Friday 14 December 2012

নক্ষত্রের গোধূলি- ৬৩ [অধ্যায়-৭]

ইচ্ছা মত গোসল করে রুমে গিয়ে রেডি হয়ে টাই বাঁধছেন এমন সময় পায়ের শব্দ পেলেন, এই দিকেই আসছে। সালামালেকুম।
খোলা দরজা দিয়ে দেখলেন চল্লিশ বিয়াল্লিশ বছর বয়সী একজন তার দিকে আসছে।
ওয়ালাইকুম আস সালাম, ভাই আপনি?

আমি আসিয়াদ আলি।
ও আচ্ছা আপনার সাথেই ফোনে কথা বলেছি?
হ্যাঁ, পথে কোন অসুবিধা হয়েছে?
না না কোন অসুবিধা হয়নি।
চিনতে পেরেছেন?
হ্যাঁ, কোন অসুবিধা হয়নি, চলে এসেছি।
আচ্ছা ঠিক আছে আপনি রেডি হয়ে নিচে আসেন, আর আপনার তো দুপুরে খাওয়া হয়নি আমি কিচেনে বলে দিচ্ছি আপনার খাবার ব্যবস্থা করবে। আপনি এই রুমেই থাকেন, আরও রুম আছে কিন্তু সেখানে একা থাকতে পারবেন না শেয়ার করতে হবে, এখানেই একটু গুছিয়ে নিলে একাই থাকতে পারবেন।
আচ্ছা ঠিক আছে তাহলে ডিউটি শেষ করে এসে একটু পরিষ্কার করে নিব।
রাশেদ সাহেব আসিয়াদ আলির সাথেই বের হয়ে নিচে এলেন। প্রথমে কিচেন। কিচেনের সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন আর কুককে বললেন
উনাকে কিছু খেতে দাও।

আপনি খেয়ে নেন, আস্তে আস্তেই আসেন
বলে উনি সামনে চলে গেলেন। মজিবর হল কুক, হেলাল তন্দুরি সেফ আর আবুল কিচেন পোর্টার। সেফ হল সালিক মিয়া, এখানকার একজন পার্টনার সে এখনো আসেনি। এখানেও সেই একই ধরনের কৌতূহলের জবাবদিহি করতে হল। খাওয়া শেষ করে সামনে এলেন। এখনো কোন কাস্টমার আসেনি। বাহাদুর আসিয়াদ আলি আর কে একজন গল্প করছে। রাশেদ সাহেবের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন
ইনি সালিক মিয়া আমাদের একজন পার্টনার এবং সেফ।
একটু পরেই এক ভদ্রলোক এলেন, সবার সাথে কথার ধরন শুনে বুঝতে পারলেন কোথাও যাচ্ছেন তাই বিদায় নিতে এসেছেন। রাশেদ সাহেবের সাথেও আলাপ হল, সেও একজন পার্টনার সমসু মিয়া, হজ করতে যাচ্ছেন এবং তার অনুপস্থিতির জন্যেই রাশেদ সাহেবেকে বহাল করা হয়েছে। সমসু মিয়া চলে যাবার পর দুএক জন করে কাস্টমার আসছে। আসিয়াদ আলি রাশেদ সাহেবকে বারে ঢুকিয়ে বললেন
দাদা আপনি এখানেই থাকবেন আর ফাঁক মত একটু বের হয়ে এদিকেও একটু দেখবেন, আপনি মুরুব্বি মানুষ দাদা বললে কিছু মনে করবেন?
না না কি মনে করব, এতো ভাল কথা।

এইতো, রাশেদ সাহেব আজ থেকে বারম্যান আর দাদা হয়ে গেলেন। এখানকার লোকজন স্টাফ সবাই ভাল মনে হল। মালিকেরা সবাই মৌলভী বাজারের মানুষ, ভদ্রলোক। সালিক মিয়া আগে দক্ষ ওয়েটার ছিল কিন্তু হজ করে আসার পর মদ ঘাটা ঘাটি করতে হয় বলে আর ওয়েটারি করেনা।, আসিয়াদ আলির কাছে সেফের কাজ শিখে নিয়েছে। আসিয়াদ আলি আবার দক্ষ সেফ। সে এখন সামনেই ওয়েটারি করে, সেও হজ করে এসেছে। সমসু মিয়া বাকি ছিল সে এবার যাচ্ছে। সবারই বাড়ি গাড়ি আছে, প্রতিষ্ঠিত ব্যবসা। এটা ছাড়াও আসিয়াদ আলির আরও অনেক ব্যবসা আছে। সাউথ ওয়েলসের ধনিদের মধ্যে সে এক জন। বাহাদুর ওয়েটার, শ্যামল কুমি ওয়েটার। সেদিন কোন ভাবে কেটে গেল। রাতে খাবার সময় সবাই একসাথে টেবিলে বসে খায়। ওখানকার মত যে যেভাবে পারছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এবং কন্টেইনারে করে পানি নিয়ে খাচ্ছে না। এখানে রীতিমত টেবিলে সবাই পানির গ্লাস নিয়ে বসেছে। টেবিলের মাঝখানে ভাত আর তরকারির গামলা। তবে সালিক মিয়া এখানে খায় না, তার স্ত্রী অপেক্ষা করে থাকে তাই সে বাসায় চলে যায়। খাবার পর কিছুক্ষণ আলাপ হল, আসিয়াদ আলি আর বাহাদুর ছিল।
দাদা আপনি কোন পার্টি করেন?
না ভাই আমি কোন পার্টি ফারটি করিনা।

