Tuesday 15 July 2014

চোরাবালি


ছবিঃ ফুলকপি ক্ষেত/লেখক

 কএই কুত্তার বাচ্চা আর কতক্ষণ বিছানায় থাকবি? রাইতে ঘুম হয় না? রাইত ভইরা কি চুরি করছ? তোর গুষ্টির পিণ্ডির যোগারে যাবি না? যা ওঠ! সকাল বেলা মেঝ ভাবির কণ্ঠে এই সুমধুর বানী শুনে ঘুম ভেঙ্গে গেল স্বপনের! কাকে বলছে? নিশ্চয় তার স্বামী দেবতা মেঝ ভাইকেই বলছে! ওপাশে আবার মেঝ ভাবির সাথে যোগ দিয়েছে তার গরুটা, সেই ভোর থেকেই হাম্বা হাম্বা শুরু
করেছে। করবে না কেন। গরুটা দুইয়ে বাছুরটাকে একটু দুধ খেতে দিলেই হয় শত হলেও ওরইতো প্রাপ্য! না, তা করবে না।  দোয়ানো হয়ে গেলে বাছুরটাকে দূরে বেধে ঘাস খাওয়াবে। আহা অতটুক বাছুর! মা কি আর তাই মেনে নিতে চায়? পশু বলে কি মায়া দয়া কিছুই নেই? বেশ কিছুদিন থেকেই শুরু হয়েছে এমন ধারা। আগে এরকম ছিল না। বাবার জমি যতদিন বিক্রি করতে পেরেছে ততদিন বেশ সুখেই কেটেছে। এমন হতে শুরু করেছে যখন বিক্রি করার মত আর কোন জমি নেই, অভাব এসে  চতুর্দিক থেকে ঘিরে ধরেছে তখন থেকে। লেখাপড়ায় অষ্ট কলা, স্কুলের গণ্ডিও পার হতে পারেনি। কোথায় পাবে সাহেব গিরি করার মত চাকরি? গায়ে গতরে দেখতে কামলা দেয়ার মত হলে কি হবে সে মুরোদও নেই। ওদিকে আবার চাচাত বোনের শ্বশুর বাড়ি বেড়াতে গিয়ে সেখান থেকে কেমন করে যেন এই চিজ ধরে নিয়ে এসেছে। মাত্র দুই দিনের পরিচয়ে যে মেয়ে মায়ের বাড়ি ছেড়ে অচেনা এক ছেলের হাত ধরে চলে আসতে পারে তার কাছে আর কতটুকই বা আশা করা যায়?
 
চার ভাই চার বোনের সংসার, মা আছে বাবা নেই। বাবা হামিদ খান হঠাৎ করেই এক দুর্ঘটনায় মারা গেল। ঝিটকা বাজারের দোকানের মালামাল কেনার জন্য ঢাকার মৌলবি বাজারে যাতায়াত সেই অনেক দিনের। কেনা কাটা করে লঞ্চে  মালামাল বুকিং দিয়ে বাসে করে চলে আসে। সেদিন বাড়িতে ফিরে আসার পথেই বানিয়া জুরি বাস স্ট্যান্ডের কাছে সড়ক দুর্ঘটনায় বাবা মারা গেল। মা এত দিন সংসারের কিছুই খোজ খবর নেয়নি, কিছুই জানে না। বড় মেয়ে বিয়ে হয়েছে বেশ অনেকদিন, বছর খানিক আগে মেঝ মেয়েরও বিয়ে হয়েছে তারা তাদের মত ভালই আছে। বড় ছেলেটা কলেজের গণ্ডি এবং মেঝ ছেলে স্কুল শেষ করতে পারল না। বাবা মারা যাবার পর সবাই পরামর্শ দিল বাবার দোকানে বসার জন্য কিন্তু সাহেবদের বাবুগিরি করার মত উপায় হবে না তাতে তাই দোকান ভাড়া দিয়ে দিল। এখন সংসার চলবে কি দিয়ে? জমিজমা বেশ ছিল, প্রায় পঞ্চাশ বিঘা। এই জমি দিয়েই হেসে খেলে দিব্যি চলে যায় এমন সংসার। কিন্তু এতদিন মা ছিল  অতিথির মত, বাবাই দোকান জমি সব সামাল দিত।  