Monday 30 March 2015

বেলা শেষের গান-৬



৮/
চান মিয়াকে জিজ্ঞেস করে খাদিজা বেগম হাসানের রুমে এসে বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে দেখল হাসান কাথা গায়ে শুয়ে রয়েছে, দৃষ্টি রয়েছে সামনের খোলা জানালায়।

কি হাসান, কেমন আছ?
মাথা ঘুড়িয়ে দেখে উঠে বসে বলল, ভাল। ম্যাডামের পিছনে দীপাকে দেখে অবাক হলো। মনে মনে ভাবল যাক অন্তত নিপা আসেনি। ওর ওই অল্প কয়েকটা কথা ভাবতে ভাবতেই এখন ওর এই অবস্থা। কি করবে এখন? কিছুই ভাবতে পারছে না। মাথা ঘুলিয়ে আসছে। কোনমতে ম্যাডামকে সালাম দিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে ম্যাডামকে বসতে দেয়ার জন্য কিছু খুজল কিন্তু কিছুই নেই, ওই একটু দূরে জানালার কাছে ওর পড়ার টেবিলে একটা আধা ভাঙ্গা চেয়ার আছে কিন্তু ওর পক্ষে ওখানে যাওয়া সম্ভব নয়। তবুও বিছানা থেকে নামার চেষ্টা করল কিছু বলতে চাইল কিন্তু কিছুই পারল না। ম্যাডাম ওকে ধরে বসিয়ে দিল।
না না উঠতে হবে না এখানেই বস। কি হয়েছে? এমন হলো কি করে?
এই প্রথম দীপার মুখের দিকে তাকাল। নির্বিকার দীপা বেদনা মাখা চোখে দরজা ধরে ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
কি জানি, সকালে ওখান থেকে আসার পর থেকেই কেমন যেন লাগছিল তাই একটু শুয়ে পরেছিলাম কখন ঘুমিয়ে পরেছি বলতে পারি না, চান মিয়া ক্লাসে যাবার জন্য ডাকতে এসেছিল কিন্তু যেতে পারিনি।
গায়ে হাত দিয়ে দেখল এখনও জর। দুপুরে কিছু খেয়েছ?
হ্যা ফজল ভাই ভাত খাইয়ে গেছে।
চল তোমাকে আর এখানে থাকতে হবে না, বাসায় চল, এই দীপা ওর কাপর চোপর নিয়ে চল।
না থাকনা আমি এখানেই থাকি আবার বাসায় কেন যাব?
হয়েছে বাবা এত কথা বলতে হবে না ওঠ।
হাসান একবার দিপার দিকে আর একবার ম্যাডামের মুখের দিকে তাকিয়ে হতবিহবলের মত বসেই রইল।
কি হলো! ওঠ, চল আমার সাথে। দীপা ওইতো রশতে ঝোলান ওর দুই একটা সার্ট প্যান্ট নিয়ে চল।
বলেই হাসানকে টেনে উঠিয়ে নিয়ে চলল বাসায়।
বাসায় এসে দীপাকে বারান্দার ঘরে বিছানা ঠিক করতে বলে হাসানকে পড়ার টেবিলের একটা চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে ভিতরে চলে গেল। দীপাও মায়ের সাথে ভিতরে গিয়ে চাদর, বালিশ আর একটা কাথা এনে বিছানা গুছিয়ে রেখে হাসানের হাত ধরে নিয়ে গেল বিছানায়। চলেন ওখানে বসবেন।
হাসান মন্ত্রমুগ্ধের মত উঠে এসে ধপ করে বিছানায় বসে পরল। হাসানকে ধরে আনার সময় পিছন থেকে  নিপা এসে দেখল দীপা ওকে ধরে বিছানায় নিয়ে যাচ্ছে। থমকে গেল, আপা কেন ওকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে? হাসানের অসুস্থতার কথা এখনও নিপার কানে যায়নি। অবাক হয়ে দরজার ধরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখল। হাসানকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে পিছনে ঘুরে দেখে নিপা দাঁড়িয়ে। মনের মধ্যে ধ্বক করে উঠল। কি হবে এখন? নিপা কি ভাবল? যাই ভাবুক মা জানে, মাইতো বলে গেল! ভয়ের কি আছে?
