Tuesday 13 November 2012

হতাশ হাঙ্গর (১-২)


ইরিশ সাগরে অক্টোবরের প্রথম থেকেই যেন শীত সাহেবের আক্রমন বেড়ে যায়। এ পাড়ে ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড আর ও পাড়ে আয়ারল্যান্ড। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি আবার তার সাথে ঝড়ো বাতাস কিংবা ঘন কুয়াশা। প্রায় সারাক্ষণ একটা না একটা
প্রাকৃতিক এলোমেলো ভাব থাকবেই। মাঝে মাঝে এমন হয় যে রীতিমত জাহাজের ডেকের উপর দাঁড়িয়ে নিজের পায়ের জুতা পর্যন্ত দেখা যায় না
এমন কুয়াশা। সাগরের পানি এবং পানিতে সাঁতরানো মাছ গুলি বাছাই করতে থারমাল গ্লোভস হাতে পরা থেকেও মনে হয় যেন হাত জমে বরফ হয়ে গেছে, কোন বোধ থাকে না। আর ডিসেম্বরে? সে তো এক ভয়ানক ব্যাপার। মনে হয় যেন সমস্ত সাগরের পানি বরফ হয়ে রয়েছে। এমন সময় সমুদ্রে মাছ ধরা হয় না বললেই চলে। তাই বলে কি আর ফিশিং ট্রলার গুলি বসে থাকবে? না, তেমন কোন সম্ভাবনা মোটেই নেই।

১৯৮০ এর দশকের প্রথম দিকে রবার্টলি নামের যে ফিশিং ট্রলারে কাজ করি সেটা স্কটল্যান্ডের উত্তরে ওবান শহর থেকে আয়ারল্যান্ডের বেলফাস্ট এবং ইংল্যান্ডের ব্ল্যাকপুল কিংবা যদি সী স্ক্যানারে দেখা যায় সাগর তলে মাছের ঝাঁক মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে তখন খুব বেশি হলে লিভারপুল পর্যন্ত আইরিশ সাগরের মধ্যেই মাছ ধরে বেড়াই। স্যালমন বা লাল স্যালমন পেলে সেটা হয় বাড়তি পাওনা। আমাদের সেফ পিটারের ওভেন যেন রেডি হয়েই থাকে কখন গ্রীল করবে। একটা বা দুইটা না মোটা মুটি ৮/১০ টা রেড স্যালমন গ্রীল না হলে যেন হয় না। জাল তুলে ফেরার পথে ব্ল্যাকপুলের একটু পশ্চিমে ‘আইল অফ মান’ দ্বিপে কয়েক ঘন্টার জন্য থেমে কিছু প্রয়োজনীয় জিনিষ পত্র নিয়ে নেই। এই ফাঁকে আবার ওই আইরিশরা যারা এ কয় দিন একটু গলা ভেজাবার জন্য পাবে যেতে পারেনি তারাও একটু সুযোগ পেয়ে জেটির কাছের একটা পাবে গিয়ে দুই এক পাইন্ট লাগার (আমাদের দেশে যাকে বিয়ার বলে) গিলে আসে। জাহাজে বসে গিললে নাকি কোন স্বাদ পায় না!!
আমাদের কোম্পানির অফিস ওবান শহরে। এটা ছোট হলে কি হবে ভীষণ সুন্দর একটা টুরিস্ট শহর। সারা বছর এখানে পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তের নানা দেশের পর্যটকেরা আসছে যাচ্ছে, তবে শীত কালে কিছুটা কম। সারাটা শীতেই হয়ত ছাতা নয়ত রেইন কোট সাথে নিয়ে কি আর টুরিস্টরা বের হতে চায়?
মাছ বোঝাই জাহাজ নিয়ে এসে জেটিতে ভিড়েই মাছ এবং সামুদ্রিক অন্যান্য শামুক, স্টার ফিশ ইত্যাদি সব আনলোড করে শুধু মাত্র জাহাজে ওয়াচ কিপিঙ্গের জন্য দুই চার জন থেকে বাকি সবাই নেমে যেতাম। গত টানা অন্তত এক মাস সাগর বাসের এক একঘেয়েমি কাটাতে নেমে যেতাম। ছোট্ট অথচ ওপাশে পাহাড় ঘেরা মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্যে সাজানো এই ওবান শহরের এখান থেকে ওখানে ঘুরে বেড়াতাম। সাধ মিটত না, অন্তত আমার কখন একঘেয়েমি আসেনি। প্রতিবার যখন এসেছি তখনি মনে হতো যেন এই প্রথম এসেছি। এর মধ্যে শহরের উত্তর দিকের সিভিক সেন্টারের টাউন হলে দেখে যেতাম কি নাটক হচ্ছে। মন মত কোন নাটক পেলে পঞ্চাশ পাউন্ড দিয়ে টিকেট করে ঢুকে পরতাম। শেক্সপিয়ারের নাটক গুলি ইংরেজরা যে ভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারে তা মনে হয় আর কেউ পারে না। কাজেই এই লোভ সামলানো কোন বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে করতাম না। নাটক না হলেও অন্তত লাইব্রেরিতে গিয়ে ঘণ্টা খানিক ধরে স্থানিয় দুই একটা সংবাদ পত্রের হেডলাইন দেখে আবার জাহাজে ফিরে এসে খেয়ে দেয়ে শুয়ে পরতাম। বেশির ভাগ সময়ে বাইরেই বিশেষ করে গোটা তিনেক বাংলাদেশি রেস্টুরেন্ট আছে তার কোন একটাতে খেয়ে আসতাম। এখানে খেতে আসলে বারতি একটা বোনাস পেতাম। কিছুক্ষণ বাংলায় কথা বলার সুযোগ পেতাম। আমার সাথে যারা আছে তারা সবাই আইরিশ। আর এরা আইরিশ টানে যা ইংরেজি বলে তা প্রথম দিকে প্রায় কিছুই বুঝতাম না। তবে ওরা আমার কথা বুঝত।

