পরীক্ষা
শেষ হলেই গ্রামে যাব বলে আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলাম। ওখানে শরিফ চাচা, চাচাত ভাই
কায়েস আর মোল্লা আছে তাদের সাথে জমানো আড্ডা হবে, টো টো করে ঘোরাঘুরি হবে, মুরগী চুরি
করে চড়ুইভাতি হবে। আরও কি হবে আগেই বলতে পারছি
না। শরিফ চাচা আগেই বলে দিয়েছিল পরীক্ষা শেষ
হবার সাথে সাথেই যেন চলে যাই।
কিন্তু সমস্যা হলো এই সময়ে আমার বাবা গ্রামে যাবার মত
কোন সঙ্গত কারণ খুঁজে পাচ্ছিলেন না। পরামর্শটা আমিই দিয়ে দিলাম। দাদু একা রয়েছে, আমি
গিয়ে ওখানে কয়েক দিন থেকে জমিজমার ঝামেলা যা আছে সেগুলি সেরে দাদুকে নিয়ে আসব।
মা’কে
নিয়ে আসবি?
হ্যাঁ,
টাই ভাবছি!
মাও
রাজী হলেন। ব্যাস আর দেরী কিসের? সেইদিনই দুপুরে একটু তাড়াতাড়ি খেয়ে দেয়ে বেড়িয়ে পড়ব
এমন ইচ্ছা জানালাম। আচ্ছা ঠিক আছে।
গ্রামে
যাত্রার বিল পাশ।
তখন
গাবতলি, ধামরাইর আগে নয়ার হাট এবং মানিকগঞ্জের পরে ত্বরা ঘাটে ব্রিজ ছিলনা। দুই নৌকা
একত্র করে বানানো ফেরিতে পাড় হতে হতো। সরাসরি কোন বাসও ছিল না। গাবতলি থেকে নয়ার হাট
আবার নয়ারহাট পাড় হয়ে মানিকগঞ্জের ত্বরা ঘাট এবং সবার শেষে ত্বরা ঘাট থেকে আরিচার বাসে
উঠে বানিয়া জুরি নামতে হতো। গাবতলি থেকে বাসে উঠে বানিয়া জুড়ি নেমে বাড়ি পৌছাতে পৌছাতে
৫/৬ ঘণ্টা লেগে যেত। দুপুর ১টায় রওয়ানা হলে সন্ধ্যা ৬/৭টার মধ্যে বাড়ী পৌঁছানো যায়।
দিনে দিনে পৌছলে একা একা রাতের ভয় থাকে না। বানিয়া জুড়ি থেকে সোজা দক্ষিণে ঝিটকার পথে হেটে যেতে হয় প্রায়
৪ মাইল এবং এর মধ্যে গাং-ডুবিতে খেয়া পাড় হয়ে চালতে বাড়ি পর্যন্ত কোন জনমুনিষ্যির দেখা
মিলে না। দিনের বেলা যদিওবা দুই একজন পাওয়া যায় কিন্তু সন্ধ্যার পর সে সম্ভাবনা নেই
বললেই চলে। চালতে বাড়ি আর ষোল ধরার মাঝে চাপা খালটা পাড় হয়ে শ্মশানটা একটা ভয়ংকর জায়গা।
দিনের বেলাই গা ছম ছম করে। পাশের বাঁশ ঝাড়ের ও পাশে চোখ গেলেই মনে হতো এই বুঝি কে আসছে
ঠক ঠক করে লাঠি হাতে। শ্মশান পাড় হয়ে প্রায় আধা মাইল দূরে পাড়াগ্রাম নামে এক গ্রাম
শুরু হয়েছে এবং এখান থেকে প্রায় আধা মাইল পথ পাড়ি দিলে আমাদের ছয়য়ানি গালা গ্রামের
বিশ্বাস বাড়ি। শুনেছি এই খালের উপরে বাঁশের সাকোতে উঠা মাত্রই কাওকে ঘাড় মটকে দেয় এবং
যার সাথে যেমন সুবিধা করতে পারে তেমন কিছু করে বসে। ওখানে দিনে দুপুরে নানা কিছু শোনাতো যায়ই অনেক কিছু
নাকি দেখাও যায়। যদিও আমার কানে বা চোখে কখনও কিছুই পড়েনি। অবশ্য এ কথা ঠিক যে আমি
কখনও একা এই পথে চলাফেরা করিনি। আর একা না হলে নাকি ভুত বা পেত্নী বা জ্বিন পড়িরা কেউ