কিছুদিন যাবার পর বড় ছেলের একটা চাকরি হলো। কিন্তু চাকরি হবার সাথেই কি আর বেতন দেয়? মাস পূর্তি না হলে যে বেতন মিলে না। চলবে কি দিয়ে? সহজ উপায় একটা আছে, বাড়ি এসে এক বিঘা জমি বিক্রি করে কিছু মাকে দিয়ে গেল আর বাকিটা নিয়ে বড় সাহেব তার কর্মস্থানে চলে গেল। শুধু মাস চলা নয় বৌয়ের চাহিদা অনুযায়ী রঙ্গিন টিভি, স্টিলের আলমারি, ঘরের অন্যান্য ফার্নিচার এগুলিও বাবার জমি বিক্রির টাকা দিয়ে মোটামুটি নির্ঝঞ্ঝাটেই চলছে। যাবার সময় মায়ের হাতে দুই এক হাজার টাকা দিয়ে গেলেই মা খুশি। টাকা কোথায় পেল সে কথা জিজ্ঞেস করার কি প্রয়োজন! গ্রামের মানুষ দশ হাজার টাকার জমি ছয় হাজারে পেলে এমনি করেই কিনে। তারা যে হামিদ খানের জমি কেনার জন্য উন্মুখ হয়ে বসে আছে! যারা কিনে তারা সবাই এলাকারই লোকজন। সবাই জানে এই ছেলে হামিদ খানের জমির বেশ কিছু অংশ পাবে কাজেই ভয় নেই এক সময় রেজিস্ট্রি করে দিলেই হলো। এক ভাই বিক্রি করে তার অন্য ভাইয়েরা কেউ কিছু জানতেও পারে না। হরিরামপুরে রেজিস্ট্রি অফিসে যেয়ে সব ভাইকে একসাথে  রেজিস্ট্রি করে দিয়ে আসতে হবে এমন কোন দরকার নেই। যার যখন প্রয়োজন হয় বা টাকার দরকার হয় তখন যার যার মত খরিদ্দার ঠিক করে রেজিস্ট্রি করে দিয়ে আসলেই হলো। কে কতটা পাবে বা অন্য ভাই বোনেরা কে কতটা পাবে তা দেখার প্রয়োজন নেই। আমার এখন টাকার দরকার আমি বিক্রি করলেই হলো। শেষ অবধি যদি কিছু থাকে তখন দেখা যাবে কে কতটা পায়। আমারটা হিসেব করে বাদ দিয়ে দিলেই হবে। এভাবেই চলছে। বড় জন সেলিম চাকরি করে, সরকারি চাকরি তবুও তার অভাব লেগেই থাকে। মেঝ জন সংসার দেখাশুনা করে। জমি বিক্রি করে আনে আর সংসার চালায়। মা কোনদিন জিজ্ঞেস করেনি হ্যাঁরে মাজেদ টাকা কোথায় পেয়েছিস বা চাল কিনে আনলি কি দিয়ে? ওদিকে সেঝ জন মানিক পাশের বিজয়নগর বাজারে ওষুধের দোকান করে। সন্ধ্যার পরে বাজারে এক কোণায় কয়েকজন মিলে নতুন করে আমোদ প্রমোদের ব্যবস্থা করে নিয়েছে সেখানে জুয়া খেলা হয়। মানিক  তাদের সবার সাথে সংগ না দিলে তার মান থাকে না বলে ওই আড্ডায় নিয়মিত বসে এবং প্রতিদিনই হেরে আসে। এতে করে দোকানের চালান পত্রে টান পরছে এখন কি করে? বন্ধু স্বজনেরা বুদ্ধি দিল আরে তোর বড় ভাই মেঝ ভাই জমি বিক্রি করে শেষ করে দিল আর তুই দোকানের চালানের জন্য ভাবছিস? চল তোকে একটা জাঁদরেল কাস্টমার যোগার করে দিচ্ছি জমি বিক্রি করে দোকানে কিছু মাল উঠাবি আর বাকিটা দিয়ে সন্ধ্যার আসর চালাবি। এই করে করে স্বপনের এবং চার বোনের যে অংশ ছিল তার তলায় এসে পৌঁছেছে। স্বপন সবার ছোট। বড় ভাইদের এই কীর্তি কাহিনী কিছুই বুঝতে বা জানতে পারেনি। ছোট দুই বোন বড় বোনেদের কাছে থাকে বলে বোনেরাও  কেউ কিছু জানতে বুঝতে পারেনি।
স্বপন একটু বড় হলে যখন এতদিনের চেনা নিজেদের জমিতে অন্যদের চাষ করতে এবং ফসল তুলতে দেখল তখন একদিন মেঝ ভাইকে জিজ্ঞেস করল আচ্ছা ভাইয়া ওই জমিটাতো দেখেছি আমাদের ছিল তাহলে ও পাড়ার হাবুলরা কেন চাষ দিল আর ফসলই বা কেন কেটে নিয়ে গেল?
