Wednesday 1 June 2011

সাগর তলে রূপনগর


বাহরাইন সিতরা ট্যাঙ্কার বার্থ থেকে বৃটিশ পতাকাবাহী ট্যাঙ্কার জাহাজ “কুইন অফ গালফ” এ ফুল লোড অর্থাৎ প্রায় ষোল হাজার টন হাই স্পিড ডিজেল নিয়ে ১৯৮২ সালের শেষ দিকে শীতের কোন এক সন্ধ্যা বেলায় আমরা ওমানের মাস্কাট বন্দরের দিকে সেইল করেছি। মাত্র দুই দিন এক রাতের পথ। জাহাজ স্বাভাবিক গতিতে আরব্য উপসাগর দিয়ে
এগিয়ে চলছে। এই সময় সাধারনত এখানে সাগর উত্তাল থাকে তবে আজ সেইল করার সময় সাগর কিছুটা শান্ত ছিল বলা যায়। কিন্তু সেইল করার পর দিন ভোর থেকেই লক্ষ্য করছি আমরা যতই এগুচ্ছি ঢেউ এর উচ্চতা আস্তে আস্তে ততই বাড়ছে। সেই সাথে তাল মিলিয়ে জাহাজের রোলিংও বাড়ছে। জাহাজে চাকরি করার অনেক সুবিধা যেমনঃ নানা দেশ দেখা যায়, তার সাথে নানা জাতির মানুষের সাথে মেশা যায়। জানা যায় তাদের জীবন যাত্রার ব্যবস্থা। পাশাপাশি কিছু অসুবিধা বা এক কথায় বলা যায় একটা দুঃসহ যন্ত্রণা রয়েছে আর তা  হচ্ছে এই রোলিং। অনেকেই রোলিং মোটেই সহ্য করতে পারে না। কাউকে এমনও বলতে শুনেছি যে, এই ভয়েজ শেষ হলেই আর আসব না। দেশে ফিরে গিয়ে পানের দোকান দেব তবুও  এই রোলিং আর না। কিন্তু হলে কি হবে, সাগরের হাতছানির নেশায় যে একবার ডুবেছে তাকে যে আবার, বারবার সাগরের বুকে ফিরে আসতেই হবে। সাগরের যেন কেমন একটা মায়া রয়েছে। যে মায়াজালে সে সবাইকে আটকে ফেলে। সাগরের বুকে গাং চিলেদের নিঃশব্দে নীলাকাশে ওড়া, মাঝে মাঝে ডলফিনের ঝাকের জলকেলি, খোলা নীল আকাশ, নীল আকাশের নিচে নীল সাগরের নীল ঢেউ, ঢেউ এর চূড়ায় মুক্তার মত সাদা ফেনার লুকোচুরি মানুষের মনকে উদ্ভ্রান্ত করে কোথায় যেন নিয়ে যায়। কোথায় যে সে হারিয়ে যায় সে নিজে কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। যখন নীল ঢেউ এসে জাহাজের গায়ে কিংবা সাগর পাড়ে আছড়ে পরে সে এক মায়াবী দৃশ্য। একটা মনকাড়া মোহ। এই মোহজাল কেউ ছিঁড়ে বের হতে পারে না। এই মায়ার টানেই আবার ফিরে আসে, আসতে হয়।
সে দিন আস্তে আস্তে রোলিং বেড়েই চলেছে, সাথে বাড়ছে বাতাসের একটানা শো শো গর্জন। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এক নাগারে এমনি চলছে। স্টিয়ারিং করতে এসে ব্রীজে কেউ টিকতে পারছে না। এক এক করে তিন জন আউট। টিকবে কি করে? ওরা কেও ব্রীজে দাঁড়াতেই পারছে না। প্রতিটা ঢেউ এসে যখন জাহাজের গায়ে আছড়ে পরছে তখনই সমস্ত জাহাজটা থরথর করে কেঁপে উঠছে। কতক্ষণ আর এ ভাবে চলা যায়? চার্টে দেখছি আমরা উপসাগরের পূর্ব পাড়ের কাছে দিয়ে যাচ্ছি। আমাদের জাহাজ থেকে প্রায় একশ মাইল দূরে কিনারা। পিছনে দুবাই এবং ডান পাশে ওমানের