আইরিশ সাগরে অক্টোবরের প্রথম থেকেই যেন শীত সাহেবের আক্রমন বেড়ে যায়। এপাড়ে ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড আর ওপাড়ে আয়ারল্যান্ড। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি আবার তার সাথে ঝড়ো বাতাস কিংবা ঘন কুয়াশা। প্রায় সারাক্ষণ একটা না একটা প্রাকৃতিক এলোমেলো ভাব থাকবেই। মাঝে মাঝে এমন হয় যে রীতিমত জাহাজের ডেকের উপর দাঁড়িয়ে নিজের পায়ের জুতা পর্যন্ত দেখা যায় না এমন কুয়াশা। সাগরের পানি এবং পানিতে সাঁতরানো মাছ গুলি বাছাই করতে থারমাল গ্লোভস হাতে পরা থেকেও মনে হয় যেন হাত জমে বরফ হয়ে গেছে, কোন বোধ থাকে না। আর ডিসেম্বরে? সে তো এক ভয়ানক ব্যাপার। মনে হয় যেন সমস্ত সাগরের পানি বরফ হয়ে রয়েছে। এমন সময় সমুদ্রে মাছ ধরা হয় না বললেই চলে। তাই বলে কি আর ফিশিং ট্রলার গুলি বসে থাকবে? না, তেমন কোন সম্ভাবনা মোটেই নেই।
১৯৮০ এর দশকের প্রথম দিকে রবার্টলি নামের যে ফিশিং ট্রলারে কাজ করি সেটা স্কটল্যান্ডের উত্তরে ওবান শহর থেকে আয়ারল্যান্ডের বেলফাস্ট এবং ইংল্যান্ডের ব্ল্যাকপুল কিংবা যদি সী স্ক্যানারে দেখা যায় সাগর তলে মাছের ঝাঁক মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে তখন খুব বেশি হলে লিভারপুল পর্যন্ত আইরিশ সাগরের মধ্যেই মাছ ধরে বেড়াই। স্যালমন বা লাল স্যালমন পেলে সেটা হয় বাড়তি পাওনা। আমাদের সেফ পিটারের ওভেন যেন রেডি হয়েই থাকে কখন গ্রীল করবে। একটা বা দুইটা না মোটা মুটি ৮/১০ টা রেড স্যালমন গ্রীল না হলে যেন হয় না। জাল তুলে ফেরার পথে ব্ল্যাকপুলের একটু পশ্চিমে ‘আইল অফ মান’ দ্বিপে কয়েক ঘন্টার জন্য থেমে কিছু প্রয়োজনীয় জিনিষ পত্র নিয়ে নেই। এই ফাঁকে আবার ওই আইরিশরা যারা এ কয় দিন একটু গলা ভেজাবার জন্য পাবে যেতে পারেনি তারাও একটু সুযোগ পেয়ে জেটির কাছের একটা পাবে গিয়ে দুই এক পাইন্ট লাগার (আমাদের দেশে যাকে বিয়ার বলে) গিলে আসে। জাহাজে বসে গিললে নাকি কোন স্বাদ পায় না!!
আমাদের কোম্পানির অফিস ওবান শহরে। এটা ছোট হলে কি হবে ভীষণ সুন্দর একটা টুরিস্ট শহর। সারা বছর এখানে পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তের নানা দেশের পর্যটকেরা আসছে যাচ্ছে, তবে শীত কালে কিছুটা কম। সারাটা শীতেই হয়ত ছাতা নয়ত রেইন কোট সাথে নিয়ে কি আর টুরিস্টরা বের হতে চায়?