তুই ছোট মানুষ এগুলি বুঝবি না, তোর মাথা ঘামাবার দরকার নেই
বারে, এ আবার কেমন কথা! আমাদের জমির ধান কেটে নিয়ে যাবে আর এ কথা আমার জানার দরকার নেই কেন?
স্বপন এই প্রশ্নের কোন জবাব কোনদিন পায়নি।
দিন থেমে থাকে না। ছয় ঋতুর এই দেশে শীত গ্রীষ্ম বর্ষা তাদের নির্ধারিত নিয়মে অনেকগুলি বছর নিয়ে চলে গেছে আর সাথে সাথে স্বপনও বড় হয়ে উঠেছে। স্বপনের এখন বিয়ে করে সংসার করার সময় হয়েছে। এর মধ্যে দুই এক জন নিকট আত্মীয় ভাইদের সবাইকে ডেকে পারিবারিক ভাগ বাটোয়ারা করে দিয়েছে। একান্নবর্তী থাকা কালীন বড় ভাইয়েরা যারা কোন রোজগার না করে শুধু বাবার  জমি বিক্রি করে সংসার চালিয়েছে এবং যার যার বৌয়ের সাধ মিটিয়েছে হিসেব করে তাদের হিসাব বাদ দিয়ে বর্তমানে অবশিষ্ট যে পরিমাণ জমি আছে তাই হিসেব করে দেখা গেল বড়রা জমি বিক্রি করার পর তাদের ভাগে আর কোন জমি নেই কেও তার প্রাপ্যের বেশিই বিক্রি করে ফেলেছে। এখন যতটা রয়েছে তা স্বপনের, বোনদের আর মায়ের অংশ। বাড়িটা ভাগাভাগি না হলেও মোটামুটি একটা নির্দেশনা দিয়ে দেয়া হলো যে তোমরা ওখানে ঘর তুলে বসবাস করতে পার। বড়দের চূড়ান্ত ভাবে বলে দেয়া হলো যে তোমরা আর কোন জমি বিক্রি করতে পারবে না। বাজারে যে দোকান আছে সেটা নিয়ে এখন আর কিছু হলো না তবে ওটার ভাড়া বাবদ যে টাকা আসবে সে টাকা মা পাবে এই ভাবে সিদ্ধান্ত হলো। একটা সাদা কাগজে এই মর্মে সর্ব সম্মতিক্রমে যা যা সিদ্ধান্ত হয়েছে উপস্থিত সবার সই স্বাক্ষর নিয়ে লিখে রাখা হলো যেন শ্রীমান সেলিম, মাজেদ এবং মানিক ভবিষ্যতে আর কোন জমি বিক্রির সুযোগ না পায়। অবশ্য এ বিষয়ে আইনগত আর কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। নিতান্ত পারিবারিক সমস্যা মনে করে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার প্রয়োজন মনে করেনি।
চোরা নাহি শোনে ধর্মের কাহিনী। স্বপনের বড় ভাইয়েরাও তেমনি করে সেদিন সই স্বাক্ষর দিয়ে আসলেও দুই এক বছর যেতে না যেতেই আবার সবার অগোচরে কাউকে না জানিয়ে যারা জমি কিনে তাদের সাথে গোপন আঁতাত করে কিছু জমি বিক্রি করতে শুরু করল। এর মধ্যে মেঝ সাহেব মানিকগঞ্জের পাশে চাচাত বোনের বাড়ি বেড়াতে গিয়ে একজন ডানাকাটা পরী ধরে এনেছে। পরীর নানা চাহিদা মেটাতে গিয়ে শ্রীমান