Saturday 22 December 2012

নক্ষত্রের গোধূলি- ৬৯ [অধ্যায়-৭]

মুল কথা হচ্ছে যে জাতি এক সময় প্রায় সমস্ত পৃথিবী শাসন থেকে শোষণ এবং অত্যাচার অনাচার নির্যাতন করে যে সাম্রাজ্য গড়েছিল যেখানে সূর্য অস্ত যেত না সেই জাতিকে এমন করে কাবু করে জেঁকে বসেছে সে এক পরম পাওয়া বললে অন্যায় হবে না। এদের সেই বিগত দিন গুলির সামান্যতম প্রতিশোধ নেয়া হচ্ছে। তবে এই পর্যায়ে
আসতে কম কাঠ খর পোড়াতে হয়নি। প্রথম দিকে বখাটে ছেলে পিলে বা বয়স্ক লোকেরাও খেয়ে দেয়ে পয়সা না দিয়ে চলে যেতে চাইত। পয়সা চাইতে গেলে ধমকে উঠত যে “তোমরা আমাদের দেশ থেকে সব টাকা পাচার করছ, লুট করে নিয়ে যাচ্ছ, কাজেই আবার কিসের দাম দিব”? তোমাদের এই ব্যবসা করতে দিব না। ক্রমে এই কথা রানীর কানে গেলে সে পাত্তা দেয়নি। রানী বলেছে এরা যদি এভাবে রান্না না করে তা হলে তোমরা খাবে কি? উনিশ’শ আশীর দশকে এক সময় ছিল যখন রেস্টুরেন্টের মালিকেরা হিথরো এয়ারপোর্টে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত কোন বাঙ্গালি আসছে কিনা তাই দেখার জন্য। কোন বাঙ্গালিকে দেখলেই তার সাথে গিয়ে আলাপ করত যে ভাই আপনি কোথায় যাবেন? এগিয়ে নেয়ার জন্য কেও এসেছে কিনা, না হলে চলেন আমি নিয়ে যাই। গাড়িতে উঠিয়ে নিজের ঠিকানা লেখা একটা কাগজ হাতে দিয়ে বলে দিত যদি ভাই কাজকর্মের প্রয়োজন হয় তা হলে আমার সাথে যোগাযোগ করবেন। আমার রেস্টুরেন্ট আছে সেখানে কাজ করতে পারবেন, ওখানেই থাকবেন, খাবেন। এমন করেও কর্মচারী সংগ্রহ করতে হয়েছে। এরা আগে থেকে এই সুযোগ করে রেখেছিল বলে অনেক বাঙ্গালি এখানে এসে কোন বিপদে পড়েনি। অন্তত থাকা খাওয়া সহ কিছু একটা কাজের সংস্থান হয়েছে।