কাওকে কিছু বলার মত রুচি বোধ করে না।
সেদিন
মা বেগুন দিয়ে ইলিশ মাছ দোপিয়াজি করেছিলেন। প্রিয় সেই ইলিশ দোপিয়াজি দিয়ে পেট ভরে ভাত
খেয়েই দুপুর একটায় বের হলাম। মা বাম হাতের উলটো পিঠে মুখ মুছে দিলেন এক কোয়া রসুন পকেটে
ভরে দিতে চাইলেন কিন্তু পকেটে ওই রসুন বয়ে বেরানোতে ঘোর আপত্তির মুখে মার এই আবদার
টিকল না। তবে এক টুকরা সুপারি মুখে দিয়েই বের হতে হলো। ইলিশ মাছ দিয়ে ভাত খেয়ে যাচ্ছিস ওখানে চালতে বাড়ির
পাশ দিয়ে হেটে যাবি সুপারিটা অন্তত মুখে দিয়ে বের হ। একা একা যাবি না। দরকার হলে একটু
অপেক্ষা করবি, কারো সাথে শ্মশান পার হবি। একা
শ্মশান ঘাট পার হবি না। খবরদার। এমনি কিছু উপদেশ দিয়ে মা দরজায় দাঁড়িয়ে বিদায় দিলেন।
হাতে একটা ব্যাগ। তাতে কয়দিন থাকার মত কাপড় চোপড় আর দাদুর জন্য মা কিছু খাবার দিয়েছেন
টাই নিয়ে বের হলাম।
গাবতলি
এসে ফেরিতে পাড় না হয়ে নৌকায় পাড় হয়েই দেখি নয়ারহাট গামী কাঠের বডি এক মুড়ির টিন স্টার্ট
দিয়ে একটু এগুচ্ছে আবার দুই পা পিছনে আসছে। লাফ দিয়ে উঠে পড়লাম। বেশ অনেক সিট ফাকা
আছে। দেখে শুনে জানালার পাশে একটা সিট দখল করে বসলাম। আধা ঘণ্টা লেগে গেল বাস ভর্তি
হতে। প্রায় আড়াইটার দিকে বাস ছেড়ে দিল এবং হিসেব অনুযায়ী সাড়ে তিনটায় নয়ারহাট পৌঁছল।
এখানেও অই আগের মত ফেরিতে পার হবার সময় নেই, নৌকায় করেই বংশী নদী পার হয়ে দেখি ওই আমিন
বাজারের মত একটা বাস সামনে এক পা যাচ্ছে আবার দুই পা পিছনে আসছে। এই মাত্র ছেড়ে যাচ্ছি
এমন একটা ভাব দেখাচ্ছে। তখন এমনি রেওয়াজ ছিল। বেশ ভাল কথা। বাসে উঠে বসলাম। একটু পরে
বাস ভর্তি হলে ছেড়ে দিল। সুতি পাড়া আসার আগেই মুড়ির টিনের ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেল। হেলপার
কন্ডাকটর নেমে হ্যান্ডেল ঘুড়িয়ে ঘুড়িয়ে ক্লান্ত কিন্তু মুড়ির টিনের ইঞ্জিন কিছুতেই
স্টার্ট করতে পারছে না।
ভাই
আপনারা একটু ধাক্কা দিবেন?
ওরাতো
এই কথা বলল কিন্তু আমি ভাবছিলাম ভিন্ন কথা। সুতি পাড়া হয়ে বায়ে সুয়া পুরের রাস্তায়ই
আমার নানার বাড়ি। বাস যদি এখানে বিগড়েই যায় তাহলে এমন কি ক্ষতি? পদব্রজে কুঠাধারা, নান্নার হয়ে রৌহা যেতে মাত্র এক ঘণ্টার পথ। যাত্রা
পরিবর্তন করে নানার বাড়ি চলে যাই! কাল সকালে এখান থেকে বাড়ি যাব! হ্যাঁ টাই ভাল কোন
হাঙ্গামা নেই। কিন্তু নানা বাড়ির আনন্দ যে ছোট মামা আর মামাত ভাই মুকুল- ওরাযে ঢাকায়!
ওরা না থাকলে ভীষণ একা একা লাগবে। কি করা যায়? নাহ নানা বাড়ি যেয়ে কাজ নেই। দেখি না
কি হয়!