মাজেদ বুঝতে পেরেছে যে জমি বিক্রি করে ভবিষ্যৎ চলবে না কারণ আর তেমন কিছু অবশিষ্ট নেই। এই ভেবে এবং পরীর পরামর্শে বিদেশে যাবার একটা যোগাযোগ পেয়ে আবার আসল জমি বিক্রি করতে কিন্তু তার প্রাপ্য আর কোন জমি না থাকায় স্বপনকে বলল তুই আমাকে মালয়েশিয়া যাবার জন্য হাজার পঞ্চাশেক টাকা ধার দে আমি ওটা বাজারের দোকানের অংশ থেকে ব্যবস্থা করে দিব। সরল স্বপন ভাইয়ের এই দুরবস্থার কথা ভেবে রাজি হয়ে ধার কর্জ করে ভাইকে টাকার ব্যবস্থা করে দিল। কিন্তু ওদিকে মাজেদ যাবার আগে গ্রামের একজনের কাছে গোপনে কিছু জমি বিক্রি করে টাকা নিয়ে পরীর হাতে দিয়ে গেল। স্বপন এর কিছুই জানতে পারল না। মাজেদ মালয়েশিয়া চলে গেল।  মাসে মাসে টাকা পাঠায় আর সে টাকা দিয়ে পরী মনের সুখে সংসার চালায়। ঢাকায় খালার বাড়ি গিয়ে রঙ্গিন টেলিভিশন, গয়না, সুন্দর সুন্দর শারী কিনে আনে।
মাজেদ চলে যাবার পর মানিক বেশ পসার জমিয়ে ফেলেছিল। আশেপাশের রুগীদের প্রেশার মেপে দেয়া, স্যালাইন দেয়া, ইঞ্জেকশন দেয়া এবং সাধারণ কিছু ডাইরিয়া আর জ্বর জারির চিকিৎসায় বেশ হাত পাকিয়ে ফেলেছিল কিন্তু এই পসারের সাথে আর এক দিকেও বেশ পসার জমিয়ে নিয়েছিল। জুয়ার আসরে হাজিরা দেয়া আগে থেকেই নিয়মিত ছিল, এর সাথে আবার নতুন করে যোগ হয়েছে বিজয় নগর বাজারের পাশে শেখ বোরহানের বিধবা মেয়ে ময়নার সাথে মন দেয়া নেয়ার খেলা। ঘরে স্ত্রী সন্তান রেখে ময়নার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। কোন কোন রাতে বাড়িতেও আসে না। ময়নার সাথে অভিসার সেরে অত রাতে বাড়িতে পুরনো হয়ে যাওয়া মর্জিনা আর কাছে আসার কোন আগ্রহ তৈরি করতে পারে না বলে দোকানেই থেকে যায়। নিরীহ মর্জিনা  যন্ত্রণায় অস্থির। কাওকে বলতেও পারছে না আবার নিজের মধ্যে চেপেও রাখতে পারছে না। কিন্তু সে না বললে কি হবে, বিষয়টা বিজয় নগর এলাকায় রাষ্ট্র হয়ে গেছে। এমন অবস্থায় ভেবে ভেবে শরীর মন দুইই যখন দুর্বল হয়ে গেছে যখন এই অবস্থা জটিল থেকে আরও জটিলের দিকে গড়াচ্ছে তখন আর কোন কুল কিনারা না পেয়ে লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে মায়ের বাড়িতে যেয়ে মাকে জানিয়ে আসল। মা বলল তোর শাশুড়ি জানে?
সবাই যখন জেনে গেছে তখন সে জানে না এ কথা কি করে বলি?
