Sunday 18 November 2012

বিলাতের সাত সতের - ৮ [৯]


[পূর্ব প্রকাশের পর]
বাসায় ফিরেই দেখি খুকু কাঁদছে আর তাই ওর ভিতর থেকে থর থর করে কাঁপছে। কিন্তু চোখে কোন পানি নেই। হঠাত করে যখন এই দৃশ্য নজরে এলো, জিজ্ঞেস করলাম কি ব্যাপার আব্বু, কি হয়েছে এমন কাঁদছ কেন? কোন কথা
নেই। আবার বুকে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম। এবার আর স্থির থাকতে পারল না। বলল-
তোমার কি কালই যেতে হবে?

এমন করুন সুর শুনে কোন বাবাই মনে হয় স্থির থাকতে পারে না। বিশেষ করে এমন এই নির্বান্ধব প্রবাসে। মনটা খুকুর মতই কেঁপে উঠল। কি বলব? বলার মত কোন ভাষা আমার মুখে আসছে না। ও যে ভাবে কাঁদতে পারছে আমি বাবা হয়ে সেভাবে কাঁদতে পারছি না। কিন্তু আমার মন ক্ষত বিক্ষত হয়ে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। ও তো বাবার বুকে মাথা রেখে পরম নিশ্চিন্তে পৃথিবীর নিরাপদ স্থানে লুকিয়ে রয়েছে। আমি কোথায় লুকাই, কোথায় আশ্রয় নিই? অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করে বললাম-
দেখি আমার মালিককে ফোন করে দেখি। যদি ওরা আরো দুই এক দিন ছুটি দেয় তা হলে না হয় থেকে যাব। কিন্তু আব্বু আজ হোক কাল হোক আমাকে যে যেতেই হবে। তুমি নিজেকে শক্ত কর। একাই থাকবে এমন করে নিজেকে প্রস্তুত করে নাও।
তখনই আমার চাকরীর কর্তাকে ফোন করলাম। বুঝিয়ে বললাম সব কিছু। শুনে সে একটু আমতা আমতা করে নিতান্ত অনিচ্ছার সাথে অনুমতি দিলেন। যাক বাবা আর না হয় দুই দিন তোমার সাথে থাকতে পারব।
কয়েক দিন থেকে কিছু কেনা কাটা করে দিলাম। লন্ডনের পিকাডেলি সার্কাস, টেমস নদী, আর্ট গ্যালারী, পেডিংটন রেল স্টেশন সহ কয়েক জায়গায় বেড়িয়ে ওর মনটাকে হালকা করে একা থাকার জন্য যত টুকু পারলাম শক্তি যোগাবার চেষ্টা করলাম। দেখতে দেখতেই আমার এ যাত্রায় লন্ডনে থাকার সময় ফুরিয়ে গেল। এবার যাবার পালা। সারা রাত শুধু এপাশ ওপাশ করেই কেটে গেল। সম্ভবত শেষ রাতের দিকে একটু কিছুক্ষণের জন্য চোখ লেগে এসেছিল এমন সময় খুকুর বিছানা থেকে কেমন যেন একটা ফোঁপানির শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল। দেখি খুকু আবার কাঁদছে। উঠে খুকুর পাশে শুয়ে ওকে বুকে নিয়ে আবার বোঝাবার চেষ্টা করলাম। এমন করে না বাবা। তুমি এখন থেকে একা থাকার মানসিকতা তৈরী কর। এমন হলে কেমন হবে বল?সময় পেলে তুমি আমার ওখানে যাবে, নতুন দেশে বেড়াবে, দেখবে। এই তো জীবন। আমার সুযোগ হলে আমিও আসব।
সকাল আটটায় ভিক্টোরিয়া কোচ স্টেশন থেকে আমার কোচ। কর্ণ ফ্ল্যাক্স আর দুধ দিয়ে নাশতা খেয়ে আমার ব্যাগটা কাধে নিয়ে মেয়ের হাত ধরে বের হলাম। স্টেপনি গ্রীন থেকে টিউবে ডিস্ট্রিক্ট লাইন ধরে যেতে হবে। আগের রাতে আরিফ ফোনে বলেছিল ভাইয়া, আপনাকে এগিয়ে দেয়ার জন্য ওকে নিয়ে যাবার নেই। একা ফিরতে না পারলে আবার আর এক সমস্যা হবে। কিন্তু আমি জানি আমার মেয়ে যে পথে এক বার যাবে সে ঠিক পথ চিনে আবার ফিরে আসতে পারবে। সাহস করে মেয়ের উপর আস্থা রেখে ওকে নিয়েই বের হলাম। পথে ট্রেনে বসে আরও বোঝালাম। এক এক করে কয়েকটা স্টেশন পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত ভিক্টোরিয়া টিউব স্টেশনে এসে গাড়ি থামল। আমরা উপরে উঠে আসতেই খুকু বলল আব্বু এই এত বড় স্টেশন? হ্যাঁ বাবা এটা লন্ডনের সব চেয়ে ব্যস্ত স্টেশন। কোন দিক দিয়ে বের হতে হবে ওকে দেখালাম। সাথে এই কথাও জানালাম যে আমি এখান থেকে কোচ স্টেশনে যেতে প্রতি বারেই পথ হারিয়ে ফেলি। শুনে খুকু হাসল। বলল-
আব্বু তুমিও হারিয়ে যাও?
হ্যা দেখছ না কত্ত বড় আর ব্যস্ত স্টেশন! আমি সব সময়ই উলটা পথে বের হয়ে আর যেতে পারি না। শেষ পর্যন্ত কাউকে জিজ্ঞেস করে তারপরে যাই। কাজেই তুমি ভাল করে দেখে নাও। এখান থেকে কোন পথে বের হতে হয়। [ চলবে]

*** আমরা উত্তরাধিকারি সুত্রে এক সুন্দর দেশ পেয়েছি যা আমাদেরকেই সুন্দর রাখতে হবে!

No comments:

Post a Comment

Thank you very much for your comments.