কি বলেন বাংলাদেশের মানুষ কোন পার্টি করেন না এ আবার কেমন কথা!
না ভাই আমাদের দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমি মনে করি রাজনীতি আর দুর্নীতি এক কথা, তাই ওসবে আমার আগ্রহ নেই। তাছাড়া সরকারি চাকরি বাকরি করেছি বলে ওই রকম কিছুতে জড়াবার প্রয়োজন হয়নি। এমনিই সরকারি চাকুরেদের অবস্থা জানেন তো, যে যখন আসে তাকেই সালাম জানাতে হয়। ভাল মন্দ দেখার সুযোগ নেই।
কিছুক্ষণ পর আসিয়াদ আলি চলে গেল। বাহাদুর বলল
চলেন আজ আর গল্প করার টাইম নেই আপনার ঘড় গুছিয়ে নেন।
হ্যাঁ তাই চলেন। আচ্ছা বাহাদুর ভাই আমি কিন্তু নতুন মানুষ আমাকে শিখিয়ে নিতে হবে।
আচ্ছা সে দেখা যাবে সে জন্য কোন চিন্তা করবেন না।
প্রথমে রুমে ঢুকে বিছানার পুরনো চাদর, বালিশের কভার, লেপের কভার এগুলি খুলে বাইরে এক জায়গায় রেখে দিলেন। শ্যামলকে ডেকে ব্রাশ আর মপের বাকেট দেখে নিয়ে আসলেন। রুম থেকে টেলিভিশন বের করে সাথের ছোট আর একটা রুমে রাখলেন চেয়ার গুলিও ওই ঘড়ে রাখলেন। এবার পুরো ঘড় ব্রাশ করে মপ দিয়ে মুছে ঝক ঝকে করে ফেললেন। নিজের চাদর ইত্যাদি বিছিয়ে রেখে নিচে থেকে একটা গ্লাস, খালি কোকের বোতল ভরে পানি আর একটা এসট্রে এনে বিছানায় বসে সিগারেট বানাচ্ছেন। সিগারেটটা নিয়ে উপরে বাহাদুরের কাছে যাবেন ভাবছেন। এমন সময় বাহাদুর এল। আরে কি করেছেন?চমৎকার, দেখেন একটু চেষ্টা করলে কি সুন্দর থাকা যায়। আমি বেশি দিন হয়নি এখানে এসেছি। মাত্র এক মাস হয় তাই কিছু বলতে পারছি না।
ও আচ্ছা!
আপনাকে তো বারে দিয়ে দিল ভালই হয়েছে। ওখানে কষ্ট একটু কম হবে, আরামে কাজ করতে পারবেন। ভাল বারম্যানেরও ভাল বেতন, চিন্তা করবেননা। আরে এরা ঝানু মানুষ কাকে কোথায় সেট করতে হবে এরা জানে।
কিন্তু বাহাদুর ভাই আমি স্কটল্যান্ডে যে সব মদ দেখে এসেছি এখানে তো সেরকম দেখছিনা এগুলি অন্য রকম।
হ্যাঁ সব জায়গায় এক হবেনা এক এক জায়গায় এক এক ধরনের চাহিদা, তবে মুল জিনিষ মোটামুটি একই ধরনের, এগুলি আমি আস্তে আস্তে দেখিয়ে দিব।
হ্যা বাহাদুর ভাই আমাকে একটু বুঝিয়ে দিবেন!
চিন্তা করবেননা, দেশি মানুষ এসেছেন যখন এটুক তো করতে হবে। সব দেখিয়ে দিব। না আজ আর না, শুয়ে পরেন রাত তিনটা বেজে গেছে।
আজ মনিকে ফোন করতে হবে। দুপুরে কাজ শেষ করে রেস্টুরেন্টের ফোন থেকে কার্ড দিয়ে বাসার নম্বর ডায়াল করলেন, মনে হল কত দিন পর ওপাড়ে মনির কণ্ঠ মধুর মত কানে এসে বাজল
হ্যালো
হ্যাঁ আমি।
কি খবর তোমার?

