১।
ভরা ভাদ্র মাস। নদী
নালা খাল বিল জলে থৈ থৈ করছে। ইছামতী নদীও তেমনি থৈ থৈ করছে। ছলাত ছলাত বৈঠা বেয়ে কত
নৌকা চলে যাচ্ছে, কোনটা পশ্চিমে মালচি, বাল্লার দিকে আবার
কোনটা পুবে হরিণা, হরিরামপুরের দিকে। কোনটায় আবার লাল নীল
রঙ বেরঙের পাল তুলে মাঝি শুধু পাছা নায় হাল ধরে ভাটিয়ালি সুর তুলে দূরের কোন দূরগায়ের নাইয়রি নিয়ে যাচ্ছে, ছৈয়ের সামনে পিছনে একটু খানি কাপড় দিয়ে পর্দা দেয়া। জনাব আলি নদীর পাড়ে বসে বিড়ি টানছে আর তাই দেখছে।
দেড় দুই মাস হলো
এই ইছামতীর পাড়ে ঝিটকা বাজারের ঘাটে তারা লগি গেড়েছে। নদীর পাড়ে বাজারের পরেই ইউনিয়ন
অফিস তারপরে হাইস্কুল। হাইস্কুলের পাশেই প্রাইমারি স্কুল। হাই স্কুলের সামনে নদীর পাড়ে
বিশাল এক কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচেই জনাব আলি বসে আছে অনেকক্ষণ ধরে।
দেখতে দেখতে পশ্চিম
আকাশ লাল হয়ে আসছে, সূর্যটা কিছুক্ষণের মধ্যেই ডুবে যাবে। এর মধ্যে তাদের বহরের কোন
কোন নৌকায় হারিকেন ঝুলিয়ে দিয়েছে। বাজারের ঘরে ঘরে বাতি দিয়ে দিয়েছে। দুই পাড়ের গ্রামেও
দুই একটা বাড়িতে আলো দেখা যাচ্ছে। আর একটা বিড়ি জ্বালাল। কিছুতেই উপযুক্ত সিদ্ধান্তে
আসতে পারছে না।
অন্ধকার হয়ে আসার
আগেই ছোট মেয়ে কলি ডাকতে এলো
খেপতে, (বাবা) নায়
যাইবা না? এহানে আর কতক্ষণ বইসা থাকবা? চল নায় চল আমরি (মা) চিন্তা করতেছে, ভাত খাইবা
চল
বলেই হাত টেনে উঠিয়ে
দিল। মেয়ের পাশে পাশে হেটে এসে পা ধুয়ে নৌকায় উঠল। নৌকার এক পাশে ব্যবসার বিক্রির জিনিস
পত্র আর এক পাশে সংসারের জিনিস পত্র। মাঝে শোবার জায়গা। পিছনে গলুইর কাছে রান্নার আয়োজন।
জনাব আলির বহরের অধিকাংশই বেচাকেনা করে। হরেক রকম চুরি, আলতা, মেন্দি, মালা, কানের
দুল, মাথার ক্লিপ, মুখ দেখার ছোট আয়না, চিরুনি, উকুনের চিরুনি, কপালের টিপ, কাজল, বাচ্চাদের
খেলনা এমনি কত কি! আবার কেও কেও শিঙ্গা লাগানো, দাঁতের পোকা বের করা, তাবিজ কবচ ঝাঁর
ফুকের কাজও করে। সাপ ধরা, সাপের খেলা দেখান, সাপের ব্যবসা করা, সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসা,
জাদু দেখানো, মাছ ধরা, বানর খেলা দেখানো, পাখি শিকার ইত্যাদি। এদের মধ্যে দুই একজন
যে এদিক সেদিক কিছু করে না সে কথা বলা যায় না। নানা জনে নানা রকম ফন্দি ফিকির করে তবে
তা জানাজানি না হলে কেও আর ও নিয়ে মাথা ঘামায় না।
ঝিটকা বাজারের পুঁটি
মাছ আর করল্লা দিয়ে চচ্চড়ির মত করেছে। জনাব আলি কি খাচ্ছে সেদিকে তার মন নেই। খেতে
বসেও ভাবছে দেখে জয়নব বেগম তাড়া দিল
কি হইছে, এমনে ভাবলেই
হইব? মাইয়ারেতো আর গাঙ্গে ফালাইয়া দিতে পারুম না। আমি কই কি চল আমরা এহান থিকা চইলা
যাই। অনেক দিনতো হইল, আর কত দিন এই ঘাটে থাকুম?
বলেই স্বামীর মুখের
দিকে তাকাল কিন্তু তার মুখের কোন ভাবান্তর দেখতে না পেয়ে একটু হতাশ হলো।
জনাব আলি শুধু জিজ্ঞেস
করল
রেশমি কনে?
আছে ওই নায়
কি করে?
কি আর করব, হুইয়া
রইছে
খাইছে?
হ, তুমি আহার আগেই
খাইয়া গেছে।
২।
জনাব আলির নৌকার
বহর ইছামতী নদী দিয়ে যাচ্ছিল, ওদের ধারনা ছিল হরিরামপুর যাবে কিন্তু পথে রাতে অমাবস্যার
অন্ধকারে পথ দেখতে না পেয়ে ঝিটকার কাছে দিয়ে যাবার সময় কি মনে করে এই ঘাটেই ভিড়িয়ে
দিল।
কি হইল জনাব ভাই,
থামলা কেন?
ভিড়া, এই ঘাটেই দেইখা
যাই।
এইতো, সেই থেকে তারা
এখানেই আছে আজ প্রায় দুই মাস। বেদেরা সাধারণত কোন ঘাটে এত দিন থাকে না কিন্তু এখানে ভাল ব্যবসা হচ্ছে বলে কেমন করে
যেন রয়ে গেল। ঘাটে বাধার পরের দিন থেকেই সবাই যার যার ঝাঁকা নিয়ে গ্রামে বের হলো ফেরি
করার জন্য। জনাব আলির মেয়ে রেশমি। দেখতে সুন্দরী। বেদের ঘরে এমন মেয়ে দেখা যায় না।
মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত সবই যেন বিধাতার নিপুণ হাতে বানানো। কাচা হলুদের মত
গায়ের রঙ, মাথায় লম্বা কাল কুচকুচে গোসলে (চুল), বাড়ন্ত গড়ন, হরিণের মত গোঙকুরি (চোখ),
সদা ধবধবে সুন্দর খোঁজ কুই (দাঁত), থুতনির বাম পাশে কাল তিল, অর্ধ প্রস্ফুটিত গোলাপ।
যৌবনের পথে পা দিয়েছে কিন্তু এখনও গন্তব্যে পৌছাতে পারেনি, এগিয়ে যাচ্ছে। রেশমি অন্য
নেমারিদের (মেয়ে) মত নামড়াদের (ছেলে) দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য সাজগোজ করে না। ওকে সাজতে
হয় না। সুফি সবসময়ই বলে ঈশ আমাগো যে আল্লায় কি দিয়া বানাইছে! তর মত একটুখানি পাইলেই
আমাগো আর কিছু লাগত না। রেশমির চোখে কাজল কিংবা কপালে টিপ কিংবা খোপায় ফুল গুজতে কেও
কখনও দেখেনি তবুও রেশমি যেখান দিয়ে যায় পথের কেও এক নজর না তাকিয়ে পারে না। পথে যেতে
যেতে চোখ যেন এমনি এমনিই আটকে যায়। সেদিন দলের আগে আগে রেশমি আর বাকিরা সবাই ওর পিছনে।
অন্য সব বেদেনীর মত গোড়ালির উপরে তোলা লাল পাড় হলুদ শারী, লাল ব্লাউজ, গলায় পুতির মালা,
হাত ভরা প্লাস্টিকের লাল চুরি, কোমরে আঁচল জড়ান মাথায় চুরির ঝাঁকা গলায় গানের সুর
‘মোরা এক ঘাটেতে রান্ধি বাড়ি আরেক ঘাটে খাই মোদের ঘরবাড়ি নাই’ আরও গাইছে ‘আমরা হেলায়
নাগেরে খেলাই নাগেরই মাথায় নাচি’ সবাই ওর সাথে সাথে গলা মেলাচ্ছে।
অনেকেই অনেক কিছু
বিক্রি করলেও জনাব আলির পরিবার মেয়েদের এই সব সাজ প্রসাধনী জিনিষ পত্র ছাড়া আর কিছু
বিক্রি করে না। তবে দলের মধ্যে পারুল, সুফি, হিরা এবং অনেকের কাছেই তাবিজ কবচ, গাছ
গাছড়ার তৈরি ঔষধ এবং ঝুরির মধ্যে সাপ নিয়েই প্রথম দিন নদীর ওপাড়ে গোপীনাথপুর গ্রামে
গেল। সারাদিন ঘুরে ঘুরে ভালই বেচা কেনা হয়েছে। সন্ধ্যার আগে আগে আবার দল বেধে সবাই
ঘাটে ফিরে এসেছে। পা ধুয়ে নৌকায় উঠে মাথার ঝাঁকা নামিয়ে বাবার প্রিয় মেয়ে আগে বাবার
সাথে দেখা না করে কিছুই করবে না। বাবার সাথে দেখা হলো। আজকের এই নতুন এলাকা কেমন এই
সব নিয়ে কথা হলো। এবার রেশমি আগা নায়ে এসে মুখ হাত ধুয়ে আগামী কালের জন্য কিছু মালামাল
ঝাঁকায় ভরে মায়ের কাছে জিজ্ঞেস করল মা কিছু রানছ?
