ্ছ তাই ভাবছিলাম!
দেখ, তুমি আমি দুজনেই অত্যন্ত রক্ষণশীল পরিবার থেকে এসেছি, আমরা এত খোলামেলা হতে পারি না।
ইচ্ছে করলে পারা যাবে না কেন? তুমি ইচ্ছে করলেই হয়
তোমার এই কেনর উত্তর আমি দিতে পারছি না
বলেই সাবিহা উঠে চলে এসেছিল।
পরদিন সন্ধ্যায় ফ্লাইট। দমদম থেকে মুম্বাই হয়ে নিউক্যাসেল। নাদিমের এয়ারপোর্টে যাবার কথা ছিল কিন্তু মা বাবা ভাই বোনদের মাঝে থেকে সাবিহা ওকে আর খুঁজে দেখেনি। গিয়েছিল কিনা তাও জানা হয়নি বা জানার ইচ্ছেও হয়নি। আসার পর ফোনও করেনি। ওর সাথে কথা বলার মত আর কোন স্পৃহা নেই। দেখা যাক। নাদিম এই পুরুষ জাতিকে সহজে বিশ্বাস করার কোন উপায় রাখেনি। বিগত পাঁচটি বছরের এই সম্পর্ক তার এই পরিণতি ভেবে নিয়েছিল? অথচ সে এই সম্পর্ককে কতই না পবিত্র বলে ভেবে এসেছে এতদিন! অবাক কাণ্ড! সবই কি তাহলে ছলনা? বিশ্বাস বলতে যা বোঝায় তা নাদিম ভেঙ্গে ফেলেছে। হতে পারে এটা নর নারীর আদিম সত্য কিন্তু তাই বলে এমন করে তা হবে? সাবিহা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। অনেক রাত হয়ে গেল। এবার উঠে ফ্রিজ খুলে কিছু খাবার বের করে মাইক্রোওয়েভে গরম করে খেয়ে রুম হিটার চেক করে শুয়ে পরল। অরিয়েন্টেশন হয়ে গেছে। পরদিন ক্লাস আছে ঘুমাতে হবে।
.৭।
 মাহমুদ সাবিহার রুম থেকে বের হয়ে হেঁটেই স্টেশনে চলে এলো। হাঁটছিল আর ভাবছিল মেয়েটা কি সুন্দর! লম্বা, গোলগাল চেহারা, দারুণ ফর্সা, ডান গালের ঠিক মাঝখানে একটা বড় তিল যাকে বলে বিউটি স্পট। পেশায় সে নাবিক, অনেক দেশেই গেছে কিন্তু এমন সুন্দর চোখে পড়েনি। কথা বলার ভঙ্গি তার চেয়েও সুন্দর। তাদের ইরানেও কি কম সুন্দরী আছে! কিন্তু তাদের কারো সাথেই এর কোন তুলনা হয় না। কি পড়ছে যেন বলল? ও হ্যাঁ, আইন এর ছাত্রী। ভাবতে ভাবতে কেমন যেন ঘোর লেগে এসেছে। রেজার কথা ভুলেই গেছে। বাসায় এসে দেখে রেজা সোফায় বসে টিভি দেখছে।
কি রে, তুই আমাকে লাইবেরিতে বসিয়ে রেখে আবার কোথায় ডুব দিয়েছিলি?
সংক্ষেপে সাবিহার কথা জানাল। শুনে রেজা বলল তুই পরীক্ষা হলেই এখান থেকে চলে যাবি আর তাছাড়া সে ইন্ডিয়ান কাজেই কি হবে তার কথা ভেবে?
পরীক্ষার কথা বলছিস কেন? পরীক্ষা হয়ে গেলে এখানে থেকে যাব আর সে ইন্ডিয়ান তাই কি হয়েছে? এমন বিয়ে হয় না? দরকার হলে এখানেই সেটল করব!
কি জানি ভাল করে ভেবে দেখ। একদিন একটুখানি দেখেই এমন হুট করে সিদ্ধান্ত নেয়া কি ঠিক হবে আর তুই এক তরফা ভাবলেইতো হবে না। সে কে কি এগুলি জানতে হবে না? তার সম্মতির প্রয়োজন নেই ভেবেছিস? ওভার সিজ বিয়ে বড় কঠিন বিয়ে জানিস না? অনেক হাঙ্গামা পোয়াতে হয়! তবে একটা ব্যাপার তোর পক্ষে আছে, সে মুসলিম।
দেখ আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি, ওর সম্মতি পেলে আমি ওকে নিয়ে দরকার হলে এখানেই সেটল করব।
তুই কি পাগল হয়ে গেলি?
কেন হব না বল? তুই যদি ওকে দেখতি তাহলে তুইও তাই হতি!
যাক বাবা না দেখে ভালই হয়েছে। এখনও আমার অনেক কাজ বাকি আছে। তাছাড়া হয়ত তোর সাথে কাড়াকাড়ি লেগে যেত। এখন চল খাবো, তোর জন্যে বসে আছি।
৮।
সকালে ঘুম থেকে উঠে চটপট কর্ণ ফ্লেকস আর দুধ দিয়ে নাশতা সেরে পায়ে হেঁটেই ক্লাসে চলে গেল। গত সন্ধ্যার কথা মনে করে সদ্য কেনা নতুন পোষাক পরেই বের হয়েছে। হাতের গ্লোভস, গলায় স্কার্ফ নিতে ভুলেনি। ক্লাস শেষে রুম থেকে বেরিয়ে আসার পথে মালয়েশিয়ার নাজিয়ার সাথে আলাপ হলো। করিডোর ধরে হাঁটছে আর কথা হচ্ছে। নাজিয়া এখান থেকেই গ্রাজুয়েশন করেছে। ওর বার করার ইচ্ছে নেই মাস্টার্স হলেই দেশে চলে যাবে।
কেন, চলে যাবে কেন?
আমার হবু বর সময় দিতে চাইছে না।
, আচ্ছা এই ব্যাপার! যাক তবুও তোমার সাথে একটা বছর কাটাতে পারব। আমি নতুন এসেছিতো তাই মনে একটু ভয় কাজ করছে।
ঠিক হয়ে যাবে এসব ভয় কয়েকদিন থাকে মাত্র। একদিন দেখবে তুমিই নতুনদের পরামর্শ দিচ্ছ।
চল কফি খাই!
হ্যাঁ খেতে পারি, উফ! যা শীত পড়েছে! এখানে কি এমন শীত পড়ে?
এইতো নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত প্রায় এমনই থাকে। নিউ ক্যাসেলে প্রায় সারা শীত জুরেই স্নো থাকে, স্নো না হলে বৃষ্টি। বিশ্রী আবহাওয়া। এপ্রিলে স্প্রিং তখন অনেকটা কমে যায় আর সেই সাথে কাপড় চোপরের বোঝাও হালকা হতে থাকে।
৯।
কথা বলতে বলতে ওরা ক্যাফেটেরিয়াতে এসে জানালার পাশে বসল। আজ ভীষণ শীত পড়েছে গতকালের চেয়েও বেশি। বারে ঢুকে দুইজনে দুই কাপ কফি নিয়ে একটা টেবিলে বসতে বসতে বাইরের দিকে তাকিয়ে নাজিয়া বলল
দেখবে আজ স্নো পড়বে। 
আমি কলকাতায় বড় হয়েছি তাই কখনও স্নো দেখিনি
স্নো দেখতে ভারি সুন্দর লাগে, আমাদের দেশেও স্নো হয় না এমনকি ওখানে তেমন শীতই পড়ে না
আমাদের দেশে কাশ্মীর, অরুণাচল প্রদেশেও স্নো পড়ে কিন্তু আমি ওদিকে কখনও যাইনি, ভাল হয়েছে এবার দেখব
সাবিহার কথা শেষ হবার আগেই বাইরে বাতাসের ঝাপটা শুরু হলো আর তার সাথে সাদা তুলোর মত স্নো ভেসে ভেসে পড়ছে দেখে নাজিয়া বলল
দেখ, বলতে না বলতেই শুরু হয়ে গেল। কতদিন থাকবে কে জানে!
সাবিহা ঘুরে দেখল।
বাহ! বেশ সুন্দরতো! আমার মনে হচ্ছে বাইরে যেয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। উঠে জানালার পাশে দাঁড়াল। জান আমরা কলকাতায় বৃষ্টিতে ভিজতাম। ঝুম বৃষ্টি হলে বাড়ির সবাই ছাদে চলে যেতাম, এখানে যেতে পারব?
বলে নাজিয়ার মুখের দিকে তাকাল
না না খবরদার, ভুলেও কখনও এমন কাজ করবে না, নির্ঘাত মারা পড়বে! তবে তুমি ছাতা মাথায় পথে হেঁটে যেতে পারবে। ভাল কথা! তুমি কি থার্মাল জুতা কিনেছ? এখানে কিন্তু গরম জুতা ছাড়া স্নোর উপরে হাঁটবে না।
হ্যাঁ, কালই কিনেছি।
তুমি থাকছ কোথায়?
এখানেই, ওয়েস্ট গেট রোডে
এখানে কিন্তু ভাড়া বেশি! কত দিতে হবে?
সপ্তাহে ৫০ পাউন্ড
বল কি! আমি দেই মাত্র ২০ পাউন্ড!
কোথায়, কেমন করে?