তুই নিজে তাকে বলে দেখ কি হয়
বলে দেখব কিন্তু কোন লাভ হবে বলে মনে হয় না। ছেলেরা কি মায়ের কোন কথার দাম দেয়? এই যে যার যার ইচ্ছা মত জমিগুলি বিক্রি করে ফেলল তাতে কি মা কোনদিন কিছু বলেছে? কিছুই বলেনি। কাজেই তাকে বললে কিছু হবে না।
তাহলে তোর বড় ননাসকে বল, দেখ সে কি করে।
বড় দুলাভাইকে জানালে সে এসে মানিককে তাৎক্ষণিক ভাবে দোকান বিক্রি করে পরিবার সহ ঢাকায় যেয়ে তার পরিচিত শহিদ সাহেবের গার্মেন্টসে চাকরি নেয়ার জন্য বলল। তুই ওখানে যা আমি শহিদকে বলে দিব, যে করেই হোক একটা ব্যবস্থা করে দিবে। সে আবার শুধু পরামর্শ দিয়েই ব্যাপারটা শেষ করেনি। রীতিমত বিজয়নগর বাজারে গিয়ে বাজার কমিটি এবং ওখানকার গণ্যমান্য লোকদের সাথে আলাপ করে বিস্তারিত জানিয়ে এসেছে। তাদের সাথে আলাপের সময় ময়নার বাবা শেখ বোরহানকেও ডেকেছিল। 
মাস বছর চলে গেল। দেখতে দেখতে দুই বছর পর ফিরে এসে মাজেদ দেখল তার ঘরে রঙ্গিন টিভি সহ কিছু ফার্নিচার আর তার পরীর গায়ে কিছু অলংকার হয়েছে এ ছাড়া আর কিছুই নেই। কি করবে এখন? ডানা কাটা পরীর সাথে অনেক বাক বিতণ্ডা হলো কিন্তু ফলাফল যা হবার তাই হলো। চ্যাঁচামেচি, ঝগড়াঝাঁটি, গালাগালি এবং মারামারি নিত্য দিনের সঙ্গী হলো।
মাজেদ কি করবে কি করবে ভাবতে ভাবতে স্থানীয় চেয়ারম্যান চাচাত ভাই কালামের সাথে পরামর্শ করল।
আরে তুই এত ভাবছিস কেন, আমি আছি না? আমারতো একজন এসিসট্যান্ট দরকার তুই এখন থেকে আমার সাথেই থাকবি! সেই থেকেই সর্বক্ষণের সঙ্গী হয়ে গেল। গম বিক্রি করা থেকে সালিস দরবার করা এবং নানা কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে গেল। রাতে বাড়ি ফেরার পথে বা শনিবার ঝিটকার হাটের দিন যা হাতে দিয়ে দেয় এই সম্বল করে ভাইয়ের সর্বক্ষণের সঙ্গী হয়ে থাকল। চেয়ারম্যান সাহেব কি করতে চাইছে তা মাজেদকে জানিয়ে দেয় আর মাজেদ সম্ভব হলে তার চেয়ে একটু বেশি করে ফেলে। অন্তত কালাম ভাই যতদিন চেয়ারম্যান আছে তত দিনের জন্য একটা গতি হলো।
ওদিকে বড় শ্রীমান সেলিম আগের মতই গোপনে গোপনে জমি বিক্রি করা বন্ধ করতে পারল না। আজ বৌয়ের শারী, কাল গয়না, পরশু এটা সেটার দাবী মেটাতে তার আর কোন পথ খোলা নেই।
ছবিঃ স্বপনের চোরাবালি/ লেখক

স্বপন এসবের কিছুই জানতে পারেনি। স্বপন জানে তার ভাগে যে পরিমাণ জমি আছে তাতে সেগুলি চাষ করে তার চলে যাবে। এই ভাবনা ভেবে স্বপন বিয়ে করে একটা বৌ নিয়ে এলো। না, এ বিয়ে মাজেদের মত নয়। বাড়ির মা বোনদের দেখে শুনে আনা বৌ। ঢাকার কাছেই শিঙ্গাইর গ্রামে বাপের বাড়ি। শিক্ষিত মেয়ে, সাহানা। বাপের বাড়ি থেকে বিএ পাশ করেই এসেছে। বৌ স্বপনের ঘরে এসেই দেখতে পেয়েছে বাড়ির অবস্থা স্বাভাবিক অন্যান্য বাড়ির মত নয় বিশেষ করে তাদের বাড়ির মততো নয়ই। তার বাবা একজন সফল কৃষক। ওখানে ধান পাটের সাথে নানা রকম শাক সবজি এমনকি পোলাওর ধান পর্যন্ত চাষ করে। ছোট বেলা থেকেই বাবাকে দেখে দেখে অনেক কিছু শিখেছে। সারা দিন কাজ কর্মের ব্যস্ততা সেরে রাতে শোবার পর  মাথায় এসে নানা চিন্তা ভিড় করে। স্বামীর এই অবস্থা দেখে ভাবনার দুয়ার খুলে গেল। কি করা যায়? ভাইয়েরা যে সব জমি বিক্রি করে ফেলেছে সেগুলি উদ্ধারের কোন উপায় নেই। এখন চলতেও হবে, বাচতেও হবে আবার ভবিষ্যতের একটা উপায়ও করতে হবে। কয়েকদিন যাবার পর একদিন রাতে খাবার পর শোবার আগে স্বপনকে মধুর সুরে বলল
কিছু আলাপ করতে চাইছিলাম
কি আলাপ? কাল সকালে করলে হয় না? ভীষণ ঘুম পাচ্ছে
না সকালের আলাপ নয়, এ আলাপ একান্তে করার আলাপ
এমন কি আলাপ, বল শুনি
কয়েকদিন থেকেই ভাবছি এভাবে কত দিন চলবে তাই আমি একটা ভাবনা ভেবেছি
কি ভাবনা বল
তুমি সেদিন বলছিলে দক্ষিণ দিকের ওই জমি নিয়ে একটা প্রজেক্ট করবে, তাহলে করছ না কেন?