রানছি
কি রানছ?
তর বাপে ইচা মাছ
আর পুই শাক আনছিল তাই আর ডাইল রানছি
দেও মা খিধা লাগছে।
এহ! সারাদিন যা ঘুরছি পাও এক্কেবারে টনটন করতেছে।
৩।
বেদেদের সমাজ ব্যবস্থা দেশের আর দশটা সমাজের মত নয়, এদের
সমাজে ভিন্ন নিয়ম শৃঙ্খলা। এদের না আছে কোন ঠিকানা না আছে বাড়ি ঘর। নৌকায়ই এদের জন্ম,
নৌকায়ই এদের জীবন, সুখ-দুঃখ, সংসার, উৎসব আনন্দ বেদনা আবার নৌকায়ই মৃত্যু। ঝর তুফান,
শীত গ্রীষ্ম, বর্ষা সারা বছর নৌকায় ভেসে এক ঘাটে এসে লগি গারে। কোথাও আবার দল বেধে
বাজার ঘাট বা স্কুল কলেজের পাশে পতিত জমি বা
খাস জমিতে পলিথিন, বাঁশের চালি বা সস্তা হোগলা পাতা খেজুর পাতা দিয়ে ছৈয়ের মত বানিয়ে
তার নিচেই বসবাস করে তবে এটাও অস্থায়ী। যাযাবর এই দল কোন এক জায়গায় স্থায়ী হতে পারে
না। রক্তেই এদের যাযাবরের নেশা। কারা এদের পূর্ব পুরুষ সে ইতিহাস এরা জানে না। দাদা
দাদি বা বংশ পরস্পরায় যা শুনে এসেছে এর বেশি আর যেতে পারে না। মাস খানিক এক জায়গায়
থেকে অস্থির হয়ে যায়, নৌকার বহর নিয়ে বা ছৈ গুটিয়ে ছুটে চলে ভিন্ন কোন ঘাটের উদ্দেশ্যে।
সর্দারই এদের নেতা। পরের গন্তব্য কোথায় হবে, কে মারামারি বা ঝগড়া ঝাটি করল, কার বিয়ে
হবে, কাদের ছাড়াছাড়ি হবে এসব সালিস বিচার সর্দারই করে। স্থায়ী কোন নিবাস না থাকায় প্রাতিষ্ঠানিক
শিক্ষা দীক্ষা এদের নেই তবে শিশুকাল থেকেই বেঁচে থাকার জন্যে এদের পেশাগত নানান শিক্ষা
দেয়া হয়। লতা (সাপ) ধরা, সাপের খেলা দেখান, সাপে কাটা রুগীর চিকিৎসা করে বিষ নামান, পোক্কর (পাখি) শিকার করা ছেলেদের শেখান হয় আবার
তেমনি করে মেয়েদেরও নানা ভাবে সেজে গুজে হাটে বাজারে পসরা সাজিয়ে বিক্রি করা বা গাওয়ালে
(গ্রামে) যেয়ে ফেরি করা শিক্ষা দেয়া হয়। ছেলে মেয়ে ১০/ ১২ বছর বয়স হলেই মাথায় ঝাঁকা
দিয়ে বা যে যেভাবে পারে তাকে সে ভাবে নিজে রোজগারের পথে নামিয়ে দেয়। ছোট ছেলেরা বনে
জঙ্গলে ঘুরে রান্নার কাঠ খড়ি কুড়ায় আবার সুযোগ পেলে পাখি টাখি শিকার করে, মাছ ধরে।
মেয়েরা সাধারণত মাথায় ঝাঁকা নিয়ে গ্রামে বা
মহল্লায় ঘুরে ঘুরে ফেরি করে আবার কখনও হাটে বাজারে পসরা সাজিয়ে বসে। পুরুষেরা নৌকা
নিয়েই গ্রামে গ্রামে ঘুরে ফেরি করে সাথে বয়স্ক মহিলা যারা ঘুরে ফেরি করতে পারে না তারা
নৌকায় থাকে। কখনও পুরুষেরা বনে জঙ্গলে ঘুরে সাপ ধরে, নৌকায় বসে বসে বড়শি দিয়ে মাছ ধরে।
বেদেনীরাও সাপ ধরতে পারে। ঢোঁরা, লাউডগা, কালনাগিনী এমন সব বিষাক্ত সাপ। তবে সবাই সাপ
ধরতে পারে না। হিংস্র মেজাজের এবং ভয়ঙ্কর বিষাক্ত দাঁড়াশ, শঙ্খিনী, গোখরো, কাল কেউটে জাতের সাপ নিজেরা ধরতে না পারলে অন্য
বেদের কাছ থেকে কিনে নেয়। কালনাগিনী বেদেনীদের ভীষণ পছন্দের সাপ, তাই হয়ত বেদেনীদের
হাঁটা চলাফেরা বা স্বভাব অনেকটা সাপের মত। লক্ষ করলে দেখা যাবে হাঁটার সময় এদের পা ফেলার ভঙ্গিও ভিন্ন রকম, এরা
এক পায়ের পর আরেক পা ফেলতে সোজা করে ফেলে। সাপ খেলা দেখানোর সময় হিংস্র বিষাক্ত সাপকে
বেদেনী বাহুতে কিংবা গলায় পেঁচিয়ে বাঁশী বাজিয়ে সুরেলা গলায় এই চির চেনা গান গেয়ে পথচারী
বা দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে
‘খা খা রে খা, বক্ষিলারে
খা,
কিপটারে খা, কঞ্জুসরে
খা।
গাঁইটে টাকা বাইন্দা
যে
না দেয় বেদেনীরে,
মা মনসার চেড়ি তাদের
খা খা করে খা।
খা খা খা ওই বক্ষিলেরে,
কিপ্পিনেরে খা
গাঁইটে পয়সা বাইন্দা
যে
না দেয় বেদেনীরে
তার চক্ষু উপড়াইয়া
খা’।
এমন অনেক গান প্রচলিত
আছে যা বিশেষ করে বেদেদের মুখে মুখে বেঁচে আছে। সমাজ এদের অবহেলা করে স্বীকৃতি না দিলেও
এদের নিয়ে অনেক মনে দোলা দেয়া কাহিনী রচনা করেছে। অনেক সিনেমা তৈরি করেছে যেমন মহুয়া,
বেদের মেয়ে, মনসামঙ্গল, সাপুড়ে, বেহুলা লখিন্দর, নাগিনী কন্যার কাহিনী, নাগিনী, সর্প
রানী, সাপুড়ে মেয়ে, নাচে নাগিনী, বেদের মেয়ে, রাজার মেয়ে বেদেনী, বেদের মেয়ে জোসনা।
এদের স্বামী স্ত্রীতে
ঝগড়া হলে কেউ কারো গায়ে হাত দেয়ার সুযোগ পায় না, নিয়ম নেই। নৌকার সামনের গলুইতে একজন
আর পিছনের গলুইতে একজন বসে উত্তেজিত হয়ে গালাগালি করে, লগি বৈঠা এ ওর দিকে ছুড়ে দেয়।
হুলুও (বিয়ে)এদের নিজেদের মধ্যেই হয়। ছেলে বা মেয়ের বয়স হবার সাথে সাথেই কোন অনাকাংখিত
ঘটনা ঘটার আগে বিয়ে দিয়ে দেয়। মেয়েদের ১৪/১৫ বছর বয়স হলেই বিয়ে দেয়া হয়। স্ত্রী গাওয়ালে
গেলে স্বামী রান্না বান্না সহ নৌকার গোছগাছ করে রাখে আবার সন্তানের দেখাশোনাও করে।
নারী শাসিত এই সমাজে নারীরাই পেশায় মুল ভূমিকা পালন করে। পুরুষেরা সাধারণত অলস হয়,
তবুও স্বামীকে বশে রাখার জন্য স্ত্রীরা নানা রকম তাবিজ কবচ তন্ত্র মন্ত্র করে যাতে
পুরুষ ভিন্ন নারীতে আসক্ত না হয়। বেদেনীরা স্বামীদের আঁচলে বেঁধে রাখতে তুলনাহীন। পুরুষ
বশে রাখতে তারা শরীরে সাপের চর্বি দিয়ে তৈরি তেল ব্যবহার করে, স্বামীর শরীরে এই তেল
নিয়মিত মালিশ করে। কোনও পুরুষের পক্ষে বেদেনীর এই কৌশল উপেক্ষা করা সম্ভব হয় না। বেদেনীর
মায়াজালে পড়লে কোন পুরুষ বেদেনীকে ছেড়ে যেতে পারে না। স্বামী বেদে স্ত্রীদের কাছে দেবতার
