Saturday 17 November 2012

বিলাতের সাত সতের - ৪ [৯]

[পূর্ব প্রকাশের পর]
বাসার সাথেই ইউনিভার্সিটির পিছনের একটা গেটের ভিতর দিয়ে হেটে মাইল এন্ড টিউব স্টেশনে এসে আরিফ চলে গেল ডিস্ট্রিক্ট লাইনে আমি একটু অপেক্ষা করলাম সেন্ট্রাল লাইনের জন্য।

ফিরোজের বাসায় বসে চা খেতে খেতে ভাবি সহ গল্প করলাম কতক্ষণ। ভাবি বলল কি ভাই মেয়ে আসছে বলে মনে খুশি লাগছে না?

কি যে বলেন ভাবি, সে কি আর বুঝেন না?আচ্ছা ফিরোজ আমাকে কখন বের হতে হবে?
কোন এয়ার লাইনে আসছে যেন?
বৃটিশ এয়ারে।
তাহলে তুমি দুটায় বের হলেই হবে কারন ও শিডিউল টাইমে ল্যান্ড করলেও ইমিগ্রেশন, হেলথ, লাগেজ, কাস্টম এসব সেরে দুই ঘন্টার আগে বের হতে পারবে না। ভাল কথা মনে হয়েছে, বৃটিশ এয়ার কোন টার্মিনালে ল্যান্ড করে জান?
না।
৪ নম্বরে।
তাই নাকি! না বললে তো আমি ৩ নম্বরে যেয়ে খুঁজতাম। আচ্ছা দুটা বাজার বেশি বাকি নেই। একটু আগেই বের হই আমি কখনো ৪ নম্বর টার্মিনালে যাইনি।
তা হলে চলেন ভাই খেয়ে নেন।
ঘড়ি দেখে বললাম দেন কি দিবেন খেয়েই যাই।
খেয়ে দেয়ে ওদের আছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেলাম। যাবার আগে ভাবি বলে দিল মেয়ে আসার পর ও একটু ঠিক হলে এনে বাড়ি চিনিয়ে দিয়ে যাবেন, আর বলে দিবেন যেন যে কোন সময় যে কোন দরকার হলে চলে আসে।

ফিরোজের বাসা থেকে টিউবে সেন্ট্রাল লাইনে এসে ইলিং ব্রড ওয়ে নেমে ডিস্ট্রিক্ট লাইনে এক্টন টাউন থেকে ট্রেন বদলে পিকাডেলি লাইনে হিথ্রো ৪ নম্বর টার্মিনাল যেতে হবে। ইলিং ব্রড ওয়ে থেকে ডিস্ট্রিক্ট লাইনে উঠেছি, সামনে মাত্র একটা স্টেশন পরেই এক্টন টাউনে নেমে ট্রেন বদলে পিকাডেলি লাইনে উঠার কথা কিন্তু অন্যমনস্ক ছিলাম বলে কখন এক্টন টাউন ফেলে টোটেনহেম গ্রীনে চলে গেছি তা আর খেয়াল করিনি। স্টেশনের নাম দেখে হঠাৎ খেয়াল হোল কি ব্যাপার এখানে এলাম কি করে?তারা তারি নেমে আবার নিচের আর এক প্ল্যাটফর্মে যেয়ে পিকাডেলি লাইনের অপেক্ষা করছি এমনিই সময় কম, মন অস্থির তারপর আবার উলটো পথে এসে সময় আরো কমিয়ে দিলাম। নিজেই নিজেকে কিছু ক্ষন বকলাম। কি, হয়েছে কি তোমার, এ আবার কোন ধরনের ভুল?তোমার মত সাবধানি মানুষের এমন ভুল হলে কি মানায়?আরে বাবা ভুল কি এমনি এমনি করেছি নাকি হঠাৎ হয়ে গেছে, খুকুর কথা ভাবছি বলেই না হয় মন একটু উতলা হয়ে একটু ভুল করেই ফেলেছি তাই বলে কি এমন গালাগালি করবে না কি?পরের যে স্টেশনে থেমেছে জানালা দিয়ে সে স্টেশনের নাম আর ট্রেনের জানালার উপরে তার চলা পথের ম্যাপ থাকে তা মিলিয়ে আরো নিশ্চিত হয়ে নিলাম। এবার আর ভুল হবার সম্ভাবনা নেই।
কেন যেন মনে হচ্ছিল ট্রেন খুব আস্তে চলছে। আরো একটু স্পিড বাড়ালে কি এমন ক্ষতি হয়?এত আস্তে গেলে কখন পৌঁছাব কে জানে। পথ একে বারে কম না। এখান থেকে ১১টা স্টেশন। সময় মত যেতে পারব তো? ঘড়িতে দেখি তিনটার বেশি বাজে। খুকু বের হবার আগেই পৌঁছা দরকার ও যেন বের হয়েই আমাকে পায়। না পেলেও ক্ষতি নেই অন্তত চাচা চাচীকে পাবে।