এত দিন করিনি কিন্তু এখন তুমি এসেছ এখন করব। আসলে এত টাকা পাব কোথায়?
তাহলে দেরি না করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শুরু কর।  জমি যেখানে যা আছে সেগুলি বর্গা দিয়ে দাও আর একটা মেশিন কিনে এখানে বাড়ির দক্ষিণে ইরির প্রজেক্ট কর, টাকার ব্যবস্থা আমি করছি। এদিকে যাদের জমি আছে তাদের সাথে আজই আলাপ কর। বাড়ির সাথে আমাদের যে জমি আছে ওখানে ভাল সবজি হবে, অঘ্রাণ মাস থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত সবজি করা যাবে। শীত আসার আগে আমি এর ব্যবস্থা করে ফেলব
মেশিন কেনার টাকা কোথায় পাব?
বললামতো আমি ব্যবস্থা করব
তুমি কি করে ব্যবস্থা করবে?
করব, দরকার হলে বাবার আছ থেকে আনব
দেখ যা ভাল মনে কর, এখন চল শুয়ে পরি।
চল
সকালে ঘুম ভাঙলে সাহানা তাড়াতাড়ি নাশতা বানিয়ে স্বামীকে খাইয়ে দিয়ে বলল এখনই যাও তুমি ওদের সাথে আলাপ কর।
যাই দেখি কি বলে
দুপুরের মধ্যে ফিরে এসে সাহানাকে জানাল, সবাইকে পায়নি তবে যাদের সাথে আলাপ হয়েছে তারা মোটামুটি ইতি বাচক জবাব দিয়েছে। যারা বাকি আছে তাদের সাথে সন্ধ্যার পর আলাপ করে সবাইকে নিয়ে একটা মিটিং করে ব্যবস্থা নেয়া যাবে। কয়েকদিনের মধ্যেই মিটিং করে সিদ্ধান্ত হলো স্বপন পানি দিবে এবং এজন্যে ফসলের তিন ভাগের এক ভাগ সে পাবে। জমি থেকেই ভাগের কাজটা করে নিবে। টিউব ওয়েলটা স্বপনের বাড়ির দক্ষিণ পাশে আম গাছের নিচে পোতা হবে ওখান থেকেই নালা কেটে সব জমিতে পৌঁছে দেয়া হবে। অঘ্রাণ মাসে বর্ষার পানি সরে গেলে নালা কাটার ব্যবস্থা হবে। চৈত্র মাসের মধ্যেই মেশিন কেনা, মেশিনের জন্য একটা চালা ঘর করা এগুলি সেরে ফেলবে। আপাতত এই হোক পরের ব্যবস্থা পরে হবে। ফলপ্রসূ আলাপে সাহানার প্রথম পরিকল্পনা কার্যকর হতে যাচ্ছে বুঝতে পেরে মনে মনে উল্লাসিত হলো এবং রাতের বেলা সে উল্লাসের ঢেউ তার স্বামীর দেহে মনেও ছড়িয়ে দিল।
ভোরে দুইজনেই চোখে মুখে আনন্দের একটা ঝিলিক আর স্বপ্নের ছায়া নিয়ে ঘুম ভেঙ্গে উঠে এক সাথে রান্না ঘরে বসে রুটি আর ডিম ভাজি দিয়ে নাশতা খেয়ে দুইজনে মিলে পুকুর পাড়ে যেখানে শীতকালীন শাক সবজির চাড়া ফলাবে সে জায়গা ঠিক করে আগাছা পরিষ্কার করে কুপিয়ে বীজ বোনার উপযুক্ত করল। সন্ধ্যায় সাহানা বলল
আমি কাল সকালে শিঙ্গাইর যাব
কেন, হঠাৎ করে আবার শিঙ্গাইর কেন?