মত, যাবতীয় ঝুট ঝামেলা বিপদ আপদ থেকে তাকে আগলে রাখার জন্য স্ত্রী আপ্রাণ চেষ্টা তদবির
করে।
৪।
ঠিকানা
হীন ভাসমান জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে বেদেরা ইসলাম ও হিন্দু উভয় ধর্মই মেনে চলে তবে
তারা নিজেদেরকে মুসলমান দাবি করে এবং অনেকেই ওয়াক্তিয়া নামাজ সহ জুম্মার নামাজ এবং
ঈদের নামাজ মসজিদে আদায় করে কিন্তু রোজা রাখার ব্যাপারে এদের অনীহা। উপার্জনের মৌসুম
শেষ হলে বেদে পরিবারে বিয়ের আয়োজন করে। বিয়ে শাদীর সময় হিন্দু রীতিনীতি পালন করে, বিয়ের
পরদিন সূর্য ওঠার আগে কনের মাথায় সিঁদুর দেয়া হয় যদিও বিয়ে পড়ানো হয় ইসলামি মতে মওলানা
দিয়ে। মেয়ে যে পুরুষকে পছন্দ করবে সে পুরুষের সম্মতি থাকলে সে বিয়ে হবে। বিয়ে করতে
হলে কনেকে যৌতুক দিতে হয়। যার যেমন সামর্থ্য, সে তাই দেয়। এ অর্থ বেদেনীর কাছে জমা
থাকে শত বিপদ আপদেও খরচ করতে চায় না। বিয়ে
এবং তালাক উভয়ই হয় কনের ইচ্ছায়, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোনও কারণে ছাড়াছাড়ি হলে সম্পত্তি
সহ ছেলে-মেয়েও ভাগাভাগি হয় এবং তালাকের সময় স্বামীর দেয়া যৌতুকের অর্ধেক স্বামীর পরিবারকে
ফেরত দিতে হয়। বিয়ের রাতে স্বামীকে সন্তান পালনের জন্য প্রতিজ্ঞা করতে হয়। যতদিন স্ত্রী
উপার্জনের জন্য বাইরে থাকে, ততদিন স্বামী-সন্তানের প্রতিপালন করে। বিয়ের পর স্বামী
স্ত্রীর নৌকায় যায়। স্ত্রীর নৌকাই স্বামীর নৌকা। ঈদের চেয়ে এরা বিয়েতেই বেশি আনন্দ
করে তবে বিয়েতে আপ্যায়ন বা উপহার দেয়ার কোন রীতি নেই। এমনিই নাচ গান করে এই আনন্দ করে।
বিয়েতে বর কনেসহ উপস্থিত সবাইকে নাচগান করতে হয়। বাইরের কেউ এলে তাকেও নাচতে হয়। এসব
নাচ গান একান্তই বেদে সম্প্রদায়ের নিজস্ব সংস্কৃতি। অবিবাহিত মেয়েরা আকর্ষণীয় জমকালো
সাজ গোঁজ করে কোমর দুলিয়ে নেচে গেয়ে নিজেদের শারীরিক সৌন্দর্য তুলে ধরে অন্য যুবকের
মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করে। তরুণ-তরুণীরা এভাবেই
বিয়ের অনুষ্ঠানে নিজেদের সঙ্গী খুঁজে নেয়। ভিন্ন সমাজের কোনও যুবক উপস্থিত থাকলে
তাকেও বেদে নারীরা বিয়ের জন্য প্রলুব্ধ করে এবং সে তরুণ যদি বেদে তরুণীকে বিয়ে করে,
তাহলে তাকেও বেদেদের গোত্রভুক্ত হতে হয় নতুবা তাদের সমাজচ্যুত করা হয়। মৃত্যুর পর ইসলামি
নিয়ম অনুযায়ী দাফন করে এবং চল্লিশা বা কুলখানির আয়োজন করে। আবার সর্প দংশন থেকে বাঁচতে
মা মনসার পূজা করে এবং শিব, ব্রহ্মাও বিশ্বাস করে।
৫।
ঝিটকা আসার আগে শিবালয়
ঘাটে যখন ছিল তখন থেকে লক্ষ করছে আসা যাওয়ার পথে নৌকায় বা ঘাটে বসে কেমন করে চোখ বাকিয়ে
জসীম তাকিয়ে থাকে। ইশারায় ইঙ্গিতে কিছু বলতে চায়, একা থাকলে এটা সেটা কিনে দিতে চায়
কিন্তু রেশমি পাত্তা দেয় না তবে মনে মনে বসন্তের আনাগোনা অনুভব করে। ইশারর তোয়াক্কা
না করে সেদিন বলেই ফেলল চল না ওই গাছের নিচে একটু বসি! রেশমি কোন জবাব না দিয়ে চলে
এসেছিল। সমবয়সী ফুলির বিয়ের সময় নাচতে নাচতে কখন যেন জসীম কাছে এসে হাতটা ধরে ফেলল।
কি হলো আমার কাছে
আসছস না কেন?
চমকে উঠে বলল, হাত
ছাড় বলছি, তুই আমাকে ছুবি না
কেন, কি হয়েছে? আমি
কি তোর যোগ্য না?
আগে হাত ছাড় পরে
অন্য কথা
হাত ছাড়ার জন্যে
ধরেছি ভেবেছিস?
হাত ছাড় নইলে সবাইকে
ডাকব আমি
দলের নিয়ম অনুযায়ী
জোর করে প্রেম হয় না। নালিশ হলে কঠিন শাস্তি। তাই ভয়ে হাত ছেড়ে দিল কিন্তু ওর কথা ভেবে
দেখার এবং অনেক যৌতুক দেয়ার লোভ দেখাল।
সারা জীবন তোর গোলাম
হয়ে থাকব রে রেশমি তুই শুধু আমার কথা একটু ভেবে দেখবি।
তুই আমার দিকে তাকাবি
না, আমার কাছে আসার চেষ্টা করবি না
সেদিনের মত ছাড়া
পেল কিন্তু তার পরে থেকেই রেশমি বুঝতে পারে তার মনে জোয়ার এসেছে, পরিপূর্ণ টইটুম্বুর
জোয়ার টলমল করছে। গায়েও তেমনি নতুন জোয়ারের ঢেউ এসে দোলা দিয়েছে। বাড়ন্ত গড়নের জন্য
মায়ের কড়া নির্দেশে অনেকদিন আগেই ফ্রক ছাড়তে হয়েছে। শারীর আঁচল দিয়ে নিজেকে ঢেকে রাখতে
শিখিয়েছে মা। বসন্তের সদ্য ফোটা কৃষ্ণচূড়ার থোকা থোকা লাল ফুলের আবেশ ছড়িয়ে যাচ্ছে
রেশমির দেহে মনে। চারদিকে যা দেখে সব কিছু রঙ্গিন মনে হয়। রেশমি বুঝতে পারে সে এখন
বড় হয়েছে। পনের থেকে ষোলয় পা দেয়া রেশমি জসীমকে নিরস্ত করতে পেরেছে কিন্তু তার মনে
রঙ ধরাবার মত কাওকে দেখা যাচ্ছে না! কে আসবে তার কাল নাগ হয়ে? যে ছোবল দিতে জানে? এমন
কাওকে দেখছি না! আমাদের এই দলে এমন কেও নেই।
এই ঘাট ছেড়ে অন্য ঘাটে গেলে খুঁজতে হবে। জসীম একটা ঢোঁরা সাপ! ওর মধ্যে কিছু নেই ওর
ডাকে সারা দেয়ার চেয়ে গলায় কলশী বেঁধে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়া অনেক ভাল।
৬।
গোপীনাথপুর থেকে
ফিরে আসার পরের দিন রেশমি দলের সাথে বের হয়েছে। আজ তার পরনে সবুজ পাড়ে কুসুম রঙ শারী,
হলুদ ব্লাউজ, গলায় আগের মত পুতির মালা, হাতে লাল চুরিতে দারুণ মানিয়েছে। জরিনা বলেই
ফেলল
তরে আইজ খুউব সুন্দর
লাগতেছেরে রেশমি, তুই যে আজ কারে পাগল করবি কে জানে! দেখিস সাবধানে থাকবি নাইলে কিন্তু
সর্দার দল থিকা বাইর কইরা দিবনে।
এই শুনে সুফি বলল
দেখস না একটু কাজল
দেয় নাই কপালে একটা টিপও নাই তাও কি সুন্দর লাগতেছে!
