Tuesday 13 November 2012

নিয়তি, তুমি এখন কোথায়

 ট্যংকার ‘নেপচুন’ জাহাজটি ত্রৈমাসিক রুটিন মেইনটেনেন্সের জন্য নিজ কোম্পানি গ্রে ম্যাকেঞ্জির রিজিওনাল হেড অফিস বাহরাইনের মোহাররেকে নিজস্ব স্লিপ
ওয়েতে এসেছে। এটি ব্রিটিশ পতাকা বাহী এবং এর ধারণ ক্ষমতা বার হাজার টন। জাহাজটির পোর্ট অফ রেজিস্ট্রি লন্ডন হলে কি হবে এতে মোটামুটি চার পাঁচটা দেশের নাবিক কাজ করে। এদের সাথে রয়েছি বাংলাদেশের আমি
এবং জসীম। আমরা এক সাথে লেখাপড়া করেছি এবং দেশ ছেড়ে দুই জনে এক সাথে রয়েছি বলে স্বাভাবিক ভাবে অন্তরঙ্গতা বা ঘনিষ্ঠতা একটু বেশি। স্লিপ ওয়েতে সাধারণত ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যেই জাহাজের বটম, প্রপেলার, রাডার চেক করা আর টুকি টাকি যা মেরামত কাজ থাকে সেগুলি সেরে পাশের সিতরা ট্যাংকার বার্থ থেকে লোড নিয়ে ভিন্ন কোন বন্দরে চলে যাই।
এবার প্রথম যে দিন সকালে এখানে এসেছি সে দিন স্লিপ ওয়ের লোকজনেরা আমাদের ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন বার্কির দেয়া লিস্ট অনুযায়ী জাহাজের মেরামত কাজ করছে। সারা দিন আমরা জাহাজের নাবিকেরা সবাই যার যার কাজ অনুযায়ী ওদের দেখিয়ে দিচ্ছি এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিচ্ছি।
বিকেলে কাজকর্ম সেরে মানামা যেতেই হবে। ওখানে একটা দোকানে দারুণ সিঙ্গারা বানায়। এক শ ফিলসে একটা কাগজের প্লেটে চারটা সিঙ্গারা আর তার সাথে যে চাটনি সেও দারুণ। তবে কোন পানি নেই, পানি খেতে হলে আলাদা সফট ড্রিঙ্কস কিনে নিতে হবে। জাহাজ যখনই এই ছোট্ট মুক্তা দ্বীপের দেশ বাহরাইন আসে তখনই আমাকে ঐ সিঙ্গারার লোভে মানামা যেতেই হবে। কখনো শোর লিভ না পেলেও ক্ষতি নেই। অন্য যেই যাক তাকেই বলে দিতাম আমার জন্য সিঙ্গারা নিয়ে এসো। এক বার এক এক করে পাঁচ প্লেট খেয়েছিলাম। আজও সে কথা মনে হলে হাসি পায়। জাহাজে শুধু মাত্র বাংলাদেশি রান্না বাদে নুন মরিচ মশলা ছাড়া পাঁচ মিশেলি যেমন কখনো ইংলিশ, কখনো ইটালিয়ান কিংবা গ্রীক। এই সব রান্না খেয়ে কি আর বাঙ্গালির মন ভরে? তাই যখন এই উপ সাগরের পাড়ে যেখানে জাহাজ যায় খুঁজে বেড়াতাম কোথায় বাংলাদেশি বা ভারতীয় বা নিদেন পক্ষে পাকিস্তানি রেস্টুরেন্ট আছে। অবশ্য অনেক দিন যাতায়াত করতে করতে আমাদের জানা হয়ে গিয়েছিল কোথায় কি আছে। জাহাজ থেকে শোর লিভ পেলেই নুন মরিচের স্বাদের আশায় ছুটে যেতাম ওই সব রেস্টুরেন্টে।
যাক, যা বলছিলাম। এবার প্রথম দিন বিকেলে বাইরে যাবার জন্য জসীমকে সঙ্গে নিয়ে জাহাজের গ্যাং ওয়েতে এসে নিচে নামার সিঁড়ির রেলিং ধরে দাঁড়িয়েছি এমন সময় ক্যাপ্টেন পিছন থেকে ডাকল। ফিরে দাঁড়ালাম।

শোন, ওই যে ডেকের উপরের ব্রিজের নিচ দিয়ে যে পানির লাইনে লিক হয়েছিল তুমি ডেভকন দিয়ে মেরামত করেছিলে মনে আছে?
