Tuesday 18 December 2012

নক্ষত্রের গোধূলি- ৬৬ [অধ্যায়-৭]

রান্না বান্না! এতো এক মস্ত শিল্প। যে শিল্পের কারুকাজ দিয়ে মানুষের মন জয় করা যায় তাৎক্ষনিক ভাবে অতি সহজে, পেটের ক্ষুধা, মনের ক্ষুধা দুয়ে মিলে পায় সীমা হীন তৃপ্তি। তখন মেনু ছিল চিকেন বা মিট (মিট বলতে এদেশে ভেড়ার মাংস বোঝায়) কারী, দোপিয়াজা, ভুনা, মালাই কারী, কোর্মা, বয়েল্ড রাইস, পোলাও রাইস, বিরিয়ানি
এবং সুপ। চিকেন পোলাও ছিল তখনকার একটা বিশেষ চাহিদার খাবার। কিন্তু মানুষ বৈচিত্র্যের সন্ধানী। কত কাল আর এই এক খাবার চলবে? নতুন কিছু চাই। রাঁধিয়েরা চেষ্টা করছে, গবেষণা করছে কি কি উদ্ভাবন করা যায়। রাঁধিয়ে বললাম এই জন্য যে তখন রান্না করত পুরুষ মানুষ তাকে তো আর রাঁধুনি বলা যায় না! অবশ্য মাঝে মাঝে তার স্ত্রীও কিচেনে সাহায্য করেছে।
এই গবেষণা বা চেষ্টা যাই বলি না কেন এর ফলে যুক্ত হল আর এক নতুন মাত্রা। টিক্কা এবং তন্দুরি। বিশেষ ভাবে কাটা মাংস টক দৈ বা ইওগার্টের সাথে মশলা পাতি মিশিয়ে সারা রাত রেখে দিয়ে লোহার শিকে গেঁথে সরাসরি আগুনে ঝলসে টিক্কা বা তন্দুরি করা হোত। এগুলি ঝলসিয়ে খাওয়া যায় আবার এই ঝলসান মাংস রান্না করেও এক নতুন পদ তৈরি করেছে। এর মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হচ্ছে টিক্কা মাসালা সে চিকেন বা মিট যাই হোক।

এই সব মশলা এবং রেস্টুরেন্টের নানা বিধ মালামাল যোগান দেয়ার জন্য আর এক দল তৈরি হয়ে গেল যারা রেস্টুরেন্টের চাহিদা অনুযায়ী মালামাল রেস্টুরেন্টে পৌঁছে দিয়ে যাচ্ছে। প্রথম দিকে আস্ত মশলা বা আস্ত মুরগী ভেড়া দিয়ে যেত। আজকাল আর সে দিন নেই এখন বিজ্ঞানের দৌলতে গ্রাইন্ডিং মেশিন এসে গেছে, রেফ্রিজারেটর এসেছে। এখন গুড়া মশলা আসছে, চাহিদা মত টুকরা করা মাংস প্যাকেটে বরফ করে দিয়ে যাচ্ছে। গ্রাহকদের খাবার পর হাত মুখ মোছার জন্য সুগন্ধ যুক্ত ভেজা ছোট তোয়ালের প্যাকেট, শাকসবজি, মদ বা নানা রকম পানীয়ও একই ভাবে আসছে। সপ্তাহের একটা নির্দিষ্ট দিনে টেলিফোনে অর্ডার নিয়ে সময় মত পৌঁছে দিচ্ছে। একই ভাবে টেবিল ক্লথ, ন্যাপকিন, সার্ভিস টাওয়েল ইত্যাদি লন্ড্রি থেকে ধুয়ে দিয়ে যাচ্ছে।শুধু দিয়ে যাচ্ছে বললে ভুল হবে। একে বারে যে জিনিস যেখানে থাকে সেখানেই তুলে দিয়ে যাচ্ছে।
যারা খেতে আসে তাদের মনোরঞ্জনের জন্য যার যার সামর্থ্য ও রুচি অনুযায়ী রেস্টুরেন্টগুলি সুন্দর পরিপাটি করে সাজান। তবে অধিকাংশই উপ মহাদেশীয় কায়দায় সাজান। এমনকি দেয়ালে টানানো ছবিতেও উপমহাদেশীয় কৃষ্টি সংস্কৃতির প্রতিফলন ফুটে উঠেছে। এই বিজাতিয় ইউরোপীয় সংস্কৃতির মাঝে চমৎকার বিদেশি সংস্কৃতি ধরে রেখেছে। এতে রেস্টুরেন্টের মালিকদের দেশ প্রেম এবং তা ইউরোপের মাঝে ফুটিয়ে তোলার যে প্রচেষ্টা তাতে তাদেরকে ধন্যবাদ জানাতেই হয়। ভিতরে অন্যান্য সাজসজ্জার সাথে মৃদু লয়ে মূর্ছিত বাংলা বা হিন্দি সুর লহরীর ঝংকার যা প্রকৃত পক্ষেই এই সুদূর পশ্চিমা সভ্যতার মাঝে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি পরিচয় করিয়ে দেয়ার এক অসাধারণ প্রচেষ্টা এবং এটাই এদের সফলতা। এটা তখন বোঝা যায় যখন এই বিলাতিদের মুখ থেকে শোনা যায় বাহ! বেশ সুন্দর বাজনা, কোন কোন মাতাল আবার এই বাংলা সুরের সাথে নেচেও ওঠে।



