Sunday 25 November 2012

নক্ষত্রের গোধূলি-১৪ [২য় অধ্যায়]

[পূর্ব সূত্রঃ নক্ষত্রের গোধূলি-১৩]
বাড়ির কাউকে কিছু না বলে বুধবার সকাল সাড়ে সাতটায় রাশেদ সাহেব মনিরাকে নিয়ে বারিধারা বৃটিশ হাই কমিশনে গিয়ে অপেক্ষা করছিল। অফিস খুলতেই গেটের সাথে ভিসা এক্সপ্রেসে রাশেদ সাহেবের পাসপোর্টের সাথে মনির পাসপোর্ট, আবেদন ফি, ফর্ম জমা দেয়ার পর রাশেদ সাহেবের পাসপোর্ট একটু উল্টেপাল্টে দেখে হাতে একটা টোকেন দিয়ে বলে দিল আগামী কাল সারে এগারোটায় এসে
পাসপোর্ট নিয়ে যাবেন। রাশেদ সাহেবের বিশ্বাস হচ্ছিল না। কোন রকম ইন্টারভিউ ছাড়াই মনির ভিসা! বিশ্বাস করবে কি করবে না এমন দুরুদুরু ভাব নিয়ে বাড়িতে ফিরে এলো।
পরদিন সকাল সাড়ে এগারোটায় আবার এসে ভিসা এক্সপ্রেসে ওদের টোকেন দেখানর পর খুঁজে ওদের পাসপোর্ট দিয়ে দিল। বাইরে এসে খুলে দেখে মনিরার এবং রাশেদ সাহেবের ভিসা দিয়ে দিয়েছে। আনন্দে রাশেদ সাহেব হিতাহিত জ্ঞ্যান হারিয়ে কেঁদে ফেললেন। কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। এই ভাবে কোন ইন্টারভিউ ছাড়া, উৎকণ্ঠা নিয়ে ওয়েটিং লাউঞ্জে বসে থাকা ছাড়া মনির ভিসা এত সহজে পাবে, এতো স্বপ্নাতীত। মনিও কেঁদে ফেললো।

মনিরা কাঁদতে কাঁদতে বলল তোমার জন্য, শুধু তোমার জন্যই আমি যাচ্ছি। আমি জানি অনেক আলোচনা সমালোচনা হবে, অনেক ঝড় উঠবে, অনেক গঞ্জনা যন্ত্রণা পোহাতে হবে তবুও শুধু তোমার জন্য আমি সব মেনে নিতে প্রস্তুত।
মনে মনে খোদাকে ডেকে বললেন ‘হে খোদা তোমার দরবারে শোকর জানাবার ভাষা আমার মনে আসছে না, তুমি তো সবই জান, তোমার মনিকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না, নিশ্চয়ই তুমি এটা জান বলেই আমার প্রতি এই রহমত করেছ’।
একটু শান্ত হয়ে মামাকে ফোন করে জানিয়ে বাড়িতে মেয়েদের জানালেন।
মামা বললেন তাহলে তোরা দেরি করবি না।
একটা ঠিকানা দিয়ে বলে দিলেন এই ঠিকানায় যেয়ে আমার কথা বলে টিকেট ফাইনাল করে এক বারে বাসায় যাবি, আমি ওদেরকে বলে দিচ্ছি।
মামার কথা মত ওরা একটা স্কুটার নিয়ে মতিঝিলের একটা ট্রাভেল এজেন্টের অফিসে এসে টিকেট কনফার্ম করে পাসপোর্ট দিয়ে চলে এলো। আগামী বুধ বারে রাত এগারোটায় ফ্লাইট। ঢাকা থেকে কুয়ালালামপুর হয়ে লন্ডন। পরশু এসে পাসপোর্ট টিকেট নিয়ে যেতে বলে দিল। বাড়িতে ফেরার পথে স্কুটারে বসে মনির মুখের দিকে চেয়ে দেখে মনির ঠোট নীল হয়ে গেছে, চেহারা ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে।

