Friday 7 December 2012

নক্ষত্রের গোধূলি-৫৬ [অধ্যায় ৬]

[পূর্ব সূত্রঃ নক্ষত্রের গোধূলি-৫৫]
চোখ অনেক দূরে চলে গেল, যেখানে মনে হচ্ছে ঝুড়িতে করে কেও অনেকগুলি তারা নিয়ে যাচ্ছিল আর হাত থেকে ঝুড়ি পরে যেন এভাবেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা তারার মতই দেখাচ্ছে। কোন শহর হবে তবে খুব বেশি বড় নয়। মাঝে মাঝে এধরনের লোকালয়
বা শহর দেখা যাচ্ছে। কোনটা বড় আবার কোনটা ছোট। এদেশে সমতল ভূমির খুবই অভাব। যার ফলে এই রকম অপেক্ষাকৃত কম উঁচু নিচু এলাকায় বসতি গড়ে উঠেছিল এক সময়, এখন তা শহর হয়ে গেছে। আমাদের দেশের গ্রাম যেমন গাছ পালা নদী নালা খাল বিল ঝোপ ঝাড় জঙ্গলে ভরা, কাচা ঘড় বাড়ি। পাখিরা সকালে ডেকে ডেকে ঘুম ভাঙ্গিয়ে চলে যায় আবার সন্ধ্যায় নিজের বাসায় ফিরে আসে, খালে বিলে জাল বড়শি বা পলো দিয়ে মাছ ধড়ার হিড়িক, ভোরে তারার মত ফুটে থাকা শাপলা, পুকুর পাড়ে বসে বৌ ঝিদের বাসন মাজার ফাকে হাসি তামাশা আর সুখ দুখের আমদানি রপ্তানি, অলস দুপুরে কোকিলের মন উদাস করা কুহু কুহু ডাক, বৌকে কথা কওয়াবার মিনতি, সন্ধ্যায় জোনাকির আলো, ঝিঝির ডাক, গোয়ালের ধুপের ধোয়া আর কাচা রান্না ঘড়ে রান্নার ধোয়ার সাথে কুয়াশার মাখামাখির একটা গন্ধ, মেয়েদের কুপি বা হারিকেন জ্বালাবার হুড়োহুড়ি। দূর দেশে থাকা ছেলের খবর জানতে ফোন করার জন্য দু মাইল হেটে কাছের বাজারে যাতায়াত, ফেরার পথে কালু ভাইয়ের মুদি দোকানে সন্ধ্যায় আসা সকালের খবরের কাগজে একটু চোখ ঘুড়িয়ে আসা। এসবের কিছুই নেই।

এখানে গ্রামেও বিজলি বাতি জ্বলে। ঘড়ে ঘড়েতো টেলিফোন আছেই রাস্তায় কয়েন বুথও আছে, ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট কানেকশন সহ কম্পিউটার, পাকা দালান কোঠা, সামনে ফুলের বাগান গ্যারেজ, কাছেই কর্নার শপ, ছোট খাট বাজার, রাস্তায় বিজলি বাতি, পাব, চার্চ সহ শহরের সবই আছে। আমাদের দেশের সাথে একটা ব্যাপারে মিল হল ঘুঘুর ডাক। এখানে যখন তখন ঘুঘু পাখি ডাকছে। এদেশে গাছ পালা ঝোপ ঝাড় কম নয় বরঞ্চ আমাদের চেয়ে বেশি কারণ এদের তো গাছ পালা ঝোপ কেটে এনে ভাত রান্না করতে হয়না। বিশ বছর আগেও যেমন জঙ্গল ছিল এখনও তেমনই পড়ে আছে। শুধু শীতে আর গরমে ন্যাড়া গাছ আর পাতার বাহার এই পার্থক্য। এদেশে যে কেউ ইচ্ছা করলেই যেখানে সেখানে মাছ ধরতে পারেনা। বড়শি দিয়ে মাছ ধরতে হলে কাউন্সিল অফিসে ফি দিয়ে লাইসেন্স করে নিতে হবে। তার পরেও দেখা যায় কেউ কেউ খালের পাড়ে বড়শি ফেলে বসে আছে, মাছ ধরছে। ট্রাউট, কার্প, হেরিং আরও নাম না জানা অনেক ধরনের মাছ। এদেশে নিরিবিলি থাকা যায় বলে বরঞ্চ শহরের চেয়ে গ্রামের বাড়ি ঘড়ের দাম কিছু বেশি। গ্রাম হলেও যখন তখন গাড়ি নিয়ে বিশ ত্রিশ মিনিটেই শহরে যাওয়া যায়। ছুটির আগের রাতে ফোন করে ট্যাক্সি ডেকে পাবে চলে যায়। সেখানে পানের সাথে নাচ ফুর্তি করে মাতাল হয়ে পাবের বার ম্যান বা বাউন্সারকে বলে ট্যাক্সি ডেকে দিতে। এমনিতেও ট্যাক্সিগুলি পাবের কাছেই লাইন ধরে বসে থাকে কখন কোন মাতাল আসবে তার অপেক্ষায়। ট্যাক্সিতে করে বাড়ি এসে বিছানায় নয়তো ড্রইং রুমের কারপেটের পরেই বেহুশ। গ্রাম থেকে অনেকেই আবার দেড় দুই ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে বড় কোন শহরে গিয়ে অফিস করে।