ভাবছি
এমন সময়-
ভাই
আপনেরা একটু নেমে ধাক্কা দিলে স্টার্ট হইতে পারে, আসেন না ভাই
কি
আর করা, আমার মত যাদের সন্ধ্যার আগে চালতে বাড়ির শ্মশানঘাট পাড় হবার তাড়া আছে তেমনি
কিছু জোয়ান অতি আগ্রহ নিয়ে নেমে পিছন থেকে ঠেলতে শুরু করলাম। অল্পতেই স্টার্ট হয়ে গেল।
আবার সবাই উঠে পরলাম। মুড়ির টিন চলতে শুরু করল। আমার যাত্রা বিরতি করে নানার বাড়ি যাবার
প্রস্তাব বাতিল হয়ে গেল!
জাগীর
পর্যন্ত মোটা মুটি কোন উপদ্রব ছাড়াই আসতে পারলাম। জাগীর ব্রিজ পাড় হয়েই ঠাস করে এক
বিকট শব্দ করে চাকা পাংচার হয়ে থেমে গেল।
এই
কি হোল?
একটু
বসেন তেমন কিছু হয় নাই চাকা পাংচার হইছে চাকা বদলি করলেই সব ঠিক হবে।
আচ্ছা
ঠিক আছে চাকা বদল কর।
ইঞ্জিন
বন্ধ আর চাকা বদলির জন্য বেশ উৎকণ্ঠা নিয়ে সবার অপেক্ষা।
বেশ
কিছুটা সময় নিয়ে বাসের ছাদ থেকে চাকা নামিয়ে সে আবার বদল করা হলো এবং পুরাতন চাকা ছাদে
উঠিয়ে নিয়েই উঠেন উঠেন তাড়াতাড়ি উঠেন!
এবার
ত্বরাঘাটে পৌছাতেই প্রায় ছয়টা বেজে গেল। হাতের ঘড়ি দেখছি। এখনও যদি কোথাও দেরি না হয়
তাহলেও অন্ধকার হবার আগে কিছুতেই চালতে বাড়ি পাড় হতে পারব না। কি করি? কেন যে মামা
বাড়ি গেলাম না, এখন নিজের উপর ভীষণ রাগ লাগছে। ওদিকে আবার ইলিশ মাছ খেয়ে বের হয়েছি।
কি জানি ইলিশের গন্ধ গায়ে লেগে রয়েছে কি না কে জানে! শ্মশানের ভুত পেত্নীরা নিশ্চয়ই
ইলিশের গন্ধেই কোলাকুলি করতে চাইবে!
ভাবছি
কি জানি হয়তো বানিয়াজুরি থেকে কিংবা গাং ডুবি খেয়া ঘাট থেকে ঝিটকাগামী কাওকে পাব। তাহলে
আর কোন চিন্তা থাকবে না। কিন্তু যা ভাবা যায় সবসময় টা নিজের প্রয়োজনে বাস্তব হয়ে উঠে
না। আজ এখানে আমার বেলায়ও টাই হলো। ধলেশ্বরী পাড় হয়ে এ পাড়ে এসে বাস ছাড়তেই প্রায় সাড়ে
ছয়টা বেজে গেল। মিনিট দশেকের মধ্যে বানিয়াজুরি নেমে দেখি সূর্য ডুবি ডুবি করছে এখনও
সন্ধ্যার অন্ধকার হতে কিছু সময় নিবে তবে আকাশে একাদশী কিংবা দ্বাদশীর একটা চাঁদ দেখা
যাচ্ছে। মনের মধ্যে একটুখানি ভয়ের ছায়া দেখা যেতে চাইল কিন্তু তারুণ্যের অহংকারে সে
ভয় এক ঝারা দিয়ে বিদায় করে দিলাম। বানিয়া জুরিতে দোকানে এসে এক প্যাকেট স্টার সিগারেট
আর একটা ম্যাচ কিনলাম। শরিফ চাচার কাছে শুনেছি ভুত পেত্নীরা আগুন দেখে ভয় পেয়ে কারো
কাছে আসে না। আর লক্ষ করলাম আমার গন্তব্যের দিকে বা আশে পাশে যাবার মত কেউ আছে কি না।
সিগারেট ম্যাচ নিয়ে ব্যাগে রাখতে গিয়েও রাখলাম না কি জানি যদি কিছু হয়েই যায় তাহলে
ব্যাগ থেকে তাড়াতাড়ি বের করা যাবে না। তারচেয়ে পকেটে রাখাই ভাল। পকেটে ভরে ২/৪ মিনিট দাড়িয়েই রইলাম কিন্তু যা খুঁজছি