আমি এখানে থাকি না, সাউথ শিল্ডে থাকি ওখানে এক রুমের একটা ঘর নিয়েছি তাতে আমি আর নেপালের জয়া দুইজনে মিলে থাকি তাতে আমাদের ২০ পাউন্ড করে চল্লিশ পাউন্ড হলেই হয়ে যায়। তুমি নতুন এসে এখানে নিয়ে নিয়েছ এটা ঠিক আছে কিন্তু পরে দেখে শুনে কাউকে পেলে সাউথ শিল্ডে থাকার ব্যবস্থা করতে পার এতে তোমার অনেক সেভ হবে। ওখানে কম দামে জিনিস পত্র পাবে, পাশেই আবার আজদা সুপার স্টোর আছে, খুব সহজেই সব কিছু হাতের নাগালেই পাবে।
সাবিহা একটু ভেবে দেখল, মনে হলো কাল মাহমুদও বলছিল ও সাউথ শিল্ডে থাকে।
হ্যাঁ তাহলেতো ভালই হয়, তুমিও একটু দেখবে কাওকে যদি পাও
হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই দেখব।
১০।
ওরা কফি খাচ্ছে এমন সময় কয়েকটা ছেলে এসে ঢুকল তাদের সাথে নেয়ামত উল্লাহ মাহমুদও ছিল। প্রথমে  সাবিহাকে লক্ষ করেনি। বারের সামনে যেয়ে সবাই এক সাথে হৈ চৈ করতে করতে যার যার কাপ নিয়ে এসে বসার জায়গা খুঁজছে এমন সময় হঠাৎ করে সাবিহার দিকে চোখ গেল।
আরে! সাবিহা তুমি?
হ্যাঁ এইতো
মাহমুদ নিজের কাপ নিয়ে সাবিহাদের টেবিলেই বসে পড়ল
তারপর বল কেমন চলছে
এইতো চলছে আরকি, ও হ্যাঁ! এ হলো আমার ক্লাস মেট নাজিয়া
আমি মাহমুদ
যাক আজ তাহলে রেডি হয়ে বেরিয়েছ!
হ্যাঁ, আসলে আমি আগে বুঝতেই পারিনি, এই নিয়েই নাজিয়ার সাথে আলাপ করছিলাম
ওদিক থেকে একজন মাহমুদকে ডাকল
মাহমুদ সরি, আসছি বলে উঠে গেল
নাজিয়া জিজ্ঞেস করল, আগে চিনতে?
না, এইতো মাত্র গতকাল আলাপ হলো।
কফি শেষ হলে নাজিয়া বলল আমাকে একটু বের হতে হবে, আমি উঠি?
হ্যাঁ চল, বলে সাবিহাও উঠে এলো। বের হবার আগে পিছনে তাকাল। মাহমুদ ওদের বেরিয়ে যাওয়া দেখছে, ওকে ইশারায় কি যেন বলে গেল।
১১।
এভাবে বেশ কয়েকদিন আসতে যেতে এখানে ওখানে প্রায়ই দেখা হয়। হাই! হ্যালো! ব্যাস, এই পর্যন্তই। দুইজনেই মনে মনে আলাপ করার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে কিন্তু সে সুযোগ আর হয়ে উঠছে না। একদিন রবিবারে ঝুর ঝুর করে স্নো ঝরা দুপুরে জানালার পাশে সোফায় বসে রাস্তার ও পাশে গোরস্তানের বিশাল ওক গাছের দিকে তাকিয়ে ভাবছিল  নাদিমের কথা মনে আসছিল কিন্তু ইচ্ছে করেই চেপে রাখার চেষ্টা করছে। কাছে ভিড়তে দিতে চাইছে না। নাদিমকে যা ভেবেছিল আসলে সে তা নয়। সাবিহা কিছুতেই ভেবে পায় না এমন একজনের সাথে সে কেমন করে জড়িয়ে পড়ল! এখানে চলে এসে ভাল হয়েছে। নয়ত কখন কোন অসতর্ক মুহূর্তে কোন ঝামেলায় জড়িয়ে যেত কে জানে? মানুষ কি সবসময় সতর্ক থাকতে পারে? মান সম্মান, পরিবারের মর্যাদা সব ধুলায় মিলিয়ে যেত। পরিণতি কি হোত ভাবতেও শিউড়ে উঠছে। কলকাতায় ফেলে আসা দিনের কথা যতই দূরে সরিয়ে রাখতে চায় কিন্তু কেন যেন বারবার জানালায় এসে উঁকি দেয়। এত দিনের সঞ্চিত কত স্মৃতি, কত কথা, কত মান অভিমান, সব কি ইচ্ছে করলেই মুছে ফেলা যায়? নানা ভাবে নানা দিক দিয়ে ভেবে এক সময় সোজা হয়ে দাঁড়াল। না, আমাকে সে সব দিনের কথা ভুলে যেতেই হবে! ভাবতে ভাবতেই কখন যেন মাহমুদ সামনে এসে দাঁড়াল। মনের দরজা আপনা আপনিই খুলে গেল। এতদিন তুমি কোথায় ছিলে? তাহলে কি তোমার জন্যেই আমি কলকাতা ছেড়ে এখানে এসেছি? সব চেয়ে ভাল লাগে মাহমুদের প্রাণ খোলা হাসি আর ছোট্ট শিশুর মত সরলতা। না হলে কি কেও প্রথম দেখায় এমন করে কোন অচেনা মেয়ের সাথে এভাবে কথা বলতে পারে? না না এ আমি কি ভাবছি? যাকে চিনি না, যার কিছু জানি না তাকে একদিন মাত্র দেখে এভাবে প্রশ্রয় দেয়া যায় না। স্নো ঝরার গতি আস্তে আস্তে বাড়ছে। দেখি, উঠে জানালার পাশে দাঁড়াল। রাস্তায় স্নো জমে সাদা হয়ে গেছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে জীবনের প্রথম স্নো দেখছে। আশেপাশের গাছগাছালির ডালে স্নো জমেছে। বাড়ি ঘরের ছাদও সাদা হয়ে গেছে। ভীষণ ভাল লাগছে দেখতে। কিন্তু মাহমুদকে নিয়ে আর ভাববে না মনে করলেও মন থেকে কিছুতেই মাহমুদকে দূরে সরাতে পারছে না। বারবার মাহমুদই সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে। এমন হচ্ছে কেন?
১২।
প্রথম দেখার দিন থেকেই মাহমুদ সাবিহাকে এক মুহূর্তের জন্যেও ভুলতে পারছে না। সেদিন ক্যাফেটেরিয়াতে দেখা হলে ভেবেছিল সঙ্গীদের বিদায় করে কিছুক্ষণ আলাপ করবে কিন্তু তার আগেই উঠে গেল। এর পরে দেখা হয়েছে কিন্তু সে কয়েক পলকের জন্য শুধু চোখের দেখা। কথা বলার জন্য মনটা ভীষণ উদগ্রীব হয়ে রয়েছে কিন্তু কোথায় কেমন করে? জীবনের প্রথম ভাল লাগা! সাধের সাজান বাগানের প্রথম গোলাপের প্রথম কলি! কত ভাবেই যে দেখতে ইচ্ছে করে তার কি কোন সীমা আছে? না আছে কোন স্বতঃসিদ্ধ! দেখতে কেমন, সুবাস কেমন কত কি মনে হয়। পাপড়িগুলি একটু হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখতে ইচ্ছে করে। কেন এমন হয়? কিছুতেই কোন ব্যাকরণ কিংবা থিউরিতে ফেলতে পারছে না। গত ছাব্বিশটা বসন্ত কোথা দিয়ে কেমন করে কেটেছে কখনও ভেবে দেখেনি, ভাবার মত তেমন সুযোগও আসেনি। এত দিন লেখা পড়া নিয়েই ব্যস্ত ছিল। এর বাইরে যে আরও কিছু আছে সে কোনদিন চোখ মেলে দেখেনি। পৃথিবীটা যে এত সুন্দর তা কোনদিন তাকিয়ে দেখেনি। এর আগে এমন কেও এসে তার মনে দোলা দিতে পারেনি, তেমন কোন সুযোগও আসেনি। হয়ত কেও এসেছিল কিন্তু সে বুঝতেই পারেনি! আজ মনে হচ্ছে সাবিহা তার ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিয়েছে, তার চোখ খুলে দিয়েছে। যে চোখ দিয়ে সে দেখতে পাচ্ছে এই সুন্দর পৃথিবী। পৃথিবী এখন অনেক সুন্দর লাগছে। চারিদিকে কত গান, কত সুর, কত রঙ যেন মন ভরে আছে!  তবে কি সে সাবিহার প্রেমে পড়েছে? এই কি তাহলে প্রেম? প্রেম কি এমন হয়? একদিন একটুর জন্যে না দেখলেও মন কেমন করে! শীতের ন্যাড়া পপলার গাছ গুলিও এখন সুন্দর লাগছে, সাউথ শিল্ড থেকে আসার পথে মেট্রো ট্রেনের ইঞ্জিনের শব্দ এখন গানের মত মনে হয়, আকাশটাও যেন অনেক বেশি নীল মনে হয়, মনে হয় যেন সারা বছর ধরেই সোনালী বসন্তের চেরি ফুল ফুটে রয়েছে।
১৩।
কয়েকদিন পরে দুপুরে ক্লাস শেষ করে সাবিহা সিভিক সেন্টারে গেল। ভিতরে ঢুকে দেখে মাহমুদ বইয়ের সেলফে কি যেন খুঁজছে। সাবিহার পায়ের শব্দ পেয়ে ঘুরে থমকে দাঁড়াল।
তুমি? ভাল আছ? অনেক দিন দেখি না!
অনেক দিন কোথায়? এইতো মাত্র কয়েক দিন!
কি বল? আমার মনে হচ্ছে কত দিন দেখা হয় না তোমার সাথে!
কি যে বল, প্রতিদিনইতো ক্লাসে আসছি, কই আমিওতো তোমাকে দেখি না, কোথাও গিয়েছিলে?
না না কোথায় যাব? ক্লাস চলছে না? সামনে পরীক্ষা
কবে?
সেপ্টেম্বরে
সাবিহা হেসে ফেলল। যেন এক সাথে অনেকগুলি পিয়ানোর তারের ঝংকার সারা ঘর জুরে অনুরণিত হচ্ছে। এমনিতে ঘরে শুধু কয়েকটা রুম হিটারের মৃদু গুঞ্জন ছাড়া আর কোন শব্দ নেই।
ও! সেতো অনেক দূর! এর মধ্যেই পরীক্ষার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছ?
মাহমুদ অবাক হয়ে সাবিহার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। মানুষ এমন সুন্দর করে হাসতে পারে!
কি হলো, কি দেখছ
সত্যি বলব?
হ্যাঁ তাইতো বলবে, শুধু শুধু মিথ্যে বলবে কেন?