সমান গতিতে গাড়ি এগিয়ে চলছে কোন ঝাঁকুনি নেই কোন বিরতি নেই, কোন ট্রাফিক সিগন্যাল নেই। সামনে দিয়ে কেউ রাস্তা পাড় হচ্ছে না, কেউ কাওকে ওভার টেক করছেনা। সবাই যার যার নিজ নিজ লেন দিয়ে নিজের সুবিধা মত স্পিডে চলছে। দূরে কাছে কোথাও ওই রকম ছোট বড় নানা শহরের অস্তিত্ব বোঝা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে আকাশ থেকে ছোট বড় নানা মাপের নানা রঙের তারা এনে ছড়িয়ে রেখেছে। একই দৃশ্য দেখতে দেখতে এক সময় কেমন যেন এক ঘেয়েমি এসে ভর করল। কি করবে, সহযাত্রীরা কেউ কেউ রিডিং লাইট জ্বালিয়ে পড়ছে কিন্তু তার সাথে পড়ার মত কিছু নেই। জুসের প্যাকেট খুলে একটু খেয়ে আর ভালো লাগল না আবার মুখ বন্ধ করে রেখে দিলেন। পায়ের জুতো জোড়া খুলে সীটের উপর পা তুলে জানালার কাচের সাথে পরদায় মাথা ঠেকিয়ে হেলান দিয়ে সামনে পা মেলে দিলেন। রাতের অন্ধকারে শুধ দুই পাশের সীটের মাঝে প্যাসেজ ডেকে মৃদু আলো জ্বলছে, কে কাকে দেখবে সবাই যার যার নিজের মাথা নিয়ে ব্যস্ত। আমাদের দেশের মত এখানে কে কি করছে না করছে তা দেখে কেও মনের সুখ পেতে চায় না। সীটের পাশ থেকে হেড ফোনটা নিয়ে কানে লাগালেন, না কোন লাভ নেই সব চ্যানেলেই যন্ত্রণা দায়ক ইংলিশ গান। হেড ফোন রেখে দিলেন।

ঘড়ি দেখলেন রাত সাড়ে তিনটা বাজে। বাংলাদেশে এখন সকাল সাড়ে নয়টা, মনি কি করছে? ছোট মেয়ে কি স্কুলে গেছে? ওর আবার স্কুলে না যাবার নানা রকমের ফন্দি ফিকির জানা আছে, স্কুল ফাকি দেবার ওস্তাদ। আজ কি করেছে কে জান। বড় দুই জন এতক্ষণ রেডি হচ্ছে কলেজ ইউনিভারসিটিতে যাবার জন্য। মনি তাদের নাশতা নিয়ে ব্যস্ত, ওরা বেড়িয়ে গেলেই আবার দুপুরের রান্নার আয়োজন নিয়ে বসবে। কি বিচিত্র এই মানুষের মন মানুষের জীবন। যে মনিকে এক বেলা না দেখে, অফিস থেকে ফিরে এসে যে মেয়েদের না দেখে তার শান্তি হত না সেই মনি সেই মেয়েরা আজ কোথায় কত দুরে? না কত দূরে হবে কেন ওরা এইতো আমার বুকের মধ্যে, আমার চোখের পাতায়। আমি এইতো তিথির গায়ের গন্ধ পাচ্ছি, যূথী আমাকে তার ওড়না দিয়ে মুখের ঘাম মুছে দিচ্ছে, বীথী মাকে বকছে এইতো ওরা।

