Friday 14 December 2012

নক্ষত্রের গোধূলি- ৬২ [অধ্যায়-৭]

এ দেশে অনেক কিছুই আছে। সচ্ছলতা, প্রাচুর্য, সম্পদ, প্রকৃতি, সৌন্দর্য সবই আছে কিন্তু একটা জিনিসের অভাব সে হল সুখ আর শান্তি। তবে সুখ শান্তির ব্যাপার ভিন্ন জনের কাছে ভিন্ন রূপ। সে দিক বিবেচনা করলে এদের সুখ শান্তির অভাব নেই বলা যায়। এরা যে ভাবে বেড়ে উঠেছে বা যা দেখেছে যা বুঝেছে, এদের রক্তে যা মিশে
গেছে তাতেই এরা অভ্যস্ত। এদেশে কোন পথিক কোন বাড়ির দরজা নক করে এক গ্লাস পানি চাইতে পারে একথা এরা জানে না। এরা ভাবতেও পারেনা সারাদিন অফিসে বা অন্য কোথাও কাজ কর্ম করে এসে দেখবে বৌ রান্না বান্না করে তার পথ চেয়ে বসে আছে কিংবা পরের দিন কি গায়ে কাজে যাবে সে কাপড় ধুয়ে ইস্ত্রি করছে।

মা বাবার বয়স হয়েছে এখন ভাল করে চোখে দেখে না, নিজের খেয়াল রাখতে পারেনা, একা একা হাসপাতালে নয়তো পেনশন তোলার জন্য পোস্ট অফিসে যেতে পারেনা বলে তার কাছে থাকতে হবে বা তাকে নিজের কাছে রাখতে হবে এটা কি সম্ভব? মাদারস ডে কিংবা কোন উৎসবে দূর থেকে একটা কার্ড কিংবা কিছু একটা উপহার পাঠিয়ে দিলেই হল। সম্ভব হলে বা সময় পেলে হয়ত সেদিন মায়ের কাছে একদিন থেকে আসা যায় এর বেশি আর কিছু দরকার আছে? মা বাবার একাকীত্বের যন্ত্রণার বোঝা বইতে হবে এ আবার কি ধরনের কথা। প্রয়োজনে হলে কাছের ডাক্তারখানা থেকে নার্স এসে দেখে যাবে। আর যদি মরেই পরে থাকে তাহলে প্রতিবেশীরা কেও স্থানীর কাউন্সিলে খবর দিলেই হবে। তারা ফোন করে জানাবে তখন গিয়ে পেশাদার সৎকার কারী দিয়ে সৎকার করে আসা যাবে। কাউন্সিল অফিস যদি ছেলে বা মেয়েকে খুঁজে নাই পায় তখন তারাই পেশাদার সৎকার কারীদের দিয়ে সব ব্যবস্থা করে নিবে আর সেই সাথে ঘরে তালা দিয়ে রাখবে। খবর পেলে পরে একদিন গিয়ে উইল অনুযায়ী সম্পত্তি নিয়ে আসা যাবে।

সময় পেলে আত্মীয় স্বজনদের ডেকে নিমন্ত্রণ করে শোক প্রকাশ করার জন্য মদের সাথে কিছু সামান্য খাবারের আয়োজন করা যেতে পারে এইতো এদের রীতি। এরা এতেই অভ্যস্ত হয়েছে, এই দেখে আসছে। এদের আর শান্তির ব্যাঘাত হবার সুযোগ কোথায়? এদের শান্তির থিওরি তো এই। এতেই এদের সুখ শান্তি। তাহলে আর এদের সুখ শান্তি নেই এ কথা বলি কি ভাবে? আমরা যেমন সোহাগ করে মেয়েকে মা কিংবা আম্মু বলে ডাকি ছেলেকে বাবা বা আব্বু ডাকি এদের তেমন রীতি নেই। এদের কথা হল মা মাই আর মেয়ে মেয়েই। মা মেয়ে হবে কি করে আর মেয়েই বা মা হয় কি করে।

ওবানে মাস খানিক সামনে কাজ করে নানা ধরনের কাস্টমারদের সাথে আলাপ করে অনেক না জানা প্রচলন, রেওয়াজ আর রীতিনীতি জেনেছে। যা আগে কখনো জানার সুযোগ হয়নি। মরন হল আমাদের। আদর সোহাগ, মায়া, স্নেহ মমতা, সূক্ষ্ম অনুভূতি, বিনা স্বার্থের ভালবাসা, রক্তের টান, আঁচলের টান, নাড়ীর টান কেন যে সব আমাদের মত লোকদের মাথায় ঘড় বেধেছে কে জানে! কি আছে আমাদের? মনের মত করে কাউকে কিছু দিতেও পারিনা। কারো জন্য মনের মত কিছু করতেও পারিনা। মনে যা চায় তার কতটুক করার মত বা দেবার মত সামর্থ্য আছে আমাদের? নিজের চলার সঙ্গতিই যেখানে সীমিত সেখানে কার জন্য কি করতে পারি। কারো অসুস্থতার খবর পেয়ে হাসপাতালে ছুটাছুটি করে দিন পার করে দেয়া, বুকের মধ্যে একটা কেমন যেন ভাব নিয়ে রাত জেগে পাশে বসে থেকে যত্ন আত্মি করা সুধু আমাদেরই মানায়।

