Friday 30 November 2012

গান ও কবিতা


Music Shop in London
ছবিঃ মোর্শেদ আখতার বাদল, লন্ডনের একটি বাদ্যযন্ত্রের দোকান।
কবিতা সম্পর্কে এবং গান নিয়ে  আলোচনার ইচ্ছা থেকেই এই পোস্ট দেয়ার কথা ভাবছি কিন্তু কোথা থেকে কি ভাবে শুরু করব সঠিক বুঝে উঠতে পারছি না তবে এখান থেকেই শুরু করি: 
সব গানই কবিতা কিন্তু সব কবিতা গান হয়ে উঠে না। গানের তাল, মাত্রা লয় ইত্যাদি নানা রকম ব্যাকরণ মানতে হয় বলে।

কবিতা আর গল্পের মধ্যে একটা অতি সাধারণ পার্থক্য রয়েছে যা আমরা সবাই জানি। যেমন ছোট্ট একটা উদাহরণ দিচ্ছি, এখানে একটু বলে নিতে হয় যে কোন বিখ্যাত বা আমাদের পথিকৃৎ কারো কোন লেখা নিয়ে কিছু বলার শক্তি বা সাহস কোনটাই আমার নেই তাই আমার লেখা কয়েকটা উদাহরণ এখানে ব্যবহার করছি-
“তুমি যদি কোন দিন আমার কথা ভুলে যাও তবে আমার এ গানের কথা ভুলে যেও না। যদি কখনও গভীর নিশীথে ঘুম ভেঙ্গে আমার কথা মনে হয় তখন আমার গান গেয়ে তোমার অতৃপ্ত মনকে কিছুটা হলেও সান্ত্বনা দিও”
উপরের এই কথা কয়টি আমি কবিতার আকারে যে ভাবে সাজিয়েছি-
যদি আমায় ভুলে যাও তুমি
ভুলো না আমার এ গান
ঘুম ভাঙ্গা রাতে এ গান গেয়ে
জুড়ায়ো তোমার প্রাণ।।
এখানে একটু লক্ষ করে দেখুন গল্প বা পত্রের আকারে লেখা গুলি মাত্র কয়েকটি শব্দে সুবিন্যস্ত ভাবে প্রকাশ পেয়েছে, আবার তাতে সুর হয়ে কেমন সুললিত ভাবে তা প্রকাশ হয়েছে।
সুরের মেলা, এখানে প্রতিটি গানের সাথে লিঙ্ক দেয়া রয়েছে ইচ্ছা করলে শুনে নিতে পারেন।
সুর: শতদল হালদার, তাল: কাহারবা
যদি আমায় ভুলে যাও তুমি
ভুল না আমার এ গান
ঘুম ভাঙ্গা রাতে এ গান গেয়ে
জুড়ায়ো তোমার প্রাণ।।

যদি নিশীথে জাগে মনে
শিয়র দীপ জ্বেলে বাতায়নে
খুঁজো আমায় তারার মিছিলে
রাত জাগা পাখি হয়তোবা
শোনাবে আমারই গান।।
বিকেলে মিষ্টি রোদে বসে
দৃষ্টি মেলে দিও দূর গগনে
কখনো খুঁজে সন্ধ্যায় সেই
উদাস নদীর তীরে আমারই সুরে
শুনো পাখির গান।।
*** আরও একটু লক্ষ করে দেখুন সুরকার এই লেখার গভীরে মিশে একাকার হয়ে তার মনের মাধুরী মিশিয়ে তুলে এনেছে সুরের মূর্ছনা যা শিল্পীর কণ্ঠে জীবন পেয়ে অনুরণিত করছে প্রিয়ার মন। হয়ত বা সে সর্বক্ষণ গুনগুন করছে এবং অন্যান্যরা কেউ কেউ এটাকে তার নিজের কথা ভেবে গুনগুন করছে।
এই যে সুরের রেশ এটা কিন্তু এমনি এমনি আসেনি। মাধবী লতা যেমন ভিন্ন কোন শক্ত অবলম্বন বেয়ে তর তর করে উঠে গিয়ে তার ফুলের সুবাস নিজ মহিমায় বিলিয়ে যাচ্ছে। তেমনি করে গীতিকারের লেখা গানের কথার সুরও কিন্তু কথার বিনুনির শক্ত অবলম্বন বেয়ে বেয়ে সুরকারের মনের গভীর থেকে উঠে এসে শিল্পীর নিপুণ কণ্ঠে সুবাসিত হচ্ছে।