নিপা জিজ্ঞেস করল কি হয়েছেরা আপা?
তুই জানিস না? সকাল থেকেই হাসান ভাইয়ের ভীষণ জর, মা ওকে এখানে নিয়ে এসেছে, ভাল হওয়া পর্যন্ত এখানেই থাকবে।
ক্ষীণ কণ্ঠে- ও আচ্ছা! বলে আবার আড়ালে চলে গেল। দীপা অস্বস্তির মধ্যেই রয়ে গেল। সে যে এজন্যে কিছু করেনি তাকি আর নিপা বুঝতে চাইবে। হাসানকে নিয়ে দুই বোনের মধ্যে ঠান্ডা একটা প্রতিযোগীতা বা রেশারেশি অনেকদিন ধরেই নিতান্ত নীরবে চলছে কিন্তু কেও কারো কাছে প্রকাশ করতে পারছে না। এমনকি নিপা যে আজ সকালে হাসানকে একটা ছোট্ট চিরকুটে তিনটি কথায় অনেক কথা বলে দিয়েছে সেকথাও দীপা এখনও জানতে পারেনি। দরজার দিকে একটু এগিয়ে এসে পিছনে ফিরে দেখে হাসান শুয়ে পরেছে, চোখ বন্ধ। আবার ফিরে এসে জিজ্ঞেস করল কাথা গায়ে দিয়ে দেই?
না দিতে হবে না আমি নিচ্ছি।
কেন দিতে হবে না কেন, বলে ওর কোন জবাবের অপেক্ষা না করে নিজেই কাথাটা খুলে যত্নের সাথে হাসানের গায়ে দিয়ে দিল। মাথায় হাত দিয়ে দেখে গা অত্যান্ত গরম। তাড়াতাড়ি মাকে ডেকে আনল। মা এসে দেখে হুলস্থুল বাধিয়ে বসল। দীপার বাবাকে ডাক্তার ডাকতে পাঠিয়ে নিজে বালতি ভরে পানি এনে মেয়েকে বলল নে মাথায় পানি দে। দেখি বাবা একটু এদিকে সরে এসো। একটু পরে আবার নিপা এসে ওই আগের মত দরজার পর্দা সরিয়ে দেখল মা পাশে বইসে আছে আর আপা হাসানের মাথায় পানি ঢালছে। এই দৃশ্য দেখে নিপার মনে আর এক আঘাত। আপাকে কিছুতেই সহ্য হচ্ছে না। মনে হচ্ছে আপাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে নিজে ওর যত্ন করে কিন্তু ইচ্ছা করলেই কি সব করা যায়? ঠোট কামড়ে অনেকক্ষণ ধরে এই দৃশ্য দেখছে আর  যন্ত্রণায় উত্তেজনায় অস্থির হচ্ছে। এখনও ফাল্গুন মাস আসেনি কিন্তু নিপা ঘামে ভিজে যাচ্ছে। কপাল থেকে বিন্দু বিন্দু ঘাম ঝরছে। ভিতরে যেন আগুন জ্বলছে। এই আগুন সে নেভাবে কি করে? তাহলে কি হাসান ওর কাছে থেকে চির দিনের জন্য হারিয়ে যাবে? ওদিকে বিছানায় শোয়া হাসানের মনের আকাশে যেমন ঝর বইছে তেমনি ঝর বইছে নিপার মনের আকাশে কিন্তু হাসান দীপা আর নিপা কেও কারো কাছে কিছুই বলতে পারছে না। কোনদিন কি এই তিনজনের অনুভুতি প্রকাশ হবে? একান্ত নীরবেই ঝরে যাবে। শুধু তুষের আগুনে পুড়তে থাকবে।
একটু পরের আক্কাস সাহেব পাড়ার রহমান ডাক্তারকে সাথে নিয়ে এলো। এইযে ডাক্তার এই হলো রুগী।
