Sunday 16 December 2012

নক্ষত্রের গোধূলি- ৬৪ [অধ্যায়-৭]

রাশেদ সাহেব যেদিন এসেছেন সেই ভাঙ্গা সপ্তাহের বেতন রবিবার রাতে দিয়েছে। সবাইকেই তাই দেয়। সোমবার রাতে শ্যামলকে কাজে দেখা যাচ্ছে না। আসিয়াদ ভাইকে বলি বলি ভাবছে এমন সময় সে নিজেই ওকে না দেখে জিজ্ঞেস করল
দাদা শ্যামল কোথায়? তাই বলতে চাইছি, আমি সকালে ঘুম থেকে
উঠেছি এগারোটায় তার পর থেকে ওকে দেখিনি। ও
র রুমে দেখেছেন?
না।

ওর সাথে কে থাকে?
ওর সাথে থাকে আবুল।
আবুল দেখেছে ওকে?
আবুলের তো আজকে অফ ও তো সকালেই কোথায় গেছে।
চলেনতো দেখি ওর রুমে।
রুমে ঢুকে দেখে শ্যামলের জিনিষ পত্র কিছু নেই।
তার মানে ব্যাটা পালিয়েছে! আচ্ছা বলেন তো দাদা পালাবার কি দরকার ছিল? বলে গেলে কি আমরা নিষেধ করতাম? যার যেখানে ভাল লাগে না তাকে কি জোড় করে রাখা যায়? এখন এই সময় মানুষ কোথায় পাই? দাদা আপনার পরিচিত কেও আছে?
রাশেদ সাহেবের নাসিরের কথা মনে হল, সেতো এই সুযোগের অপেক্ষায়ই আছে।
হ্যাঁ আছে কিন্তু সে নতুন মানুষ!
তা হোক, ইংলিশ জানে?
হ্যাঁ তা জানে। এইতো আমি যেদিন এখানে এসেছি তার পর দিন ও ডিডকোটে এক রেস্টুরেন্টে কাজে ঢুকেছে।
তা হলে উনাকে বলেন না এখানে আসতে! আসবে?
বলে দেখি।
এখনই ফোন করেন।
আচ্ছা।
পকেট থেকে নাসিরের ফোন নম্বর বের করে রেস্টূরেন্টের ফোন দিয়ে ডায়াল করল। ওপাশে রিং হচ্ছে।
হ্যালো!
নাসির, আমি রাশেদ বলছি!
সালামালেকুম রাশেদ ভাই, কেমন আছেন?
ভাল আছি, তুমি কেমন? ভাল রাশেদ ভাই!
আচ্ছা  শোন, তোমার জন্য একটা কাজ পেয়েছি আমার এখানে, এইতো আসিয়াদ ভাই মানে এখানকার মালিকের সাথে কথা বল নাও ধর।
কথার শেষে আসিয়াদ ভাই বলল আপনি আসেন আমি আপনাকে বাস স্ট্যান্ড থেকে নিয়ে আসব।
তাহলে আসছে?

হ্যাঁ তাইতো বলল আগামী সোমবারে আসবে।
ভালই হল আপনারা একত্রে থাকতে পারবেন।
তার পরের সোমবারেই নাসির এল, বাস স্ট্যান্ডে নেমে ফোন করলে আসিয়াদ ভাই তার গাড়ি নিয়ে বের হবার আগে বললেন চলেন দাদা আপনিও চলেন। দুজনে একত্রে গিয়ে নাসিরকে নিয়ে এলেন। শ্যামল যেখানে থাকত নাসিরকেও সেখানেই থাকার ব্যবস্থা দেখিয়ে দিলেন। নাসির আসার পর এখানে কাছেই একটা টেক এওয়ের মালিক ফরহাদ সাহেব আসল একদিন। পরিচয় হল এখানে প্রায় চৌদ্দ পনের বছর যাবত আছে, বাড়ি কুমিল্লা। ভদ্রলোক যাবার সময় বলল অফের দিন আসবেন আমার ওখানে, ও ইতো কাছে, লিটেন ট্রি পাবের পাশে যে রেডিও ক্যাবের অফিসটা তার সাথেই। এর পর আবার এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই বাহাদুর নোটিশ দিয়ে দিল, এখানে আর থাকবেনা। পরের সপ্তাহেই চলে যাবে, তার ধারনা অনুযায়ী তাকে বেতন কম দিচ্ছে। তবে এর মধ্যেই অনেক কিছু শিখিয়ে দিয়েছে রাশেদ সাহেবকে। এই অল্প সময়ের মধ্যে বেশ ভাল একটা হৃদ্যতা জমে উঠেছিল। চলে যাবে শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল। যাক, যার যেখানে খুশি সেখানে যাক। টাকা পয়সার ব্যাপার যেখানে জড়িত সেখানে সে আর কি করে নিষেধ করে? যে জন্য দেশ ছেড়ে আসা। যে যেখানে বেশি টাকা পাবে সে সেখানেই যাবে। মায়া বাড়িয়ে কি হবে?