হিরা খিল খিল করে
হেসে বলল
অরে আবার দল ছাড়া
করব কেরা ওতো সর্দারের মাইয়া!
এমনি হাসি আনন্দে
এগিয়ে যাচ্ছে। আজকে ওপাড়ে যাব না চল ওইদিকে যাই বলে ঝিটকা স্কুল ছাড়িয়ে পুব দিকে গেল।
যেতে যেতে হুগলাকান্দি এসে পৌঁছল। গ্রামে ঢুকে হাঁক দিল
চুরি নিবেন চুরি!
রেশমি চুরি বেলোয়ারি চুরি আরও আছে ফিতা, কাটা, আলতা, কাজল!
মাঝে মাঝে সুরেলা
গলায় গান গাইছে
সঙ্গীরা নানা দিকে
ছড়িয়ে গেল। এক সাথে থাকলে কে বেচবে কে দেখবে তাই এদের এই রীতি। এক সাথে বের হয়ে পরে
যার যার সুবিধা মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায়। আবার বেলা শেষে এক জায়গায় জড় হয়ে এক সাথে ঘাটে
ফিরে আসে।
গ্রামের ভিতরের দিকে
একটু এগিয়ে যেতেই এক বাড়ি থেকে ডাকল
এই বাইদানী
রেশমি শব্দ অনুসরণ
করে বাড়ির উঠানে ঢুকে মাথার ঝাঁকা নামিয়ে ডাকল
কইগো বিবিসাবেরা
আহেন
বাড়ির মেয়েদের একে
একে তার পণ্য সম্ভার দেখাচ্ছে। বাড়ির মেয়ে মহিলা সহ বুড়িরা পর্যন্ত সবাই ঘিরে ধরেছে।
পাশের বাড়ি থেকেও বৌ ঝিরা এসেছে।
রতন এই বাড়ির ছেলে,
ঝিটকা প্রাইমারি স্কুলে মাস্টারি করে। স্কুলে যাবার জন্য বের হয়ে দেখে উঠানের মাঝখানে
মা বোন এবং ভাবিদের জটলা। কি ব্যাপার এরা সবাই কি দেখছে? পায়ে পায়ে কাছে এগিয়ে এক বোনকে
সরিয়ে দাঁড়াল। বেদেনীর মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক স্তব্ধ হয়ে গেল। আগেও অনেক বেদেনী দেখেছে
কিন্তু তারা শুধুই বেদেনী আর কিছু নয়। কিন্তু এ যেন ভিন্ন কেও, এ কি আসলেই বেদেনী?
এত সুন্দর! মানুষ এত সুন্দর হতে পারে? অবাক চোখে ওর মুখের দিকে তাকিয়েই রইল। বোন ভাবিরা
নানা কিছু কেনা কাটা করছে কিন্তু রতনের কোন দিকে হুশ নেই। স্কুলের দেরি হচ্ছে সেদিকেও
মন নেই। হঠাৎ করেই এক ভাবির চোখে রতনের কাণ্ড ধরা পরল। সে আবার বড় জা কে দেখাল। কিরে রতন বাইদানীরে এত
দেখার কি আছে? মনে ধরেছে নাকিরে রতন? ভাল করে দেখ, পছন্দ হলে বল, কি সুন্দর বেদেনী!
সবাই এদিকে রতনের অবস্থা দেখে অনেকক্ষণ হাসাহাসি। ওরাও বলাবলি করছিল মেয়েটা খুব সুন্দর।
আহারে, কি জন্যে যে এই মেয়ে বাইদার ঘরে জন্মেছে! এই রূপ নিয়ে কি গাও গেড়ামে ঘুরে ফেরি
করা যায়? কবে কি হবে কে জানে! রতন বুঝতে পেরে স্কুলের পথে পা বাড়াল। কিন্তু বাড়ি ছেড়ে
আসার পরেই তৃষ্ণার্ত মন আবার ফিরিয়ে নিয়ে গেল। বাড়িতে ওঠার পথের পাশে বড় জাম গাছের
নিচে বেদেনীর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইল। বেচা বিক্রি করে বেদেনী বাড়ির বাইরে এসে জাম গাছের
নিচে রতনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে
কিগো বাবু, তুমি
যে কিছু নিলা না?
কি নেব, আমার কিছু
কি তোমার কাছে আছে?
কি যে কও, কত কি
আছে, বিবি সাবের জন্যে চুরি নেও খুশি হইব, কও কি নিবা বলেই মাথার ঝাঁকা আবার নামাল
আচ্ছা নেব, আগে বল
তোমার নাম কি?
আমরা হইলাম ছোট জাত,
আমার নাম দিয়া কি করবা
তোমরা কোন ঘাটে থেমেছ
ওইতো ঝিটকা বাজারে
বল না তোমার নাম
কি?
কইলামতো আমার নাম
দিয়া কি করবা? আমারে বিয়া করবা?
আহা! বল না!
রেশমি। কইলামতো এহন
কি নিবা কও
রতন বিপদে পড়ল। এখন
কি করে? বোনেরা তাদের সব নিয়ে নিয়েছে। কার জন্যে নিবে?
নিরুপায় হয়ে ছোট
বোনকে ডাকল
এই ঊষা
ঊষা বাইরে এসে ভাইকে
দেখে অবাক, দাদা তুই স্কুলে যাসনি?
তোরা কি কি নিয়েছিস?
আর কিছু নিবি?
তুই কিনে দিবি?
দেখ আর কি লাগবে
ঊষা সুযোগ পেয়ে আরও
অনেক কিছু কিনে বাড়ির ভিতরে চলে গেল।
রতন পকেট থেকে টাকা
বের করে বেদেনীর হাতে দিতে দিতে বলল
কাল কোন গ্রামে যাবে?
কি যে কও বাবু! আমাগো
কি কোন ঠিক ঠিকানা আছে যেদিন যেদিকে মনে চায় সেদিকেই যাই, কেন? আবার কি নিবা?
আশেপাশে এদিক ওদিক
তাকিয়ে দেখে নিয়ে সাহস করে রতন বলেই ফেলল
আর কি নিব? আমি তোমাকেই
নিতে চাই
কি কইলা বাবু?