হ্যাঁ থাকবে না কেন, এইতো সেদিনের কথা।
তা হলে কাল ওয়ার্কশপের লোকজনেরা আসার আগে ওই ডেভকনের প্রলেপ সরিয়ে দিও যাতে ওটা ওয়েল্ডিং করে নেয়া যায়।
আচ্ছা ঠিক আছে কাল সকালেই করে ফেলব।
বলে নেমে গেলাম। যাবার পথে জসীমের সাথে নানা ধরনের গল্প। ওর ভয়েজ শেষ করে দেশে ফেরার সময় হয়ে গেছে কিন্তু ও চাইছে আরও কিছু দিন থেকে আরও কিছু ডলার সাথে নিয়ে যেতে। ওকে বোঝাবার চেষ্টা করছি দেরি করে কি হবে তার চেয়ে তুই এবার চলে যা, আবার না হয় তাড়াতাড়ি ফিরে আসবি! ওদিকে তোর বৌ অপেক্ষা করছে। না, ও কথা সে মানছে না। যাক, না মানলে আমি কি করব? আমার যেতে অন্তত আরও মাস খানিকের মত দেরি আছে। ও জানে কিন্তু তবুও আমাকে বলল তুই চলে যা। আরে আমি কি করে যাই? আমার আরও দেরী আছে না?
সে দিন আগের মতই মানামা থেকে সিঙ্গারা খেয়ে অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরি করে রাতে একটা ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে খেয়ে জাহাজে ফিরে এসে শুয়ে পরলাম।
পর দিন সকালে একটু তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে ডেকে গেলাম। শুকনো ডেভকনের আস্তর তোলার জন্য চিপিং হ্যামার এনে যেই প্রথম বারিটা দিলাম আর ওমনিই ডেভকনের একটা বিরাট টুকরো এসে আমার ডান চোখে আঘাত করল। সে কি যন্ত্রণা! মনে হচ্ছিল এই বুঝি জীবনের শেষ। সমস্ত পৃথিবী এক ঝলক করে নানা রঙ্গে রঙ্গিন হয়ে উঠল। রঙ গুলো আসছে যাচ্ছে। ভাবছি, আমি বুঝি মরে যাচ্ছি। শুধু একটা চিৎকার দিতে পেরেছিলাম। এই মনে আছে। আর কিছু মনে নেই। যখন জ্ঞান ফিরে পেলাম তখন দেখি আমার পাশে সাদা পোশাক পরা এক জন ইন্ডিয়ান নার্স দাঁড়িয়ে আমাকে দেখছে। ওকে দেখে মনে হচ্ছিল কবরের ভিতরে এই মানবী এলো কেমন করে?সেও আবার আমার দেশের মেয়েদের মত চেহারা! দুনিয়ার কাজ কর্মের হিসেব নিবে না কি করবে বুঝে উঠতে পারছি না। অবাক হয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। কিছুই বুঝতে পারছি না। আমাকে ওই ভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভদ্র মহিলা ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল এখন কেমন লাগছে?

এ কি! এ দেখি আবার মানুষের মতই ইংরেজিতে কথা বলছে। ফেরেশতারা কি এমন হয়, ইংরেজিতে কথা বলে?
কিন্তু দুনিয়াতে শুনেছি ফেরেশতারা আরবিতে কথা বলে। তাহলে? পাপ পুণ্যের কিছু জিজ্ঞেস করছে না কেন? তাহলে এ কি ফেরেশতা নয়? আবার জানতে চাইল,
কেমন লাগছে?
এ্য, এটা কোন জায়গা?
এটা বাহরাইন জেনারেল হাসপাতাল।
আমি এখানে কেন?
তোমার চোখে একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে।
শোনার সাথে সাথে অনুভব করলাম আমার ডান চোখে ব্যান্ডেজ।
সম্ভবত কোন আঘাত পেয়ে তুমি সেন্স লেস হয়ে গিয়েছিলে। ডাক্তার এক্স রে করে তোমার ডান চোখ অপারেশন করে মণির ডান পাশ থেকে প্রায় তিন মিলিমিটার ডিপ থেকে লোহার মরিচার গুড়া বের করেছে। কি হয়েছিল?