*** পৃথিবীতে যত সুর আছে তা সে নদীর কলতান, পাখীর কুজন কিংবা বাতাসের মর্মর ধ্বনি বা বৃষ্টির রিমঝিম যাই হোক না কেন সবই কিন্তু মাত্র সাতটি সুরে বাঁধা। সুরের আরোহ এবং অবরোহের উপর ভিত্তি করে এসেছে নানা রাগ এবং তার কিছু শাখা প্রশাখা ঠাট। দিন, ক্ষণ, লগ্ন এবং সর্বোপরি মানুষের মনের উপর নির্ভর করে কখন কোন রাগ তাকে দিবে শান্তির পরশ বা কোন রাগ হবে অশান্তি বা বিরক্তির কারণ। যেমন, সকাল বেলা ভৈরবী রাগের পরিবর্তে ইমন রাগের কোন সুর তাকে কোন ভাবেই আকৃষ্ট করতে পারবে না আবার সন্ধ্যা বেলা ঠিক তেমনি ইমন রাগ ছাড়া ভিন্ন কোন রাগের গান ভাল লাগবে না। রিমঝিম বৃষ্টি ভেজা কোন শ্রাবণ গভীর নিশীথে মেঘমল্লার রাগ ব্যতীত কোন গান ভাল লাগবে না। গুরুজীর “মেঘ মিদুর বরষায় কোথায় তুমি” এই চার লাইনের ছোট্ট গানটি সারা রাত ভরে শুনেও ক্ষণকালের জন্য বিরক্ত হবেন না। আবার আমার লেখা এই গানটিও সারা রাত ধরে শুনেও ক্লান্ত হবেন না: (বর্তমানে আমার কাছে রেকর্ড নেই)
সুর: শতদল হালদার, রাগ-মেঘ মল্লার
(এ গানের কোন রেকর্ড ধারন করা হয়নি)।
আজি মেঘ গরজিছে শ্রাবণ আকাশে
গুরু গুরু ডাকে দেয়া সুবাসিত বাতাসে।।
ঘনঘটা বেজে শোন পিয়ালের বনে
উথলে বিরহ জ্বালা প্রিয়ার মনে
এ লগনে তাহারে বলা যায় কি আভাসে
যদি না বাতাস বহে বকুল সুবাসে।।
ধীরে ধীরে বরষণে মন নিশীথে
পুলকিত হরষে চায় তারে দেখিতে
না দেখিয়া তারে ভাবি নিরলে বসে
সেও বুঝি ডাকে মোরে এমন ফুল বাসে।।

*** সাধারণত গানের কথা ৩ বা ৪ প্যারায় হয়ে থাকে। ১ম প্যারা হচ্ছে গানের মুখ বা আভোগ, এই অংশে গানের ভূমিকা থাকে। ২য় ও ৩য় প্যারাকে বলা হয় ১ম এবং ২য় অন্তরা, এই দুই অন্তরা গানের বিবরণ। আবার যে গানে ৪ প্যারা থাকে তার ৩য় প্যারাকে বলে সঞ্চারী, এই অংশে গানের মুল পট ভুমি বা উপসংহার থাকে এবং এই অংশের সুর অন্যান্য অংশের চেয়ে ভিন্ন হয়। যে সুরে গানের মুখ গাওয়া হয় সে সুর যেখানে শেষ হয় সেখান থেকে শুরু হয় অন্তরার সুর। দুইটি অন্তরার সুর একই থাকে। এখানে লক্ষণীয় যে যারা গান লিখবেন বা গান লিখতে আগ্রহী তারা অন্তরার মাত্রা সমান রাখার চেষ্টা করবেন। নিচের গানটি দেখুন, কোন অংশে দুইটি দাড়ি এবং একটি দাড়ি দিয়ে এই চিহ্ন দেয়া হয়েছে। তবে অন্তরার সুরের বেলায় যে কোন ব্যতিক্রম নেই তা ঠিক নয়, কিছু ব্যতিক্রম অবশ্যই হয়ে যায় এবং সেখানকার সুর সারগম দিয়ে মেলান হয় তবে এটা সচরাচর ঘটে না, বিশেষ কোন ক্ষেত্রে এই সারগম এর সাহায্য নেয়া হয়, যেমন ঝরে ওই চঞ্চল ঝর্ণা গানটি শুনলেই বুঝতে পারবেন। আজকাল অবশ্য সঞ্চারী ছাড়াই গান হচ্ছে। সম্ভবত এই জন্যেই এই সব গানের রেশ বেশী দিন থাকে না।