রুগী কি হয় আপনার, একেতো আগে কখনও দেখিনি! আমার ছাত্র। ব্রিলিয়ান্ট! হঠাত করেই কেন এমন জর কিছু বুঝলাম না। ব্যাগ খুলে থার্মোমিটার বের করে বলল দেখি বাবা হা কর। জিহবার নিচে থার্মোমিটার রেখে হাতের নাড়ি দেখল। জরটা একটু বেশি কিন্তু কই আরতো তেমন কিছু দেখছি না! তাহলে এমন জর কেন? বুঝতে পারছি না তবে জরটা একটু বেশি, সর্দি কাশিও কিছু নেই লাংস পরিষ্কার দেখছি, কোন ভয় পেয়েছ? না।
একটু ভেবে, মাস্টার সাহেব চিন্তা করবেন না, তবে একটু লক্ষ রাখবেন রাতে জর বৃদ্ধি পেতে পারে। এই ওষুধটা এনে খাইয়ে দেন সেরে যাবে ভয়ের কিছু নেই।
ডাক্তারের সাথে আক্কাস সাহেব বের হয়ে গেলেন ওষুধ আনতে। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করল আরো পানি দিবে কিনা। মায়ের ইঙ্গিত পেয়ে পানির বালতি সরিয়ে মাথা মুছে দিল। দেখি বাবা এবার একটু ভাল করে শুয়ে পর। কি খাবে বল।
কিছুই খেতে ইচ্ছে করছে না।
তাই বললেই কি হবে? কিছু খেতে হবে, বল কি খাবে, সাগু জাল দিয়ে দেই?
মাথা কাত করে সম্মতি জানাল।
খাদিজা বেগম সাগু আনার জন্য উঠে দাড়াল। মাকে উঠতে দেখে নিপা দরজা ছেড়ে ভিতরে চলে গেল। হাসান এদিক ওদিক দেখে দীপাকে জিজ্ঞেস করল আমি তোমাদের কি ঝামেলায় ফেলেছি, তাই না? চুপ করেন, কোন কথা বলতে হবে না। মা সাগু নিয়ে আসছে খেয়ে ঘুমাবার চেষ্টা করেন। ডাক্তারতো বললই তেমন কিছু না, একি? সার্ট ভিজে গেছে, ওঠেন সার্টটা বদলে দিচ্ছি। হাসান উঠে বসল।
দীপা  নিজের হাতে সার্টের বুতাম খুলে বিছানার এক পাশে নামিয়ে রেখে বিকেলে হোস্টেল থেকে নিয়ে আসা একটা সার্ট গায়ে দিয়ে বলল নিন এবার শুয়ে পরুন। এর মধ্যে মা একটা পেয়ালায় গরম সাগু নিয়ে এসেছে আবার আক্কাস সাহেবও ওষুধ নিয়ে এসেছে। মাজেদা বেগম হাসানকে উঠিয়ে চামচ দিয়ে সাগু খাইয়ে ওষুধ খাইয়ে বলল, নাও এবার শুয়ে ঘুমিয়ে পর দেখবে সকালেই সব ঠিক হয়ে গেছে।
কাথা গায়ে দিয়ে লাইট নিভিয়ে দিয়ে বলল চল আমরা যাই ও ঘুমাক।
সবাই চলে যাবার পর হাসান এবার নিশ্চিন্তে একা একা আবার তার ভাবনার সাগরে ডুবে গেল।  অনেক বড় স্বপ্ন দেখে ফেলেছে, অনেক সিঁড়ি বেয়ে আকাশের কাছে না হোক অন্তত মাটির ধরা ছাড়িয়ে অনেক উচুতে উঠতে হবে। তার সাথে আজ যোগ হয়েছে দীপার সাহচর্য। সন্ধ্যা থেকে দীপা এক নাগারে পাশেই রয়েছে। এমন করে কখনও দীপাকে দেখেনি। ওদিকে দরজায় দাড়ান নিপার দিকেও মাঝে মাঝে চোখ ঘুরে এসেছে কিন্তু ম্যাডাম পাশে ছিল বলে কিছুই ভাবতে পারেনি। নিপা কেন কাছে আসেনি? নাকি ইচ্ছে করেই আসেনি, নাকি দীপাকে ওর কাছে দেখে অন্তর্জালায় জ্বলেছে? ভাবতে চাইলেও কিছু ভাবতে পারছে না। মাথাটা আবার ঝিম ঝিম করছে। তবুও কিছুতেই মন থেকে ভাবনার স্রোত সরাতে পারছে না। [চলবে]
[নওরোজ সাহিত্য সম্ভারের প্রকাশনায় আগামী ২০১৭ বই মেলায় প্রকাশের অপেক্ষায়।]

No comments:

Post a Comment

Thank you very much for your comments.