তেমন কাউকে পেলাম না। শেষ পর্যন্ত একাই রওয়ানা হলাম। দোয়া কালাম যা জানা ছিল মনে মনে
সব পড়ছি আর বুকে ফু দিচ্ছি।
যখন
অন্ধকার পুরোপুরি হয়ে এসেছে আর চাদের আলো ছড়াতে শুরু করেছে এমনি এক সময় গাং ডুবি খেয়া
ঘাটে পৌঁছলাম কিন্তু পৌঁছেই দেখি খেয়া নৌকাটা একটু আগে ঘাট ছেড়ে প্রায় মাঝ গাঙ্গে চলে
গেছে। দাঁড়িয়ে রইলাম। বেশ কিছুক্ষণ পরে ওপাড়ে নামিয়ে আবার এপারে আসার মত দুই এক জনকে
নিয়ে নৌকাটা এসে ঘাটে ভিড়ল কিন্তু এই এতক্ষণেও আর একজন কেউ এলোনা যে কিনা আমার সাথে
ওপাড়ে যাবে। মনটা একটু খারাপ হয়ে এলো। কিছু করার নেই। এই এলাকায় চেনা জানা কেউ নেই
বা এখনকার মত মোবাইল ফোনও হাতে নেই যে শরিফ চাচাকে ফোন করে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য বলব!
আছে শুধু মাত্র এক এই মাঝি উপেন কাকা। কিন্তু
তাকে বলা মানে তারুণ্যের অপমান করা। না কিছুতেই উপেন কাকাকে বলা যাবে না আমাকে শ্মশান
ঘাট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসুন। যদিও প্রায়ই এই পথে আসা যাওয়া হয় বলে কাকা আমাকে ভাল
করেই চিনে, গালার বিশ্বাস বাড়ির ছেলে। সে শুধু বলল এত দেরি করলে কেন, আর একটু আগে আসতে
পারলে না? এসেছিলাম কাকা কিন্তু পথে দুইবার বাস নষ্ট হয়ে দেরি হয়ে গেল।
ও
আচ্ছা, আমিও এইতো তোমাকে নামিয়ে দিয়ে বাড়ি চলে যাব , রাত হয়ে গেছে অনেক।
তখন
এমন সময়েই গ্রামে রাত হয়ে যেত।
খেয়া
থেকে নেমে এদিক ওদিক দেখে নিলাম। দূরে দূরে গ্রামের কোন কোন ঘর দুই একটা বাতি দেখা
যাচ্ছে একটু পড়েই হয়তো নিভে যাবে। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা বাজলে কি হবে গ্রামের হিসাবে
রাত প্রায় দুপুর হয়ে গেছে। যদিও চাদের আলো না থাকলে অন্ধকার হয়ে যেত এতে কোন সন্দেহ
নেই। চাদের আলোতে কিছুদূর এগিয়ে গেলাম। ওইতো ষোল ধরার খালের বাঁশের সাকোর বাঁশ দেখা
যাচ্ছে, জোসনার আলো পড়ে বেশ চিকচিক করছে। সাকোর কাছে আসতেই সারা গায়ের লোম খারা হয়ে
গেল গায়েও কেমন যেন ছমছম করা ভাব এলো, সারা গায়ে একটু একটু ঘাম হচ্ছে মনে হলো। দাঁড়ালাম।
একটা সিগারেট জ্বালালাম। একটা টান দিয়ে হাতের ব্যগটার বেল্ট টেনে বড় করে গলায় ঝুলিয়ে
নিলাম যাতে করে সাকোর উপরে হ্যান্ডেল ধরার জন্য একটা হাত ফ্রি থাকে। ঠোটে শক্ত করে
সিগারেট চেপে ধরলাম। সাকোর উপরে উঠেছি। একটু একটু করে পা টিপে টিপে এগিয়ে যাচ্ছি। প্রথম
বাঁশটা যেখানে শেষ হলো সেখানে পরের বাঁশে পা দিতে গিয়ে একটু উপরে ছিল বলে পায়ে হোঁচট