একবার নিকির সাথে চলে গিয়েছিলাম বৃটেনের সর্ব্বোচ্চ শহর ফোর্ট উইলিয়ামে। ওবান থেকে বাসে করে উত্তর দিকে প্রায় তিন ঘণ্টার পথ। বাস যখন পাহাড়ী পথ বেয়ে ধীরে ধীরে একে বেঁকে উপরে উঠছিল সে এক মায়া ভরা অপূর্ব দৃশ্য। চারদিকে পাহাড়ী উঁচু নিচু সবুজের তেপান্তর। কোথাও কুয়াশা কুয়াশা ঝাপসা আবার কোথাও ঝিকিমিকি রোদ্দুরের আলোছায়া। প্রকৃতি যে এমন সুন্দর হতে পারে তা এই স্কটল্যান্ডে না এলে দেখা কঠিন। এমনিতে এখানে জন সংখ্যা খুবই কম। অনেক দূরে দূরে পাহাড়ের ঢালু বেয়ে কিছু কিছু জন বসতির ছোঁয়া। দূর থেকে বাড়ির ছাদের লাল রঙের টালি গুলি চোখে পরার মত। ফোর্ট উইলিয়াম পৌঁছে মনে হলো কে যেন মনের মাধুরী মিশিয়ে অনন্ত কালের অলস সময় নিয়ে বসে বসে হাতে এঁকে সাজিয়ে রেখেছে। শহরের এক পাশে এসে যখন দাঁড়িয়ে সামনের দিকে দৃষ্টি মেলে দিলাম আহা! সে কি মন জুড়ানো ছবি! কত দূরে দেখা যাচ্ছে। চারদিকে নিঝুম নিস্তব্ধ, শুধু আঁকাবাঁকা এলো মেলো পাহাড়ী সবুজ আর সবুজ। দূরে ওই উত্তরে এবং পশ্চিমে পাহাড়ের ওপাশে নীল সাগর, দুই চারটা গাং চিল উড়ে বেড়াচ্ছে। চোখের পলক পরতে চায় না। মন প্রাণ চোখ সব এক সাথে বলে উঠেছিল বাকিটা জীবন এখানেই থেকে যাই। খেয়ে না খেয়ে শুধু এই প্রকৃতি দেখে দেখেই জীবন কাটিয়ে দেই।
গরম কালে স্কটল্যান্ডের উত্তর প্রান্তের শহর ইনভার্নেস এর উত্তরে দেড় দুই শত মাইলের মধ্যে যখন যেখানে মাছের ঝাঁক বেশি থাকে ওই এলাকায় জাহাজের পিছনে জাল ফেলে ট্রলিং করতাম একটানা সপ্তাহ খানিক। দিনে অন্তত তিন চার বার জাল টেনে মাছ তুলে বাছাই, গ্রেডিং করে হোল্ডে সাজিয়ে রাখতাম। স্যালমন, রেড স্যালমন, ট্রাউট, কড, হোয়াইট ফিশ, চিংড়ি, লবস্টার, স্নিফার, হেরিং আরো কত ছোট বড় হাজার রকমের মাছের সাথে জেলি ফিশ, স্টারফিশ, কাঁকড়া, নানা জাতের ঝিনুক, শামুক, বাচ্চা হাঙ্গর, বাচ্চা অক্টোপাস‌ সহ কত কি যে উঠত সে এক দেখার মত দৃশ্য। সমুদ্রের নিচে যে এত প্রাণী তা এই মাছের জাহাজে কাজ না করলে হয়ত কোন দিনই জানতাম না। এগুলির মধ্যে আবার যা মানুষের খাদ্য নয় সেগুলি পশু খাদ্য তৈরীর জন্য ব্যবহার হতো আর মানুষের খাদ্য যোগ্য গুলি আলাদা গ্রেডিং করতে করতে নাজেহাল অবস্থা। মানুষের খাদ্য বলতে আমাদের দেশে যা বোঝায় এখানে ঠিক তেমন না। এদের সুস্বাদু খাদ্য তালিকায় এক রকম ছোট ছোট মুসেল নামে ঝিনুক আছে যা বেশ দাম দিয়েই এরা কিনে বিশেষ করে ফ্রেঞ্চরা। অবশ্য আমাদের পিটার সামুদ্রিক সাদা কাঁকড়া দিয়ে যে কাটলেট বানাত তা প্রথম দিকে দেখে মোটামুটি নাক সিঁট্‌কাতাম। কিন্তু এক দিন ওদের সাথে ডাইনিং টেবিলে এক সাথে খেতে বসে নানান পদের সস দিয়ে ওই কাঁকড়ার কাটলেট খাবার ভঙ্গি দেখে একটু মুখে দিয়েই রীতি মত আফসোস হল। এত দিন কেন খাইনি?
[চলবে]

No comments:

Post a Comment

Thank you very much for your comments.