এই এতক্ষণে সব কিছু একটু একটু মনে পরছে। আমি ক্যাপ্টেনের নির্দেশে ডেকের উপর দিয়ে ফোর ক্যাসেলে যাতায়াতের পথের নিচের পানির লাইন থেকে ডেভকন তুলছিলাম। কি একটা যেন ছুটে এসে আমার চোখে আঘাত লাগল। এরপর আর কিছু মনে পরছে না। মনে করার চেষ্টা করছি কিন্তু কিছুই পারছি না। নার্স আবার জানতে চাইলে যা মনে পরেছে তাই বললাম। শুনে খুব আফসোস করল। সিথানের পাশে দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর সান্ত্বনার কথা বলছে।
তোমার ভাগ্য ভাল বলতে হবে যে চোখের মণিতে লাগেনি। চোখটা রক্ষা পেয়েছে, কয়েক দিনেই ভাল হয়ে যাবে চিন্তা করো না এখন এই ওষুধটা খেয়ে নাও। সেই সকাল থেকে এমনি রয়েছ, আমি তোমার খাবার নিয়ে আসছি।
বিকেলে ক্যাপ্টেন ই বার্কি, জসীম এবং আরও কয়েক জন এল।
জসীম বলল
আমি তোমার চিৎকার শুনেই দৌড়ে কাছে এসে দেখি তুমি ডেকে পরে রয়েছ পাশে চিপিং হ্যামার। তোমাকে তুলে দেখি পকেটে প্রায় চার ইঞ্চি সাইজের একটা পুরু ডেভকনের টুকরো। ওই দেখেই বুঝলাম ওটা তোমার চোখে লেগেছে। সেফটি গ্লাস পরে নাওনি কেন?যাই হোক তাড়াতাড়ি ক্যাপ্টেনকে জানালাম উনি সাথে সাথে ওয়ার্কশপের গাড়িতে করে তোমাকে নিয়ে এই হাসপাতালে এলো। সাথে আমি আর ড্যানি এসেছিলাম। ইমার্জেন্সীতে নিয়ে সাথে সাথে এক্স রে করে দেখে অপারেশন করে এখানে নিয়ে এলো। আমরা সবাই ছিলাম। তোমার জ্ঞান ফিরছে না বলে এই নার্স এখানেই ছিল।
বেশ অনেকক্ষণ থেকে ওরা চলে গেল। এর পর থেকে পালা করে কয়েক জন নার্স ডিউটি করেছে। বেশ যত্ন করছিল সবাই। গোসল করা যাবে না বলে গরম পানিতে শরীর মুছে দেয়া থেকে সময় মত খাবার এবং ওষুধ খাওয়ানো সব কিছু। শুধু টিভি দেখতে বা কোন পত্রিকা পড়তে দেয়নি। তারপর দিন বিকেলে আবার জাহাজ থেকে কয়েক জন এলো। ওদের সাথে আমাদের এই স্থানীয় অফিসের ক্রু সুপার ক্যাপ্টেন রামস বটম এলো। এ দেশে হাসপাতালে রুগীর জন্য বাইরে থেকে কোন খাবার দাবার বা ফুল বা কোন কিছুই সাথে করে নিয়ে আসার কোন নিয়ম নেই। সে দিন যাবার সময় ক্যাপ্টেন বার্কি বলল
জাহাজের মেরামত হয়ে গেছে, আমরা কাল সকালে সিতরা থেকে লোড নিয়ে দোহা যাব।
ক্যাপ্টেন রামস বটম বলল তুমি এখানেই থাকবে, সুস্থ হলে পরে তোমাকে হোটেলে পাঠিয়ে দিব। জাহাজ থেকে তোমার পাসপোর্ট আমি নিয়ে এসেছি। ইমিগ্রেশনে এন্ট্রি করিয়ে নিয়েছি। পরে তোমার জাহাজ কোথায় থাকে সেই অনুযায়ী জাহাজে যাবার ব্যবস্থা করা যাবে।
আমার চিন্তিত মুখ দেখে বলল,
ডোন্ট ওরি মাই বয় আই উইল বি হেয়ার। আমি প্রতি দিন এক বার এসে তোমাকে দেখে যাব।
আমি বললাম আমার ভাল লাগছে না আমি বাড়ি যাব।
আচ্ছা ঠিক আছে দেশে যাবে, তবে এমন শরীরে জার্নি করবে কি করে? একটু সুস্থ হয়ে নাও তখন যেও।
চার পাঁচ দিনের মধ্যে সুস্থ হলে আমার অফিসের গাড়ি এসে হোটেল মানামায় নিয়ে গেল। হোটেলে তিন চার দিন থাকার পর এক দিন সকালে অফিস টাইমে ফোন এলো। ওপাশ থেকে ইন্ডিয়ান মুর্থি কুশলাদি জিজ্ঞেস করে বলল তোমাকে আবুধাবি যেতে হবে, কাল তোমার ফ্লাইট। গাড়ি পাঠাচ্ছি অফিসে এসে তোমার টিকেট আর পাসপোর্ট নিয়ে যাও। অফিসে যেয়ে মুর্থির সাথে দেখা না করে সরাসরি রামস বটমের রুমে চলে গেলাম।
আমি আবুধাবি যাব না, আমাকে দেশের টিকেট করে দাও।
আচ্ছা ঠিক আছে তোমার কথা আমার মনে আছে। আপাতত তুমি ওখানে যাও, আমি চিটাগাং এ এজেন্টের কাছে তোমার রিলিভার এর জন্য টেলেক্স পাঠিয়েছি কেউ এক জন এলেই তোমাকে পাঠিয়ে দিব।

আচ্ছা ঠিক আছে বলে ধন্যবাদ জানিয়ে রুম থেকে বের হয়ে এবার মুর্থির রুমে এলাম। কিছুক্ষণ কেমনে কি হল এসব নিয়ে আলাপ করে চা খাইয়ে টিকেট পাসপোর্টের খাম দিয়ে বলে দিল কাল বিকেলে ড্রাইভার তোমাকে এয়ারপোর্টে দিয়ে আসবে। আবুধাবিকেও বলে দিয়েছি তুমি ওখানে পৌঁছে অফিসে ফোন দিলেই ওরাও গাড়ি পাঠাবে।