আমতা আমতা করে রতন
আবার কথাটা বলল, আমি তোমাকে নিতে চাই
রেশমি অবাক চোখে
বাবুর আপাদমস্তক দেখল। বাবুর ঠাট আছে, শরীরতো নয় যেন এক্কেবারে কেউটে সাপ! দাতে বিষ
আছে! এরেই কয় পুরুষ মানুষ। পুরুষ হইলে এমনই হইতে হয়। এর আগে গাওয়ালে এমন কথা কেও বলেনি।
তবে ঠারে ঠারে চাউনি দেখেছে, পুরুষ মানুষের চাউনির মানে রেশমি বুঝতে শিখেছে। নানান
প্রস্তাব শুনেছে, ইতর প্রস্তাব। ওকে দেখে কোথাও কোথাও আবার শীষ দেয়, গানের কলি আওড়ায়।
এই বাবু তেমন বাবু না। মনে ঘোর লেগে আসছিল, বসন্তের টকটকে লাল কৃষ্ণচূড়ার বনে কে যেন
উঁকি দিতে চাইছিল কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে বলল
ছি! ছি বাবু! তোমরা
হইলা গেল খেনুস (ভদ্রলোক মানুষ), তুমি এইডা কি কইলা? কইলাম না আমরা ছোট জাত আমাগো দিকে
নজর দিতে নাই। আমার বাবা আমাগো দলের সর্দার, লোকে জানলে বাবা আমারে আস্ত থুইবো না,
কাইটা গাঙ্গে ভাসাইয়া দিব।
বাড়ির সামনের রাস্তা
দিয়ে কে যেন যাচ্ছিল তাকে দেখে রতন থেমে গেল। বলল
আচ্ছা ঠিক আছে এখন
যাও
রেশমি খুচরা টাকা
বাবুর হাতে দিয়ে ঝাঁকা গোছান শুরু করল আর রতন স্কুলের পথে পা বাড়াল।
ছবিঃ বিজয়নগর বাজার/ লেখক
ছবিঃ বিজয়নগর বাজার/ লেখক
৭।
বিকেলে স্কুল থেকে
বাড়ি ফিরে খেয়ে দেয়ে প্রতিদিনের মত বের হলো। ঝিটকা আসবে, বন্ধুরা মিলে রাজার চায়ের
দোকানে আড্ডা দেয়। রাত আটটা নয়টা বাজলে যার যার বাড়ির পথ ধরে। আজও বের হলো। কিছুক্ষণ
আড্ডা দিয়ে বেলা ডোবার পরেপরেই আমার কাজ আছে বলে আড্ডা থেকে বেরিয়ে এসে বেদের ঘাটে
দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক খুঁজছে। ২০/২৫ টা নৌকার মধ্যে রেশমি কোন নৌকায় রয়েছে কে জানে! নৌকার
ভিতরে মিট মিট করে হারিকেন জ্বলছে, সবাই খাওয়া দাওয়া নিয়ে ব্যস্ত, কেও আবার শুয়ে পড়েছে।
কি করেই বা কাকে জিজ্ঞেস করবে? অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে না পেয়ে হঠাৎ মনে হলো রেশমি বলছিল
না ওর বাবা ওদের দলের সর্দার? সর্দারের নৌকা খুঁজে পেতে আর এমন কি!
একজনকে পাছা নৌকায়
বসে বিড়ি ফুকতে দেখে তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করল
এই যে শুনছেন
আমারে কইলেন?
হ্যাঁ হ্যাঁ আপনাদের
সর্দারের নৌকা কোনটা?
কেন? সর্দাররে দিয়া
কি হইব?
কাজ আছে, একটু ডেকে
দিবেন?
ওই যে ডাইনের তিন
নাও বাদের নাও
রতন এগিয়ে গেল নৌকার
কাছে। বুক ঢিব ঢিব করছে, কি বলবে? এতক্ষণ ভাবেনি! কিছু না ভেবেই হঠাৎ ডাকল
সর্দার নায় আছে?
কে ডাকে?
বলতে বলতে লুঙ্গি
পরা ফতুয়া গায়ে মাঝ বয়সী এক লোক ছৈয়ের ভিতর থেকে বেরিয়ে রতনকে দেখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে
তাকাল। আপনে, কি হইছে, কি চান?
আপনে কি এই দলের
সর্দার?
হয়, কি হইছে?
আপনার কাছে দাঁতের
পোকা বের করার ওষুধ আছে?
আছে, কার জন্যে?
আমার ভাতিজার
ও! কাইল সকালে বেলা
ওঠার আগে নিয়া আইতে পারবেন?
বাবার কথার শব্দ
শুনে রেশমি আর তার মা বাইরে এসে দেখে কে একজনের সাথে সর্দার কথা বলছে। রেশমি চিনতে
পারল সকালে যার সাথে কথা হয়েছে সেই লোক। একটু অবাক হলো। কি ব্যাপার? এর মধ্যে নায়ে
এসে হাজির! বসন্তের সেই টকটকে লাল কৃষ্ণচূড়া আবার উকি দিতে চাইল কিন্তু আকাশ কুসুম
ভেবে নিজেকে বোঝাল। লোকটা না হয় ভাবের মোহে পইরা মনে যা আইছে কইয়া ফালাইছে আবার এই
খানেও আইসা পরছে কিন্তু যা সম্ভব নয় তারে প্রশ্রয় দিতে নাই। আমরা বাইদার জাত আমাগো
এত স্বপ্ন দেখতে
আপনের বাড়ি কোন গ্রামে?
নাই। এই ফাঁকে রতন
দেখল ছৈয়ের ভিতর থেকে বের হয়ে রেশমি বোকার মত আগা নায়ে তার দিকে চেয়ে বসে আছে। আল আধারিতে
আরও বেশি সুন্দর লাগছে
না আনা যাবে না,
আপনারা বাড়ি যেতে পারবেন না? বেশি ফি দেব! যাবেন না?
আপনের বাড়ি কনে?
কাছেই, হুগলাকান্দি,
এই রাস্তা দিয়ে সামনে গেলে যে গ্রাম পড়বে সেখানে রতন মাস্টারের বাড়ি বললেই দেখিয়ে দিবে।
আমি এই যে এই প্রাইমারি স্কুলে মাস্টারি করি।
বুঝলাম
যাবেনতো?
৮।
রতন সে রাতের মত
আশ্বস্ত হয়ে বাড়ি ফিরে এলো। সর্দারের কথায় বুঝতে পারল না কাকে পাঠাবে। যাকেই পাঠাক
রেশমির আস্তানা চিনতে পেরেছে। দেখা যাক, এখন সকালের অপেক্ষা। রেশমির স্বপনে মগ্ন হয়েই
কোথা দিয়ে যেন সারা রাত চলে গেল কিছুই বুঝতে পারল না। কি মায়া ভরা চোখ! এই চোখ দিয়ে
যাকে দেখবে সেই ধন্য হয়ে যাবে। বারবার বাম থুতনির নিচের তিলের কথাও মনে হচ্ছিল। মনে
মনে সমস্ত চেহারা দেখে এসে ওই তিলেই চোখ আটকে যায়। ভোরে যখন মোরগের বাগ শুনে উঠে বাড়ির
বাইরে এসে পথের দিকে চেয়ে আছে কে আসে, কখন আসে! পুব আকাশ লাল হয়ে গেছে একটু পরেই বেলা
উঠবে। রতনকে বলে দিয়েছে বেলা ওঠার আগেই দাঁতের পোকা বের করতে হবে। পথ থেকে দৃষ্টি সরছে
না। হঠাৎ চমকে উঠল কালকের ওই শারী পরে রেশমি হাতে একটা থলে নিয়ে দুই পাশের ধান ক্ষেতের
মাঝের রাস্তা দিয়ে ভোরের আলো হয়ে এদিকেই এগিয়ে আসছে। কাছে এলে দেখল মাথার এলো চুল আলতো
করে খোঁপা বাধা। গলায় মালাও নেই হাতেও চুরি নেই। এই নিরাভরণ দেহে সত্যিই ভোরের আলোর
মতই মনে হচ্ছে। জাম গাছের নিচে রতনকে দেখে রেশমি চমকে দাঁড়াল!
বাবু, আপনার ভাতিজা
কোথায় ওরে নিয়া আসেন, সময় বেশি নাই, বেলা উঠার আগেই সারতে হইব।
তুমি আসবে আমি ভাবতেও
পারিনি
দেরি কইরেন না, তাড়াতাড়ি
নিয়া আসেন
কাকে আনব? আমার কোন
ভাইই নেই তো ভাতিজা আসবে কোথা থেকে?
তাইলে যে রাইতে কইয়া
আসলেন!
বলেছি শুধু তোমাকে
দেখার জন্য
বাবা যদি মায়ের পাঠাইত
তাইলে কি করতেন?
একটা কিছু বলে দিতাম
আর সে ফিরে যেত
কামডা ভাল করেন নাই,
বাবা শুনলে রাগ করবো। একটু ভেবে, তাইলে আমি যাইগা?
যাবার জন্যেতো তোমাকে
আসতে বলিনি!
তাইলে কি করুম?
