Monday 30 March 2015

বেলা শেষের গান-৫

৭।
হাসান ক্লাস নাইন থেকে প্রথম হয়ে টেন এ এবং দীপা নিপা ক্লাস সিক্স থেকে প্রথম ও দ্বিতীয় হয়ে ক্লাস সেভেন এ উঠেছে। হেডস্যার ভীষণ খুশী, ম্যাডামও। এর পর নতুন ক্লাসের বই কেনা ইত্যাদি ঝামেলা শেষ হতে বেশ কয়েকদিন

চলে গেল। আবার শুরু হলো আগের মত নিয়ম করে পড়তে আসা আর সকালের নাশতা খেয়ে এ বাড়ি থেকে বের
হওয়া। ঝর, বৃষ্টি, শীত-গ্রীষ্ম কিছুতেই এর বিরাম নেই। হেডস্যার একদিনের জন্যেও কোনদিন ছুটি নেননি।  দিনের সবকিছুর সাথে সাথে যেমন হাসানের পড়ালেখার মান দিনকে দিন উন্নত হচ্ছে তেমনি করে দীপার প্রতি তার আগ্রহের মাত্রাও উন্নীত হচ্ছে। এদিকে দীপার চেয়ে নিপা এ ব্যাপারে একটু বেশিই এগিয়ে এসেছে। স্কুল ফাইনালের আগে একদিন হেডস্যার কি কাজে যেন পড়াতে বসতে পারেনি সেদিন নাশতা আনার ছুতা করে আপাকে বাড়ির ভিতরে পাঠিয়ে আগে থেকে লিখে রাখা একটা ছোট্ট ভাজ করা কাগজের টুকরা হাসানের হাতে ধরিয়ে দিয়ে আস্তে করে চেয়ার ছেড়ে উঠে সরে গেল। হাসান কিছু বুঝে ওঠার আগেই দীপা এসে পরাতে সে কাগজের টুকরাটা আর খুলে দেখতে পারেনি, সোজা সার্টের পকেটে রেখে দিয়েছে। দীপা নাশতার ট্রে টেবিলে নামিয়ে রেখে চলে গেল। হাসান লোভ সামলাতে পারল না। নিপা কি লিখেছে সেটা দেখতে হবে, একবার পকেটে হাত দিল কিন্তু সাথে সাথে ম্যাডামের পায়ের শব্দ পেয়ে পকেটের কাগজ পকেটেই রেখে দিল। যাই লিখে থাক বাইরে গিয়েই দেখবে। কিন্তু নাশতা খাচ্ছে আর মনে মনে ভাবছে নিপা আবার কি লিখবে! দীপা কিছু লিখলে নাহয় কিছু অনুমান করতে পারত, কিন্তু...............। একটা প্রশ্ন রয়েই গেল। তাড়াতাড়ি খেয়ে বইখাতা নিয়ে বের হয়ে পুকুর পাড় দিয়ে এগিয়ে মেইন গেটের বাইরে বের হয়ে কাগজটা বের করে দেখল শুধু তিনটা শব্দ লেখা, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’। কি! এ কি লিখেছে? না না এ হতে পারে না! কিছুতেই না! দীপার কাছ থেকেই সে এমন কিছু আশা করছে, কিন্তু নিপা এ কি করল? ওকে কেমন করে বোঝাবে? হাসানের মন পড়ে রয়েছে দীপার দিকে। কি করে নিপাকে বোঝাবে? এ হতে পারে না। তার মন যে অন্য কোথাও বাধা পরে গেছে! পা চলতে চাইছে না। ক্লাসের সময় হয়ে গেছে তাড়াতাড়ি যেতে হবে। কিন্তু কিছুতেই পা চলছে না। দীপা এ কি করল? ভাবতে ভাবতে কখন যে হোস্টেলের গেট পার হয়ে নিজের ঘরে এসে বিছানায় শুয়ে পরেছে কিছুই বুঝতে পারেনি। একটা কথাই শুধু চারিদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। নিপা এই করল? প্রচন্ড ভাবে মন আলোরিত হচ্ছে, সামনে শুধু বিশাল এক দেয়াল দেখতে পেল। এই দেয়াল অতিক্রম করে সে কেমন করে তার স্বপ্নের দীপার কাছে যাবে? সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ যেমন কিনারায় আছরে পরে তেমনি করে হাসানের মনও বারবার স্রোত নদীর কিনারে আছরে পরছে। কি হলো? দুর্দান্ত গতিতে ঝর বইছে। মনের সাথে যুদ্ধ করে কুলিয়ে বুঠতে পারছে না। ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পরেছে। মন এবং শরীরের অন্তর্দন্দের এই ফাক পেয়ে শরীরে প্রচন্ড জর এসেছে। ঘুমের মাঝে মনে হয়েছে ক্লাসে যেতে হবে কিন্তু শরীর কোন সারা দেয়নি। এই প্রথম হাসানের ক্লাসে অনুপস্থিতি। ক্লাস টিচার ক্লাসে ঢুকে হাসানকে না দেখে ওর সাথে একই রুমে থাকে আসাদকে জিজ্ঞেস করল কিরে আসাদ হাসান আসেনি কেন? জানি না স্যার, ওকে দেখলাম ঘুমিয়ে রয়েছে ডাকলাম কোন সারা না পেয়ে আমি চলে এসেছি। মনে হয় জর হয়েছে। বলিস কি? আচ্ছা তোরা বস ক্লাস শেষ হলে যেয়ে দেখে আসব।  এক এক করে সব স্যারের একই কথা, সবাই অবাক। সত্যিই ক্লাস শেষ করে ক্লাস টিচার হোস্টেলের ঘরে এসে দেখে হাসান অঘোরে ঘুম। গায়ে হাত দিয়ে দেখল গা গরম। কিরে হাসান! অসময়ে ঘুমচ্ছিস কেন? আজ ক্লাসে গেলি না? জর হয়েছে? কিন্তু হাসানের কোন সারা নেই। পাশের আসাদের বিছানা থেকে কাঁথা এনে গায়ে দিয়ে চান মিয়াকে ডেকে ওর দিকে লক্ষ্য রাখতে বলে চলে গেল। হেড স্যারের রুমে ঢুকে জিগ্যেস করল আজ কি হাসান আপনার কাছে যায়নি? হ্যাঁ গিয়েছিল কিন্তু আমি ওদের দেখতে পারিনি, কেন, কি হয়েছে? ও আজ ক্লাসে আসেনি বলে আমি দেখে আসলাম, মনে হয় জর হয়েছে! গা গরম মনে হলো।
বিকেলের মধ্যে স্কুল ছুটি হবার পরে পরেই হেডস্যার সবাইকে নিয়ে এলো হাসানকে দেখতে। এর মধ্যে হাসান উঠে বসেছে। জরের তাপে সবকিছুই যেন কেমন ঘোলা লাগছে, মাথাটা ভারি মনে হচ্ছে। তার সাথে আবার নিপার কথাটা মনে এলো। কেমন যেন একটা ঘোর লেগে আসল। আবার শুয়ে পরল। একটু পরেই বাবুর্চি ফজল মিয়া এসে ডেকে গায়ে হাত দিয়ে বুঝতে পেরেছে জর এসেছে। কল পারে নিয়ে মাথা ধুইয়ে দিয়ে কোনমতে কিছু খাইয়ে দিয়েছে। ভাত খেয়ে এসে আবার বিছানায়। কিছুই ভাল লাগছেনা। সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো মনে হচ্ছে। আবার ঘুমিয়ে পরেছে। হাসান! কি হয়েছে বাবা? হেডস্যারের ডাক শুনে চমকে উঠে তাকিয়ে হেডস্যারের পিছনে সবাইকে দেখে উঠে বসার চেষ্টা করল কিন্তু পারল না। উঠতে হবে না, শুয়ে থাক। কি হলো, হঠাত এমন জর কেন এলো, সকালেই তো দেখলাম ভাল ছেলে!