আচ্ছা গুডবাই বলে চলে এলাম।
আবুধাবি পৌঁছে এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি জাহাজে এসে দেখি ওরা তেল আনলোড করে জেটিতে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমি ওঠার পরেই লোড নেয়ার জন্য সউদি আরবের রাস্তানুরাহ এর উদ্দেশ্যে ছেড়ে দিল। এই ভাবে কয়েকটা ট্রিপ পরেই এক দিন দুবাই থেকে কুয়েত যাবার পথে ক্যাপ্টেন জানাল আগামী সপ্তাহে তোমার রিলিভার আসছে। খুশিতে লাফিয়ে উঠলাম। হাতের কাছে যা ছিল তাড়াতাড়ি গুছিয়ে নেয়ার ব্যস্ততা শুরু হল। আবুধাবি যাবার পর টিকেট পেতে দুই এক দিন সময় লাগবে তখন কিছু কেনা কাটা করে নিব। যদি দুবাই থেকে ফ্লাইট হয় তাহলে ভাল হবে। এখানে সব কিছুর দাম কম। কুয়েত থেকে লোড নিয়ে আবার আবুধাবি পৌঁছাতে এক সপ্তাহ লেগে গেল। আবুধাবি পৌছার দুই দিন আগেই জাকির এসে দুবাইর এক হোটেলে থাকছে। গ্রে আবুধাবি (আমাদের কোম্পানিকে রেডিওতে ডাকার নাম) জানিয়েছে। জুলাই মাসের ২২ তারিখ সকালে আবুধাবি পৌঁছে সরাসরি জেটিতে ভীরে দেখি জাকিরকে নিয়ে এজেন্ট অপেক্ষা করছে। আমি আগেই রেডি হয়ে ছিলাম। জাকির জাহাজে ওঠার পর আমার সাইন অফ করে আমার পাসপোর্ট দিয়ে দিল। সাথে চিটাগাং এর এজেন্টকে দেয়ার জন্য ক্যাপ্টেনের লেখা একটা চিঠি। জসীমের কাছে বিদায় নিয়ে ব্যাগ সুটকেস সহ নেমে এজেন্টের সাথে গাড়িতে উঠে বসলাম। পিছনে তাকিয়ে দেখি জসীম করুণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মনটা কেন যেন একটু বিষণ্ণ হয়ে গেল। মনের অবচেতনা থেকে একটা প্রশ্নের উদয় হল। জসীম, আবার কি দেখা হবে? নিজেকে ধমক দিলাম, কি সব ভাবছ? কেন দেখা হবে না? গাড়ি চলতে শুরু করেছে। একটু পরেই একটা বিশাল শেড এর আড়ালে চলে গেলাম। ওরা এখন জাহাজ ছেড়ে আবুধাবির অফ শোর মুরিং এ যেয়ে তেল আনলোড করবে। আর সেই তেল গিয়ে পৌঁছাবে অফ শোর থেকে প্রায় ১০ মাইল দূরে “আবুধাবি ন্যাশনাল ওয়েল কোম্পানি” বা এডনকের ট্যাঙ্কে। ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে দুবাই পৌঁছে জাকির যে হোটেলে ছিল ওখানেই আমাকে নামিয়ে দিল। যাবার সময় ড্রাইভার বলে গেল তোমার টিকেট হলে অফিস থেকে জানাবে, তখন এসে এয়ারপোর্ট নিয়ে যাব। ওকে ইব্রাহিম, বাই!
ইব্রাহিম চলে যাবার পর হোটেলের কাউন্টারে গেলাম। আমাদের এই গ্রে মেকেঞ্জি ম্যারিন সার্ভিস কোম্পানির যত সিম্যান এই দুবাই দিয়ে আসা যাওয়া করে তার সবাই এই হোটেলেই থাকে। এখানকার সবই আমাদের চেনা। অফিস থেকে আগেই হোটেল ম্যানেজারকে জানিয়ে রেখেছিল। রিসিপশনের খাতায় নাম ধাম লিখে আমার হাতে ৬ তলার একটা রুমের চাবি দিয়ে বলে দিল
“হ্যাভ এ নাইস টাইম হেয়ার”।
দুপুরে খাবার পর বের হয়ে সোজা বার দুবাই মার্কেটে চলে গেলাম। দেশে যাচ্ছি বলে কিছু কেনা কাটা করব। হাতে যা ডলার ছিল সেগুলি সব ভাঙ্গিয়ে যা যা মনে ধরল কিনে নিলাম। কিনে দেখি এখনও বেশ কিছু দিরহাম পকেটে রয়ে গেছে। আচ্ছা ঠিক আছে কাল আবার আসব। কাল সকালে একবার দেরা তে অফিসে যাব দেখি টিকেটের কি করেছে জেনে আসব আর হিসেব নিকেশ করে কত ডলার বাকী আছে তা যদি দিয়ে দেয় তা হলে নিয়ে আসব। একটা ট্যাক্সি নিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম। ট্যাক্সি থেকে নেমে হোটেলের ভিতরে ঢুকে লাউঞ্জ পার হয়ে রিসিপশনের পাশ দিয়ে লিফটে উঠবো বলে দরজার পাশে দাঁড়িয়েছি আর অমনি রিসিপশনের ইন্ডিয়ান জন একটু উত্তেজিত ভাবে ডাকল
এই এদিকে আস, তোমার একটা জরুরী ম্যাসেজ আছে!