এক দিনে যেমন রোম নগরী তৈরি হয়নি তেমনি এই শিল্পও রাতারাতি এক দিনে হয়ে উঠেনি। যতটা সহজ ভাবে ভাবা যায় ততটা সহজে এই সুনাম গড়ে উঠেনি। যারা এর সাথে জড়িত কেবল তারাই জানে কি মূল্য দিতে হয়েছে। ঘড়ে স্ত্রী সন্তান রাত জেগে শেষ পর্যন্ত হয়ত না খেয়েই ঘুমিয়ে পরেছে অথচ কর্তা তখন খরিদ্দারের মনোরঞ্জনের জন্য, তাদের রসনা তৃপ্তির জন্য ফ্রাই প্যান নিয়ে জালফ্রেজি রাঁধছে কিংবা লোহার শিকে মাংস, পিয়াজ, টমাটো, ক্যাপসিকাম গেঁথে শাসলিক বানাচ্ছে। এদিকে ঘরে তার নতুন বিয়ে করা বৌ একা ছটফট করছে। হয়তবা কারো সন্তানকে কাল সকালে স্কুলে নিয়ে যেতে হবে ভর্তির জন্য অথচ বাবা তার গ্রাহকদের মন তুষ্ট করে রাত তিনটা বা তারও পরে ঘড়ে ফিরে বিছানায় যাবার সাথে সাথেই ঘুমে বেহুশ। সকালে সময় মত উঠতে না পেরে ছেলেকে নিয়ে আর স্কুলে যাওয়া হয়নি বলে ছেলের স্কুলে ভর্তিও হয়নি।
সবাই যখন দিনের কাজ শেষে ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে ঘরে ফিরছে তখন এই রেস্টুরেন্টের মালিক বা কর্মচারীরা ছুটে আসছে রেস্টুরেন্টে। এসেই রেস্টুরেন্ট খুলে বাতি জ্বালিয়ে সুগন্ধি ছড়িয়ে সাজসজ্জা করে নানা খাদ্যের পসরা সাজিয়ে বসছে। কখন ঘড় মুখো ক্ষুধার্ত গ্রাহকেরা ভুরি ভোজনের জন্য আসবে সেই পথ চেয়ে তীর্থের কাকের মত চেয়ে থাকছে। খরিদ্দার এলেই হাসির টেবলেট খেয়ে একটা হাসি দিয়ে তাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে জিজ্ঞেস করছে
গুড ইভনিং ম্যাডাম, টেবিল ফর টু?
ওহ!
 ইয়েস ম্যাডাম/স্যার প্লীজ ফলো মি।
বলেই আগে আগে যেয়ে সাজানো টেবিল থেকে চেয়ারটা একটু টেনে দেখিয়ে বলবে হ্যাভ ইয়োর সীট প্লিজ। তারপর শুরু হবে যান্ত্রিক হাটা চলা, মাপা কেতা দুরস্ত মেকী কথা বার্তা। কাজকর্ম শেষ করে মালিক তার গাড়িতে করে চলে যাবে বাসায় বা অন্যান্য বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়ার জন্য বা যারা এর মধ্যে মদ বিক্রি করতে করতে কখন যে সে নিজেও মদে আসক্ত হয়ে গেছে তা সে নিজেও জানে না। বন্ধুদের সাথে এমন কোন পানের আড্ডা বসে যায়। আরও অনেক কাহিনী আছে। এদেশে ভাল মেয়ের অভাব বলে নিজ দেশে যায় পাত্রীর সন্ধানে। পাত্রীর বাবা বা অভিভাবক বিলাতি পাত্রের কথা শুনে তার কাছে মেয়ে দেয়ার জন্য পাগল হয়ে যায়। অনেক সময় পাত্রী নিজেও আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায়। কিন্তু সে কোথায় আসছে তা টের পায় যখন এখানে আসে।

এমনও দেখা যায় ৩, ৪ বা ৫ দিন পর্যন্ত স্বামী ঘড়ে ফিরছে না। স্ত্রীর মলিন মুখ। কি করবে, কাকে বলবে? নিজের ভিতরেই একটা চিতা জ্বেলে তার আগুনে দগ্ধ হতে থাকে, অথচ তার শরীরে মাথা থেকে পায়ের আঙ্গুল পর্যন্ত দামী গহনা, হীরের গহনা জড়ান রয়েছে! আলমারি ভরা নানা রকম দামী শাড়ি, বছরে অন্তত একবার আমেরিকা বা ফ্রান্স ঘুরে আসা সবই আছে কিন্তু যার কাছে আসা তার কোন দেখাই নেই। এমন অনেক ঘটনা আছে। আবার সে নিজেই দেখে শুনে অন্য কার হাত ধরে চলে যাচ্ছে নিজের অনন্ত সুখী ভবিষ্যতের স্বপ্নে বিভোর হয়ে। কিন্তু সুখ কি আর শাড়ি গহনা কিংবা পেরিসের টিকেটের মত দোকানে কিনতে পাওয়া যায়?
যারা কর্মচারী তারা কাজ শেষ করে রেস্টুরেন্টের উপরে বা কাছে কোথাও মালিকের ভাড়া করা ঘড়ে গিয়ে শুরু করে নিজেদের আড্ডা। এর মধ্যে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ রয়েছে। লাঙ্গল ছেড়ে লন্ডন এসেছে এমন থেকে শুরু করে দেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সরকারি কোন পদস্থ কর্মকর্তা, কোন ব্যাবসায়ী বেশ বড় কোন ব্যবসায় মার খেয়ে জীবন বাঁচাবার জন্য এসেছে বা অন্তত পড়তে এসেছে এমন পর্যন্ত। সবার সাথে সবার আড্ডা জমে না।

