Saturday 24 November 2012

নক্ষত্রের গোধূলি-৭ [১ম অধ্যায়]

 [পূর্ব সূত্রঃ নক্ষত্রের গোধূলি-৬]
রাশেদ সাহেব আর একটা ব্যার্থ মিশন শেষ করে এগিয়ে চললেন রাজধানী ঢাকা শহরের দিকে। যে শহর আজ তার জন্য বিভীষিকার মত। যে শহরের নাম মনে হলে তিনি চমকে উঠেন, যে শহর তার আর তার স্ত্রী সন্তানের জন্য দুমুঠো অন্যের সংস্থান করেনি, যে শহর তাকে ঠাঁই দিতে রাজী নয়, যে শহর তাকে তার স্ত্রী সন্তানদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করার স্বরযন্ত্রে লিপ্ত, যে শহরে তার প্রিয় স্ত্রী সন্তানদের
একা অসহায় ভাবে রেখে তাকে চলে যেতে হবে ভিন্ন কোন শহরে যেখানে তার পথ চেয়ে কেউ বসে থাকবে না, বারবার ফোন করে কেউ তার তদারকি করবে না, অসুস্থ হলে বা অসহনীয় ক্লান্তির পর কেউ কপালে একটু মমতা ভেজা হাতের পরশ বুলিয়ে দিবে না।

যতক্ষণ দেখা গেল দেখলেন রফিক দাঁড়িয়েই আছে তার কোচের দিকে তাকিয়ে। সন্ধ্যার ট্রাফিক জ্যামের জন্য কোচ স্পিডে চালাতে পারছে না বলে অনেকক্ষণ দেখলেন এ ভাবে। এক সময় চোখের সীমানার বাইরে চলে গেল রফিক।
শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কোচের আরামদায়ক সিটে বসে পিছনে হেলান দিলেন। চোখ বন্ধ হয়ে এলো। গাড়ির ভিতরের আলো নিভিয়ে বিলাস বহুল কোচের সৌখিন যাত্রীদের আয়েশের জন্য মৃদু এক টুকরো নীল আলো জ্বালিয়ে দিয়েছে ড্রাইভার। চোখ বন্ধ হবার সাথে সাথে চোখের পাতার পর্দায় একটা সিনেমা দেখতে পেলেন।

ছোট ছোট ভাই বোনদের সুখের জন্য, তাদের লেখা পড়া করে মানুষ করার জন্য, তদের সুনাম হবার জন্য, সুখ সমৃদ্ধিতে জীবন যাপনের জন্য, সংসারে সাচ্ছন্দ্য আনার জন্য এক জন নিতান্ত যে বয়সে মন দিয়ে পড়া শুনা করার কথা তা না করে বাড়ি ছেড়ে, ঢাকা শহর ছেড়ে, অবশেষে দেশ ছেড়ে গিয়েছিলেন। শিক্ষা, শান্তি, সুখ সচ্ছলতা কুড়িয়ে আনতে। কিছুটা এনেছিলেন যার উপযুক্ত ব্যবহার হলে আজ তাকে এভাবে দারে দারে ঘুরতে হতো না। যা পেয়েছিলেন তা দিয়ে সব পাওয়া হয়নি তবে তখনকার মত কিছু সামাল দেয়া গেছে। ভাই বোনেরা আজ সবাই উচ্চ শিক্ষিত হয়েছে, কিছু দিন সংসার চলেছে কিন্তু সাথে আর একটি প্রাপ্তি যা বাড়ির সবার অলক্ষ্যে, একান্ত নীরবে সে একাই পেয়েছে বাড়ির আর কেউ তা বুঝতে পারেনি। দীর্ঘ দিন বাড়ির বাইরে থাকার ফলে অতি ধীরে ধীরে বাড়ির সাথে তার একটা দুরত্ব তৈরী হয়েছে।

প্রথম দিকে দুই তিন মাস পর পর তিন চার দিনের জন্য বাড়ি আসার পথে ভাই বোনেরা কে কি পছন্দ করে সে অনুযায়ী ফল মুল, কাপড় চোপর নিয়ে আসতেন, এসে মাকে সংসারের কিছু বাজার করে দিতেন, রান্না ঘরে বা বাড়ির যা যা প্রয়োজন তা কিনে দিয়ে যেতেন বা মনে করে মাথায় করে একটা ফর্দ তৈরী করে নিয়ে যেতেন আবার আসার সময় নিয়ে আসতেন। ভাই বোনেরা নিতান্ত ছোট ছিল বলে তারা অনেক দিন পর পর বড় ভাইকে দেখত বলে তাদের মনে একটা ধারনা জন্মেছিল যে এতো আমাদের মেহমান। পরে যখন দেশ ছেড়ে চলে গেলেন তখন তো বৎসর একবার আসা হতো।

বাড়ির মানুষ কি আর এতো দিন পরে আসে, এমন ধারনা জন্মান অস্বাভাবিক কিছু নয়। নিয়ম করে টাকা পাঠাত। যে অভাবের যন্ত্রণা সে দেখেছে, সে অভাবের ছোয়া যেন ছোট ভাই বোনদের গায়ে না লাগে। প্রতি মাসে একটা করে বিরাট চিঠি লিখত মায়ের কাছে, বাবার কাছে। তাতে ওই এক কথাই বারবার লিখত ওদের যেন কোন অসুবিধা না হয়, বিশেষ খেয়াল রাখবেন। ছুটিতে আসার সময় পছন্দ মত খেলনা, পোষাক আশাক সবার জন্য যা মনে হতো নিয়ে আসতো।

[আবার দেখা হবে পৌষের হিম ঝরা রাতের কোন এক রূপকথার গল্পের আসরে। যে যেখানে আছেন সবাই এ পর্যন্ত সুস্থ থাকুন, ভাল থাকুন, সুন্দর স্বপ্ন দেখুন আর পরবর্তী পর্বের অপেক্ষা করুন। ধন্যবাদ]

No comments:

Post a Comment

Thank you very much for your comments.