[একটি দুর্লভ মুহূর্তের বিবরনঃ
যখন আমি এই লেখা লিখছি তখন বিবিসি-২ থেকে একটা কালচারাল প্রোগ্রামের জন্য আমার সাক্ষাতকার নিতে এসেছে। অনুষ্ঠানটি ২০০৪ সালের ডিসেম্বর মাসের ২ তারিখ রাত আটটায় বিবিসি-২ চ্যানেলে প্রচারিত হয়েছে।
এখন আমি বিবিসির ক্যেমেরার সামনে বসে এই লেখা লিখছি। এ যে আমার জন্য কত বড় আনন্দের ব্যাপার তা বোঝাই কি করে, এর চেয়ে বড় আনন্দ আর কি হতে পার জানি না। আমি জীবনেও যা কল্পনা করিনি যে বিশ্বের প্রথম শ্রেণীর একটা মিডিয়ার ক্যেমেরার সামনে বসে আমি সাক্ষাতকার দিব আর লিখবো। এটা শুধু আনন্দের এবং আনন্দের, চরম আনন্দের ব্যাপার। যা কেবল মাত্র মনে মনেই ভাবা যায় অনুভব করা যায়, যা প্রকাশ করার মত ভাষার স্বল্পতা এই মুহূর্তে আমাকে ভীষণ ভাবে আলোড়িত করছে। মনে হচ্ছে আমি যদি নতুন কিছু শব্দ বানিয়ে এখানে যোগ করতে পারতাম। হয়তোবা এমন কোন শব্দ রয়েছে যা এই মুহূর্তে আনন্দের আতিসহ্যে আমার মনে আসছে না।
পৃথিবীর সমস্ত ভাল লাগা গুলি যেন আমার ভাবনার মিছিলে যোগ দিয়েছে। এই এত ভাল লাগা আমি কি করে প্রকাশ করি, ভেবে পাচ্ছি না। এই চরম প্রাপ্তির জন্য আমার সৃষ্টি কর্তার কাছে শোকর জানাবার ভাষাও খুঁজে পাচ্ছি না। যে আমাকে প্রায় পাঁচ হাজার মাইল দূরের বাংলাদেশের ঢাকা জেলার রৌহা গ্রামের এক ছোট্ট কুড়ে ঘর থেকে তুলে এনে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছে। যা অসংখ্য কোটি কোটি দর্শকে দেখবে। জানি না কে কি ভাববে, কি ভাবে এর মূল্যায়ন করবে। তবে যে যাই ভাবুক বা যে ভাবেই এর মূল্যায়ন করুক এযে আমার এক চরম প্রাপ্তি তাতে কোন সন্দেহ নেই। এই বিশ্বে অনেক বড় বড় নামি দামি গুণী লেখক অনেক মূল্যবান লেখা লিখে গেছেন যা হৃদয়ে দোলা দেয়, অনন্ত কাল ধরে যে লেখা সারা বিশ্বকে আলোকিত করে রাখবে। জানিনা কয় জন লেখকের ভাগ্যে এই সৌভাগ্য এসেছে। ধন্যবাদ বিবিসির প্রযোজক ফেনোলাকে এবং তার সম্পূর্ণ টিমকে।]