এগিয়ে গেলাম।

কি খবর জন?
তুমি কি জান যে তোমাদের নেপচুনে আগুন লেগেছে?
শুনেই বুকটা ধক করে উঠল। জসীম, জাকিরের চেহারা মনের পর্দায় ভেসে উঠল।
কি বলছ জন?
হ্যাঁ তুমি বেরিয়ে যাবার পর তোমাকে জানাবার জন্য তোমাদের অফিস থেকে ফোন করেছিল।
বল কি?
হ্যাঁ তুমি তোমার অফিসে ফোন করে জেনে দেখ। বলেই ফোনটা আমার দিকে এগিয়ে দিল। ওদের ফোন বুক বের করে আমাদের গ্রে মেকেঞ্জির ফোন নম্বর বের করে দিল। নম্বর ঘুরিয়ে রিসিভার কানে নিয়ে রিং টোন শুনছি আর বুক ঢিব ঢিব করছে ‘আল্লাহ জন যা বলছে তা যেন সত্যি না হয়!’ ওপাশ থেকে ইন্ডিয়ান স্টেনলির কণ্ঠ চিনতে পারলাম।
হ্যালো স্টেনলি, নেপচুনের কি হয়েছে?
আমি খুবই দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে নেপচুন ইজ ডেড এন্ড মস্ট অফ দি ক্রুজ আর ইন হসপিটাল এন্ড মোর ওভার সাম আর ডেড।
কি করে হল?
সংক্ষেপে সব বলল। সাথে যারা জীবিত আছে তারা আবুধাবির কোন হাসপাতালে আছে বলে দিল।
আমি কি এখন ওখানে যেতে পারি?
না এখন পারবে না, কাল সকালে যেও।
বলেই রিসিভার নামিয়ে রাখল। আমার হাত থেকে কখন রিসিভার নামিয়ে রেখেছি না কি জন নিয়ে রেখেছে বলতে পারছি না। মনে একটা প্রচণ্ড ঝড় বইছে। জসীম আর ওর নতুন বৌ মল্লিকার চেহারা মনে ভাসছে। আজ সকালেই মাত্র জাকির এসেছে। ওর হাসি খুশি চেহারা মনের পর্দায় ভেসে এলো। আমাকে দেখেই বলেছিল যান, আপনার জন্য ঢাকা শহর সহ পুরো বাংলাদেশ রেখে এসেছি। নিজেকে অসম্ভব অসহায় মনে হচ্ছে। এত তাড়াতাড়ি কেন শপিং করতে গেলাম বলে নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। কি হল? জসীমের কি হয়েছে? ওকি বেচে আছে না কি? সেকেন্ডে কয়েক হাজার মাইল বেগে মনের আকাশে অসংখ্য প্রশ্নের ধারা বয়ে গেল। কিছু ভেবে পাচ্ছি না। এখন কি করব? দুবাই থেকে ট্যাক্সিতে আবুধাবি গেলেও দেড় ঘণ্টা লাগবে। কিন্তু এখন ওখানে যেয়েও কিছু হবে না। কাউকে দেখতে পাব না, কিছু জানতে পারব না। অনেকক্ষণ হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে রইলাম। কোন বোধ নেই। জন ডেকে লাউঞ্জের একটা সোফা দেখিয়ে বলল
ওখানে একটু বস। চিন্তা করে কিছু হবে না। কাল সকালে আবুধাবি গিয়ে দেখ।