সীমা রেখা। সামনেই লিটল কুইন এবং লার্জ কুইন নামে ওমানের সীমানার ভিতরে সাগরের মাঝে প্রায় মাইল দুয়েক জুড়ে মাত্র মাইল খানিক দূরত্বে দুটি পাহাড় সারি অনন্ত কাল ধরে দাঁড়িয়েই আছে। আবহাওয়া যখন ভাল থাকে তখন আমরা একটু মজা করার জন্য এই দুই পাহাড়ের মাঝ দিয়ে যাতায়াত করি। তবে এই মাইল দুয়েক পথে খুব সাবধানে স্টিয়ারিং করতে হয় কারন পাহাড়ের চৌম্বক ক্ষেত্রের কারনে ওখান দিয়ে যাতায়াতে জাহাজের কম্পাস কিছুটা এলোমেলো হয়ে যায় বলে জাহাজের কোর্স ঠিক রাখা বেশ কঠিন কাজ। মোটামুটি খুব ভাল স্টিয়ারিং না করলে পাহাড়ের গায়ে যে কোন সময় ধাক্কা লেগে যেতে পারে। আর তেমন কিছু হলে এখান থেকে উদ্ধার পাওয়া দুঃসাধ্য ব্যাপার। কিন্তু আজ এটা মোটেও সম্ভব নয়। কারো তেমন মানসিকতা নেই। সবাই রোলিং এর দাপটে অস্থির। বমি করতে করতে অসার। এই মধ্য সাগরে তো আর জাহাজ এমনি ছেড়ে দেয়া যায় না তাই যে কোন ভাবে সামনে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। এমন আবহাওয়ায় ইঞ্জিন চালু রাখতেই হবে। ইচ্ছে করলেই পাড়ে এসে লগি গেড়ে বেঁধে রাখার উপায় নেই। সন্ধ্যার একটু আগে  আমাদের ক্যাপ্টেন ডেভিড ল্যাম্ব ব্রীজে এসে বলল কাসাব বে আর কত দূর? চার্ট দেখে হিসেব করে বললাম ওই ত লিটল কুইন তার পরেই কাসাব বে, তা এখান থেকে চল্লিশ নটিকাল মাইল হবে। যেতে হয়ত চার পাঁচ ঘণ্টা লেগে যাবে। লিটল কুইন ছাড়িয়ে একটু এগিয়ে ডান দিকে কাসাব বে হচ্ছে এমন একটা জায়গা যেখানে প্রায় চারদিকে ওমানের জন বসতি হীন মাইলের পর মাইল ধূ ধূ রুক্ষ পাথুরে পাহাড়ী এলাকা। শুধু সাগরের দিকে একটু খানি খোলা এবং ওই খোলা জায়গা দিয়ে ভিতরে ঢুকলেই প্রায় মাইল পাঁচেক এলাকা জুড়ে ত্রিশ মিটার গভীরতা নিয়ে একটা আশ্রয় নেওয়ার মত জায়গা। সামুদ্রিক চার্টে দেখান আছে। আমরা এর আগেও এখানে বেশ অনেকবার এসে নোঙ্গর করে থেকেছি। ক্যাপ্টেন চারদিকে দেখে বলল তাহলে ওখানে ঢুকে নোঙ্গর করে থাকি, দেখি আবহাওয়া একটু শান্ত হলে পরে যাওয়া যাবে। বললাম তাই ভাল হয়। সাথে সাথে আমাদের বাহরাইনের কোম্পানীর অফিসে কন্ট্রোল রুমের সাথে রেডিওতে যোগা যোগ করে জানিয়া দিলাম।

রাত প্রায় এগারটা নাগাদ আমরা কাসাব বের ভিতরে ঢুকে নোঙ্গর করলাম। এই এতক্ষণে যেন সবাই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। যারা রোলিং শুরু হবার পর থেকে এতক্ষণ না খেয়ে শুয়ে ছিল তারা উঠে সবাই গ্যালিতে (জাহাজের কিচেন) গিয়ে যে যা পাচ্ছে তাই খেয়ে একটু সুস্থ হলো। সে রাতে আর তেমন কিছু করায় কারো মন ছিল না। কেবল মাত্র ব্রিজ ওয়াচে দুই জন ডিউটি করছিল আর বাকী সবাই যার যার বিছানায়।