খেয়ে এক ঝাঁকি লাগল আর ওতেই ঠোট থেকে সিগারেট পড়ে গেল। এক হাতে প্যাকেট থেকে সিগারেট
বের করে জ্বালান সম্ভব নয়। ভাবলাম সাকোটা পাড় হয়েই আর একটা সিগারেট জ্বালাতে হবে কিন্তু
মনে হোল আমার পিছন দিকে কে যেন সাকোতে উঠেছে। মনে করে দেখলাম সাকোতে ওঠার আগে আমার
পিছনে যতদূর দেখা যায় তাতে কাওকে দেখিনি যে এত তাড়াতাড়ি সাকোতে উঠতে পারবে। সমস্ত শরীর
ভয়ে কাঁপছে বুঝতে পারছি। পিছনে তাকাবার সাহস নেই। তবুও দুই হাতে শক্ত করে সাকোর হ্যানডেলের
বাঁশ ধরে ধরে একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছি ওপাড়ের দিকে। শূন্যের উপরে ভুতের শক্তি বেশী
থাকে। যে কোন সময় এক ধাক্কা দিয়ে পানিতে ফেলে দিবে এই অপেক্ষায় আছি। নিচে পানি বেশি
নেই, খুব বেশি হলে কোমর পর্যন্ত হতে পারে। ঘার মটকে খালের কিনারার কাদায় পুতে রাখার
জন্য এই টুক পানিই যথেষ্ট। অনেক কিছু মাথায় আসছে যাচ্ছে কিন্তু কিছুই করতে পারছিনা
তবে পা গুলি ঠিক ভাবেই চলছে কিছুটা বুঝতে পারছি। এর মধ্যে পায়ে পায়ে প্রায় ওপাড়ে এসে
পড়েছি। কি যেন পানিতে পড়ার শব্দ পেলাম। হটাত দাঁড়িয়ে গেলাম। সামনে তাকালাম। পিছনে বা
পায়ের নিচে তাকাবার সাহস নেই। জোড়ে জোড়ে কালাম পড়ছি কিন্তু কি পড়ছি নিজেই কিছু বুঝতে
পারছি না। জোসনায় সামনে বেশ অনেক দূর দেখা যাচ্ছে। খালের বাম পাশে কালীবাড়ি, এপারে
বাঁশ ঝাড়ের পাশে বুনো গাছের লম্বা চিকন জংলা ভিটা, এই ভিটার পাশের রাস্তা দিয়েই যেতে হবে। কোথাও কোন অস্বাভাবিক কিছু
দেখলাম না। এক লাফ দিয়ে এ পাড়ে নেমে এলাম। লাফ দেয়ার সময় পানিতে আবার কি যেন পড়ল। নেমে
এসে বুঝলাম জুতায় লেগে থাকা ঘাটের কিছু কাদার চটা পড়েছে। এর আগের বারেও টাই পরেছিল।
একটু
বায়ে এসে খালটা আবার ডানে ঘুরেছে। এ পাড় দিয়ে আমার রাস্তা ওপাড়ে কালীবাড়ি। কালীবাড়ির
টিনের চালা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। আর একটা সিগারেট জ্বালালাম। দুই টান দিয়ে বেশ কিছু ধোয়া ছেড়ে সামনে হাঁটছি। প্রায় এক’শ হাত
এসেছি হটাত করে সামনে ডান দিকে জংলা ভিটায় কয়েকটা লম্বা দেবদারু গাছের দিকে চোখ পড়তেই
পা থেমে গেল। চিকন একটা ভয়ের রেখা মেরুদণ্ডে বেয়ে কাঁধ থেকে চিন চিন করে পায়ের পাতা
পর্যন্ত ছড়িয়ে গেল। পা আর এগুতে চাইছে না। মুখ এবং পিঠের ঘাম হটাত করেই যেন বেড়ে গেল।
সামনে আবার তাকালাম দেখলাম গাছের মাথার দিকে কে যেন মাথা দুলিয়ে হাসছে আর হাত দিয়ে
ইশারায় কাছে ডাকছে। আয়! আয়! আয়! কাছে আয়!
কিন্তু
অত উপরে উঠবো কি করে? আর ডাকছে বলেই কি যেতে হবে নাকি?