সত্যি কথা বললে বলতে হয় আমি তোমার হাসি দেখছিলাম। তুমি এত সুন্দর করে হাসতে পার? এত সুন্দর হাসি জীবনে এই প্রথম দেখলাম তাই অবাক হয়ে দেখছিলাম।
কি যে বল! তুমিও কিন্তু সুন্দর করে হাসতে পার। আচ্ছা, বল কি খুঁজছিলে?
একটা রেফারেন্স খুজছিলাম, একটু বসবে? চল একটু বসি!
এখানে? একটু ভেবে বলল, চল
দুই জনেই পাশের ওয়েটিং লাউঞ্জে গিয়ে একটা সোফায় পাশাপাশি বসল। সময় যাচ্ছে কিন্তু কেও কিছু বলছে না। মাঝে মাঝেই এ ওর দিকে শুধু তাকাচ্ছে, চোখে চোখ পড়লেই আবার চোখ সরিয়ে নিচ্ছে। নীরব। আপ-অন-টাইন নদী দিয়ে যেমন পানি গড়িয়ে যাচ্ছে তেমনি সময়ও বয়ে যাচ্ছে কিন্তু সেদিকে কারো কোন খেয়াল নেই। এক সময় সাবিহা একটু হেসে জিজ্ঞেস করল
কি হলো, কিছু বলছ না তাহলে এখানে আসলে কেন?
তাইতো! বলত কি বলব? এখানে কেন এসেছি?
তুমিই না এখানে নিয়ে আসলে!
তাই নাকি?
কি হলো ভুলে গেলে? তুমি কি কিছু ভাবছ?
হ্যাঁ অনেক কিছু ভাবছি!
কি ভাবছ?
তোমার কথাই ভাবছি
আমার কথা আবার কি ভাবছ?
আচ্ছা, একটা কথা বলব?
কি বলবে বল
What is love?
সাবিহা আবার হেসে উঠল। আবার পিয়ানোর তারে ঝংকার বেজে উঠল। মাহমুদ আবার অবাক হয়ে সাবিহার মুখের দিকে তাকিয় রইল।
আবার কি দেখছ অমন করে?
কই, আমার প্রশ্নের উত্তর দিলে না?
সাবিহা হঠাৎ করেই যেন কোথায় হারিয়ে গেল। অনেকদিন ধরে যে কাল মেঘ তার মনের আকাশে ছেয়ে আছে সেই মেঘের ছায়া ছড়িয়ে গেল চোখে মুখে। সে মাহমুদের এই প্রশ্নের কি জবাব দিবে?
কি হলো কিছু বলছ না?
কি বলব বল?
সাবিহা জানালা দিয়ে বাইরে ঝুর ঝুর করে ঝরা তুষারের দিকে তাকিয়ে উদাস কণ্ঠে বলল
আসলে প্রেম এক এক জনের কাছে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে ধরা দেয়। কেও দুমড়ে মুচরে আছরে ফেলে, আবার কেও অনন্ত কাল ধরে এর তপস্যা করে আবার কেউ এটাকে গোলাপের মত সুন্দর করে সাজিয়ে রেখে মুগ্ধ চোখে চেয়ে থাকে। এর কোন নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। যে যে ভাবে নেয় তার কাছে তাই।
যেমন?
যেমন! সাগরের অশান্ত ঢেউয়ে কোন নাবিক তার জাহাজ রক্ষা করতে পারে না জাহাজটা ডুবে যায় আর নিরুপায় নাবিক তার অক্ষমতার ফল চেয়ে চেয়ে দেখে তেমনি, আবার কখনও নীরবে বয়ে যাওয়া শান্ত নদীর মত আবার কখনও শিশির সিক্ত গোলাপের মত স্নিগ্ধ। তোমরা জোসনা দেখ? ভরা পূর্ণিমার জোসনা দেখেছ কখনও? শীতের কুয়াশা ভেজা জোসনা! দেখেছ কখনও?
মাহমুদের মুখে কোন কথা নেই
এক নাগারে কথা গুলো বলে সাবিহা মাহমুদের দিকে তাকাল। মাহমুদ অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শুনছিল ওকে শান্ত সুবোধ কোন অবুঝ শিশুর মত দেখাচ্ছিল। সাবিহা এক দৃষ্টিতে তাকিয়েই আছে। আবার কারও মুখে কোন কথা নেই। আবার নিস্তব্ধ। অনেক, অনেক দূর থেকে ভেসে আসা অচেনা কোন সুরের মূর্ছনায় উভয়েই মগ্ন। উভয়ের মনই দুরন্ত গতিতে ছুটছে অজানা কোন নিরুদ্দেশের পথে। কে কোথায় যাবে?
এবারও সাবিহা প্রথমে কথা বলল
চল অনেক হয়েছে, এবার উঠি।
সাবিহা উঠে দাঁড়াল। মাহমুদও উঠে দাঁড়াল। যে কথা কোনদিন কাওকে বলতে পারেনি, বলা হয়নি এমনিকি এমন কথা কাওকে বলা যায় তাও কোন দিন ভেবে দেখেনি। এক মুহূর্ত ভেবে সংগে সংগে টেবিলের এ পাশ থেকে হাত বাড়িয়ে সাবিহার হাত ধরে বলল
Sabiha, I am in love with you! এই মাত্র যে গোলাপের কথা বললে আমি তোমার মুখে তাই পেয়েছি, তুমিই সেই গোলাপ
সাবিহা চমকে উঠে ধপাস করে বসে পরল। মাহমুদের হাতে ওর হাত যেভাবে ছিল তেমনিই রইল। সাবিহা ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করল না।
মুহূর্তের জন্য চুপ থেকে বলল, চল আজকে উঠি
মাহমুদ আবার বসে বলল, তুমি কিছু বলবে না?
কালকে আবার দেখা হবে।
কোথায়?
এখানেই।
১৪।
পরের দিন বিকেলে ক্লাস শেষ হতে চাচ্ছে না। সময় যেতে চায় না। মনে হচ্ছে সময় যেন স্থির হয়ে আছে, ঘড়ির কাটা কে যেন বন্ধ করে দিয়েছে। তবুও এক সময় ঘড়ির কাটার হিসেব করে সাবিহার ক্লাস শেষ হলো।
মাহমুদের ক্লাস দুপুরেই শেষ করে দুইটার মধ্যে সিভিক সেন্টারে এসে দরজার দিকে মুখ করে বসে আছে। রাস্তার মাঝ খানে ইঞ্জিন বিকল হয়ে রেল গাড়ি যেমন থেমে থাকে কোন দিকে যেতে পারে না তেমনি মনে হচ্ছে আজকের দিনটাও থেমে আছে। স্নো পড়ছে বলে সূর্যের দেখা নেই কয়েকদিন থেকেই। হে মার্কেটের টাওয়ারের ঘড়িটাও কি কেও বন্ধ করে রেখেছে নাকি? তাহলে বিকেল হচ্ছে না কেন? অপেক্ষা অত্যন্ত ভয়ংকর। সেটা যদি হয় কোন প্রিয়জনের জন্যে তাহলে আরও বেশি ভয়ংকর। বুক ঢিব ঢিব করার শব্দ কাছের যে কেও শুনতে পায়, ঘন ঘন গলা শুকিয়ে আসে আর কেমন যেন এক অচেনা অনুভূতি হয়। কোথাও স্থির হয়ে বসার উপায় থাকে না, বারবার উঠছে আবার বসছে। উঠে জানালা দরজার কাছে দিয়ে ঘুরে এসে আবার বসছে, হাতের ঘড়ি দেখছে, কিছুই ভাল লাগছে না। প্রতিবারে দরজা খুলে যেই ঢুকছে তাকেই দেখছে। প্রতীক্ষার উৎকণ্ঠায়, উত্তেজনায় চোখ, ফর্সা মুখ লাল হয়ে গেছে তখন দরজা খোলার শব্দ পেয়ে তাকাল। দেখল এক ইয়া মোটা মহিলা রুমে ঢুকছে এবং পিছনে তার প্রতীক্ষিত সাবিহা মাথার টুপি খুলতে খুলতে রুমে ঢুকছে। মাহমুদ বিশাল এক হাফ ছাড়ল।
সময় হলো তোমার?
কি করব বল সাড়ে চারটে পর্যন্ত ক্লাস ছিল টিচার বের হবার সাথে সাথেই এক দৌড়ে চলে এসেছি, তুমি কখন এসেছ?
সে কথা আর বলো না, সেই দুইটা থেকে বসে আছি
বল কি, তোমার ক্লাস ছিল না?
ছিল, দেড়টায় শেষ হয়েছে
তাই বলে এতক্ষণ ধরে বসে ছিলে? আশ্চর্য! চল বসি
কোথায় বসবে?
কেন কাল যেখানে বসেছিলাম
না আজ এখানে নয়, এখানে ফিস ফিস করে কথা বলতে হয়, চল সেই কফি শপে যাই
চল। সাবিহা মাথার টুপি পড়ে হাতের গ্লোভস পড়তে পড়তে মাহমুদের পিছনে চলল।
বাইরের রাস্তা পাড় হয়ে সেদিনের সেই কফি শপে গিয়ে বসল। কয়েকদিন থেকেই অনবরত স্নো পড়ছে। রাস্তায় বরফ জমে গেছে। প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় লোকজন তেমন বাইরে নেই। দোকান প্রায় ফাকা। সুবিধা মত জানালার পাশে একটা টেবিলে দুইজনে মুখোমুখি বসল।
কফির সাথে আর কিছু খাবে?
হ্যাঁ ভীষণ ক্ষুধা লেগেছে
আমারও। মাহমুদ উঠে বারে গেল।
সাবিহা ভাবছিল, ঝোঁকের মাথায় কাল বলে দিয়েছি আজ দেখা হবে কিন্তু এখন ওকে কি বলব? একটু পরেই জিজ্ঞেস করবে। এমনও হতে পারে কফি নিয়ে এসে বসার আগেই জিজ্ঞেস করবে। তখন? সাবিহা এত ভাবলে কি হবে? স্নো পড়ে রাস্তায় জমে বরফ হবার আগে যেমন ঝুর ঝুরে দানার মত হয় তেমনি করেই সাবিহার মনেও মাহমুদের ছায়া দানা বাধতে শুরু করেছে। হয়ত কিছুক্ষণের মধ্যেই সেটা জমে  স্নিগ্ধ শীতল নীলচে আভা মেশান স্বচ্ছ বরফ হয়ে যাবে। তবুও ভাবছে, কি বলব, কি করব এখন?