পর দিন সকালে ঘুম ভেঙ্গে দেখি আবহাওয়ার তেমন কোন পরিবর্তন নেই। মনে মনে কটু খুশি হলাম যাক আজও হয়ত এখানেই থাকা যাবে। এখানে থাকার একটা বাড়তি সুবিধা আছে। বড়শী দিয়ে প্রচুর মাছ ধরা যায়। আর জায়গাটাও চমৎকার। চারদিকে বেশ উঁচু নিচু নানা সাইজের পাহাড়। কোথাও খাড়া হয়ে সমুদ্রের নিচে তলিয়ে গেছে আবার কোথাও ঢালু  বালুকা বেলার মত মাঝে মাঝে কিছু কিছু ছোট বড় নানা আকারের পাথরের টুকরো দিয়ে কে যেন সাজিয়ে রেখেছে এমন মনে হতো। কোথাও কোথাও আবার  এমন যে আকাশের মেঘেরা উড়ে এসে প্রায়ই এই সব কোন পাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে একটু ঘুমিয়ে নেয় নয়তো ধাক্কা দিয়ে সাথে করে উড়িয়ে নিয়ে যেতে চায়। দেখতে দারুণ লাগে। এখানে এসে যখন থাকি তখন আমাদের জাহাজে  রাবারের একটা ইঞ্জিন চালিত ডিঙ্গি বোট আছে ওটায় পাম্প করে ফুলিয়ে প্রায়ই কয়েক জন মিলে জাহাজ ছেড়ে ওই সব কিনারায় চলে যেতাম। অহেতুক নিচু পাহাড়ের গা বেয়ে উপরে উঠে দেখার চেষ্টা করতাম। এখান থেকে উত্তরে এবং পশ্চিমে সাগর বা পিছনের পাহাড়ী তেপান্তর কেমন দেখায়। মনে হতো যেন মৌন পাহাড় গুলি আমাদের সাথে কত দিনের না বলা সঞ্চিত কথা বলে মনের আকুতি মেটাতে চাইছে। আমরাও নানা দেশের কয়েক জন পাহাড়ের সাথে চীৎকার করে নিজ ভাষায় কথা বলতাম। আবার কখন সাথে করে রঙের টিন আর ব্রাশ নিয়ে পাথরের গায়ে নিজেদের নাম লিখে রাখতাম। আজও হয়ত যারা ওখানে যায় তারা আমাদের নাম দেখতে পায়। মাইক, হ্যারি, কার্লো, অসীম, মহসীন, তিরু, গোল্ডি এমন আরো অনেক যা আজ এত দিনে স্মৃতির পাতা থেকে মুছে গেছে।
সে দিন সকালে নাশতা করে বসে আছি এমন সময় ক্যাপ্টেন এসে বলল
“দেখছ এখন ওয়েদার চেঞ্জ হয়নি, আজ আর যাব না গ্রে বাহরাইনকে ডেকে বলে দাও তারপরে চল মাছ ধরি”।
ক্যাপটেন নিজে এ কথা বললে আর ঠেকায় কে? যেই বলা সেই কাজ। সাথে সাথে ব্রিজে যে ডিউটি করছিল ওকে সু সংবাদটা দিয়ে বলে এলাম তুমি গ্রে বাহরাইনকে কল দিয়ে বলে দাও খারাপ আবহাওয়ার জন্য আমরা আজ এখান থেকে বের হতে পারছি না। সাথে সাথেই হ্যারি রেডিওর রিসিভার হাতে নিয়ে ডাকা শুরু করল ‘গ্রে বাহরাইন গ্রে বাহরাইন দিস ইজ কুইন অফ গালফ কলিং’। ওপাশ থেকে জবাব এল
‘ইয়েস কুইন ইউ আর লাউড এন্ড ক্লিয়ার’।
হাই স্টেনলি গুড মর্নিং, ডিউ টু ব্যাড ওয়েদার উই আর নট সেইলিং ফ্রম কাসাব বে টু ডে।
ওকে কুইন
এবার ধন্যবাদ জানিয়ে এবং ওভার এনড আউট বলে রিসিভার নামিয়ে রাখল আর আমি নিচে নেমে এসে মার্কিকে বললাম
চল আজ একটা নতুন এক্সপেরিয়ান্স নেয়ার চেষ্টা করি।
নতুন আবার কি, এখানে যা করার তা সবইতো করা হয়ে গেছে!