সময়ের প্রলেপ, সময় কেমন অদ্ভুত এক প্রলেপ দিয়ে দেয় যা ভুলে থাকার আশ্চর্য এক ক্ষমতা যা কখনো সে কল্পনাও করতে পারেনা। আজ যাকে না হলে চলে না, যাকে না দেখে থাকা যায় না সময়ের ব্যবধানে তা কত বদলে যায়, বদলাতে হয়। সময় তার প্রলেপ দিয়ে সব কিছু ঢেকে দেয় কিন্তু তার পরেও মনের ক্ষত কি ঢেকে রাখা যায়, যায় না। ঢেকে রাখার, ভুলে থাকার অভিনয় করে যেতে হয়, প্রয়োজনের তাগিদে সময়ের কঠিন বিচার সহ্য করে নিতে হয় ।

মাইকে ড্রাইভারের কণ্ঠ ভেসে এলো, লেডিজ এন্ড জেন্টল ম্যান, আমরা কিছুক্ষণের মধ্যে সার্ভিস স্টেশনে থামবো আপনারা ত্রিশ মিনিট সময় পাবেন। সেই আগের মত একই ঘোষণা। আজ নেমে দেখে এটা আগের দেখা সার্ভিস স্টেশন না এটা অন্য আর একটা। তবে সেদিনের মত আজ অত ভিড় নেই। মনে হয় রাত বেশি বলে ভিড় কম। প্রথমে টয়লেটে গেল সেখান থেকে কফি শপে এসে কাগজের কাপে একটা এসপ্রেসো কফি নিয়ে খেতে খেতে ঘুরে ঘুরে দেখল। বাইরে গাড়ির কাছে এসে একটা সিগারেট বানিয়ে জ্বালাল।

সকাল সাড়ে সাতটার কিছু আগেই ভিক্টোরিয়া কোচ স্টেশনে পৌঁছে সেখান থেকে আবার টিউব স্টেশনে হেটে এসে জোন এক এবং দুই এর ডে টিকেট নিয়ে ডিসট্রিক্ট লাইন ধরে মাইল এন্ড নেমে রীতা আপার বাসায় যেতে সেন্ট্রাল লাইনের ট্রেনে উঠল। কোচে বসে টিউব ম্যাপ দেখে নিয়েছিল। প্রায় সাড়ে নয়টায় রীতা আপার বাসায় এসে দরজায় নক করল। অনেকক্ষণ পর আপা দরজা খুলল, দেখে মনে হল দরজার নক শুনে ঘুম ভেঙ্গেছে। তুমি আমার ম্যাসেজ পাওনি?
হ্যাঁ আপনি ফোন করেছিলেন শুনে আমি ফোন করেছিলাম কিন্তু কেও ফোন ধরেনি। তখন ভাবলাম আপনাকে আমার ফোন নম্বর দেয়া হয়নি নিশ্চয় আপনি ফিরোজের কাছে আমার নম্বর পেয়েছেন তাই ফিরোজকেও ফোন করেছি সেও বাসায় ছিলনা বলে যোগাযোগ হয়নি। এদিকে আমার কোচ ছিল সন্ধ্যা সাতটায়। আমি ওবান ছেড়ে এসে গ্লাসগো পৌঁছে আবার ফোন করেছিলাম তখনো কাউকে পেলামনা।
আচ্ছা আস ভিতরে আস।
নিয়ে বসতে দিলেন।
আপা আমি একটু টয়লেট থেকে আসি।
আচ্ছা আস।
টয়লেট সেরে এসে দেখে আপা ড্রইং রুমে বসে আছে। তার পাশের আর একটা সোফায় বসে বলল
আপা আসলে আমি তারপরে আর আপনার সাথে যোগাযোগ না করে ভুল করেছি। আপনি হয়তো আমি আসব কিনা এইরকম একটা দ্বিধার মধ্যে ছিলেন। এর মধ্যে আমার আর একবার ফোন করা প্রয়োজন ছিল।
এতক্ষণে আপা মুখ খুললেন। আমি ফিরোজকেও বলেছি তোমাকে বলার জন্য, ব্যাপারটা হল তোমার দুলাভাই তো অসুস্থ মানুষ, সে কখন কি করে না করে তার কোন ঠিক ঠিকানা নেই। সকালে উঠে ঘড় থেকে বেড় হয়ে হয়তো এক দিকে চলে গেল। এখন কোথায় গেল তাকে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। এইতো কদিন আগেও এরকম করেছে। কাকে কি বলে তারও কোন ঠিক নেই। বিশেষ করে অপরিচিত মানুষ দেখলে সে ভীষণ ভয় পায় বলে তোমরা আমাকে মেরে ফেলার জন্য ওকে এনেছ, তাই ডাক্তার বলেছে বাসায় কোন অচেনা মানুষ যেন না থাকে।
কিন্তু দুলাভাই তো আমাকে চিনে আমার ব্যাপারেও কি এমন কথা বলবে?
আহা, তুমি বুঝতে পারছ না তোমাকে যে সে চিনে একথা কি আর তার মনে আছে? তা যদি মনে থাকত তাহলে তো কোন কথাই ছিল না, এটাইত তার অসুখ।