সত্যিই, একটু পরেই দুই হাতে দুই ট্রে নিয়ে মাহমুদ টেবিলের কাছে এসে ট্রে নামাবার আগেই জিজ্ঞেস করল
তুমি এখনও বললে না?
কি বলব?
কাল যে আমি বললাম, আমার কথার জবাব দিবে না?
আজই বলতে হবে?
আজ নয় এখনই
আমাকে একটু ভেবে দেখার সময় দিবে না?
না। বলেই মাহমুদ একটু এগিয়ে সাবিহার হাত ধরে বলল
জান, আমি সারা রাত ঘুমাতে পারিনি শুধু তোমার জবাবের অপেক্ষায় প্রহর গুনেছি। যেদিন তোমাকে প্রথম দেখেছি সেদিন থেকেই আমার সব কিছু ওলট পালট হয়ে গেছে।
সাবিহা অনেকক্ষণ চুপ করে আছে কোন কথা বলছে না। সামনে টেবিলে স্যান্ডউইচ আর কফি ঠাণ্ডা হচ্ছে। আচ্ছা ঠিক আছে আগে খেয়ে নাও, চল শুরু কর বলে একটা স্যান্ডউইচ সাবিহার হাতে তুলে দিল।
উভয়েই চুপচাপ খাচ্ছে। এবার কফির পেয়ালায় চুমুক দিয়ে মাহমুদ সাবিহার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল
আমার জবাব কিন্তু এখনও পেলাম না! আমি আর দেরি করতে পারছি না, প্লিজ কিছু বল সাবিহা, চুপ করে থেক না
তোমার জবাব শোনার আগে যে তোমাকে আরও কিছু শুনতে হবে!
বল, তুমি যাই বলবে আমি শুনব
আমাকে আর কয়েকটা দিন একটু ভাবার সময় দাও
না না, সময় দেয়া যাবে না, তোমাকে এখনই বলতে হবে। প্লিজ সাবিহা তুমি বোঝার চেষ্টা কর
আস্তে আস্তে সাবিহা কফির পেয়ালায় চুমুক দিয়ে বলল
তুমি জান আমি কে?
এটা আবার কেমন কথা বললে? তুমি সাবিহা খানম, ফ্রম ইন্ডিয়া
হ্যাঁ সে কথা ঠিক কিন্তু আমার একটা ইতিহাস আছে সে ইতিহাস তুমি জানবে না?
আমি কিছুই শুনতে চাই না। ইতিহাস আবার কিসের? ইতিহাস জেনে কি হবে? আমি ইতিহাস চাই না আমি তোমাকে চাই
এ কথা না জানালে তোমাকে প্রতারণা করা হবে আর আমি সেটা পারব না। শোন মাহমুদ, কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে যে তোমাকে সব জানতে হবে! আমার পিছনের কাহিনী কোন সরল সোজা কাহিনী নয়
কফির পেয়ালা এক পাশে সরিয়ে রেখে বলল, বল তাহলে কি বলতে চাইছ। তোমার মত মেয়ের এমন আর কি কাহিনী থাকতে পারে বল শুনি
এর মধ্যে সাবিহা কফি শেষ করে টেবিলের এক পাশে খালি পেয়ালা সরিয়ে রেখে একটু প্রস্তুতি নিয়ে বলতে শুরু করল। একে একে নাদিমের সাথে পরিচয় থেকে শুরু করে দীর্ঘ পাঁচ বছরের কথা সব বলল। এমনকি এখানে আসার আগের বিকেলে বেহালার কফি শপের কথা সব খুলে বলল। সব কথা বলা হলে সাবিহা ক্লান্ত হয়ে বলল আর একটা কফি আনবে?
মাহমুদ সঙ্গে সঙ্গে উঠে গেল। একটু পরে কফি নিয়ে এসে বলল
দেখ সাবিহা, এতক্ষণ তুমি যা বলেছ আমি তার প্রতিটি বর্ণ শুনলাম কিন্তু তুমি এটাকে আমাদের মাঝে টেনে আনছ কেন? তুমিতো সে ইতিহাস মুছে ফেলেছ! আর তাছাড়া সে এখন অতীত। অতীত নিয়ে কি ভবিষ্যৎ বা বর্তমান চলে? অতীততো এক সময় এমনি এমনিই মুছে যায়, সে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় যে ভাবেই হোক। এমন করে ভেবে নিজেকে কেন কষ্ট দিচ্ছ? চল, এখন থেকে তুমি একা নও আমি তোমার সাথে আছি, এভাবেই নিজেকে বুঝিয়ে নাও। আমরা দুজনে মিলে এগিয়ে যেতে পারব না?
সাবিহা চুপ করে ওর কথা শুনল। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। কি করবে কি বলবে কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। অনেক, অনেক দূর থেকে ভেসে আসা অচেনা কোন সুরের মূর্ছনায় মগ্ন। কি বলবে?
কি হলো, কিছু বল, পারব না?
কয়েক মুহূর্ত নীরব থেকে সাবিহা মাথা নিচু করে আস্তে বলল, পারব।
কি বললে একটু জোরে বল
এবার সাবিহা মাথা উঁচু করে ওর দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলল, পারব
মাহমুদ চেয়ার থেকে লাফ দিয়ে উঠে সাবিহার দুই হাত ধরে চিৎকার করে বলল
ওহ! সাবিহা! তুমি আমাকে বাঁচিয়েছ!
মাহমুদের চিৎকার শুনে বার থেকে মেয়েটা বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল
এনি প্রবলেম?
নো নো এভরি থিং অলরাইট! নো প্রবলেম!
শোন, আমি আজই বাড়িতে ফোন করে জানাব। তোমার ছবি পাঠাব।
পকেট থেকে মোবাইল বের করে সাবিহার কয়েকটা ছবি নিয়ে নিল।
আমি মাকে সব জানাব। তোমার কথা সব বলব।
মাহমুদের দিকে তাকিয়ে বলল
চল, তাহলে এবার উঠি
চল।
১৫।
সাবিহাও বাড়িতে বাবাকে জানিয়েছে কিন্তু প্রথমে বাবা সাবিহার মার সাথে আলাপ করে মৃদু অসম্মতি জানিয়েছিল।
কেন, ইন্ডিয়াতে কি ছেলের অভাব? ভাল ছেলে কি এখানে নেই?
আছে বাবা! তুমি না বলেছিলে আমাদের পূর্ব পুরুষেরা ইরান থেকে এসেছিল! তাহলে?
তারা এসেছিল তেহরান থেকে আর এ হলো আবাদানের
তাতে কি? দেশ জাততো একই!
তাই বলে কি তুই আমাদের ছেড়ে দেশ ছেড়ে যাবি?
তা কেন হবে বাবা? ও বলেছে  আমার বার করা হয়ে গেলে তত দিনে ও মাস্টার ম্যারিনার হয়ে যাবে আর তখন আমরা বিয়ে করে এখানেই সেটল করব। মাঝে মাঝে  কি আর ছুটিতে ইন্ডিয়া বা ইরানে যাব না? তোমরাও কি এখানে আসবে না? তুমি আমাকে না দেখে কয়দিন থাকতে পারবে বাবা? তুমিতো এখানেই আসতে দিতে চাইছিলে না!
বাবা মায়ের সাথে এ নিয়ে অনেক কথা হয়েছে, অনেক যুক্তি তর্ক হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাবা মা উভয়েই সম্মতি দিয়েছে।
১৬।
একদিন মাহমুদ সাথে নিয়ে ওদের বাসায় গিয়ে রেজার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। রেজা ইয়ার্কি করে মাহমুদকে বলল তুই সত্যি কথাই বলেছিলি! আমি ওকে আগে দেখলে সত্যিই পাগল হয়ে যেতাম হয়ত পিছে পিছে ঘুরে মরতাম।
সাবিহা না বুঝে জিজ্ঞেস করল এর মানে কি?
তখন রেজা মাহমুদের প্রথম দেখার গল্প শোনাল।
ও! এই কথা!
আচ্ছা সাবিহা বলত তুমি কাকে বেছে নিতে?
যাকে বেছে নেয়ার তাকেই পেয়েছি, তোমার কি কোন সন্দেহ আছে?
যাক খারাপ করনি, অন্তত আমার বন্ধু একজন উপযুক্ত সঙ্গী পেয়েছে এতেই আমি ধন্য। তোমরা একটু বস আমি চা নিয়ে আসছি, আর কিছু খাবে?
না, তুমি বস আমি নিয়ে আসছি, তোমরাতো প্রতিদিনই নিজেরা করে নাও আজ না হয় আমি করি
না না তাই কি হয় তুমি হলে মেহমান, আমিই যাচ্ছি, বল আর কিছু খাবে?
না, শুধু চা হলেই চলবে
মাহমুদ এখন সাবিহাক নিয়ে তার নতুন পাওয়া সুন্দর পৃথিবীতে প্রজাপতির মত ঘুরে বেড়াচ্ছে। নানা রকম রঙ্গিন স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। সকালে ঘুম থেকে উঠেই সাবিহাকে ফোন করে জেনে নেয় আজকে তার কি প্রোগ্রাম। মাঝে মধ্যে নাদিম এসে সাবিহার মনে বৃশ্চিকের মত দংশন করে, সাবিহা ভুলে থাকার চেষ্টা করলেও মনকে বুঝিয়ে উঠতে পারে না। তবে কি সে মাহমুদকে ঠকাচ্ছে, তার সংগে প্রতারণা করছে? নানা চিন্তা এসে ভিড় করে। নিজে কোন দিশা না পেয়ে অনেক চিন্তা ভাবনা করে মাহমুদকে জানাল। শুনে মাহমুদ হো হো করে হেসে উঠল।
কি যে বল তুমি! যেই আসুক তাতে হয়েছেটা কি? এখন থেকে শুধু তুমি আর আমি, এর বাইরে আর কিচ্ছু নেই আর কিছুই ভাববে না।
কিন্তু ও যে আমার পিছু ছাড়ছে না!