নিজেকে তৈরি করে নেবার যার যার নিজস্ব পথ রয়েছে। নিজস্ব চিন্তা ভাবনা রয়েছে। এর মধ্যে মতামত দেয়ার কোন সুযোগ নেই। সে যেভাবে তার পথ বেছে নিতে চায় তাতে আমার কিছু করার নেই। তবে আমার মনে হয় আমার জন্য এই জায়গাই ভাল। ওর সাথে আমার তুলনা করা চলেনা। ও এখন যেখানে সেখানে দৌড়া দৌড়ী করতে পারে আমার পক্ষে তা সম্ভব না,  আমার চাই একটু স্থিতি।  টাকা কিছু কম হলেও মেনে নিতে হবে। এ কয় দিনে দেখলাম এত ছুটাছুটি করে কুলচ্ছে না। এখানে ভালই আছি, মালিকের সুনজর আছে,  সম্মান আছে,  শান্তি আছে,  আরাম আছে আর কি? এতেই চলে যাবে, যা দিচ্ছে এই যথেষ্ট,  বেশি দরকার নেই। নাসির এসেছে, ফরহাদ ভাইয়ের সাথে কথা বলে ভালই মনে হল, বেশ আলাপী। সময় কেটে যাবে। আর কি? এখানে এই ভাবে যত দিন থাকা যায়। রাতে খাবার পর সবাই চলে গেলে নাসিরের সাথে সুখ দুঃখের আলাপ আলোচনা গল্প গুজবে সময় কেটে যাচ্ছে। সেদিন সালিক ভাই লাইব্রেরিতে নিয়ে গিয়েছিলেন লাইব্রেরি কার্ড করে দেয়ার জন্য, এখানকার ঠিকানায় কার্ড হয়েছে। দুপুরে কাজের পরে পাশের লাইব্রেরিতে যেতে পারছি। বাড়িতে এবং অন্যান্য বন্ধুদের সাথে মেইলে যোগাযোগ হচ্ছে, দেশের পত্র পত্রিকা পড়তে পারছি। এর মধ্যে পাশের ব্যাঙ্ক থেকে ট্রাভেলার্স চেক ভাঙ্গিয়ে এনেছে, সাথের স্কটিশ নোট গুলি বদলিয়ে এনেছে। বাড়িতে টাকা পাঠাবার ব্যাপারে গত কাল আসিয়াদ ভাইয়ের সাথে আলাপ করেছিল। কোথা থেকে কি ভাবে টাকা পাঠানো যায়। উনি বললেন এখানে ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন থেকে পাঠাতে পারেন যদিও চার্জ বেশি নেয় তবে এক দিনের মধ্যেই পেয়ে যাবে।
ভাই আপনি একটু আমার সাথে যাবেন?
কেন আমার যাবার কি দরকার আপনি ইতো পারেন!
যদি প্রশ্ন করে তুমি টুরিস্ট মানুষ এতো টাকা কি করে পাঠাচ্ছ? তাই ভাবছি আপনার নামে পাঠিয়ে দিবেন।

ও আচ্ছা ঠিক বলেছেন,  হ্যাঁ তা হতে পারে,  ঠিক আছে আমি যাব।
আজ তাকে সাথে নিয়ে যাবার কথা। দুপুরে কাজ শেষ করে মনে করিয়ে দিল
আসিয়াদ ভাই আমার সাথে যেতে হবে মনে আছে?
ওহ: আমিতো ভুলেই গিয়েছিলাম, চলেন।
তাকে সাথে নিয়ে গিয়ে টাকা যা ছিল সব পাঠিয়ে দিয়ে এলেন। এসে মনিকে ফোন করে জানিয়ে দিলেন আর কোড নম্বরটাও দিয়ে দিলেন, কি ভাবে কোথায়  গিয়ে টাকা উঠাতে হবে সবই বলে দিলেন। আমি মেইলে সব কিছু লিখে দিচ্ছি কোন ভুল যাতে না হয় মেইল দেখে নিও, আমি পরশু ফোন করে জানবো কি হল। ফোনের কথায় নির্ভর করতে না পেরে লাইব্রেরিতে গিয়ে মেইলে সব বিস্তারিত লিখে দিয়ে আসলেন। কাজের ফাঁকে ফাঁকে, ছুটির দিনে নিজের রুম পরিষ্কার করে গুছিয়ে নিয়েছে। রুমে কেমন একটা গন্ধ ছিল তা দূর হয়েছে। জানালায় যে পর্দা ছিল মনে হয় রেস্টুরেন্ট ওপেন করার সময় ঝুলিয়েছিল তারপরে আর ধোয়া হয়নি সেই পর্দাও একদিন ধুয়ে নিলেন। কাপড় চোপর জিনিষ পত্র গুছিয়ে রেখেছেন এখন বেশ সুন্দর লাগছে। একদিন আসিয়াদ ভাই রুমে ঢুকে বললেন
আরে দাদা করেছেন কি এখন আপনার এই রুমই সবচেয়ে সুন্দর লাগছে। আপনি যখন এতো কষ্ট হরে এতো সুন্দর করেছেন এক কাজ করেন আমার বাসায় একটা নতুন কার্পেট আছে ওটা এনে বাসায় বিছানোর পর আমার ওয়াইফের রঙ পছন্দ হয়নি তাই উঠিয়ে রেখে দিয়েছিলাম। সেটা আমি নিয়ে আসব আপনি বিছিয়ে নিবেন আরও সুন্দর হবে।