আস, এই খানে একটু
বসি। ডর নাই বাড়ির মানুষ উঠতে দেরি আছে। এতক্ষণ তোমার সাথে গল্প করি
রতন ওর হাত ধরে টেনে
এগিয়ে গেল বাংলা ঘরের পাশে খড়ের গাদার আড়ালে যাতে সামনের রাস্তা থেকে ওদের দেখা না
যায়।
বাবু, আপনে কামডা
ভুল করতেছেন, দেহেন আমরা নিচা জাতের বাইদা আমাগো কেও মানুষ বইলা মনে করে না। আমাগো
কোন ঠিক ঠিকানা নাই আমাগো সাথে এত মেলামেশা ভাল দেখায় না। আপনে আর এমন কাম কইরেন না,
আমাগো নায়েও আর যাইবেন না।
তাহলে তোমার সাথে
দেখা হবে কেমন করে?
কইলামতো আপনে এই
পথে পাও বাড়াইয়েন না। মনে যা আইছে মুইছা ফালান
বললেই কি তা হয়?
কেন হইব না? আপনে
জানেন এর ফল কি হইতে পারে? আপনের কিছু হইব না কিন্তু আমার মরণ ছাড়া কোন উপায় থাকবো
না। আমার বাবারে কেও সর্দার বইলা মানব না, বাবার মান সম্মনা থকব না
রেশমি, তুমি কি বল!
দরকার হলে আমি তোমাকে নিয়ে দূরে অনেক দূরে কোথাও চলে যাব
তাই কি হয়? আপনের
ঘর আছে ঠিকানা আছে সংসার আছে সমাজ আছে, আপনে শিক্ষিত মানুষ
আমার কি আছে কোন?
না জানি লেখা পড়া না আছে ঘর, ঠিকানা, সমাজ কিছুই নাই। খড় কুটার মত গাঙ্গের জলে ভাইসা
বেড়াই। তেলে জলে কি কোনদিন মিশ খায়?
ভয়ে রেশমির গলা শুকিয়ে
এসেছে, মুখ শুকিয়ে গেছে, দ্রুত শ্বাস নিচ্ছে, হাঁপাচ্ছে, বুক ওঠা নামা দেখে বোঝা যাচ্ছে।
কথা বলার সময় ঠোট কাঁপছিল, বাবু আমি যাই
বলেই পিছনে ঘুরে
দাঁড়াল
কি হলো কোথায় যাচ্ছ?
বলে আঁচল টেনে ধরল
নায়ে যাই
টাকা নিয়ে যাবে না?
না
তাহলে সর্দারকে কি
বলবে?
একটা কিছু কমুনে
না শোন তোমার সাথে
আবার কখন কোথায় দেখা হবে?
বসন্তের টকটকে লাল
কৃষ্ণচূড়ার ছায়া উদয় হয়ে আবার সঙ্গে সঙ্গে সমাজ নামের পাহাড়ের আড়ালে কোথায় যেন হারিয়ে
গেল। এ পাহাড় ডিঙ্গানো তার পক্ষে সম্ভব নয়। এই বসন্ত তার মত বাইদার মেয়ের জন্যে নয়।
যে পুরুষের দাতে সাপের মত বিষ আছে, যে পুরুষ কাল নাগের মত ফণা তুলতে পারে তেমন কাল
কেউটেইতো সে চেয়েছিল। তার অপেক্ষায় সে দিন গুনে জসীমকে প্রত্যাখ্যান করেছে, কিন্তু!
বাবু, আপনে আমারে বিপদে ফালাইয়েন না, আপনের পায়ে ধরি
বলে সত্যি সত্যি
রেশমি নিচু হয়ে রতনের পা ধরে বলল
বাবু আপনে এই পাগলামি
কইরেন না, আমারে রেহাই দেন
রতন রেশমির বাহু
ধরে টেনে তুলে বলল
না রেশমি আমি পাগলামি
করছি না, আমি তোমার আশায় থাকব
জীবনে এই প্রথম কোন
পুরুষের ছোঁয়া কয়েক মুহূর্তের জন্য রেশমিকে অনেক দূরের ঝর্ণা ধারার তান শুনিয়ে দিল
কিন্তু রেশমি হাত ছাড়িয়ে পিছনে ঘুরে দৌড়ের মত ছুটে পালাল
রতন ওর পথের দিকে
চেয়ে রইল। আবার দেখা পাবার সুযোগ খুঁজছিল মনে মনে। নৌকার কাছাকাছি থাকলেই হবে। সকালে
গাওয়ালে যাবার সময় কিংবা সন্ধ্যায় যখন ফিরে আসবে তখন পেতেই হবে।
৯।
প্রায় দৌড়েই নৌকায়
ফিরে এলো। নৌকার সামনের গলুইতে বাবাকে দেখে বুকের ধড়ফড়ানি বেড়ে গেল। কি বলবে বাবাকে?
এতক্ষণ কিছু ভাবেনি দৌড়ে পালিয়ে এসেছে। কাছে এসে বাবাকে দেখে আপনা আপনি গতি কমে গেল।
একটা বুদ্ধি এসেছে মাথায়!
কি রে কি হইছিল?
না বাবা রুগীরে পাই
নাই, কাইল বিকেলে মামা বাড়ি গেছেগা, ফিরা আইলে খবর দিব কইছে
ও, ঠিক আছে যা দেখ
রান্ধনের যোগার দেখ তর মায়ের জ্বর আইছে
ডিম, ডাল ভাত রান্না
করে সঙ্গীদের নিয়ে আবার বের হলো গাওয়ালে।
ওই, আইজ কুন দিকে
যাবি?
চল আইজ ওই তাল গাছ
দেহা যায় ওই দিকে যাই।
চল।
বাজারের শেষ প্রান্তে
বড় তাল গাছের নিচে দিয়ে ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের বাঁধানো রাস্তা ধরে পশ্চিমে মালচির দিকে
চলে গেল। রেশমি হাঁটছে আর সকালের ঘটে যাওয়া অপ্রত্যাশিত ঘটনার স্রোতে ভাসছে আবার কখনও
ডুবেও যাচ্ছে। জীবনের প্রথম বসন্তের স্পর্শ! ষোল বছরের রেশমির মনে ঘোর লেগে আসছে। তাদের
বহরে এই বয়সেই ফুলি দুইজনের মা হয়েছে। মাস্টার বাবুর মুখ কিছুতেই দূরে সরিয়ে দিতে পারছে
না। অন্যমনস্ক ভাবে কয়েকবার হোঁচট খেল দেখে প্রিয় বান্ধবী সুফি জিজ্ঞেস করল
কিরে আইজ তর কি হইছে
মুখে কথা নাই আবার হাঁটতে হাঁটতে উস্টা খাইলি কয়বার। ওই ছেমরি গান ধর!
রেশমির মুখে কোন
কথা নেই। স্বপ্নের ছায়া তরী মন যমুনায় ঘোরা ঘুরি করছে কিন্তু কিছুতেই কোন ঘাটে ভিড়াবার
ঠাই খুঁজে পাচ্ছে না। এ কি সম্ভব? মাস্টার বলেছে দূরে কোথাও চলে যাবে! কোথায় যাবে?
এতদিনে আশেপাশের পুরুষদের চাউনি দেখে রেশমি তার রূপের কথা বুঝতে পেরেছে কিন্তু এই রূপ
যৌবনের মোহ কয়দিন থাকবে? মোহ ফুরিয়ে গেলে! তখন সে কোথায় দাঁড়াবে?