তাতে কি হলো? তোমাদের দেশে ছেলেরা মেয়েদের পিছু নেয় না? অবশ্য  শুধু তোমাদের দেশের কথা বলছি কেন সব দেশেই মেয়েরা বড় অসহায় সবসময় নিরাপত্তাহীণতায় ভুগে। ছেলেরা সব সময় মেয়েদের পিছু নিয়েই থাকে। এখন থেকে ওসব নিয়ে মোটেই ভাববে না, forget it forever!
দেখি, চেষ্টা করব তুমি যা বলছ তাই হবে
শোন, একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে
সাবিহা চমকে জিজ্ঞেস করল কি সমস্যা?
এখন বাড়িতে ফোন করলেই অর্ধেক সময় কেটে যায় তোমাকে নিয়ে। মা এটা সেটা নানা কিছু জিজ্ঞেস করে, সাবিহা কি করছে, কেমন আছে, কোথায় থাকে, তুই দেখবি, সবসময় লক্ষ রাখবি, ওর বাড়িতে মা বাবা কেমন আছে এই সব। আমি বলেছি তোমাকে ওর নম্বর দিয়ে দিব তোমার যখন ইচ্ছে হবে তখন তুমি নিজেই ফোন করে নিও। তোমার নম্বর দিব?
এ কথা আবার আমাকে জিজ্ঞেস করতে হবে?
পকেট থেকে মোবাইল বের করে ইরানের আবাদানে মাহমুদের বাড়ির লাইন পেয়ে
হ্যালো মা!
কিরে, কেমন আছিস?
ভাল আছি মা। এই দেখ তুমি যার সাথে কথা বলতে চেয়েছিলে তাকে নাও। বলেই মোবাইলটা সাবিহার হাতে দিয়ে দিল।
হ্যালো,
হ্যালো, কে সাবিহা?
এর পর থেকেই প্রায় প্রতি রবিবারে নিয়মিত ভাবে মাহমুদের মা সাবিহাকে ফোন করে তার কুশলাদি জানতে চায়, আরও নানা কথা হয়। আমার ছেলে তোমাকে ভালবেসেছে আমি যে কত নিশ্চিন্ত হয়েছি মা তা বোঝাবার নয়তুমি আমার বৌ হবে, আমার বাড়ির লক্ষ্মী হবে আমি খুউব খুশি। তোমার বাড়ির ফোন নম্বর দিও আমি তোমার বাবা মার সাথে কথা বলব। 
ছবিঃ নিউ ক্যাসেল মেট্রো শপিং মল/ লেখক।
১৭।
এর মধ্যে নাজিয়া আর জয়া সাউথ শিল্ডে ওশেন রোডের পাশে আজদা সুপার মার্কেটের সাথেই একটা বাসায় সাবিহার সাথে কলকাতার বাঙালি মেয়ে মৌ মিতার থাকার ব্যবস্থা করেছে। বাসাটা পাবার জন্য মাহমুদ হন্যে হয়ে লেগে ছিল। ইউক্রেনের এক কাপল বাসাটা প্রায় নিয়েই নিয়েছিল লেটিং এজেন্টের সাথে অনেক জোরাজুরি করে তবে সাবিহাদের পাইয়ে দিয়েছে। এতে করে আসা যাবার পথে মাহমুদের সাথে দেখাতো হয়ই বেশির ভাগ দিনে যেদিন কাছাকাছি সময়ে দুই জনের ক্লাস থাকে বা ক্লাস থেকে ফিরে আসে তখন এক সাথেই আসা যাওয়া করে। এভাবেই  দিন মাস গড়িয়ে যায় আর সাথে বয়ে নিয়ে যায় নিউ ক্যাসেলের পাশে দিয়ে বয়ে যাওয়া  আপ-অন-টাইন নদীর পানি উত্তর সাগরে। আর সেই সাথে সাবিহা এবং মাহমুদের কাহিনী গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকে। ধীরে ধীরে শীতের আমেজ কেটে যাচ্ছে গাছে গাছে নতুন পাতা দেখা যাচ্ছে, কোন কোন গাছে ফুল ফুটেছে, পথের পাশে হলুদ ডেফোডিল ফুটে বসন্তের আগমনী বার্তা জানিয়ে দিচ্ছে, প্রকৃতি তার আপন মহিমায় সেজে উঠছে। শীতের ভারি পোষাকের বোঝা কমছে ছুটির দিনে দুই জনে নানা জায়গায় বেড়াতে যায়। রঙ্গে রঙ্গে অনেক প্রতীক্ষিত সময় গুলো ভরিয়ে দিতে চায়।
সাবিহা একদিন জিজ্ঞেস করল
আচ্ছা তোমার পরীক্ষা হয়ে গেলে অক্টোবরে তুমি এখান থেকে চলে যাবে তখন কি হবে?
কেন? আমি কি আর আসব না ভেবেছ? ব্রিটেন রুটে চলে এমন ইরানি জাহাজ না পেলে দরকার হলে আমি এই দেশের জাহাজেই চাকরি নেব! এতে ভাবনার কিছু নেই। তারপরে আবার যখন মাস্টার ম্যারিনার এর জন্য পরীক্ষা দেব তখন এখানেই আসতে হবে। তোমাকে ছেড়ে কি আমি বেশি দিন থাকতে পারব ভেবেছ? তুমি যে আমার স্বপ্ন, আমার জীবন, যে গোলাপ আমি সারা পৃথিবী খুঁজে পাইনি তুমি যে আমার সেই গোলাপ। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব কি নিয়ে? তুমি আমাকে যে পৃথিবী দেখতে শিখিয়েছ, ভাল লাগতে শিখিয়েছ সে পৃথিবী মিথ্যে হয়ে যাবে না?
একদিন নিউ ক্যাসেল মেট্রো শপিং মলে কেনাকাটা করার সময় দোতলার এক কফি শপে বসে আলাপ করছিল। সাবিহা কথায় কথায় বলল জান মাহমুদ
আমার পূর্ব পুরুষেরা কিন্তু তোমাদের ইরান থেকে ভারতে গিয়েছিল!
তাই নাকি? বল কি? এত দিন বলনি কেন? তাহলে তুমিও ইরানি! তাহলে তোমাকে ইরানে যেতেই হবে। যে গোলাপ ইরান থেকে তুলে নিয়ে ভারতে রোপণ করেছিল কোন দিনের কোন এক মহা পুরুষ আমি সেই গোলাপ আবার ইরানে ফিরিয়ে নিয়ে যাব, ইরানের সম্পদ ইরানেই ফিরে যাবে।
ছবিঃ নিউ ক্যাসেল এলডন স্কোয়ারে ডামি স্টেজ কোচ/ লেখক।
১৮।
ক্যালেন্ডারের পাতায় একদিন সেপ্টেম্বরের ৭ তারিখ এসে উপস্থিত হলে মাহমুদের পরীক্ষা শুরু হলো এবং  দেখতে দেখতে একদিন শেষও হয়ে গেল। এবারে শুরু হলো প্রতিদিন ক্যাফেটেরিয়াতে বসে সাবিহার ক্লাস শেষ হবার অপেক্ষা। প্রতি দিন এসে ক্যাফেটেরিয়ার একটা জানালার পাশের এক টেবিলে বসে থাকে কখন সাবিহা আসবে। সাবিহা আসার সাথে সাথেই উঠে যায়। কিছুক্ষণ কোথাও বসে গল্প করে যার যার মত বাসায় ফিরে আসে। সে গল্প গুলা কোন গতানুগতিক গল্প নয়। কোথা থেকে কোথায় যায় তার কিছুই ঠিক ঠিকানা থাকে না। সামনের দিনগুলো কেমন করে কোথায় কাটবে কি করবে এমনি সব নানা স্বপ্নের কথা, কে কবে কি স্বপ্ন দেখেছে এই সব। কোন দিন রাত দুপুরও হয়ে যায়। সময় সম্পর্কে কারো কোন হুশ থাকে না।
আমার পরীক্ষা আপাতত শেষ কিন্তু তোমার এখনও দেরি আছে তোমাকে ভাল করে পড়াশুনা করে এক বারেই পাশ করে যেতে হবে। ভাল রেজাল্ট না হলে কিন্তু বার করার সুযোগ পাবে না। রেজেল্ট বের হবার আগে ইচ্ছেমত কয়েকদিন ঘোরাঘুরি করলআশেপাশে যা যা ছিল সব এক এক করে দেখা হল। সান্ডার ল্যান্ড, ডারহ্যাম, ডার্লিংটন সব দেখল কিন্তু এভাবেই একদিন তার যাবার সময় হলো
তুমি চলে যাবে? তুমি চলে গেলে আমি থাকব কেমন করে? এখানে কোথাও কাজ পাবে না?
হ্যাঁ, না গেলে, চাকরি না হলে যে এক্সপেরিয়ান্স দেখাতে পারব না আবার পরের পরীক্ষাটাও দেয়া হবে নাআর এখানে কাজ পাবার মত এখনও উপযুক্ত হয়ে উঠিনি পরের মাস্টার ম্যারিনার পরীক্ষাটা দিলে তখন পারবো।
আবার কবে আসবে? এত দিন তোমাকে না দেখে থাকব কেমন করে?
আরে পাগল, এত উতলা হলে কি চলবে? আমাদের উভয়ের ভবিষ্যতের জন্য যে এটুক ধৈর্য ধরতেই হবে! মাত্র দুইটা বছর। বলছিতো এর মধ্যে তোমার বার হয়ে যাবে আবার ওদিকে আমার মাস্টার ম্যারিনার পরীক্ষায় এপিয়ার করার সি টাইম হয়ে যাবে। এর মধ্যে জাহাজ এদিকে এলে কি আমি এখানে আসব না?
যদি জাহাজ না আসে?