যাই হোক, আবার ফিরে আসছি যেখানে ছিলাম। এই যে আমাদের বাংলাদেশিরা তার নিজের ভাবমূর্তি, সংস্কৃতি, নিজের খাদ্যের স্বাদ গন্ধ ভিন্ন জাতির মাঝে পরিচিত করে দিচ্ছে তাদেরকে এর সাথে একাত্ম করে দিচ্ছে যে প্রচেষ্টা দিয়ে সে অবশ্যই আনন্দের এবং গর্বের। একটা ব্যাপার যা উল্লেখ না করে পারছি না তা হচ্ছে এই প্রচেষ্টা যা আজ একটা বিশাল শিল্পে পরিণত হয়েছে তার যারা উদ্যোক্তা তারা কিন্তু কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত নয় এমনকি তাদের তেমন কোন সাধারণ শিক্ষাও নেই। কেবল মাত্র নিজের সংসার পরিচালনার তাগিদে নিজের অভিজ্ঞতার এবং আগ্রহের উপর ভিত্তি করে এর বিকাশ ঘটিয়েছে। যা আজ বিলাতের সরকারী পর্যায়ে স্বীকৃত এমনকি ব্যক্তিগত ভাবে সরকারি উচ্চ মহলের পদস্থ ব্যক্তিবর্গ অত্যন্ত আগ্রহের সাথে এই খাদ্য গ্রহণ করছেন।
কোন রকম শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ ছাড়াই যে ভাবে এই শিল্পের প্রসার ঘটেছে তাতে অবাক না হয়ে পারা যায় না। আমাদের দেশে বা এই দেশে যদি সরকার বা বেসরকারি পর্যায়ে এমন কোন প্রতিষ্ঠান থাকতো যেখানে এসব শিক্ষা দেয়া হয় তা হলে নিশ্চয়ই এর প্রতিফলন আরও ব্যাপক আরও বিস্তৃত হতে পারত। তবে, এখনো সে সুযোগ হারিয়ে যায় নি। এখনো সারা যুক্তরাজ্যে প্রায় বিশ হাজার রেস্টুরেন্ট এবং টেক এওয়ে রয়েছে যার অন্তত ৮০% আমাদের বাংলাদেশিদের মালিকানায় রয়েছে। কোনটা একক মালিকানায় আবার কোনটা একাধিক মালিকানায় রয়েছে। শুধু যুক্তরাজ্যেই নয় সারা ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা সহ অনেক জায়গায় এই ব্যবসা বিস্তারিত। তবে বিলাতে এর প্রসার উল্লেখযোগ্য।
এতে যে শুধু ভিন দেশিদের রসনা তৃপ্ত হচ্ছে তা নয় এর মাধ্যমে এই রেস্টুরেন্টের স্বত্বাধিকারীদের সম্পদের বিশাল ভাণ্ডার জমে উঠছে যার বেশ একটা মোটা অংশ আমাদের দেশে যাচ্ছে। নানা ভাবে যাচ্ছে। তারা নিজেরাও পাঠাচ্ছে আবার এখানে যারা কাজ করে তারাও বাংলাদেশি কাজেই তারা যে মজুরী পাচ্ছে তা থেকে সে নিজের জন্য কিছু রেখে প্রায় সবটাই পাঠিয়ে দিচ্ছে দেশে। এতে বাংলা দেশের ছাত্র যারা এখানে পড়তে আসে তাদের একটা আশ্রয় হয়েছে। রেস্টুরেন্টে কাজ করলে অন্তত থাকা খাওয়ার কোন চিন্তা নেই, অধিকন্তু সপ্তাহ শেষ কিছু স্টার্লিং পাউন্ড পাচ্ছে যা এদেশের জন্য নগণ্য হলেও আমাদের দেশের জন্য অনেক।

No comments:

Post a Comment

Thank you very much for your comments.