না, আজ ডাইভিং করব। দেখছ না আজ পাহাড়ের কত কাছে নোঙ্গর করা হয়েছে। এত কাছে কি সাধারণতঃ নোঙ্গর করে?এই সুযোগ কি বারবার আসে?
ইয়া, ডাইভিং! বল কি?
হ্যা তুমি যাবে না কি অন্য কাওকে বলব?
এদিকে আমাদের জাহাজে ডাইভিং সেট আছে মাত্র দুটা কাজেই এক সাথে দুই জনের বেশি যেতে পারব না।
না না আমি যাব। কখন নামবে?
যদি যাও তাহলে এখনি।
বেশ, চল। ডিঙ্গি রেডি করে ডাইভিং সেট রেডি করতে করতে আরো কয়েক জনের নজরে এলো যে আমরা আজ এখানে ডাইভ দিচ্ছি।
সবার এক কথা আমাকে বললে না কেন?
আরে এইতো বললাম। আমরা ফিরে আসি তোমরা এক এক করে সবাই যেও। কাওকেতো উপরে থাকতেই হবে। তোমরা আমাদের দেখবে ফিরে এসে আমরা তোমাদের দেখব, তাই না?
হ্যাঁ ঠিক আছে।
বেশ। আমি আর মার্কি ডাইভিং স্যুট পরে ক্রেন দিয়ে নিচে ডিঙ্গি নামিয়ে দিলাম।
এখানে পানির গভীরতা প্রায় ত্রিশ চল্লিশ মিটার হলে কি হবে জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে একেবারে সমুদ্রের তলা পর্যন্ত দেখা যায়। স্বচ্ছ কাচের মত পরিস্কার টলটলে পানি। কত রকমের কত কি পানির তলে দেখা যায় তা কাছে থেকে দেখার লোভ ছিল অনেক দিন থেকেই। আজ তা হতে যাচ্ছে বলে মনে এক ধরনের চমক বোধ করছিলাম। সিঁড়ি বেয়ে  ডিঙ্গিতে নেমে এলাম। দুই জনের কোমরে রশি বেঁধে রশির এক প্রান্ত ধরে উপরে পাহারায় থাকবে দুই জন। ওদের সাথে যোগাযোগ রাখার জন্য প্রথা অনুযায়ী রশির টানের মানে নিয়ে একটু আলাপ করে নিয়েছি।

ডিঙ্গিতে নেমে পিঠের অক্সিজেনের টিউব, পায়ের ফিনস, হাতের গ্লোভস, ডাইভার্স নাইফ, পানি রোধক চশমা সব কিছু ঠিক আছে কি না দেখে ডিঙ্গির পাশে বসে পিছনে তাকিয়ে ইশারা দিয়ে ঝুপ করে নেমে গেলাম। নিচে সাগর তলে এগিয়ে যাচ্ছি। সাঁতরে সাঁতরে পাহাড়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি আর নিচে নামছি। কত রকমের মাছ আশেপাশে দিয়ে আসছে যাচ্ছে। কেউ একটু কৌতূহল নিয়ে এগিয়ে আসতে চাইছে। এরা আবার কারা এলো আমাদের এই স্বর্গ রাজ্যে? এমন একটা ভাব। একটু কাছে এসে ভাল করে দেখে সুরুত করে দিক বদলে চলে যাচ্ছে। নিচে নেমে এসেছি। এবার আর সাঁতার নয় হাঁটছি। পানিতে সাঁতরানো যত সহজ হাঁটা ততটাই কঠিন। হাঁটছি আর দেখছি। ফিনস পরা পায়ের নীচে পাথুরে তল বলে হাঁটা যাচ্ছে না লাফিয়ে সাঁতারের মত করে এগুচ্ছি।  ভয় ভয় লাগছে কিন্তু দুর্বার কৌতূহলের কাছে এই ভয় কিছুই নয়।