দেখে শুনে এমন জাহাজ বেছে নিব যে জাহাজ এদিকে আসবে। কখনও এমন হতে পারে জাহাজ লন্ডন কিংবা ব্রিস্টল কিংবা অন্য কোন পোর্টে আসবে তখন তোমাকে আগে থেকে জানিয়ে দিব তুমি সেখানে চলে যাবে।
১৯।
মাহমুদ পাশ করেছে। টিকেট নেয়া হয়েছে। আস্তে আস্তে যাবার দিন ঘনিয়ে আসছে আর সাবিহার মন কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছেনাওয়া খাওয়া অনিয়মিত হচ্ছে, এটা সেটা ভুলে যায়। এসব দেখে মৌ মিতা বুঝতে পেরে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করে।
তোমার মত এমন স্মার্ট মেয়ে এত বোকা কেন বলত?
সে কথা তোমাকে বোঝাব কেমন করে? ওর যাবার কথা শুনে আমার কিচ্ছু ভাল লাগছে না। মনে হয় আমিও সব ছেড়ে চলে যাই
কোথায় যাবে?  চলে গেলেই কি এর সমাধান হবে ভেবেছ? তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে, ধৈর্য ধরতে হবে, সহ্য করতে হবে এবং সবার পরে পরিস্থিতি মেনে নিতেই হবে।
চেষ্টা করতে চাই কিন্তু পারছি কোথায়? কিছুতেই মন মানতে চায় না
দেখ তুমি খুবই ভাগ্যবতী, মাহমুদ ভাইয়ের মত ছেলেকে পেয়েছ। ওর জন্য তোমাকে মানিয়ে নিতেই হবে,
তুমি যত সহজে বলতে পারছ আমি অত সহজে পারছি না মিতা
তুমি যে কি বল বুঝি না, এমন ছেলের  জন্য সারা জীবনও অপেক্ষা করা যায়। কি, মিথ্যে বললাম?
না, সত্যিই বলেছ আমিও বুঝতে পারি কিন্তু মনকে বোঝাতে পারি না ও চলে যাবে মনে হলেই আর কিছু ভাল লাগে না
তাহলে পারবে না কেন বলছ, পারতে তোমাকে হবেই, এমন ছেলে কয়টা মেয়ের জীবনে আসে বলতে পার?
২০।
সকাল দশটায় ফ্লাইট। মাহমুদ রেজার গাড়িতে উঠে সকালেই সাবিহার দরজায় এসে থেমে সাবিহাকে নিয়ে এয়ারপোর্টে গেলো। রেজা গাড়ি চালাচ্ছে আর মাহমুদ এবং সাবিহা পিছনের সীটে। সাবিহা রেজার হাত ধরে শুধু কেঁদেই চলেছে, কিছুতেই থামছে না। মাহমুদ বোঝাচ্ছে কিন্তু কোন কাজ হচ্ছে না। এয়ারপোর্টের টিকেট ইত্যাদি কাজ সেরে আসলে রেজা একটু দূরে সরে দাঁড়াল। মাহমুদ সাবিহার পাশে এসে দাঁড়াল আর সাবিহা আবার ওর হাত চেপে ধরল কিছুতেই মাহমুদের হাত ছাড়তে চাইছিল না। জোরে চেপে ধরে রেখেছে যেন
ছুটে না যায়। ইরানীয়ান এয়ারলাইন্সের ডেস্ক থেকে বারবার যাত্রীদেরকে প্লেনে বোর্ড করার জন্য ঘোষণা দিচ্ছিল কিন্তু সে ঘোষণা সাবিহার কানে আসতে পারছিল না। 


ছবিঃ নিউ ক্যাসেল পিলগ্রিম স্ট্রিট/ লেখক

এক সময় মাহমুদ ভেজা কণ্ঠে বলল
ছাড়, যেতে দাও।
না, আমি তোমাকে যেতে দিব না
পাগলামি করে না, আমি যেয়েই ফোন করব। তোমাকে ছাড়া আমার কেমন কাটবে তুমি জান না?
সাবিহা অনবরত কেঁদেই চলেছে কিছুতেই থামছে না। টিসু দিয়ে মাহমুদ বারবার চোখ মুছে দিচ্ছে। সাবিহার কান্না মাহমুদের মধ্যেও সংক্রমিত হলো। মাহমুদও নিজেকে সামাল দিতে পারল না। তার চোখ দিয়েও কয়েক ফোটা জল সাবিহার হাতে পড়ল। তাই দেখে সাবিহা  উতলা হয়ে উঠল। বিদায়ের আগে  মাহমুদের বুকে, তার পৃথিবীর বুকে মাথা রেখে পৃথিবীর উষ্ণতা অনুভব করতে চাইল কিন্তু তার অবচেতন মন তাকে থামিয়ে দিল। এত দিনের সংস্কার আর বিশ্বাস সাবিহাকে এগিয়ে যাবার সায় দিতে পারল না, সে সময় এখনও আসেনি। এবার শেষ ঘোষণা শুনে মাহমুদ শক্ত হলো। সাবিহার কানের কাছে মুখ এগিয়ে বলল এবার যেতে দাও!
সাবিহা অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে হাতটা ছেড়ে দিল। শুধু বলতে পারল সাবধানে থেকো। মাহমুদের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল চোখে জল টলমল করছে।
একি! তুমি কাঁদছ কেন? ছি! পুরুষ মানুষের কাঁদতে নেই বলে স্কার্ফের আঁচল দিয়ে মাহমুদের চোখ মুছতে মুছতে বলল প্রতিদিন ফোন করবে। মাহমুদ আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল সিকিউরিটি গেটে। রেলিং ধরে  দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে শুধু কাঁদছে। রেজা পাশে এসে বুঝিয়ে শুনিয়ে পাশে দাঁড়িয়েই রইল। এক সময় হাত ধরে টেনে নিয়ে গাড়িতে বসিয়ে দিলএকটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সাবিহা রেজার সাথে বাসায় ফিরে এলো। রেজা ওর বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে কাঁদতে নিষেধ করে চলে গেল। মাহমুদ উড়ে চলল ইরানের আবাদান বিমান বন্দরের পথে।
আবাদান নেমে দেখে বাড়ি থেকে গাড়ি নিয়ে মা অপেক্ষা করছে। গাড়িতে উঠে বসার আগে সাবিহার নম্বরে ফোন করে মায়ের হাতে ফোনটা দিয়ে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
ফোনটা হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, কে?
দেখ কে!
হ্যালো,
মাহমুদের মায়ের কণ্ঠ শুনে সাবিহা নিজেকে সংযত করতে চাইল। ক্ষীণ কণ্ঠে হ্যালো বলে জিজ্ঞেস করল মা বলেন আপনি কেমন আছেন, আপনার ছেলে পৌঁছেছে?
সাবিহার ভারি কণ্ঠ শুনে বুঝতে পারল ও কাঁদছিল। হ্যাঁ ও পৌঁছেছে কিন্তু তুমি কাঁদছ কেন মা?
এ পাশে নিশ্চুপ। শুধু মাঝে মাঝে সাবিহার ফুঁপানির শব্দ শুনতে পারছিল।
আমি এখন কি করে থাকব? এখানে আসার পর থেকেই ও আমাকে কোনদিন কিছু করতে দেয়নি। সব কিছু ওই করে দিয়েছে। আমার ভারি একা লাগছে মা, অসহায় মনে হচ্ছে!
না না এমন করে ভেঙ্গে পড়তে নেই, তোমাকে শক্ত হয়ে ওর জন্য প্রস্তুত হতে হবে, তুমি না মায়ের জাত! তুমি ভেঙ্গে পড়লে ওকে কে দেখবে? ও কাকে নিয়ে জীবন কাটাবে। ও যে তোমাকে ভীষণ ভালবাসে!
হ্যাঁ মা আমাকে শক্ত হতেই হবে।
মাস ছয়েক পরে একদিন সাবিহা সকালে যথারীতি ক্লাসে এসেছে। দুপুরে মৌ মিতা ফোন করে বলল
সাবিহা তুমি কোথায়?
লাইবেরিতে
তুমি তাড়াতাড়ি বাসায় চলে আস
কেন, কি হয়েছে?
ডান্ডি থেকে তোমার এক রিলেটিভ এসেছে
সাবিহা অবাক হয়ে বলল, ডান্ডি থেকে?
হ্যাঁ, তাইতো বলল
কিন্তু ডান্ডিতে আমার কেও আছে বলে কখনও শুনিনি, নাম বলেছে?
না নাম বলেনি শুধু বলল সাবিহাকে একটু তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে বল।
নামটা জিজ্ঞেস করবে না? আচ্ছা আসছি।
বাসায় এসে কলিং বেল বাজাতেই মাহমুদ দরজা খুলে সাবিহার দিকে তাকিয়ে দাঁড়াল আর তার পিছনে মৌ মিতা মিটমিট হাসছিল। সাবিহা অবাক হয়ে ওকে দেখছে। যেন নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছে না। অস্ফুট কণ্ঠ বেরিয়ে এলো, তুমি!
ম্যাডাম কি আমাকে চিনতে পারছেন না? আসুন ভিতরে আসুন! আমি নিয়ামত উল্লাহ মাহমুদ, আসুন!
কোথা থেকে কেমন করে এলে? আমাকে আগে জানাওনি কেন?
তুমিই বল আগে জানালে কি তোমার এই চেহারা দেখতে পেতাম? আস, ভিতরে আস
হঠাৎ কোথা থেকে কেমন করে এসেছ?
পরশু আমাদের জাহাজ ডান্ডি এসেছে আর আজ দুপুরের ডিউটি সেরে সোজা এখানে চলে এলাম। তোমাকে চমকে দেব বলে আগে কিছু জানাইনি, বুঝলেন ম্যাডাম? এবার বল তুমি কেমন আছ?
পরশু এসে একটা ফোন করলে না কেন? আবার পরশু এসে আজ কেন এলে?