কেন আবার, বীজ আনতে হবে না? বাবার কাছ থেকে কিছু ভাল জাতের ফুলকপি, টমাটো, ঢ্যাঁড়স আর কাচা মরিচের বীজ নিয়ে আসি
ভাল কথা বলেছ।
বাবার বাড়ি থেকে উন্নত জাতের বীজ এনে বাড়ির সামনে পিছনে স্বপনের দখলে থাকা মাত্র চার বিঘা জমিতে ওই সব  চাড়া বুনে নিয়মিত ভাবে দুইজনে মিলে ভাল যত্ন করে। সময়মত সেচ দেয়া, উপযুক্ত সার দেয়া, কীট নাশক স্প্রে করার কাজ সাহানা নিজেই করে স্বামী স্বপন শুধু তার সাথে থেকে তাকে জোগান দেয়। দেখতে দেখতে আশাতীত ফলন হলো এবং তা স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে বেশ লাভ হলো। পাশাপাশি ইরির প্রজেক্ট থেকেও ভাল ফলন পাওয়া গেল। সাহানা নিজেই পাম্প চালান থেকে শুরু করে সমস্ত প্রজেক্ট ঘুরে ঘুরে কোন জমিতে কখন পানি দিতে হবে তা সে নিজেই নিয়ন্ত্রণ করে বেশ মনের মত ফল পেল। পুকুরের জন্যে শিঙ্গাইর থেকে মাছের পোনা এনে আশ্বিন মাসে ছেড়েছিল সেগুলাও এখন বেশ বড় হয়েছে। নিজেদের খাবারতো চলেই কিছু বিক্রিও করা যায়। এ ছাড়া এত বড় বাড়িতে রান্না ঘরের পাশে একটা দোতলা মুরগির খোপ বানিয়ে তাতে উপরে মুরগি আর নিচে হাস পেলে বাড়ির ডিম মাংসের যোগানতো আগে থেকেই করেছে।  আর এই সাথে সারা গ্রামে সোর পরে গেল যে, স্বপন একটা বৌ এনেছে! সবার মুখে মুখে এই এক কথা। স্বপনের সংসারে সুখের কোন অভাব নেই। স্বপন বাড়ির সামনে দক্ষিণের পুকুর পাড়ে বড় বকুল গাছের নিচে বসে সামনে সবজি ক্ষেতের দিকে তাকিয়ে থাকে আর ভাবে সংসার সুখের হয় রমণীর গুনে।
সাহানা এবার নজর দিল স্বামীর  ভাগের জমিগুলি যেগুলি বড় ভাইয়েরা বাগি দিয়ে দিয়েছে সেগুলি নিজেদের আওতায় এনে চাষ করার জন্য।  সাহানার নিয়ম অনুযায়ী রাতে স্বামীকে আনন্দ দিয়ে নিজে কিছু পেয়ে সকালে উঠে স্বামীকে পাঠিয়ে দেয় নতুন কাজে। তেমনি একদিন সকালে ভোরে তোলা ফুলকপি ভাজি আর ডিম ভাজি দিয়ে রুটি খেয়ে স্বপন চলল জমিগুলির বাগির ভাগ ছাড়িয়ে আনতে? কিন্তু দিনান্তে যে সংবাদ জেনে আসল তা মোটেও সুখের কোন  সংবাদ নয়। বড় ভাইয়েরা বিশেষ করে সেলিম এবং মাজেদ এর মধ্যে সব বিক্রি করে ফেলেছে। এটা কেমন করে করল? কিছুতেই স্বপন ভেবে পাচ্ছে না এমন হলো কি করে? এই কাজ কখন করল? বড় দুলাভাই যে নিষেধ করে দিয়েছিল! তাহলে তাকে অমান্য করেই করেছে এগুলি? সঙ্গে সঙ্গে বাড়ি ফিরে এসে সাহানার সাথে পরামর্শ করে ঢাকায় মেঝ দুলাভাই, বড় দুলাভাইকে মোবাইলে জানাল। বড় দুলাভাই বলল আচ্ছা ভেবে দেখি কি করা যায়। দুই দিন পরে স্বপন আবার দুলাভাইকে জিজ্ঞেস করল
কি করবেন?