সোফায় বসলাম। জন রিসিপশন কাউন্টার থেকে বেরিয়ে এসে আমার পাশে বসে সান্ত্বনা দিচ্ছে। আসা যাওয়ার পথে দুবাই এলে এই হোটেলে থাকি বলে প্রায় সবার সাথে বেশ আলাপ আছে। ওর কথা কিছু কানে ঢুকছে অধিকাংশই ঢুকছে না। বুঝতে পারছি। জাকির যদি আর মাত্র কয়েকটা দিন পরে আসত কিংবা জসীম যদি আমার আগে চলে যেতে চাইত তা হলে আমি নিজেই ওই জাহাজে থাকতাম। “নেপচুন ইজ ডেড” বারবার স্টেনলির এই একটা কথাই শুধু মনের আকাশে কাল মেঘের মত ছেয়ে আছে। এ কথার মানে কি তা আর কেউ না জানলেও যারা নাবিক, সাগরে ভেসে যাদের জীবন কাটে তারা খুব ভাল করেই জানে।
মানুষ নিজেই জানে না তার নিজের একটা অসম্ভব সুন্দর এবং কার্যকর গুণ আছে। আর তা দিয়ে যত রকমের বিশাল বা ক্ষুদ্র মনের আঘাত এক সময় ভুলে যেতে পারে। মনের উপরে ভুলের একটা প্রলেপ দিয়ে দেয়। যেমন পারে নিজের সন্তানের অকাল মৃত্যু যন্ত্রণা, মায়ের সাধ না মিটিয়ে তাকে কবরে রেখে আসার ব্যথা কিংবা প্রিয়তমর হঠাৎ করে এই পৃথিবী থেকে চিরতরে চলে যাওয়ার হাহাকার। তেমনি একটা গুণ বোধ হয় আমারও আছে আর তাই সম্ভবত এক সময় যে কোন ভাবেই হোক আমিও সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে লিফটে করে উপরে চলে গেলাম।
সারা রাতে ঘুম আসেনি। বারবার জসীম, জাকির, মাত্র গত ভয়েজের শেষে বিয়ে করা জসীমের নতুন বৌ মল্লিকা আর আমার অবস্থান নিয়ে একটি করুণ বিষাদে ভরা চলচ্চিত্র দেখেছি। যার পরিচালক নিয়তি স্বয়ং। অভিনয় করেছি আমরা এই কয়েক জন এবং আশে পাশে ছিল আরও কয়েক জন। তাদের এক জন হচ্ছে এমন এক জন যার সাথে এই ভয়েজের শেষে দেশে যাবার পরে আমার সাথে সারা জীবনের জন্য একটা মধুর সম্পর্ক হবার কথা গুরু জন মহলে ঠিকঠাক হয়ে আছে।
কি হবে এই সম্পর্কে? এই তো জসীম কত গুলি বছর ধৈর্য ধরে কত অপেক্ষা করে কত বাধা বিপত্তি এড়িয়ে মল্লিকাকে নিয়ে এলো। আজ কোথায় মল্লিকা আর কোথায় জসীম? মল্লিকা কি জানতে পেরেছে? ওর এত প্রতীক্ষার জসীম এখন কোথায়? গ্রে ম্যেকেঞ্জি টেলেক্স পাঠাবে চিটাগাঙের এজেন্টকে। ওই টেলেক্স পেয়ে চিটাগাঙের এজেন্ট টেলিগ্রাম পাঠাবে জসীমের বৌ মল্লিকাকে। তাতে অন্তত তিন থেকে চার দিনের আগে মল্লিকার এ সংবাদ জানার কথা নয়। কিন্তু সত্যি কি তাই? মল্লিকা কি স্বপ্নে কিছুই দেখেনি? তার হাত থেকে কি কিছু ছুটে পরে যায়নি? হাটার পথে কি কোন হোঁচট খায়নি? কিংবা মল্লিকার বুকের ভিতরে লুকান জসীমের জন্য ভালবাসার যে স্বপ্ন সরোবর রয়েছে সেই সরোবরে কি উথাল পাথালি কোন ঢেউ ওঠেনি? নিশ্চয় টেলেক্স টেলিগ্রামের ধাঁধা ডিঙ্গিয়ে মল্লিকার লুকান সরোবরে এতক্ষণে উত্তাল প্রলয়ঙ্করী কোন ঢেউ আছড়ে পরছে। মল্লিকা কি ধারনাও করতে পারছে এই ঢেউয়ের মানে কি?