কত রকমের প্রবাল, মাছ, নানা রকম সামুদ্রিক উদ্ভিদ, বিভিন্ন প্রাণী এর কিছুই আগে দেখিনি। একটা ঝোপের মত মনে হচ্ছে প্রায় মানুষের সমান উঁচু। প্রবাল ঝোপ হবে নিশ্চয়! মার্কিকে খোঁচা দিয়ে ইশারা করলাম চিনেছ? ও তেমনি হাত নেড়ে নিষেধ করল। কি এটা? দেখতে হবে। কাছে গেলাম। নিচে থেকে ঝাঁক ঝাঁক ছোট ছোট সার্ডিন মাছ বের হয়ে গেল। আরো কত কি মাটি ঘেঁষে বসে ছিল তারা সবাই সুরুত সুরুত করে এদিক ওদিক চলে গেল। অবাক হয়ে দেখছি। কত রকমের রঙ্গিন মাছ। অদ্ভুত সব কারুকাজ তাদের গায়ে। লাল, কাল, ধবধবে সাদা, লাল কাল ডোরা কাটা, হলুদের মাঝে সাদা বা কালো ডোরা। কত যে রঙের বাহার তা আমাদের দেশের কাটাবনের একুরিয়ামের মাছের বাজারেও নেই। বিশাল ফিনস, গায়ের চেয়ে ফিনস বড়, বিশাল। কাকচি মাছের চেয়েও ছোট এক রকম মাছের ঝাঁক। সবাই মনের আনন্দে নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মনে হচ্ছে এখানে হাঙ্গর বা ছোট ছোট মাছ খেয়ে ফেলে এমন কেউ নেই তাই এরা এত স্বাধীন। এক রকম ছোট্ট মাছ দেখলাম ঝাকে ঝাকে সাঁতরে বেড়াচ্ছে যাদের শরীরের এ পাশ থেকে ও পাশ ভেদ করে পানি দেখা যাচ্ছে, কোন রঙ নেই। গায়ের ভিতরে শুধু লাল কিছু রক্তের সরু অস্তিত্ব দেখা যাচ্ছে। সাগর তলের বিছানায় কত রকমের স্টার ফিশ সহ আরো কত নাম না জানা প্রানী নিশ্চিন্তে শুয়ে আছে। আমাদের সারা পেয়ে ঝট পট এদিক ওদিক নিরাপদ দুরত্বে চলে গেল। একটা  প্রবাল ধরে তুলে দেখলাম আমদের কক্সবাজারের দোকানে যেমন দেখা যায় তেমন নয় মোটেই। বিশ্রী শেওলা জড়ান। পানির হালকা স্রোতে শেওলা গুলি একটা ছন্দ তুলে দুলছে। নানা রকম নানা রঙের লতা পাতা স্রোতে দুলছে। এ যেন স্বর্গ রাজ্যের রূপনগর। পানির নিচে এত সুন্দর সে তো শুধু এত দিন টেলিভিশনের পর্দায় দেখেছি কিন্তু আজ নিজে চোখে দেখেও বিশ্বাস হতে চাইছে না। অথচ নিজের চোখকে কি করেইবা অবিশ্বাস করি? আস্তে আস্তে কিনারার দিকে অর্থাৎ পাহাড়ের নিচে যেতে চাইছি এমন সময়  মার্কির পায়ের ছোঁয়া লেগে ঝোপের বেশ খানিকটা ভেঙ্গে গেল। পিছনে ঘুড়ে উঠিয়ে হাতে নিলাম। আরে এত প্রবাল! প্রবালের এত বড় ঝোপ? সারি সারি অনেক। হাতে নিয়ে শেওলা সরিয়ে দেখি এগুলি সাদা নয় ভিন্ন রঙ, একটু লালচে ধরনের। দেখতে দেখতে নানা ঝোপঝার পার হয়ে একটু দূরে লক্ষ্য করলাম অন্ধকার মনে হচ্ছে। থমকে দাঁড়ালাম। মার্কি ইশারা করল। কি হয়েছে? ওকে ওই অন্ধকার দেখিয়ে বোঝালাম। ইশারায় বলল ওটা পাহাড়ের নিচের দিক।
তাই নাকি?