বললামতো ইচ্ছে করেই ফোন করিনি আর ছুটি পাচ্ছিলাম না বলে আগে আসতে পারিনি, দয়া করে ক্ষমা করা যাবে না? এর আগে ইজিপ্ট থেকে যখন ফোন করেছিলাম তখন থেকেই ভেবে রেখেছি এবার তোমাকে একটা সারপ্রাইজ দেব তাই আমাদের নেক্সট পোর্টের কথা তোমাকে বলিনি
মৌ মিতা ওদের একা থাকার সুযোগ করে দিয়ে বসতে বলে চা আনতে গেল।
কত দিন থাকবে?
কালই যেতে হবে, জাহাজ আন লোড হচ্ছে ছুটি পাবার উপায় নেই। আগামী পরশু সেইল করে সাউথ আফ্রিকা যাব
রাতের খাবারও মৌ মিতাই রান্না করল।
প্রায়ই ফোনে কথা হচ্ছে তবুও মনে হচ্ছে কত কথা জমে আছে। কত কি বলার আছে। অনেক রাত পর্যন্ত কথা বলে মৌ মিতা সহ এক সাথে রাতের খাবার খেয়ে মাহমুদ কাল সকালে আবার দেখা হবে বলে রেজার বাসায় চলে গেল।
বের হবার আগে বলে দিল, সকালে কিন্তু এখানে এসে খাবে।
ছবিঃ ডেফডিল, বসন্তের আগমণী বার্তা ঘোষনা করছে/ লেখক
বিভিন্ন বন্দরে থাকার সময় ফোনে আলাপ, জাহাজ যখন সাগরে থাকে তখন ই মেইলে পত্রালাপ আর দুজনে দুজনার স্বপ্ন দেখে দিন গুলি চলে যাচ্ছিলো। মাহমুদের মাও নিয়মিত ফোন করে হবু পুত্র বঁধুর খোজ খবর নেয়। সাবিহার মা বাবা এক বার এসে মেয়ের কাছে প্রায় মাস খানিক থেকে বেড়িয়ে গেছেএক ভয়েজে জাহাজ মুমবাই গিয়েছিল সেখান থেকে কলকাতা গিয়ে আলিপুরে ডায়মন্ড হারবার রোডে সাবিহাদের বাড়িতে হবু শ্বশুর শাশুড়ির সাথেও দেখা করে জামাই আদর পেয়ে আবার পরের দিনের ফ্লাইটে মুম্বাই ফিরে এসেছে। মাহমুদও আর একবার লন্ডনে এসেছিল তখন সাবিহা লন্ডনে যেয়ে ৩/৪ দিন থেকে দেখা করে এসেছে। সাবিহা এমএতে ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছে। এমনিতেও ছাত্রী হিসেবে সাবিহা খুবই ভাল। সাবিহা এখন ব্যারিস্টার হবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। লেখাপড়ার ভীষণ চাপ। যে করেই হোক তাকে এবারই শেষ করতে হবে, সময় নেয়া যাবে না এত সময় হাতে নেই। যত দিন যাবে মাহমুদের সাথে তাদের মিলনের দিনও তত পিছিয়ে যাবে। নিতান্ত নিরুপায় হয়ে যোগাযোগের পরিমাণ অনেক কমে গেছে। আগের মত ইচ্ছে করলেই ফোন নিয়ে বা মেইলে লিখতে বসতে পারে নে। মাহমুদ মনে মনে কষ্টে থাকলেও নিজেই মনকে প্রবোধ দেয়, এইতো আর একটা বছর একটু ধৈর্য ধরতেই হবে। সাবিহাকেও তেমনি সান্ত্বনা দেয়। সামনে প্রচুর সময় পাব। সাবিহার বার হয়ে গেলে ওকে নিউ ক্যাসেল বা লন্ডনে এফিলিয়েট করে রেখে আগে অন্তত একটা বছর এক সাথে ভয়েজ করব। দুজনে এক সাথে সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াব তারপরে নিউ ক্যাসেলে সেটল করব। সাবিহা এক বার ব্যারিস্টারি শুরু করলে ওকে নিয়ে যখন তখন বের হতে পারব না।
বিরহ বড়ই কঠিন যন্ত্রণাহৃদয়ের অলিতে গলিতে কাটার মত বিধতে থাকে। এক পলকের জন্যেও ভুলে থাকতে দেয় না, অনবরত দহন হতেই থাকে। তুষের আগুন যেমন শিখা না তুলে ধীরে ধীরে ক্ষয়ে ক্ষয়ে জলে তেমনি করে। এ আগুনে যে একবার হাত দিয়েছে তার আর কোন উপায় থাকে না। ফিরেও আসতে পারে না আবার সহ্য করাও কঠিন। এত কিছু সহ্য করে একসময় মাহমুদের চিফ মেট হিসেবে দুই বছর এক্সপেরিয়েন্স হয়ে গেল এবার নিউ ক্যাসেলে এসে মাস্টার ম্যারিনার পরীক্ষার জন্য রিফ্রেশর কোর্স করতে হবে। মাস ছয়েকের ব্যাপার। এদিকে সাবিহার ফাইনাল পরীক্ষার সময় ঘনিয়ে আসছে। মাহমুদ আবার সাবিহাকে ফিরে পেয়েছে। ঠিক তেমনি করেই সব ব্যবস্থা করে নিয়েছে যেমনটি আগে ছিল। এসে আগের মতই রেজার বাসায় উঠেছে। রেজা মাহমুদের মত ম্যারিনার নয় সে স্পেস সাইন্সের ছাত্র। ওর শেষ হতে এখনও দেরি আছে।
পৃথিবীর পথ পরিক্রমায় দিন থেমে থাকে না। সময়ের ঘড়ি চলতেই থাকে। অনেক আনন্দ বেদনা, সুখ দুঃখ, হাসি কান্না আর সাবিহার চোখের জল নিয়ে মাহমুদের হিসেব অনুযায়ী দুইটা বছর চলে গেছে। দুই জনেরই পরীক্ষা হয়ে গেছে এবং দুইজনেই পাশ করেছে। সাবিহা এখন ব্যারিস্টার সাবিহা খানম হয়েছে, তার একটা সাধ পূর্ণ হয়েছে আবার মাহমুদও ক্যাপ্টেন মাহমুদ হয়েছে। এত দিনের পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রতীক্ষার অবসানের জন্য এবার বিয়ের পালা। নিউ ক্যাসেল, আবাদান এবং কলকাতার টেলিফোন লাইন অনেক সময় ধরে ব্যস্ত থাকছে। নানা কথা বার্তা, জল্পনা কল্পনা আলাপ আলোচনা ইত্যাদিতে অনেক ফোন বিল পাচ্ছে লাইন প্রোভাইডার। কিন্তু এরা উপযুক্ত কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারছে না। এদিকে সাবিহা এবং মাহমুদ একরকম ভাবছে, ওদিকে আবাদানে মাহমুদের মা এক রকম ভাবছে আবার কলকাতায় সাবিহার মা বাবা আর এক রকম ভাবছে। ওরা চাইছে নিউ ক্যাসেলেই বিয়ে হবে, এতে ঝামেলার মধ্যে শুধু কোন হ ভাড়া করে হোম অফিসের পারমিশন নিয়ে বর কনের ধর্ম মতে বিয়ে হবে। তারপরে এদেশে থাকার অনুমতি চেয়ে হোম অফিসে আবেদন করতে হবে। আবার মাহমুদের মা ভাবছে কনে আবাদান যাবে বিয়ে সেখানে হবে কিন্তু সাবিহার মা বাবা বলছে বিয়ে কলকাতায় হবে। এই নিয়ে বেশ কিছুদিন পর্যন্ত আলাপ আলোচনা চলে এক সময় কুয়াশায় ঢাকা পড়ে গেল। কবে রোদ উঠে এই কুয়াশা কাটবে?
মাহমুদ এবং সাবিহা চোখে মুখে অন্ধকার দেখা ছাড়া আর কোন পথ দেখছে না। কিন্তু এতদিন ধরে অপেক্ষা করে যে পরিকল্পনা চলে এসেছে তাতে পথ দেখা না গেলে চলতে পারে না। যে করেই হোক একটা বিহিত করতেই হবে। সাউথ শিল্ড মেট্রো স্টেশনের পিছনে লম্বা মাঠের মত আছে তার এক পাশে বেঞ্চে বসে কথা হচ্ছিল।
সাবিহা মাহমুদকে তাগিদ দিচ্ছে, কি করবে এখন? বাবা যে কড়া মেজাজের মানুষ তাকে বশ করা কঠিন ব্যাপার। আমি কিছু ভাবতে পারছি না, কি হবে? তুমি কিছু করছ না কেন? তুমি জান না সব সময় বর পক্ষ কনের বাড়ি যেয়ে বৌ নিয়ে আসে? তাহলে মাকে বোঝাচ্ছ না কেন?
আবার মাহমুদ বলছে তুমি কলকাতা চলে যাও বাবার সাথে আলাপ করে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে এসো
না, আমি একা যাব না, যেতে হলে তোমাকে নিয়েই যাব
তার চেয়ে চল আমরা ইরান চলে যাই
না আমি এখন বিয়ের আগে ইরান যাব না
তাহলে চল আমরা এখানেই বিয়ে করে ফেলি
বিয়ে করে ফেলি বললেই হলো?
আমার মা বাবা তোমার মা এদের কি হবে? আচ্ছা এক কাজ করা যায় না?
কি কাজ?
তুমি যাও মাকে বুঝিয়ে মাকে নিয়ে কলকাতায় চলে আস
তাহলে চল দুইজনে এক সাথেই যাই
সাবিহা একটু ভাবল। দাও দেখি ফোনটা দাও
আবাদানের নম্বরে ডায়াল করে অপেক্ষা করছে, হ্যালো
মা আমি সাবিহা
বল মা কেমন আছিস? মাহমুদ কেমন আছে
মা আমরা ভাল আছি, আমরা আবাদান আসছি
তাই নাকি? যাক তোদের মত বদলেছে তাহলে, খুব ভাল হয়েছে আয় মা কবে আসবি?
না মা তুমি যা ভাবছ আসলে তা নয়, আমি যেতে পারি কিন্তু একটা শর্তে
সে আবার কি কথা? কি শর্ত?