সেদিনের মত সন্ধ্যায়
বাইদানীর দল ফিরে এসেছে। আসার পথে মাস্টারকে দেখল বাজারে চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছে।
এক পলকের জন্য চোখাচোখি হলো।
১০।
পরের দিন বিকেলের
আড্ডা বাদ দিয়ে নদীর পাড় থেকে বাজারের ও মাথা পর্যন্ত এদিক ওদিক ঘোরা ঘুরি করছিল আর
রেশমি কোন পথে ফিরে আসে দেখছিল। তাদের গ্রামে যাবার পথে না যেয়ে উত্তরে গেলে কৌড়ি যেতে
পারে, তাদের গ্রাম ছাড়িয়ে চালা, মানিক নগর, আবার ঝিটকা থেকে উত্তরে গেলে কান্দা লংকা,
ধুসুরিয়া, গালা, পশ্চিমে মালচি, বাল্লা যেতে পারে। আজ কোন দিকে গেছে? রাজার চায়ের দোকানে
দাঁড়িয়ে এক কাপ চা হাতে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছে আর পথ পাহারা দিচ্ছে। বেলা ডোবার আগে তাল
গাছের নিচে দিয়ে ঝাঁকা মাথায় ওদের আসতে দেখল। সামনে দিয়ে যাবার সময় থামিয়ে জিজ্ঞেস
করতে চাইল সর্দারকে কি বলেছে কিন্তু ভারী দল দেখে নীরব রইল। শুধু এক পলকের জন্য একটু
দৃষ্টি বিনিময় হলো।
আবার প্রতীক্ষা।
কাল সকালে স্কুলে না গিয়ে ইউনিয়ন অফিসের সামনে ঝাউ গাছের নিচে দাঁড়িয়ে রইল। আজ যেদিকেই
যাক পিছনে অনুসরণ করবে। বেলা নয়টা দশটার দিকে একে একে দলের সবাই নৌকা থেকে নেমে এসে
উত্তর দিকে যাচ্ছে। একটু দূরত্ব রেখে রতন পিছু নিল। ওরা কান্দা লংকার পথে যাচ্ছে। রতন
ঘুরে বাস স্ট্যান্ডের সামনে দিয়ে, গার্লস স্কুলের সামনে দিয়ে কান্দা লংকার পথে গরু
হাটের বট গাছের নিচে দাঁড়াল। ওরা এখনও আসেনি। হ্যাঁ ওইতো দেখা যাচ্ছে। সামনেই রেশমি।
ও বাইদানী, কি আছে
তোমাদের কাছে?
ওরা ওর সামনে এসে
থামল। রেশমি বাবুকে দূর থেকেই দেখেছে। মনের ভিতর উথাল পাথাল শুরু হয়েছে কিন্তু সামনে
এসে কাওকে কিছু বুঝতে না দিয়ে একটু হেসে জিজ্ঞেস করল
কিগো বাবু কি নিবা?
বৌর লিগা নিয়া যাও, পুতির মালা আছে, কাজল আছে, কপালের টিপ আছে
বলে মাথার ঝাঁকাটা
বট গাছের নিচে পথের পাশে নামিয়ে বাবুর সামনে মেলে ধরল। দলের ওরা সামনে এগিয়ে যেতে যেতে
বলল রেশমি তর ভাগ্য ভাল, আইতে না আইতেই কাস্টমার পাইলি। তুই বাবুরে সামলা আমরা যাই।
ওরা এগিয়ে গেল।
আপনেরা না কইছি আমার
পিছ ছাড়েন! এইহানে খারাইয়া রইছেন কেন?
কেন দাঁড়িয়ে আছি
তুমি বুঝ না?
বুঝি দেইখাইতো না
করি। এইটা সম্ভব না মাস্টার বাবু, আমরা নিচু জাতের আমাগো দিকে নজর দিতে নাই
বলেছিতো তোমাকে নিয়ে
অনেক দূরে চলে যাব কেও কিছুই জানবে না। আমাদের ঘর হবে, সংসার হবে তুমি বৌ হবে
কিন্তু
কিন্তু বলেই রেশমি
থেমে গেল। মনের মাঝ দরিয়ায় উত্তাল ঢেউ উঠেছে সে ঢেউ কিছুতেই সামাল দিতে পারছে না। মুখে
কোন কথা নেই। এমন সময় রাস্তা দিয়ে লোকজন বাজারের দিকে আসছে দেখে রেশমিকে বলল দাও দেখি
আজ কি দিবে! যন্ত্রের মত রেশমি কিছু চুরি বের করে দিল আর রতন তার দাম দিয়ে বলল কাল
আবার দেখা করব। রতন দেখল টুপ করে রেশমির চোখ দিয়ে এক ফোটা জল পড়ল।
১১।
সূর্য তার প্রতিদিনের
উদয় অস্তের সাথে রতন রেশমির সম্পর্ক গভীর থেকে গভীরতর করে প্রায় দুটি মাস কেমন করে
কোথায় নিয়ে গেছে ওদের কেও বুঝতে পারেনি। কেও কাওকে একদিন না দেখে থাকতে পারে না। নানা
রকম ফন্দি করে অন্তত একবার হলেও দেখা হতেই হবে। রেশমি তার এত দিনের সমস্ত ভয় দূরে ঠেলে
দিয়ে নির্ভয় হতে পেরেছে। স্বপ্ন দেখতে পারছে। মাস্টার বাবুর উপর আস্থা রাখা যায়, সে
ওকে ঠকাতে পারে না। মাস্টার বাবুর মত মানুষ শুধু রেশমি কেন কাওকেই ফাঁকি দিতে পারে
না। বসন্তের টকটকে লাল কৃষ্ণচূড়া এত দিনে হাতের কাছে এসে ধরা দিয়েছে।
এদিকে যেমন ধীরে
ধীরে চাঁদটা পূর্ণতা পেয়েছে, পূর্ণিমার চকচকে জোসনার আলোতে দুইজনে স্নান করছে ওদিকে
তেমনি বাজারের ঘাটের বেদের বহরের এক উঠতি বয়সের বেদেনীর সাথে রতনের মাখামাখির কথা ছড়িয়ে
গেছে। রতনের বাড়ি, স্কুল এবং বেদের বহরও বাদ পড়েনি। জনাব আলির কানেও কথাটা গেছে। স্কুলের
অন্যান্য মাস্টার, বাজার কমিটি জনাব আলিকে ডেকে ইউনিয়ন পরিষদের এক রুমে বসে সালিশ করেছে।
জনাব আলিকে তিন দিনের মধ্যে এখান থেকে তার বহর নিয়ে চলে যেতে বলেছে।
অতি আদরের মেয়ে রেশমির
সম্পর্কে এমন একটা সিদ্ধান্ত শুনে জনাব আলি হতভম্ব হয়ে গেছে, নির্বাক হয়ে গেছে। দলের
কাছে মুখ দেখাবে কেমন করে? পরিষদ থেকে বের হয়ে এসেই নদীর পাড়ে বসে ছিল। দুপুরে খেতেও
আসেনি। কি চেয়েছিল আর কি হলো তাই ভাবছে। কোন কুল কিনারা পাচ্ছে না। কারো সাথে পরামর্শ
করার নেই কারণ সে যে এই দলের সর্দার সে কার সাথে আলাপ করবে? সে নিজে সবাইকে বুদ্ধি
দেয় কিন্তু তাকে কে দিবে? সেদিনের মত শুয়ে পরল। যা হয় কাল সকালে দেখব। ঘুম আসেনা তবুও
শুয়ে থাকতে হয়। এতদিন এই ঘাটে থাকাটাই মস্ত ভুল হয়ে গেছে। এর আগে এমন কোন ঘটনা ঘটেনি
বলে এদিকটা জনাব আলির মাথায় আসেনি তাই নিশ্চিন্তায় ছিল।
রেশমি এবং রতনও সালিশের
রায় সাথে সাথেই জানতে পেরেছে। এখন কি হবে? পরদিন স্বাভাবিক ভাবে যখন রেশমি সঙ্গীদের
সাথে গাওয়ালে যাবার জন্য তৈরি হচ্ছিল তখন বাবা বলে দিল আইজ থিকা এই ঘাটে যদ্দিন আছি
তর আর গাওয়ালে যাওন লাগব না।
কেন বাবা?
জানস না কি করছস?
এত বড় সর্বনাশ কইরাও তর হুশ হয় নাই?
বাবা, ওই মালচির
কয়ডা বাড়িতে কিছু পাওনা আছে হেগুলি আইজ নিয়া আসি তারপরে আর যামু না
জানসনা আমরা বাইদার
জাত, যে কোন সময় ঘাট ছাইড়া যাওন লাগে তুই বাকি থুইয়া আইছস কেন?
ভুল হইছে বাবা, আর
থুমু না
যা, তয় ঝাঁকা নেওন
লাগব না, পাওনা যা আছে দিলে দিব না দিলে আইসা পরবি
ঝাঁকা নিয়া গেলে
কি হইবো, নিয়া যাই?
একটু ভেবে জনাব আলি
সম্মতি জানাল, আইচ্ছা যা, তাড়াতাড়ি আইবি
আচ্ছা বলে ঝাঁকা
নিয়ে রেশমি বেরিয়ে পড়ল।
ঘাটে নেমে একটু আড়ালে
যেয়ে এদিক ওদিকে দেখল, রতন যে দোকানে চা খায় ওখানে দেখল কিন্তু সে কোথাও নেই। চায়ের
দোকানের সামনে পয়াটা বেঞ্চে বসে পরল। এক কাপ চায়ের অর্ডার দিল। অনেকক্ষণ ধরে চা খেল
কিন্তু এর মধ্যেও রতনের দেখা নেই। দোকানি একটু ইয়ার্কি করল,
কি বাইদানী আইজ যে
বড় চা খাওনের ইচ্ছা হইছে?