তা হলে আমি কেন এই কণ্টক বিভীষিকা এবং পায়ে পায়ে বিপদের হাতছানি জড়িত জীবনের সাথে তাকে জড়াব? তাকে কি জানাব জসীম মল্লিকা জাকিরের কথা? এ সব কথা জেনে সে কি আমাকে সহজেই বরণ করে নিবে? তার মনে কি দ্বিধা থাকবে না? তা হলে কি হবে, কি হবে ভেবে ভেবেই রাতটা যে কোথা দিয়ে কেমন করে চলে গেল কিছুই বুঝলাম না। ভোরের আজানের সুরে মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল। বিছানা ছেড়ে উঠে জানালার পর্দা সরিয়ে পাশের দরজা খুলে বারান্দায় চেয়ারে বসলাম। অনেক দূরের মরু পাহাড়ের উপর দিয়ে সূর্যের লাল রশ্মি চিক চিক করে উপরে উঠে আসতে চাইছে কিন্তু কি জানি মল্লিকার কথা ভেবে হয়ত সাহসে কুলিয়ে উঠতে পারছে না। বেশ অনেক ক্ষণ তাকিয়ে থেকে এক সময় ভিতরে এসে সকালের কাজ কর্ম সেরে কাপর পরে নিচে এসে রিসিপশনে বলে হোটেল ছেড়ে এলাম। ভাগ্য ভাল, সাথে সাথেই একটা ট্যাক্সি পেয়ে সোজা আবুধাবির ওই হাসপাতালে চলে এলাম।
রিসিপশনের লোকদের আমার পরিচয় জানালাম। সাথে আরও বললাম, ওখানে আমিও থাকতে পারতাম কিন্তু নিতান্ত নিয়তির অনিচ্ছা ছিল বলে থাকা হয়নি। শুনে ওরা আফসোস করল, ভেরি স্যাড! এক জন আমাকে ডান বাম ইত্যাদি বলে লিফট দেখিয়ে দিল। লিফট বেয়ে ওদের ডান বাম অনুযায়ী ৩২ ডি নম্বর রুমে ঢুকে দেখি জাকির শুয়ে আছে। সারা শরীরে ব্যান্ডেজ, গায়ে কোন কাপড় নেই, শুধু ব্যান্ডেজ। নার্সকে বললাম, পাশের টুল দেখিয়ে বসতে বলে ডাকতে নিষেধ করল। ঘুম ভাঙলে কথা বলতে বলল। অপেক্ষা করছি। রুমের বাইরে এসে নার্সকে জিজ্ঞেস করলাম অন্য যারা ছিল তারা কোথায়?
নার্স রুম ছেড়ে পাশের রুম থেকে একটা টাইপ করা কাগজের ফটো কপি এনে হাতে দিল। পড়ে দেখলাম পাঁচ জন স্পট ডেড। তার মধ্যে জসীমের বিকৃত ডেড বডি পাওয়া গেছে বাকী কারো কোন চিহ্নই পায়নি। এডনকের যে পাইপ ফিটার ছিল তাকেও পাওয়া যায়নি। হয়ত বা কোন হাঙর বা কোন সামুদ্রিক জীবের ক্ষুধার খাদ্য হয়েছে কি না কে জানে? এই হাসপাতালে বার জন চিকিৎসায় আছে।
প্রায় ঘণ্টা খানিক পরে জাকির চোখ মেলে তাকিয়েছে। দেখে পাশে দাঁড়ালাম। আমার দিকে হাসি কান্না সব কিছু ভুলে কেমন যেন ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইল। মনে হচ্ছে ওর কোন বোধ বিকার কিছুই নেই। আমাকে চেনার কোন লক্ষণ দেখছি না। কি হয়েছে বা ও কোথায় আছে কিছুই বুঝতে পারছে বলে মনে হচ্ছে না। ওর সাথে আমিও কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। কিন্তু এ ভাবে কতক্ষণ? মিনিট দশেক পরে ডাকলাম,
জাকির! কেমন আছ জাকির?

মনে হল কিছুটা সম্বিত ফিরে পেয়েছে। ব্যথায় মুখটা বিকৃত হয়ে গেল, বুঝে আমার মনেও আঘাত লাগল। মাত্র এই, এই টুকু সময়ের মধ্যে কি থেকে কি হয়ে গেল। কাল সকালেই যাকে দেখেছি ফুরফুরে বাতাসের মত হাসছে। আজ তার এ কি চেহারা! শুধু কাল সকালে কেন, বিগত ৭/৮ বছর ধরেই দেখছি যে জাকির কখনও মুখ ভার করে থাকেনি। আস্তে আস্তে ওর চোখ দুটি ভিজে আসছে। গায়ে মাথায় কোথাও হাত দেয়ার উপায় নেই। শুধু ব্যান্ডেজ। অনেকক্ষণ কাঁদল। কিছু বলতে পারলাম না, কোন সান্ত্বনার ভাষা খুঁজে পেলাম না। শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলাম। প্রায় আধা ঘণ্টা পর একটু ঠোট নড়ল দেখে বুঝলাম হয়ত কিছু বলতে চাইছে। ওর ঠোটের কাছে কান এগিয়ে আনলাম। নিস্তেজ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল
ভাই, আপনি কি ভাবে জানলেন? এখানে এলেন কি ভাবে?
বললাম সব কিছু। কি হয়েছিল জাকির?