আমি আর তোমার ছেলে এক সাথে তোমার কাছে যাব আর তোমাকে নিয়ে কলকাতা যাব এবং সেখান বিয়ে হবে, তুমি যদি এই শর্ত মেনে নাও তাহলে আমরা আজই টিকেট বুকিং দিবো।
না মানলে কি করবি মা?
কি আর করব, সারা জীবন তোমার অপেক্ষায় থাকব, তুমি যেদিন নিজে এসে নিয়ে যাবে সেদিনই যাব তার আগে নয়
পারবি মা তুই আমার ছেলেকে আগলে রাখতে পারবি, আমি এমন মেয়েই খুজছিলাম। আয়, তোরা কবে আসবি? আমি তোর সব শর্ত মেনে নিলাম
এখনই ট্রাভেল এজেন্টের অফিসে যাব, যেদিন টিকেট পাই ওই দিনেই চলে আসব। তুমি কলকাতা যাবার জন্য রেডি হয়ে থাকবে কিন্তু
আচ্ছা বাবা আমি রেডি হয়েই থাকব।
তাহলে এখন রাখছি।
ফোন রেখে মাহমুদের হাত ধরে উঠিয়ে কাছে মেট্রো স্টেশনের পাশের একটা ট্রাভেল এজেন্টের অফিসে গেল।
আবাদানের দুইটা টিকেট কবে পাব?
কাউন্টারে বসা লোকটা কম্পিউটারে দেখে বলল
আগামী পরশুর আগে কোন ফ্লাইট নেই।
ঠিক আছে তাই দাও
মাহমুদ পকেট থেকে ওয়ালেট বের করে কার্ড দিয়ে পেমেন্ট দিয়ে টিকেট নিয়ে সাবিহার বাসায় এলো।
নাও এবার গোছগাছ করে রেডি হও
রেডি আবার কি! যেমন আছি তেমনিই চলে যাব
তাহলে অন্তত কলকাতায় একটা ফোন করে বলে দাও
হ্যাঁ তা করতে হবে, কিন্তু আমাকে বলছ কেন তুমি বলতে পারছ না?
আমি বলব?
হ্যাঁ তুমি বল, মাকে নিয়ে আসছি আপনারা বিয়ের ব্যবস্থা করেন।
সময় মত আবাদান পৌঁছে দেখে বাইরে মা গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে। এই প্রথম সাবিহাকে দেখে মা মুগ্ধ হয়ে হা করে ওর মুখের দিকে চেয়ে রইলো। মাহমুদ যা বলেছে, ছবিতে যা দেখেছে তার চেয়েও অনেক বেশি সুন্দরী এই মেয়ে। কিছুক্ষণ হতভম্বের মত চেয়ে থেকে সম্বিত ফিরে পেয়ে আয় মা বলে সাবিহাকে বুকে চেপে ধরল। মায়ের বুকের উষ্ণতা পেয়ে সাবিহা ছোট্ট বাচ্চার মত অনেকক্ষণ ওই ভাবেই রইলো।
আমি তোমার কাছে এসেছি মা, এবার তুমি আমার সাথে যাবে
যাব মা নিশ্চয় যাব
মাহমুদ তাগিদ দিল, কি হলো বাড়ি যাবে না?
হ্যাঁ হ্যাঁ চল, বলে সবাই গাড়িতে উঠে বসলো।
সাবিহা বাড়ি এসে দেখে মা রীতিমত বধূ বরণের আয়োজন করে রেখেছে। সাবিহা অবাক হয়ে শুধু এই সব কাণ্ড দেখছিলজার্নির ধকল কাটিয়ে পরদিন সকালে মাহমুদকে নিয়ে গাড়ি বের করে আবার আবাদানের এক ট্রাভেল এজেন্টের অফিসে গেল এবং যথারীতি আবাদান-কলকাতা-আবাদানের তিনটা টিকেট নিয়ে ফিরে এসে মাকে জানাল
মা, আমরা সামনের বুধ বারে কলকাতা যাচ্ছি, ফেরার কনফার্মেশন ওখানে গিয়ে করবো।
আচ্ছা তাহলে এখন চল তোর মা বাবার জন্য কিছু নিয়ে আসি, সময়তো বেশি নেই
না কিছু নিতে হবে না তুমি এমনিই চল
আরে আমার পাগলী মেয়ে বলে কি! এক দেশ থেকে আর এক দেশে নতুন আত্মীয়ের বাড়ি কি এমনি এমনি যেতে আছে, কিছু উপহার নিয়ে যেতে হয়
মাহমুদের মা বেয়াইনের সাথে দেখা হবার সাথে সাথেই তার মেয়ের প্রশংসা করে কোন কুল পাচ্ছে না। বেয়াইন সাহেব আপনি একজন সার্থক মা, এমন মেয়ে জন্ম দিয়েছেন বলে আপনাকে আগেই আমার সালাম এবং ধন্যবাদ জানাচ্ছি। সত্যিই এমন মেয়ে আমার চোখে পড়েনি। প্রথম দিনে টেলিফোনেই ও আমার মন জয় করে নিয়েছে। আমি সেই থেকে এমন মেয়ের মাকে দেখার জন্য উন্মুখ হয়ে ছিলাম, আজ মনে হচ্ছে আমার এখানে আসা সার্থক হয়েছে। আমিতো এখানে আসতে চাইনি কিন্তু মেয়ের কথায় আমাকে আসতে হয়েছে। মেয়ে বলে কিনা তুমি যতদিন নিজে এসে আমাকে নিয়ে না যাবে দরকার হলে ততদিন আমি অপেক্ষা করবো। শুনেছেন মেয়ের কথা? এই কথা শুনে কোন মা বসে থাকতে পারে? তাই চলে আসলাম।
আপনার ছেলের মত ছেলেও কিন্তু সচরাচর চোখে পড়ে না। খুব ভাল ছেলে, আমাদের খুবই ভাল লেগেছে। এই মেয়ে কিন্তু এখন আপনার আপনি ওদের জন্য দোয়া করবেন যাতে ওরা সুখী হয়।
হ্যাঁ বেয়াইন ওরা সুখী হলেইতো আমরা সুখী।
২৮।
মাহমুদের মা আয়েশা আক্তার এই প্রথম ভারতে এসেছে। প্রথমত ভাষা নিয়ে সমস্যা হবে ভেবেছিল কিন্তু এখানে এসে দেখে এরা উর্দু ভাষায় কথা বলে। আয়েশা আক্তার এর বাবার বাড়ি ইরান পাকিস্তানের সীমানার কাছে তাই সেও মোটামুটি উর্দু বলতে এবং বুঝতে পারে। কোন সমস্যা হচ্ছে না বলে ভারি খুশি। এদের চালচলন, আচার আচরণ, খাবার দাবার এবং বাড়ির রীতিনীতি দেখে অবাক হলো। প্রায় তাদের মতই, ভাবতেই পারছে না সে ভিন দেশের কোন বাড়িতে এসেছে। মনে হচ্ছে ইরানেই রয়েছে।  রাতে খাবার পরে সাবিহার মা সাজান পানের বাটা এগিয়ে দিল কিন্তু ইরানে পান খাবার প্রচলন নেই তাই টেবিলে  বসে এসব নিয়েই আলাপ হচ্ছিল। আলাপে আলাপে এই প্রথম জানতে পারল এদের পূর্ব পুরুষ ইরান থেকেই এসেছিলো। অবাক হলো, কই ওরাতো এ ব্যাপারে কেও আমাকে কিছু বলেনি!
এ বাড়ির বিয়ের আয়োজন দেখছিল আর ভাবছিল ইরানে যে ভাবে বিয়ে হয় তেমনি সব আয়োজন চলছে। মাঝে মধ্যে কিছু এ দেশিয় আচার অনুষ্ঠান রয়েছে তবে বেশির ভাগই তাদের মত। তাহলে মাহমুদ সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছে, কোন ভুল করেনি!
মহা ধুমধামের সাথে জাঁকজমক করে বিয়ে হলোবিয়ের পরে আবাদান ফিরে যেতে আরও তিন দিনের আগে কোন ফ্লাইট পাওয়া যায়নি বলে এখানেই বাসর ঘর সাজান হয়েছে।
অনেক প্রতীক্ষা, অনেক দিনের চাওয়া, অনেক চোখের জল ফেলে আজ সাবিহা এবং মাহমুদের বাসর হবেসাবিহা আগে থেকেই পালঙ্কে বসে ছিল। মাহমুদ ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে যখন পালঙ্কের পাশে এসে দাঁড়াল সাবিহা নেমে মাহমুদের বুকে মাথা রেখে আলিঙ্গন করল। এ আলিঙ্গন শুদ্ধ পবিত্র ভাল বাসার আলিঙ্গন, এ আলিঙ্গন আপনজনকে কাছে পাবার আলিঙ্গন প্রিয়জনের হাত ধরে চলার আলিঙ্গন, এ আলিঙ্গন সাবিহা খানম থেকে সাবিহা মাহমুদ হবার আলিঙ্গন এ আলিঙ্গনে রয়েছে প্রিয়জনের বুকে নিজেকে সঁপে দেয়ার তৃপ্তি। প্রিয় জনকে কাছে পাবার, একান্ত আপন করে পাবার সীমাহীন বাধ ভাঙ্গা নির্মল পবিত্র স্বর্গীয় আনন্দ।
ওরা যেদিন আবাদানে ফিরবে সেদিন বাড়িতে বঁধু বরণের আয়োজন করে রেখেছে, বাড়ি ভরা আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধব পাড়া পড়শি আনন্দ করছিল। সাবিহা যখন মাহমুদের হাত ধরে বঁধু বেশে গাড়ি থেকে বাড়ির ল্যান্ডিঙ্গে নামল তখন মাহমুদের মা বলল,
তোমরা শোন, আজ আমার বাড়িতে অনেকদিন পরে বিকেল বেলা বৃষ্টি এসেছে ওকে বরণ করে ভিতরে নিয়ে চল

1 comment:

Thank you very much for your comments.