তাহলে আপা এখন কি করা যায়?
তুমি কিছু মনে করনা রাশেদ, তুমি অন্য কোথাও থাকার ব্যবস্থা কর।
লাটিম যেমন তার একটা ছোট বিন্দু পরিমাণ পায়ের উপর দাড়িয়ে প্রচণ্ড গতিতে ঘুরতে থাকে রীতা আপার কথা শুনেও রাশেদ সাহেবের মাথা সেই ভাবে ঘোরা শুরু হল। উন্মত্ত সাগরের বিশাল পাহাড় সমান ঢেউ যেমন পাহাড়ের মত খাড়া পাড়ে এসে প্রচণ্ড গর্জন করে আছড়ে পরে ভেঙ্গে খান খান হয়ে ছিন্ন ভিন্ন টুকরো গুলি ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছু আবার সাগরে মিশে যায়, কিছু পাড়ের উপড়ে পড়ে আর কিছু ক্ষুদ্র কণা হয়ে বাতাসে উড়ে কোথায় হারিয়ে যায় তার কোন চিহ্ন পাওয়া যায় না। রাশেদ সাহেবের মনের অবস্থাও তেমনি হল। রাশেদ সাহেব নিজেকে মুহূর্তের মধ্যে সামলে নিয়ে নিস্তেজ কণ্ঠে বললেন
তাহলে আপা আমি আসি!
বলেই টলমল পায়ে উঠে দাড়িয়ে ব্যাগটা হাতে নিলেন।
না এখনই কেন যাবে সারা রাত জেগে এতো দূর থেকে এসেছ নাশতা খেয়ে যাও!
না আপা আমি এখন ব্রিকলেন যাব ওখানেই কোথাও খেয়ে নিব, যত তাড়াতাড়ি যেতে পারি ততই ভাল।
বলে যে দরজা দিয়ে ঢুকেছিলেন সেদিকে এগিয়ে গেলেন। দরজাটা খুলে বাইরে বের হলেন পিছনে দরজায় দাড়িয়ে আপা বললেন
তুমি কিছু মনে করোনা রাশেদ।
না আপা আমি কিছুই মনে করিনি,
মনে মনে ভাবলেন যার কোন সংস্থান নেই তার কিছু মনে করা সাজে না, সে কোন অধিকারে কিছু মনে করবে? রিতা আপার বাড়ির কাছে রেড ব্রিজ টিউব স্টেশনে নেমেছিলেন, সেদিকে এগিয়ে গেলেন।

আবার দেখা হবে। তত দিন অপেক্ষা করুন, যেন রাশেদ সাহেবের ভাগ্যাকাশে একটা একাদশীর চাঁদ দেখা দেয়!

No comments:

Post a Comment

Thank you very much for your comments.