শুনেই আবার কান্না। কাঁদার সুযোগ দিলাম। কান্নার পানিতে যদি দুঃখ কষ্ট গুলি ধুয়ে ফেলতে পারে। কাঁদুক, ও যতক্ষণ পারে কাঁদুক।
প্রায় আধা ঘণ্টা পর একটু শান্ত হলে আবার জিজ্ঞেস করলাম। তখন অতি নিচু কণ্ঠে যা বলল:
আমাকে নামিয়ে দেয়ার পর ওরা অফ শোর বয়াতে মুরিং করে সাগর তলা থেকে তেলের পাইপ তুলে মুখে লাগান ঢাকনা খুলে লাইনের তেল বের হয়ে যাবার অপেক্ষা করছে। সমস্ত জাহাজ পেট্রোলের গ্যাসে ভরে গেছে। জাকির, জসীম আর ইরানি জাবের জাহাজের পিছনের ডিসচার্জিং লাইন এডনকের যে লোকটা খুলছে তার পাশে দাঁড়িয়ে দেখছে এমন সময় পাকিস্তানি কুক হেলপার আরাফাত গ্যালিতে (কিচেন) ঢুকে গ্যাসের চুলা জ্বালাবার জন্য দিয়াশলাই জ্বালাবার সাথে সাথেই আগুনের শিখা মুহুর্তের মধ্যে সমস্ত জাহাজে ছেয়ে গেল। জসীম ভাই চিৎকার দিয়ে পরে গেল জাবেরও ওই ভাবে একটা চিৎকার দিয়ে কি হল জানি না আমি আর কোন উপায় না দেখে পাশের বয়াটা নিয়ে পানিতে ঝাপ দিলাম কিন্তু ঝাপ দেয়ার সময় লক্ষ্য করলাম এতক্ষণে এডনকের পাইপ দিয়ে যে তেল পরে পানিতে ভাসছিল তাতে আগুন ছড়িয়ে গেছে এবং আমি ওই আগুনের মধ্যেই নামছি। চট করে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম বয়া ধরে সাঁতরাতে পারব না। যতক্ষণ পারা যায় ডুব দিয়ে থেকে শ্বাস নেয়ার জন্য হাত দিয়ে উপরের পানি সরিয়ে মাথাটা কোন ভাবে উঠিয়ে শ্বাস নিয়ে আবার ডুবে থাকতে হবে। কিন্তু পানিতে পরার একটু পরেই আমার হাত থেকে বয়াটা ছুটে গেল। এর মধ্যে পানিতে নামার সাথে সাথেই সমস্ত শরীর পুরে গেছে বুঝতে পেরেছি, শরীরে জ্বালা করছে। সাগরের নোনা পানির জন্য চোখ খুলে কিছু দেখতে পারছি না। হাত পুরে গেছে। সাঁতরাতে পারছি না। শেষ যখন হাতে বয়া ছিল তখন দেখেছিলাম যেখানে জাহাজ ছিল তার আশে পাশে আগুন আর আগুন। জাহাজের কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। শুধু আগুন। এডনকের পাইপ ফিটারদের যে বোট ছিল ওরা যে কখন বোট নিয়ে সরে পরেছিল জানি না। ওরাই ওয়ারলেস দিয়ে শোর অফিসে সংবাদ দিয়ে ওই আগুনের মধ্যেই কিছুক্ষণ ফায়ার এক্সটিঙ্গুইশার দিয়ে ফোম ছিটিয়ে ছিটিয়ে যাকে যাকে দেখেছে তাদের তুলে নিয়েছে। এর মধ্যে আবুধাবি হারবার থেকে ফায়ার ফাইটিং টাগ আসতে দেখেছি। এর পর আমার আর কিছু মনে নেই।
আমাকে জিজ্ঞেস করল
জসীম ভাই কোথায়?

আমি কোন জবাব দিতে পারিনি। শুধু এটুক বলেছিলাম অন্য কেবিনে আছে।
আপনার টিকেট হয়েছে?
না এখনও অফিসে যাইনি। আজ সকালে যাব ভেবেছিলাম কিন্তু কাল রাতে তোমাদের এই সংবাদ জেনে আজ অফিসে না যেয়ে একটা ট্যাক্সি নিয়ে এখানে চলে এসেছি।
এর দুই এক দিন পরেই আমার টিকেট হয়ে গেল। মনের মধ্যে একটা গভীর টান থাকা সত্বেও বিদেশের নানা জটিলতার জন্য আর জাকিরকে দেখতে আবুধাবি যেতে পারিনি। দুবাইতে অফিস, ইমিগ্রেশন ইত্যাদি নানা ঝামেলা সেরে বিষণ্ণ মনে দুবাই এয়ারপোর্ট থেকে প্লেনে উঠে সিট বেল্ট বাধছিলাম আর ভাবছিলাম, “নিয়তি, তুমি এখন কোথায়”? একটু পরে ব্রিটিশ এয়ারলাইন্সের প্লেন যখন দুবাইর মাটি ছেড়ে আকাশে উঠে যাচ্ছিল তখন ফেলে আসা জসীমের নিশ্চিহ্ন দেহ, জাকিরের করুণ দৃষ্টি আর মল্লিকার কল্পিত হাহাকারের কথা ভেবে কেমন যেন পাথরের মত বসে বসে জানালা দিয়ে সিনেমার মত সব দেখলাম। কিছুক্ষণ পরে এয়ার হোস্টেসের ডাকে যখন সিনেমা দেখা থেমে গেল ততক্ষণে প্লেন উড়ে চলেছে স্বপ্নের মহানগরী ঢাকার পথে।

No comments:

Post a Comment

Thank you very much for your comments.