 তবে এরাও যে মায়া দয়া করে না ছোট মেয়ে বা ছেলেকে সোহাগ করে না আমি সে কথা বলছি না। ভাই বোনের খবর নেয় বোন ভাইয়ের খবর নেয়। প্রেমিক প্রেমিকা এক সাথে টেবিলে মুখোমুখি বসে একে অপরকে খাইয়ে দেয়, তবে চামচ দিয়ে। আমাদের মত হাতে নয়। ভাগ্নি মামার সাথে ফোনে কথা বলে কখনো তার এলাকায় এলে পাবে বা কোন রেস্টুরেন্টে গিয়ে ডিনার করিয়ে দেয়, এই পর্যন্তই। এরাও করে তবে আমাদের মত নয়। সেদিন দেখা গেল মা বাবা টেবিলে বসে খাচ্ছে, ছোট ছেলেটা ছুটা ছুটি করতে গিয়ে এক টেবিলের সাথে গুঁতা লেগে মাথায় ব্যথা পেয়ে চিৎকার। না, মায়ের বা বাবার কোন বিকার নেই তারা খেয়েই চলেছে। উলটো ধমক, তোমাকে নিষেধ করেছি না ওখানে যেতে! ছেলেটাও বুঝে নিলো কান্না কাটি করে লাভ নেই কেও এগিয়ে আসবেনা। কান্না থামিয়ে চুপ করে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে এক পাশে বসে রইল।

ও ইতো ব্রিজেন্ড আর মাত্র ছয় মাইল। মনের মধ্যে এবার আর এক অজানা আতঙ্ক উঁকি দিচ্ছে। এখানে কি হবে কেমন হবে, কদিনের জন্য এরা এনেছে তা কে জানে! একটু পরেই শহরে ঢুকে পরল। দেখেই বোঝা যায় ছোট্ট শহর। বাস এসে স্ট্যান্ডে থামল। তার সাথে আরও দু তিন জন নামল। লাগেজ বক্স থেকে ব্যাগটা নিয়ে কাঁধে ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক দেখছে কোন দিকে যাবে। রাস্তার ওপাশে পুলিশ স্টেশন, ডান এবং বাম দুই দিকেই রাস্তা চলে গেছে। তাকে কোন দিকে যেতে হবে? ডানের যে রাস্তা সেদিক দিয়ে এসেছে কাজেই এখন বামে যেতে হবে। অচেনা শহরে এভাবে সারা দিন দাঁড়িয়ে থাকলেই কি পথের সন্ধান পাওয়া যাবে? কাউকে জিজ্ঞেস করতে হবে। ন্যাশনাল এক্সপ্রেসের কোচ যেখানে থেমেছিল সেখানে আরও কয়েকটা লোকাল বাসের ছাউনি আছে। কয়েক জন বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। আগের দু জায়গার অভিজ্ঞতায় পা এগুতে না চাইলেও জোড় করেই আস্তে আস্তে এগিয়ে একজনকে জিজ্ঞেস করলেন, উইন্ডহ্যাম স্ট্রীট কোন দিকে? জবাব পেল এখান থেকে বেশ একটু দূরে, তবে আমি তোমাকে যে পর্যন্ত বলে দিচ্ছি তুমি সে পর্যন্ত গিয়ে আবার কাউকে জিজ্ঞেস করবে। এখান থেকে ওই যে রাস্তা বামে টার্ন নিয়েছে সেদিকে গিয়ে আবার ডানে যাবে, ওখানে একটা মার্কেট দেখবে সেখানে গিয়ে আবার কাউকে জিজ্ঞেস করবে।