আরো একটু ভয় ভয় নিয়ে আবার এগিয়ে যাচ্ছি। দুই জনের কোমরে দুইটা আলাদা রশি বাধা। রশির আরেক মাথা ধরে জাহাজের ডেকে দুই জনে সজাগ রয়েছে কোন রকম একটু সিগন্যাল পেলেই টেনে জাহাজের দিকে নিয়ে যাবে। আবার এদিকে দুই জনের সাথে আলাদা যে রশি দুই জনকে বেধে রেখেছে যেন দুই জন একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে না যায়। স্রোত বা অন্য কোন উপায়ে  বিচ্ছিন্ন না হতে পারে। এগিয়ে যাচ্ছি আর এই রূপনগরের রূপ দেখে বিস্মিত হচ্ছি। মাটির পৃথিবী এবং সাগর তলের পৃথিবীর মধ্যে যে কত তফাত তা আজ এখানে না এলে কোন দিন জানা হত না। পানির নিচেও বাগান, বন জঙ্গল, নানা জাতের নানা ধরনের প্রাণী রয়েছে। অবশ্য সব প্রাণী যে নিরীহ বা হিংস্র নয় তা আমরা জানি। এখানেও ভয়ঙ্কর, হিংস্র বা বিষাক্ত বিভিন্ন প্রানীও বাস করে। এ নিয়ে তেমন আনন্দিত বা দু;খিত হবার কিছু নেই।

পাহাড়ের যতই কাছে যাচ্ছি ততই কেমন যেন গা ছম ছম করা একটা ভাব হচ্ছিল। ভয়ের মাত্রা বেড়েই যাচ্ছিল, কিছুতেই সামাল দেয়া যাচ্ছিল না। বারবার হাতের ডাইভিং নাইফ এবং রশির অস্তিত্ব ঠিক আছে কিনা পরখ করছিলাম। কিছু হলেই যাতে জাহাজে সংকেত পাঠাতে পারি নিজেকে সেই ভাবেই রেডি রাখছিলাম। যদিও জানি হাতে যে ছুড়ি আছে ওটা দিয়ে হাঙ্গর বা তেমন কোন সামুদ্রিক হিংস্র মহাশয়কে কাবু করা অন্তত আমার পক্ষে সম্ভব নয় তবুও হাতে রাখা। তবে মার্কি কি ভয় পাচ্ছিল না কি স্বাভাবিক ছিল তা আর জিজ্ঞাসা করিনি। আমি বুদ্ধি করে ওর পিছনেই থাকছি। এর মধ্যে জাহাজের তলা থেকে প্রায় দুইশত মিটার চলে এসেছি। আসার সময় জাহাজের নোঙ্গর দেখেছি। একটা শেওলা জড়ান বিশাল পাথরের ফাকে আট্‌কে আছে।
এগিয়ে যাচ্ছি আর এই নতুন দেখা রূপনগরের রূপের শোভা দেখছি। এক সময় পাহাড়ের নিচে এসে পৌঁছলাম। এতক্ষণ আর কি দেখেছি? এখানে আরও সুন্দর। অসম্ভব রকমের সুন্দর। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি মাটির উপরে এমন কোন সাজানো বাগান নেই যা এখানকার চেয়ে সুন্দর। কিন্তু কথা হচ্ছে এই বাগানের মালী কোথায়? পানির উপর থেকে সূর্যের আলো এসে যেন সমস্ত বাগান আলোকিত করে রেখেছে। এখানেই এত সুন্দর তাহলে লিটল কুইন এবং লার্জ কুইনের নিচে বা বন্দর আব্বাসের পূর্ব দিকে সমুদ্রের পাড়ে যেখানে পাহাড় সাম্রাজ্য বিস্তার শেষ করে সাগরে মিশেছে সেখানে কেমন হবে? ভাবনার সাগরে ডুবে আবার কোথায় হারিয়ে গেলাম জানি না। হঠাৎ মার্কির সাথে ধাক্কা লেগে থেমে গেলাম। অক্সিজেনের মিটারের দিকে চেয়ে দেখি প্রেসার যথেষ্ট আছে। মার্কি দাঁড়িয়ে