হেডস্যার বাড়িতে পৌছে খাদিজা বেগমকে বলতেই সেও অবাক হলো। বল কি? এই না সকাল বেলায় দেখলাম ভাল ছেলে! চলতো দেখে আসি! যাওনা তুমিই যাও আমি এই মাত্র এলাম! একা যাব? একা যাবে কেন নিপা বা দীপা কাওকে নিয়ে যাও। আচ্ছা দেখি, কইরে দীপা! কি বলছ মা? যাবি আমার সাথে? কোথায়? দেখতো কি কান্ড! হাসানের নাকি ভীষণ জর হয়েছে, এই সকালবেলা ছেলেটা গেল তখন দেখেতো কিছু মনে হয়নি। চল যাবি আমার সাথে? একটু দেখে আসি! চল। ওই হোস্টেলে ছেলেটা কি করবে এখন? ঘুরে দাঁড়িয়ে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, নাকি ওকে এখানে নিয়ে আসব? দেখ তুমি যা ভাল মনে কর। আয়, দীপা! ইচ্ছা না হলেও দীপা মায়ের সাথে পা বাড়াল।
[চলবে]
[নওরোজ সাহিত্য সম্ভারের প্রকাশনায় আগামী ২০১৭ বই মেলায় প্রকাশের অপেক্ষায়।]

No comments:

Post a Comment

Thank you very much for your comments.