লোকটাকে ধন্যবাদ জানিয়ে এগিয়ে গেলেন। তার কথা মত মার্কেট পেয়ে আবার জিজ্ঞেস করে করে উইন্ডহ্যাম স্ট্রীটে তার গন্তব্যে পৌঁছলেন।
বেলা চারটা বাজে এখনো রেস্টুরেন্ট খুলেনি। কাকে কিভাবে ডাকবে কিছু খুঁজে পাচ্ছেন না। সামনে এসে একটা দোকানের পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন। রেস্টুরেন্টের ডান পাশে একটা ব্যাঙ্ক, বাম পাশে কি কি যেন অনেক দোকান পাটের মত। উপর থেকে জানালা দিয়ে যদি কেও উকি টুকি দেয় অন্তত তাকে দেখতে পাবে। প্রায় আধা ঘণ্টা পরে এক জন বত্রিশ চৌত্রিশ বছর বয়সের বাঙ্গালি তিন তলার জানালার পর্দা সরিয়ে দাঁড়াল। তাকে দেখেই রাশেদ সাহেব ডাকলেন। হ্যাঁ জানি, আপনার আসার কথা জানি, একটু দাঁড়ান পিছন গেট দিয়ে লোক পাঠাচ্ছি।
একটু পরেই ব্যংকের পাশ থেকে পঁচিশ ছাব্বিশ বছরের এক যুবক এগিয়ে এসে বলল
আসেন আমার সাথে আসেন,
পিছনের গেটে এই দিক দিয়ে ব্যংকের পাশ দিয়ে ঘুরে যেতে হয়। যেতে যেতেই সে বলল
আমার নাম শ্যামল, আমি সামনে কাজ করি।
পিছন দিয়ে দোতলায় উঠে এল। এখানে এসে যাকে জানালায় দেখেছিল তার সাথে পরিচয় হল।
আমার নাম রাশেদ, বাড়ি ঢাকা।
এখানে এই কদিনের মধ্যেই রাশেদ সাহেব বুঝে নিয়েছেন যার সাথেই আলাপ হোক বাড়ি কোথায় জিজ্ঞেস করবেই, বাড়ি কোথায় সেই অনুযায়ী আচার ব্যাবহার করতে হবে তাই। এখানে যারা সংখ্যায় বেশি তাদের এক ধরনের মিল রয়েছে আর যাদের সংখ্যা কম তারা যেন আলাদা কোন গোত্র। ভিন্ন গ্রহের বাসিন্দা, তাদের সাথে দূরত্ব বজায় রেখে চলাই ভাল। তাই নামের সাথে বাড়ির ঠিকানাও বলে দেন।
ও আচ্ছা আমার নাম বাহাদুর।

একটা রুম দেখিয়ে বলল
ব্যাগটা আপাতত এখানে রাখেন পরে মালিকেরা এলে যা বলে তাই হবে।
রুমে একটা খাট একটা টেলিভিশন ছাড়া আর যা রয়েছে তা হল কয়েকশ সিগারেটের শেষাংশ, অনেক গুলি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের খালি সিগারেটের প্যাকেট, কয়েকটা খালি লাইটার, পানির গ্লাস, চায়ের কাপ, কমলার খোসা আর গোটা দুয়েক ভাঙ্গা তবে ব্যাবহার যোগ্য চেয়ার আর এগুলির সাথে কেমন যেন একটা ভ্যাপসা গন্ধ। দেখে মনে হচ্ছে এখানে বসে টেলিভিশন দেখে আর সিগারেট টানে, শেষ হলে মেঝেতেই ফেলে পা দিয়ে চেপে নিভিয়ে ফেলে, কমলা খেয়ে খোসা গুলিও এখানেই ফেলে দেয়। ভাগ্য ভাল মেঝেতে কার্পেট নেই তাহলে এভাবে কি আর সিগারেট ফেলা যেত? বাহাদুরের কথা শুনে বুঝেছে এর বাড়িও ঢাকা, ঢাকার আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলছে।
ভাই আমাদের ডিউটির সময় হয়ে গেছে আমরা নিচে যাচ্ছি আপনি একটু গুছিয়ে নিয়ে আসেন।
আমাকে আগে গোসল করতে হবে, শেভ হতে হবে। সেই স্কটল্যান্ড থেকে আমি গত চার দিন যাবত এই এক ভাবে এক কাপড়ে রয়েছি।
আচ্ছা আসেন দেখিয়ে দেই।

বাথরুম দেখিয়ে বলল
আপনি তাহলে গোসল সেরে তাড়াতাড়ি আসেন আমরা যাই, সাদা শার্ট আছে ?
হ্যাঁ আছে।
এখানকার ড্রেস হল সাদা শার্ট আর কালো প্যান্ট।
আচ্ছা।
রাশেদ সাহেব বাথরুমের পানির টেপ ছেড়ে দেখলেন গরম পানি আছে। আহ! বলে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লেন। রুমে ফিরে গিয়ে ব্যাগ খুলে লুঙ্গি তোয়ালে সাবান শেভিং রেজর টুথ ব্রাশ নিয়ে এলেন। গত কয়েক দিন শেভ তো দূরের কথা দাঁতও ব্রাশ করা হয়নি। দাঁত ব্রাশ করে শেভ করলেন। এবার গোসল। গত এক মাসের গোসল।

No comments:

Post a Comment

Thank you very much for your comments.