ওরা একটা ফোনও করলো না। আমার সাথে আলাপ করেনি বলে আমিও আর জিজ্ঞেস করিনি। সেই পিটারবোরো থেকে আসছিস ভাল কথা, তা আমাকে একটু জানাবি না? যাক আসবি যখন ভালই হবে। অনেক দিন আমিও দেখি না অন্তত এই সুযোগে একটু দেখা হবে। তবুও মন মানছিল না। মনে হচ্ছিল খুকু যেন বের হবার আগেই আমি দেখতে পাই আমার খুকু আসছে।
চার নম্বর টার্মিনালে কোন দিন যেতে হয়নি বলে এখানে যাত্রীরা কোথা দিয়ে বের হয় জানি না। যদিও গেলেই দেখে নিতে পারব। তবুও মনে হচ্ছিল দেরি হয়ে যায় নাকি। এই সব ভাবতে ভাবতে ট্রেন হানসলো ইস্টে এসে পরেছে। ঘড়িতে দেখি সাড়ে তিনটা বেজে গেছে। মনে মনে যা ভাবছি তাই বুঝি হয়। ঠিক পৌনে চারটায় যেখান দিয়ে যাত্রীরা বের হয় সেখানে এসে একটু দূর থেকে দেখি যা ভেবেছি তাই। খুকু দাঁড়িয়ে চাচার সাথে কথা বলছে পাশে হাফিজের মেয়ে। আমাকে দেখেই এক দৌড়ে এসে হঠাত্ করে এ পাশে জমে থাকা কোন বাধ ভেঙ্গে গেলে জল ধারা যেমন প্রবল বেগে ছুটে যায় তেমনি করে বুকে আছড়ে পরলো। কত দিনের জমে থাকা পিতৃ স্নেহ থেকে বঞ্চিত খুকু শুধু আব্বু বলে বুকে মাথা রেখে প্রায় কেঁদে ফেলার অবস্থা। মনে হচ্ছিল যেন ওর বাবাকে কেউ ছিনিয়ে নিতে চাচ্ছে আর তাই বাবাকে আপ্রাণ শক্তি দিয়ে ধরে রেখেছে। কোন কথা বলতে পারছে না। জিজ্ঞেস করলাম কখন এসেছ?কোন জবাব নেই। সাহারার বুকে অজস্র ধারা বইলে যেমন সমস্ত পানি শুষে নেয় তেমনি ঘড়ির কাটার হিসেবে আমি নিজেও জানি না এ ভাবে কত ক্ষন কেটে গেছে। হাফিজ এসে যখন বলল চলেন গাড়িতে উঠি তখন সম্বিত ফিরে পেয়ে দেখি চোখে স্রোত বইছে। গায়ের জ্যাকেটের হাতায় চোখ মুছে আমার খুকুর মাথাটা টেনে ভেজা কণ্ঠে বললাম চল আব্বু। পাশে দেখি হাফিজের বউ একটা কাগজের কাপে কফি নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। খুকু চাচীর হাত থেকে কাপটা নিয়ে আমার হাতে দিল। বলল নাও, তুমি আসার আগে আমরা খেয়েছি।
[চলবে]

**** স্বাধীনতা যেমন অনেক ত্যগের বিনিময়ে পেয়েছি তেমনি কষ্ট করে একে রক্ষা করতে হবে যে কোন কিছুর বিনিময়ে। 

No comments:

Post a Comment

Thank you very much for your comments.