পরেছে। কি ব্যাপার? ও তখন সামনে একটু বাম দিকে দেখিয়ে দিল। দেখে আমার হৃৎপিণ্ড থেমে গেল শ্বাস নিতে ভুলে গেছি। বিশাল একটা কি যেন আশেপাশের সব কিছু নিতান্ত তাচ্ছিল্য ভরে মুখ হা করে এগিয়ে আসছে আর তার চার দিকে নানা আকৃতির নানা প্রজাতির মাছ ঘুর ঘুর করছে। কেউ কেউ আবার ওটার গায়ে জমা শেওলা ঠুক্‌রে ঠুক্‌রে খাচ্ছে। ওটা হাঙ্গর নয় চিনতে পেরেছি কারণ হাঙ্গর হলে এই এত গুলি মাছ ওর কাছে থাকার সাহস পেত না। প্রাণীটা  যে  হিংস্র নয় তা তার চলা ফেরা এবং তার সঙ্গীদের দেখেই বুঝতে পারছি। মাঝে মাঝে ওটা নিজেও আসে পাশের গাছ পালা, লতাপাতা মুখে দিয়ে এবং পাথর আর প্রবাল থেকে একটু আধটু শেওলা চেখে দেখার ভাব করছিল। ওটার আকার প্রায় পাঁচ ছয় মিটার ব্যাসের একটা গোলাকার চাকতির মত, পিছনে প্রায় তিন মিটার লম্বা চিকন লেজ, সামনের অর্ধেকটাই প্রায় মুখ আর পিঠে উপরে ত্রিকোণাকৃতির আইর মাছের মত একটা প্রায় দুই মিটার উচ্চতার কাটা, মুখের দুই পাশে চার পাঁচটা কুলার আকারের ফিনস। সারা গায়ে সবুজ শেওলা জমে রয়েছে আসল রঙ বোঝা যাচ্ছে না। দেখে ভয়ংকর দর্শন মনে হলেও মোটেও হিংস্র মনে হচ্ছে না। তবুও অচেনা মহাজন বলে মন থেকে ভয় দূর করতে পারছি না। কি করব?মার্কি ইশারা করে বোঝাল এখানেই চুপ করে দাঁড়িয়ে থাক, কোন নড়াচড়া করবে না। এমন বিকট এবং ভীষণ দর্শনের কোন প্রাণী দেখাতো দূরের কথা কোন দিন ছবিও দেখিনি। যাক, আমরা দুই জনেই চুপ করে নিশ্বাস প্রায় বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। শুধু মাত্র অক্সেজেনের বোতল থেকে শ্বাস নেয়ার পর বুদ বুদ বের হচ্ছে অথচ রূপনগরের মহাজন সে দিকে ভ্রুক্ষেপ না করেই আস্তে আস্তে আমাদের কয়েক মিটার সামনে দিয়ে যেমন গতিতে আসছিল তেমনি  গজেন্দ্র গতিতে তার হেলাফেলা ভাব নিয়ে চলে গেল । সামনে দিয়ে যাবার সময় লক্ষ করলাম উনার চোখ মাত্র একটা। মুখের সামনের দিকে একটু উপরে এবং গোলাকার পাতা সহ। মানে উনি চোখ বুজে ঘুমাতে পারেন।
আমাদের ছেড়ে কিছু দূর যাবার পরেই মার্কির হাতে চিমটি দিয়ে ইশারা করে হাতের ঘড়ি দেখালাম  আধা ঘন্টার বেশি হয়ে গেছে। চল যথেষ্ট হয়েছে, আর না। রশিতে টান দিয়ে জাহাজে সংকেত পাঠিয়ে যে পথে এসেছিলাম সেই পথে যাবার জন্য উপরে ভেসে উঠলাম। আর আমাদের দেখা মাত্র জাহাজ থেকে যারা আমাদের পাহারায় ছিল ওরা রশি টেনে আমাদেরকে জাহাজে ফিরিয়ে নিয়ে এলো। ওই রূপ নগরের কথা আজও ভুলতে পারিনি। এখনও মনে হয় এইতো সেদিন দেখে এসেছি।






No comments:

Post a Comment

Thank you very much for your comments.