ওবান ছেড়ে আসার পর রিতা আপা, ব্রিকলেন, নাসির এবং সবার শেষে ব্রিজেন্ডের কথা একে একে সব বলল।
রিতা আপা এই কাণ্ড ভাল কিভাবে অবাক লাগছে, যাক একটা ভাল জায়গা পেয়েছ জেনে নিশ্চিন্ত হলাম, আমি এ কয় দিন কি চিন্তায় ছিলাম।
এবার তোমাদের কি খবর বল।
এখানে আমরা সবাই ভাল আছি তুমি কোন চিন্তা করবেনা।
টাকা পয়সার কি অবস্থা কিভাবে চলছ?
চলছে এখনো কোন অসুবিধা হয় নি।
আচ্ছা দেখি এখান থেকে পাঠাতে পারি কিনা।
পাঠাবে যে পাবে কোথায়?
কেন এতো দিন বেতন পেলাম না, আর ওই যে তুমি যে ট্রাভেলারস চেক রেখে গেছিলে সেগুলি তো আমার দরকার হয় নি, ওগুলি ভাঙ্গিয়ে আর আমার কাছে যা জমেছে সবই পাঠিয়ে দিব।
না শোন সব পাঠিও না তোমার কাছে কিছু রেখ কখন কি প্রয়োজন হয়। আচ্ছা তুমি ওষুধ খাও ঠিক মত? আর কত দিন চলবে কি পরিমাণ আছে?

খাই তবে গত কয়েক দিন খুব এলোমেলোর মধ্যে ছিলাম তাই হয়ে উঠেনি, ওষুধ যা আছে তাতে আর মাস খানিক চলবে তার পরে যে কি করবো তাই ভাবছি, দেখা যাক একটা উপায় বের করতে হবে।
আব্বার কি অবস্থা কেমন আছে?
হ্যাঁ ভালই আছে।
মেয়েরা ওদের দাদার যত্ন টত্ন করে?
হ্যাঁ করে, তোমার মেয়ে না?
আচ্ছা তা হলে আজ রাখি?
আচ্ছা ঠিক আছে।
মনিকে রেখে নাসিরকে ফোন করল।
নাসির কি খবর তোমার?
হ্যাঁ ভাই, আমি ডিডকোটে এসেছি। বিরাট রেস্টুরেন্ট, মালিক এক বাজে ধরনের মানুষ সারা ক্ষণ ক্যাচ ক্যাচ করতেই থাকে তার কাছে সে ছাড়া আর কেউ ভাল মানুষ নেই। উপরে থাকার ব্যবস্থা আর গোসলের পানি নিতে হয় নিচে কিচেন থেকে বালতি করে। আপনার ওখানে কেমন?
আমার এখানে ভাল সব দিক দিয়েই ভাল। আছা যাই হোক তুমি করতে থাক, দেখা যাক।
ফিরোজকেও ফোন করে জানিয়ে দিলেন।

এর পর এখানে বেশ ভালই দিন কাটতে লাগল। সারা দিন রাত সেন্ট্রাল হিটিং সিস্টেম চলছে, গোসলের গরম পানি, বেশ বড় এক ঘড়ে একা থাকা, খাবার ব্যবস্থা মন্দ বলা যায়না। দুপুরে ডিউটি শেষ করে বাহাদুরের সাথে বাইরে ঘুরতে যাওয়া, রাতে ডিউটি শেষে সবাই একসাথে বসে খাওয়া, উপরে এসে তার রুমে সবার আড্ডা, রেস্টুরেন্টের বাম পাশে দুই দোকান পরেই লাইব্রেরি, সব মিলিয়ে আগের চেয়ে ভাল। সবাই বেশ সমীহ করে চলে, সম্মান করে, আজে বাজে কথা বা গালাগালি করার মত কেউ নেই। আসিয়াদ মিয়া বা সালিক মিয়া এসেই আগে দাদার খোঁজ করে। দেখা হলে সুবিধা অসুবিধার কথা জিজ্ঞেস করে ঠিক ঠাক মত আছে কি না জানতে চায়। সব কিছুই খুটিয়ে খুটিয়ে নাসিরকে জানালেন।

No comments:

Post a Comment

Thank you very much for your comments.