ভয়
পাচ্ছি কিন্তু এটাও বুঝতে পারছি এখানে ভয় পেলে চলবে না। আশে পাশে কেউ নেই যে গলা চড়িয়ে
ডাকব! আবার দাঁড়ালাম। সিগারেট জ্বলছে। টান দিয়ে আবার আগুনের অস্তিত্ব নিশ্চিত হলাম।
হাত দিয়ে পরখ করে দেখলাম তাপ লাগছে। শরিফ চাচা শিখিয়েছে আগুন থাকলে কোন ভয় নেই। তবুও
নির্ভয় হতে পারছিলাম না। সিগারেট শেষ হয়ে আসছিল এটার আগুন দিয়েই আবার আর একটা জ্বালালাম।
আগুনের জন্য সিগারেট জ্বালাচ্ছি সিগারেটের জন্য নয়। এখান থেকে কাওকে ডাকলে কোন লাভ
নেই, আধ মাইলের মধ্যে কোন বসতি নেই। পারাগ্রামের ওই মাঝামাঝি যাবার পর বসতি শুরু হয়েছে।
কি করি? কি করি? একটু একটু বাতাস আছে তবুও ঘামে জামার নিচে গেঞ্জি ভিজে গেছে। নাক মুখ
দিয়ে ফোটা ফোটা পরতে চাইছে। সার্টের হাতায় মুখ মুছে নিলাম একবার। আবার ভাবছি কি করি?
হটাত একটু জোড়ে বাতাসের ঝাপটা এলো আর ওই যিনি ইশারা করে ডাকছিলেন যেখানে যে পাতা সহ
দেবদারুর ডাল ছিল তাতে নিচে থেকে একটা বেত গাছের পাতা বেয়ে উঠে এমন করে ধনুকের মত বাঁকা
হয়ে আছে যে বেতের চিকন পাতা একটার পর একটা মিলে নুয়ে এসে মানুষের মাথার মত আকার হয়েছে
আর দেবদারুর ডালটা হাতের মত আকার ধরে ঝিরই ঝিরই বাতাসে দুলছে আর তার উপরে চাদের জোসনা
পড়ে চিক চিক করছিল যাতে মনে হচ্ছিল মাথা ঝাঁকিয়ে হাত নেড়ে কাছে ডাকছে। বাতাসে ওটা সরে
গিয়ে সব পরিষ্কার হয়ে গেল।
আরে
ধুর! এই দেখে এতক্ষণ ভয় পাচ্ছিলাম? মনে হলো বুক থেকে একটা বিশাল পাথর নেমে গেল। তবুও
আস্তে আস্তে কাছে এসে নিশ্চিত হলাম। এবার আর একটা সিগারেট জ্বালিয়ে প্রায় দৌড়ের মত
এগিয়ে যেয়ে যেখানে বসতি শুরু হয়েছে সেখানে ডান পাশে নিমাই বাবুর বাড়িতে উঠে ডাকলাম,
নিমাই কাকা বাড়ি আছেন?
অজ
গ্রামে এর মধ্যেই রাত দুপুর হয়ে গেছে। ডাকাডাকির সারা পেয়ে নিমাই কাকা জবাব দিল
কে?
কাকা,
আমি শরিফ চাচার ভাতিজা, কাকা বাতিটা একটু জ্বালাবেন?
তুমি
এত রাতে কোথা থেকে এলে?
সে
অনেক কথা কাকা, একটা বাতি জ্বালান সব বলছি
আচ্ছা
একটু সবুর কর
কাকা
উঠে হাতিয়ে দিয়াশলাই খুঁজে পাচ্ছেন না, দিয়াশলাইটা যে কোথায় রাখলাম পাচ্ছি না
লাগবে
না কাকা এইযে আমার কাছে দিয়াশলাই আছে
কাকা
এবার দরজা খুললেন
পায়ে
পায়ে এগিয়ে কাকার দরজার কাছে গিয়ে কাকার হাতে দিয়াশলাই দিলাম, কাকা একটা কুপি বাতি
জ্বালালেন। একটা পিড়িতে বসলাম কাকাও বসল। বুকের ধড়ফড়ানি এখনও যায়নি। টাই দেখে
তুমি
অমন করছ কেন, কোথা থেকে এত রাতে এসেছ, কোথায় গিয়েছিলে, ভয় পেয়েছ নাকি?
কাকার
এক সাথে এতগুলি প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়ে আস্তে আস্তে সমস্ত ঘটনা খুল বললাম। শেষে
বললাম কাকা আমাকে একটু বাড়ি দিয়ে আসেন।
কাকা
আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন
চলো।
No comments:
Post a Comment
Thank you very much for your comments.