তার পর দিন দুপুরে ওই কার্পেট এনে দিলেন।
কাল সোমবার, ভোঁরে বাহাদুরের চলে যাবার দিন। আজ রাতেই সবার কাছে বিদায় নিয়ে নিল। স্কটল্যান্ডের পূর্ব প্রান্তে আবারডিন যাচ্ছে। স্কটল্যান্ড যাচ্ছেন যান তবে আমি ওখানকার যে চেহারা দেখে এসেছি তাতো বলেছি কত ভয়ঙ্কর। যান দেখেন ওখানে কেমন। তবে যোগাযোগ যেন অবশ্যই থাকে।
কি যে বলেন রাশেদ ভাই আপনার কথা ভুলে যাবো এও কি হয়? এই অল্প কদিনে আমাদের যে সম্পর্ক হয়েছে আশা করি তা ভুলে যাবার নয়। আমার ফোন নম্বর তো দিয়ে গেলাম, নাসিরের ফোন নম্বর নিয়ে গেলাম। নাসির ভাই আপনি রাশেদ ভাইকে একটা ‘পে এজ ইউ গো’ ফোন নিয়ে দিয়েন তো।
হ্যাঁ আমি কয়েকবার বলেছি উনি আবার সব টাকা বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন তাই নেয়া হয়নি, দেখি আমার কাছে টাকা আছে আমি কাল অথবা পরশুই একটা ফোন নিয়ে নিব।

ফোন নেয়া হলে আমাকে ফোন দিয়ে নম্বর জানিয়ে দিবেন পরে আমিই ফোন করবো। আর একটা কথা বলে যাই, আপনি আর কোথাও যাবার চেষ্টা করবেন না এখানেই থাকবেন, এরা আপনাকে যথেষ্ট সম্মান করে আমি লক্ষ করেছি। এটা কিন্তু একটা বিরাট ব্যাপার।
হ্যাঁ আমিও তাই ভেবেছি। বাহাদুর ভাই কাল সকালে যাবার সময় ডাকবেন কিছু খাবার দিয়ে দিব আপনিতো নিবেন না। বিশাল জার্নি কোথায় কি খাবেন, সাথে কিছু থাকলে ক্ষতি কি?
না আর কেন ডাকব? এখন ইতো বিদায় নিয়ে নিলাম শুধু শুধু ঘুমের ডিস্টার্ব!
না আপনি ডাকবেন। আর ওই যে বলেছি সকালে কখনো না খেয়ে থাকবেন না, মনে যেন থাকে। আপনি তো যাচ্ছেন এখন আপনার জায়গায় যে আসছে সে কেমন হবে কে জানে, আপনার সাথের দিন গুলি যদিও অল্প কয় দিন তবুও ভালই গেল। এখানে আসার পর থেকেই ডিউটির জন্য উপড়ে থেকে বাহাদুর আর রাশেদ সাহেব এক সাথেই নিচে নেমে আসতো। বাহাদুর কখনো সকালে নাস্তা করতো না তা লক্ষ করে রাশেদ সাহেব দুই জনের জন্য নাস্তা বানিয়ে বাহাদুরকে নিয়ে এক সাথে খেত আর বাহাদুর বলতো
আপনি আমার অভ্যাস খারাপ করে দিচ্ছেন।

খারাপ করছি না ভাল করছি?
সকালে কখনো খালি পেটে থাকবেন না।
নাসির আসার পরও সকালের নাস্তা রাশেদ সাহেবই বানাতেন। নাস্তা আর কি! কয়েক স্লাইস ব্রেড তাওয়ায় সেকে নেয়া আর কয়েকটা ডিম ওমলেট বা পোচ এইতো?
টোস্টার নেই। কর্মচারীদের জন্যে আবার টোস্টারের কি দরকার, তাই থাকেনা। তবে চা বানাত নাসির। জেনে গেছে রাশেদ ভাই একটু বেশি চা খায় তাই যখন তখন এক কাপ চা এনে সামনে দিত নেন রাশেদ ভাই মাথা ঠাণ্ডা করে নেন। ওরা তিন জনেই ঢাকার বলে অন্যরা হাসি তামাশা করত ‘ওই যে তিন ঢাকাইয়া আসতেছে সবাই পথ ছেড়ে দাও’। 

No comments:

Post a Comment

Thank you very much for your comments.