নিচের এই গানটি লক্ষ করলে দেখা যাবে এখানে সঞ্চারী রয়েছে, এখানে অনুপ্রাসের ব্যবহারও এসেছে।
মাতাল বসন্ত
সুর: শতদল হালদার, তাল: কাহারবা
স্বর্ণালী সুন্দর এই দিন
কে বাজায় দূরে মধুর বীণ
ঘরে আমার এ মন রয় না
কেন চৈতী হাওয়া বয় না।।

আমি যে হারিয়ে যেতে চাই
এ লগন কোথায় খুঁজে পাই
দখিনা বাতাস বলে দেয় না
কেন যে তাকে পাওয়া যায় না।।
হারিয়ে যাবার এই দিন
সুর জাগাল মনে রঙ্গিন
বসন্ত বাঁধনে বাঁধা বল্লরী
মাতাল সুরভি ছড়াল মাধুরী।
বন ফুলে রেখেছে দুয়ার খুলে
নদী কূলে উথলে হৃদয় দুলে
ব্যাকুল এ মন ধরে বায়না
একেলা কেন যে প্রাণে সয় না।।

*** এবার আসছি শব্দ চয়নের দিকে। কোন শব্দ এবং লাইন দুই বার লেখা যাবে না, এটা পরিহার করতে হবে। আমরা এমন দুই বার বা একাধিক বার যা শুনি সেটা আসে সুরের লয় মেলাবার জন্য ওটা গান বা কবিতার কোন অংশ হিসেবে নয়। আর এমন কোন শব্দ চয়ন করা যাবে না যা উচ্চারণ করতে গিয়ে সুর আটকে যায় বা বাঁধাগ্রস্ত হয়ে সুর থেমে যেতে চায়। অনেকেই ভাবতে পারেন মানে বা ভাবতো ঠিক আছে তাহলে ? তাহলে সেই শব্দটির পরিবর্তে সমার্থক এমন একটি শব্দ খুঁজে পেতে হবে যার সাথে সুরের সখ্যতা রয়েছে মানে সুর সাবলীল ভাবে নির্বিঘ্নে এগিয়ে যেতে পারছে। শব্দ চয়ন কবিতার ক্ষেত্রে তেমন জরুরী না হলেও গানের ক্ষেত্রে অত্যন্ত জরুরী। সব জায়গায় সব শব্দ প্রয়োগ করা যায় না। আপনি যা লিখেছেন তা যখন সুর হবে তখন কিন্তু হুবহু এক নাও পেতে পারেন। সুরকার কিছু এদিক ওদিক বা পরিবর্তন করতে পারেন, তাকে এই স্বাধীনতা দিতেই হবে। যেমন শুনেছি বিখ্যাত সুরকার সলিল চৌধুরী বিখ্যাত গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়কে বলতেন ‘এই পুলক এখানে এই শব্দ বদলে এই শব্দ লিখে দাও’। যেমন আমাকেও আমার সুরকার শতদল হালদার, খন্দকার মনসুর এবং আমীর হোসেন বলতেন এবং সমস্যা হলেও আমাকে তাদের কথা মেনে কোন ক্ষেত্রে শব্দ বদলে বা কোন ক্ষেত্রে গানের কথাও কিছু বদলে দিতে হত।

*** আমি সুরকার বা শিল্পী কোনটাই নই তবুও অনেক লিখে ফেলেছি। ভুলভ্রান্তি হলে দেখিয়ে দিবেন। আজ আর নয়, পরে কখনও সময় পেলে আবার কিছু নিয়ে আসব। এর মধ্যে কারো কোন জিজ্ঞাস্য থাকলে জানাবেন, যতটুক সম্ভব চেষ্টা করব।
আজ তাহলে এই পর্যন্তই!

No comments:

Post a Comment

Thank you very much for your comments.