ওদিকে থাকার ব্যবস্থা নিতান্ত আমাদের দেশের কাজের বুয়াদের চেয়ে খুব একটা ব্যবধান নেই। কোথাও হিটার নেই, কোথাও গোসলের পানি নেই, পানি আছে তো গরম পানি নেই এদেশে গরম পানি ছাড়া গোসলের কথা ভাবাও যায় না। কোথাও একটা ছোট্ট ঘড়ের মধ্যে ৩ থেকে ৭ জন পর্যন্ত থাকতে হয়। রাতের কাজের পর ঘড়ে গিয়ে গায়ের জামাটা খুলে কোথাও হ্যঙ্গারে ঝুলিয়ে রাখবে তেমন কোন ব্যবস্থা নেই। অথচ মালিকের কড়া নির্দেশ ধোপ দুরস্ত কড়া ইস্ত্রি করা জামা প্যান্ট, পালিশ করা জুতা পায়ে টাই বেঁধে ডিউটি করতে হবে। কিন্তু কাপড় চোপর ধোয়ার বা শুকবার জায়গা নেই সেদিকে মালিক পক্ষের কোন মাথা ব্যথা নেই। এদেশে সাধারণত কেও হাতে কাপড় ধোয় না। রেস্টুরেন্টের কর্মচারীদের জন্য মালিক পক্ষ একটা সাধারণ মানের ওয়াশিং মেশিন পর্যন্ত কিনে দিতে টাকার অপচয় মনে করে। অবশ্য অসুবিধাও আছে। যেমন যারা লাঙ্গল ছেড়ে লন্ডন এসেছে তারা এই মেসিনের মর্ম বুঝবে কেমন করে। কমোড কি করে ব্যবহার করতে হয় তাও জানে না।

এদের সাথেই যদি ওই একটু আগে যাদের কথা বলেছি তাদের থাকতে হয় তাহলে কি অবস্থা দাঁড়ায় তা সহজেই অনুমান করা যায়। হাতের ঘড়িটা রাখতে হয় বালিশের নিচে। টুথ ব্রাশ বা মাথার চিরুনি পায়ের কাছে বা মাথার পাশে নিচে কোথাও রাখতে হয়, একটা টেবিল পর্যন্ত নেই। কোন রকমে এসে ক্লান্ত শরীরটাকে বিছানা নামের একটুখানি ভাঙ্গা খাটে ছেড়ে দিয়ে আগামী কালের ডিউটির প্রস্তুতি নেয়ার অপেক্ষা।  রাতে কারো একটু নীরবে ঘুমানো সম্ভব নয়। এত গুলি মানুষ এক ঘড়ে থাকলে যা হবার তাই হয়। কাউকে বিরক্ত করা বা এমন কিছু করলে কেহ বিরক্ত হতে পারে এই সাধারণ বোধও অনেকের নেই। এর ব্যতিক্রম যে নেই তা কিন্তু নয় তবে সে হটাত দুই একটা, সাধারণত এই ছবিই বেশি দেখা যায়।
সমস্ত সপ্তাহের কাজের অন্তত দুই সেট কাপড়, প্রতিদিনের েক জোড়া মুজা, দুই একটা বাইরে যাবার কাপড় সব কিছু মিলিয়ে প্রায় এক বালতি কাপড় এই শীতের দেশে হাতে ধোয়া আবার শুকানো এক কঠিন ব্যাপার। অনেকেই গরম কাপড় ধোয়ার ঝামেলায় না গিয়ে যত দিন এমনি গায়ে দেয়া যায় তত দিন গায়ে দিয়ে সেটা ফেলে দিয়ে আবার গরিবের বন্ধু প্রিমার্ক থেকে কম দামে আর একটা কিনে নেয়াই সুবিধা মনে করে।

এখানকার মালিকেরা সাধারণত এই সব কর্মচারীদের জন্য কাপড় ধোয়ার মেশিন দেয় না বলে তাদের মনে কোন আফসোস বা বিকার নেই বললেই চলে। অযথা খরচ বাড়াবার এমন কি প্রয়োজন? এমনটা ভেবেই সামান্য এক শ পাউন্ডের একটা সেকেন্ড হ্যান্ড মেশিন কিনে দেয়া হয় না। অভাবের তাড়নায় কিংবা নিতান্ত সখের বসে কিংবা চোখে রঙিন স্বপ্নের ঘোরে আমাদের দেশের অধিকাংশের কাছে এটাই বিলাতের স্বাভাবিক চিত্র।
এমনি করে দিন গুলি কেটেই যাচ্ছিল। সময় কেটে যেতে হবে তাই। রেস্টুরেন্টের পাশে লাইব্রেরি, মাঝে একটা ইটালিয়ান বেকারি দোকান শুধু কেক বিষ্কুট পাওয়া যায়।

No comments:

Post a Comment

Thank you very much for your comments.