কি ব্যাপার মনি তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন, কি হয়েছে?
সাধে কি আর তোমাকে আমি নাদু গোপাল বলি?
কেন কি হয়েছে?
আমাকে তো নিচ্ছ কিন্তু যেয়ে থাকবো কোথায়?তুমি একা পুরুষ মানুষ যেখানে সেখানে থাকতে পারতে।
আরে বোকা এ হচ্ছে লন্ডন এখানে কি ভেবেছ মানুষ ফুটপাথে বা রেল স্টেশনে থাকতে পারে?ওটা শীতের দেশ না?ওখানে কেউ ফুটপাথে থাকে না। আমার ভাই তার ওখানে যেতে নিষেধ করেছে বলে কি ভেবেছ আমার কোন জায়গা নেই?তুমি জান না, সারা পৃথিবীতে আমার সব বন্ধুরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে?আর আমার বন্ধুদের তো জানই তারা কেমন।
ওখানে কে আছে?
আছে, আছে। ভেবো না।
বল না কে আছে।
ওখানে ফিরোজ আছে, শাহিনের বোন আছে। ফিরোজকে আজই মেইল পাঠাবো।
কোন ফিরোজ?
গেলেই চিনবে, তুমি চেন, তাকে দেখেছ।
ওঃ আচ্ছা সেই ফিরোজ?
হ্যা।
তবুও যে আমার ভয় করছে।
আরে পাগল নাকি?কি যে বল, আমি আছি না?সারা জীবন দেশের বাইরে কাটান স্বামীর স্ত্রি তুমি, আর তুমি আমার উপর এটুকু আস্থা রাখতে পারছ না?
কথা বলতে বলতে বাড়িতে এসে পৌছে গেল। বাড়িতে এসে সবাইকে জানিয়ে দিল, মনিও যাচ্ছে আমার সাথে। বৌ যাচ্ছে, ভাবী যাচ্ছে শুনে সবাই অবাক।
এতো টাকা পেলেন কোথায়?
টাকা কি আর পাওয়া যায়, ম্যানেজ করেছি।
এই শুরু হোল সন্দেহের আর এক স্তর যা রাশেদ সাহেবের সরল মস্তিষ্কে কিছুই ঢুকল না।

ঘনিষ্ঠ দুই এক জন আত্মীয় স্বজনকে জানিয়ে দিল। মনের ভিতর একটা করুন বেহাগের সুর বাজিয়ে আস্তে আস্তে বাধা ছাদার কাজ করছে। মনিরার মন থেকে অজানা আতংক কোন ভাবেই দূর হচ্ছে না। সব সময় তার মনে হচ্ছে কি জানি কখন কোথা থেকে কি হতে কি হয়ে যায়। রাশেদ সাহেব তাকে অভয় দিয়ে বুঝিয়ে যাচ্ছেন আর যা যা নিয়ে যেতে হবে তা সংগ্রহ করছেন। দু এক জন আত্মীয় এসে দেখা করে তাদের মত করে কিছু পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে। এক দিন বিকেলে মনিরার বড় বোন আর দুলাভাই এলেন। তারাও মনিরাকে বোঝালেন।
এ তো ভালোর জন্যই হয়েছে। তুমি ওকে হতাশ করে দিও না। ও যা বলে সেই ভাবে চল। মনে সাহস সঞ্চয় কর। যে যাই বলে বলুক এখন তোমার সেদিকে মন দিলে চলবে না। তুমি শুধু রাশেদের কথা ভাব। বাসায় মেয়েদের জন্য চিন্তা করো না। ওদের চাচী থাকছে তাছাড়া ফুফু, নানি, খালা যে যখন পারে এসে থাকবে। মাত্র কয়েকটা দিনের ব্যাপার। তুমি তো আবার চলেই আসবে। সামনে আর মাত্র দুই দিন বাকী আছে। বিকেলে মামিকে নিয়ে মামা এলেন। মামা মামি দুজনেই বোঝালেন।