শরীরডা ভাল না একটু
জ্বর জ্বর লাগতেছে তাই
১২।
ওদিকে রতন ঘাটে আসার
পথে দেখে বেদেনীরা আজ ওদের পথে সম্ভবত চালার দিকে যাচ্ছে কিন্তু দলের সাথে রেশমি নেই।
মুখোমুখি হলে একটু দাঁড়াল।
কিগো নাগর কারে খুঁজ?
আইজ তুমার রেশমি আসে নাই
সবাই একসাথে খিল
খিল করে হেসে উঠল
কেন? আসে নাই কেন?
ওর বাবায় অরে আইতে
দেয় নাই, আমরা কাইল এই ঘাট ছাইরা যামু তাই রেশমি আইজ পাওনা আদায়ের জন্যে মালচি গেছে
কথাটা শুনেই রতন
এক মুহূর্ত দেরি না করে হন হন করে হেটে মালচির পথে পা বাড়াল। বাজারের উত্তর দিক দিয়ে
এসে বাজারের পশ্চিম পাশের তাল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে রইল।
১৩।
অনেকক্ষণ বসে থেকে
মাস্টার বাবুর দেখা না পেয়ে মনে মনে অনেক কিছু ভাবছে কিন্তু আর কতক্ষণ বসে থাকবে? এক
সময় উঠে পড়ল। কোথায় যাবে? বাবাকে বলে এসেছে মালচি যেতে হবে। যাই একবার মালচি থেকে ঘুরে
আসি। মনে করেই উঠে এগিয়ে চলল মালচির দিকে। বাজার ছাড়িয়ে দূর থেকে তাল গাছের নিচে রতনকে
দেখে স্বস্তি পেল। কাছে এসে মাথার ঝাঁকাটা এক পাশে নামিয়ে লোকজনকে দেখাবার জন্য বোচকা
খুলে জিনিসপত্র নারা চারা করে একটা হাতে নিচ্ছে আবার সেটা নামিয়ে আর একটা দেখাচ্ছে
আর এর ফাঁকে ফাঁকে কথা বলছে।
মাস্টার বাবু সবতো
হুনছ, এখন কি করবা? বাবা আইজ থিকা আমারে গাওয়ালে আসা বন্ধ কইরা দিছে আমি বুদ্ধি কইরা
পাওনা আদায়ের কথা কইয়া বাইর হইছি। আমারে একশ টাকা দেও আগে, বাবারে দেওয়া লাগব
শোন, এটা সহজে কেও
মেনে নিবে না তাই আমি তোমাকে আগেই বলেছি আমরা দূরে কোথাও চলে যাব
কেমনে যাইবা, কোথায়
যাইবা? তুমি আমারে কিসের মধ্যে জড়াইলা মাস্টার বাবু, আমি এখন কি করুম? বাবার মুখের
দিকে দেখতে আমার ডর করতেছে। ওদিকে বাবা সবাইরে কইয়া দিছে আমরা কাইল এই ঘাট ছাইড়া চইলা
যামু
কোথায় যাবে জান?
না, কেউ জানে না,
বাবাও জানে না
চিন্তার বিষয়, কি
করা যায় বলতো, যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে। চল আমরা আজ রাতেই পালাই!
রাইতে কেমনে পলাইবা?
রাইতে তুমি বাইর হইতে পারবা কিন্তু আমি কেমনে নাও থিকা বাইর হমু?
তাহলে? বলেই রেশমির
মুখের দিকে তাকিয়ে রইল
একটু ভেবে রেশমি
বলল
একটা বুদ্ধি পাইছি,
পারবা তুমি আমারে উদ্ধার করতে? খুব কঠিন কাজ! পারবা?
কি করতে হবে বলই
না!
পলাইতে হইব দিনে
দুফুরে
দিনে? বল কি!
হ্যাঁ দিনের বেলা।
আমি যখন গোসল করতে গাঙ্গে নামুম তখন তুমি একটা নাও নিয়ে চালা যাইয়া বইসা থাকবা আর আমি
ডুব দিয়া অনেক খানি যাইয়া তারপরে সাঁতরাইয়া স্রোতের সাথে ভাটিতে চালা পর্যন্ত যাইয়া
কিনারে উঠুম। পারবা আমারে উদ্ধার করতে?
বল কি? এত দূর সাঁতরে
যাবে? পারবে? আর ডুব দিয়েই বা কতদূর যাবে?
শুনে রেশমি হো হো
করে হেসে উঠল, কি যে কও মাস্টার বাবু! আমরা বাইদা না? ডুব দিয়া আমরা গাং পার হই, পানিতে
আমাগো বসবাস আর এইটুক সাঁতরাইয়া যাইতে পারুম না? কি যে কও! তুমি আমারে উদ্ধার করতে
পারবা নাকি তাই কও
আমার ভীষণ ভয় করছে
রেশমি
কিসের ভয়?
তোমাকে এত দূর সাঁতরে
যেতে কি করে বলি? কিছু হয়ে গেলে?
কইলামতো এইডা আমাগো
জন্যে কিছুই না, আমি পারুম, তুমি পারবা নাকি তাই কও
ঠিক আছে তাহলে এই
কথাই ফাইনাল! কি বল
হয়, কাইল দুফুরে,
এখন আমারে একশ টাকা দিয়া তুমি বাড়ি যাও।
ছবিঃ রেশমি।
ছবিঃ রেশমি।
১৪।
পরদিন বাড়ি থেকে
টাকা পয়সা যা কাছে আছে পকেটে নিয়ে সকাল সকাল নাস্তা খেয়ে রতন মালচির পথে রওয়ানা হলো।
ওখান থেকে নৌকা ভাড়া করতে হবে। ঝিটকা থেকে কোন নৌকা নেয়া যাবে না, এখানকার মাঝিরা সবাই
চেনা। মালচি এসে বাজার থেকে একটা শারী, পেটিকোট, ব্লাউজ, গামছা আর এক জোড়া স্যান্ডেল
কিনে জিজ্ঞেস করে দূর এলাকার মাঝি দেখে হরিরামপুর যাবার জন্য একটা নৌকা ভাড়া করল। রেশমির
কথামত ঝিটকা বাজার এবং বেদেদের বহর পার হওয়া পর্যন্ত ছৈয়ের ভিতরে বসে রইল। রেশমি কি
ওর প্ল্যান মত ডুব দিতে পেরেছে? সাঁতরে অত দূরে যেতে পারবেতো? ভয়ে চিন্তায় রতন ঘামছে।
ওদের পার হয়ে বেশ কিছুটা দূরে এসে নিরাপদ মনে করে ছৈয়ের বাইরে বসে নদীর দিকে চোখ রেখে
এগুচ্ছে। চালার কাছে এসে দেখে সত্যিই এক মেয়ে ভাদ্র মাসের ভরা গাঙ্গের মাঝ গাং দিয়ে
সাঁতরে সামনে যাচ্ছে। মাঝিকে ইশারা করে ওই মেয়ের কাছে যেতে বলল। মাঝি মেয়েটার কাছে
যেতেই দেখল রেশমি। নৌকায় তুলে একটু শান্ত হলে গামছা এবং সদ্য কেনা কাপড়ের প্যাকেট এগিয়ে
দিল।
উহ্! আমি যে কি দুশ্চিন্তায়
ছিলাম, কি ভয়েই ছিলাম তুমি আসতে পারবে কি না!
এখন কোথায় যাইবা?
আগে হরিরামপুর তারপর
ওখান থেকে সোজা ঢাকা।
দুইজনেই চুপচাপ।
কারও মুখে কোন কথা নেই। ঘণ্টা খানিক পরে নৌকা হরিরামপুর ঘাটে এসে ভিড়ল। নৌকার ভাড়া
মিটিয়ে দিয়ে দুইজনে বাস স্ট্যান্ডে এসে ঢাকা গামী বাসে উঠে পিছনের দিকে সুবিধাজনক সীট
নিয়ে বসার অল্প পরেই ওদের নিয়ে বাস ছুটে চলল ঢাকার পথে।
so many thank for this...
ReplyDeleteShihab
Shihab