এক কাজ কর সামনের শুক্রবারে আমি আসছি তুই ওখানে তাহের, হানিফ, জলিল, বাদল এদেরকে বলে রাখ ওরা যেন নামাজের পরে থাকে আর তাহেরকে বলবি সেলিম, মাজেদ, মানিক দের বলতে যাতে ওরাও উপস্থিত থাকে, ওরা যেন অবশ্যই থাকে ওরা না থাকলে কিন্তু কোন সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে না। আর শোন, কালাম চেয়ারম্যানকেও বলবি।
ওদিকে সাহানাও তার বাবাকে জানাল সালিশের দিনে যেন সে এখানে আসে।
শুক্রবারে নামাজের আগেই বড় আর মেঝ দুলাভাই সহ সব বোনেরাও আসল। নামাজের পরে সাহানার খোপের মুরগির মাংস, পুকুরের মাছ, ক্ষেতের সবজি দিয়ে ভাত খেয়ে ওই বকুল গাছের নিচে পাতা মাদুরে বসে অপেক্ষা করছে কখন সবাই আসবে। একে একে গ্রামের যাদের বলা হয়েছিল তারা প্রায় সবাই এলো। বাড়িতে খোজ নিয়ে দেখা গেল মেঝ ভাই বাড়িতে নেই। বড় ভাই, সেঝ ভাই এবং চেয়ারম্যানের দেখাও নেই। মোবাইলে কথা বলার চেষ্টা হলো কিন্তু কেও ফোন ধরছে না। তাহেরকে জিজ্ঞেস করল
তুমি কি ওদের জানিয়েছ?
হ্যাঁ আমি সেদিনই জানিয়েছি আবার গতকালও মনে করিয়ে দিয়েছি
কি বলেছিল?
বলেছিলতো আসবে
এমন সময় হারুন আসল। কি, ওরা কেও আসেনি?
তাহের বলল এলেতো দেখতেই
ওরা আসবে না
কে বলল আসবে না?
সেদিন আমি মাজেদের সাথে এ নিয়ে আলাপ করছিলাম ও তখন বলল
স্বপন যদি জমি পায় তাহলে ওকে নিতে বল
কি করে নিবে? তোমরাতো সব বিক্রি করে দিয়েছ
বেশ তাই যদি হয় তাহলে আদালতে যেতে বল
আদালত তোদের তিন ভাইকে জেলে দিবে, তখন কি করবি?
জেলে দিবে কি করে, হিসেব অনুযায়ী আমরা আরও পাব
পাবি কেমন করে, তোদের কি আর কোন জমি আছে?
কেন, বাড়িটা আছে না? দোকান আছে না?
শুনে সবাই স্তম্ভিত হয়ে নীরব হয়ে রইল।  বাড়ির দক্ষিণে যেখানে তাদের জমির আল দিয়ে হেটে আসতে কয়েক ঘণ্টা লেগে যেত সেখানে আজ স্বপনের কোন দাবী নেই। বড় ভাইয়েরা সব বিক্রি করে দিয়েছে। যে জমির আশায় দিন গুনছে, অপেক্ষা করছে কখন চাষ দিয়ে ফসল ফলাবে। সাহানার জানা আধুনিক চাষ পদ্ধতি প্রয়োগ করবে সে জমি এখন তার কাছে চোরাবালি! অনেকক্ষণ ওই চোরাবালির দিকে তাকিয়ে থেকে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। কাছেই নারকেল গাছের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়ান সাহানা স্বামীর এই অবস্থা দেখে কাছে যেয়ে ইশারা করে ভিতরে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল
এত চিন্তা করছ কেন? এই বুকে তোমার জায়গা হবে না? মাথা গোজার এই বাড়িটাতো আছে। যেভাবে চলছে, যা আছে এভাবেই আমাদের চলে যাবে, দরকার হলে আমি মাস্টারি করব।

No comments:

Post a Comment

Thank you very much for your comments.