মনে কর ও যাবার পর কোন অসুখে পরলে তখন কি হবে, অন্তত তুমি যদি ওর পাশে গিয়ে দাড়াতে পার তাহলে কেমন হবে আর যদি কেউ কাউকে দেখতে না পার তাহলে কেমন হবে মন স্থির কর ওখানে তোমাকে কাছে পেলে ওর শক্তি সাহস বেড়ে যাবে কয়েক গুন। ওর শরীর চেহারা কেমন হয়েছে দেখছ না। এরকম অবস্থায় তোমাকেই সব চেয়ে বেশি দরকার। তুমিই পার ওকে আগের সেই অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে। কাজেই মন খারাপ না করে কে কি ভাবল তা চিন্তা না করে ওর সাথে যাওয়াই মঙ্গল। লোক লজ্জা নিন্দা যা আসে তা আমি দেখবো। এসব নিয়ে তুমি ভেবো না।
এই মামাই রাশেদ সাহেবের সুখ দুঃখের খবরা খবর রাখেন, বিপদ আপদে সাহায্য সহযোগিতা করেন, পরামর্শ দেন। তার কথা মনি ফেলতে পারলো না। মনে মনে প্রস্তুত হোল, মুখে কিছুটা হলেও শ্রাবণ আকাশের বৃষ্টির পর মেঘের ফাকে যেমন একটু খানি রোদের ঝিলিক দেখা যায় তেমনি একটু হাসি ফুটে বের হোল, বিশেষ করে মামার অনুরোধ বেশ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করল। তবুও পদ্ম পাতার পানি যেমন টলমল করে তার মনের তেমন দোদুল্যমান ভাবটা কিছুটা হলেও রয়ে গেল।
মামাতো ঠিকই বলেছেন। ওখানে যাবার পর যদি আমার পাগলের কিছু হয়েই যায় তখন কি উপায় হবে?তার চেয়ে ওর সাথে এক বার যেয়ে আমার যাতায়াতের পথটা খুলে দেয়াই ভাল।
রাতের খাবার খেয়ে মেহমানরা সবাই চলে গেলে মনি রাশেদকে নিয়ে ছাদে গিয়ে বসল আলাপ করার জন্য। রাশেদ মনির এই পরিবর্তন দেখে মহা খুশি। মনের আনন্দে মনির হাত ধরে গেয়ে উঠলো
‘তরে লইয়া যাইমু আমি লন্ডনে, ভিসা করছি টিকেট করছি উইরা যাইমু পেলেনে’।
শুনে মনিরা হেসে উঠলো।

সে হাসিতে যে একটু অবাক মাখানো চমক ছিল তা এক মাত্র রাশেদ সাহেবই টের পেলেন। আজ কতদিন পর যেন মনির হারিয়ে যাওয়া সেই ছোট বেলার হাসিটা দেখতে পেলেন। দুজন দুজনকে ছুঁয়ে হাসনা হেনার টবের পাশে বেঞ্চে বসে রইলেন। অনেকক্ষণ কারো মুখে কোন কথা নেই উভয়েই উভয়ের উ্ষ্ণ স্পর্শে কত দিন পর যেন সেই ঝর্ণা ধারায় স্নান করছিলেন। সে রাত আর রাত রইলো না হয়ে গেল মধু যামিনী। কতক্ষণ এভাবে বসে ছিল সেদিকে কোন খেয়াল ছিল না। হঠাৎ করেই একটু একটু বৃষ্টি নামছে দেখে মনি উঠে রাশেদের হাত ধরে নিয়ে নিচে নেমে শুয়ে পরলো। মধু মাখা এই রাতটা যে কোথা দিয়ে কেটে গেল দুজনের কেউই টের পায় নি। ভোর হতে পাশের মসজিদ থেকে আজান ভেসে এলো। চল মনি গোসল করে আসি, ভীষন ক্ষুধা লেগেছে। চল। গোসল করে এসে নামাজ পরে মনি চলে গেল রান্না ঘরে।

নাশতা খাবার পর রাতের এই ক্ষণিকের মধু মাখা বসন্তের আমেজ বেশিক্ষণ রইলো না। পৃথিবীর সব অনর্থের মূল এই অর্থ। অভাবের গ্লানি আর দুঃশ্চিন্তার ছায়া যার চারিদিকে তার কিইবা করার আছে। মধু বসন্ত সারা জীবনের জন্য আসেনি, এসেছিল ক্ষণিকের জন্য। চোখের পলকেই যেন আবার কোথায় হারিয়ে গেল, মিলিয়ে গেল দূর দূরান্তের স্বপ্নে দেখা গভীর প্রশান্তির অতলে। সেখানে জায়গা করে নিল্ ঘন কুয়াশা ঢাকা অনিশ্চিত ভবিষ্যত। কি হবে কি হবে না তাই ভেবে রান্না ঘরের জানালা দিয়ে নারকেল গাছের মাথায় যে সিনেমা দেখেছিল সেই কথা মনে এসে ভীড় করলো আবার।

[আবার দেখা হবে যখন আকাশে উঠবে একাদশীর চাঁদ, তেমনি কোন তারা ভরা রাতে। এ পর্যন্ত সুস্থ থাকুন, ভাল থাকুন আর সুখ স্বপ্নে মগ্ন হয়ে পরবর্তী পর্বের অপেক্ষা করুন। ধন্যবাদ]

No comments:

Post a Comment

Thank you very much for your comments.