মাছ বোঝাই জাহাজ নিয়ে এসে জেটিতে ভিড়েই মাছ এবং সামুদ্রিক অন্যান্য শামুক, স্টার ফিশ ইত্যাদি সব আনলোড করে শুধু মাত্র জাহাজে ওয়াচ কিপিঙ্গের জন্য দুই চার জন থেকে বাকি সবাই নেমে যেতাম। গত টানা অন্তত এক মাস সাগর বাসের এক একঘেয়েমি কাটাতে নেমে যেতাম। ছোট্ট অথচ ওপাশে পাহাড় ঘেরা মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্যে সাজানো এই ওবান শহরের এখান থেকে ওখানে ঘুরে বেড়াতাম। সাধ মিটত না, অন্তত আমার কখন এক ঘেয়েমি আসেনি। প্রতিবার যখন এসেছি তখনি মনে হতো যেন এই প্রথম এসেছি। এর মধ্যে শহরের উত্তর দিকের সিভিক সেন্টারের টাউন হলে দেখে যেতাম কি নাটক হচ্ছে। মন মত কোন নাটক পেলে পঞ্চাশ পাউন্ড দিয়ে টিকেট করে ঢুকে পরতাম। শেক্সপিয়ারের নাটক গুলি ইংরেজরা যে ভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারে তা মনে হয় আর কেউ পারে না। কাজেই এই লোভ সামলানো কোন বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে করতাম না। নাটক না হলেও অন্তত লাইব্রেরিতে গিয়ে ঘণ্টা খানিক ধরে স্থানিয় দুই একটা সংবাদ পত্রের হেডলাইন দেখে আবার জাহাজে ফিরে এসে খেয়ে দেয়ে শুয়ে পরতাম। বেশির ভাগ সময়ে বাইরেই বিশেষ করে গোটা তিনেক বাংলাদেশি রেস্টুরেন্ট আছে তার কোন একটাতে খেয়ে আসতাম। এখানে খেতে আসলে বারতি একটা বোনাস পেতাম। কিছুক্ষণ বাংলায় কথা বলার সুযোগ পেতাম। আমার সাথে যারা আছে তারা সবাই আইরিশ। আর এরা আইরিশ টানে যা ইংরেজি বলে তা প্রথম দিকে প্রায় কিছুই বুঝতাম না। তবে ওরা আমার কথা বুঝত।
একবার নিকির সাথে চলে গিয়েছিলাম বৃটেনের সর্ব্বোচ্চ শহর ফোর্ট উইলিয়ামে। ওবান থেকে বাসে করে উত্তর দিকে প্রায় তিন ঘণ্টার পথ। বাস যখন পাহাড়ী পথ বেয়ে ধীরে ধীরে একে বেঁকে উপরে উঠছিল সে এক মায়া ভরা অপূর্ব দৃশ্য। চারদিকে পাহাড়ী উঁচু নিচু সবুজের তেপান্তর। কোথাও কুয়াশা কুয়াশা ঝাপসা আবার কোথাও ঝিকিমিকি রোদ্দুরের আলোছায়া। প্রকৃতি যে এমন সুন্দর হতে পারে তা এই স্কটল্যান্ডে না এলে দেখা কঠিন। এমনিতে এখানে জন সংখ্যা খুবই কম। অনেক দূরে দূরে পাহাড়ের ঢালু বেয়ে কিছু কিছু জন বসতির ছোঁয়া। দূর থেকে বাড়ির ছাদের লাল রঙের টালি গুলি চোখে পরার মত। ফোর্ট উইলিয়াম পৌঁছে মনে হলো কে যেন মনের মাধূরী মিশিয়ে অনন্ত কালের অলস সময় নিয়ে বসে বসে হাতে এঁকে সাজিয়ে রেখেছে। শহরের এক পাশে এসে যখন দাঁড়িয়ে সামনের দিকে দৃষ্টি মেলে দিলাম আহা! সে কি মন জুড়ানো ছবি! কত দূরে দেখা যাচ্ছে। চারদিকে নিঝুম নিস্তব্ধ, শুধু আঁকাবাঁকা এলো মেলো পাহাড়ী সবুজ আর সবুজ। দূরে ওই উত্তরে এবং পশ্চিমে পাহাড়ের ওপাশে নীল সাগর, দুই চারটা গাং চিল উড়ে বেড়াচ্ছে। চোখের পলক পরতে চায় না। মন প্রাণ চোখ সব এক সাথে বলে উঠেছিল বাকিটা জীবন এখানেই থেকে যাই। খেয়ে না খেয়ে শুধু এই প্রকৃতি দেখে দেখেই জীবন কাটিয়ে দেই।
গরম কালে স্কটল্যান্ডের উত্তর প্রান্তের শহর ইনভার্নেস এর উত্তরে দেড় দুই শত মাইলের মধ্যে যখন যেখানে মাছের ঝাঁক বেশি থাকে ওই এলাকায় জাহাজের পিছনে জাল ফেলে ট্রলিং করতাম একটানা সপ্তাহ খানিক। দিনে অন্তত তিন চার বার জাল টেনে মাছ তুলে বাছাই, গ্রেডিং করে হোল্ডে সাজিয়ে রাখতাম। স্যালমন, রেড স্যালমন, ট্রাউট, কড, হোয়াইট ফিশ, চিংড়ি, লবস্টার, স্নিফার, হেরিং আরো কত ছোট বড় হাজার রকমের মাছের সাথে জেলি ফিশ, স্টারফিশ, কাঁকড়া, নানা জাতের ঝিনুক, শামুক, বাচ্চা হাঙ্গর, বাচ্চা অক্টোপাস্ সহ কত কি যে উঠত সে এক দেখার মত দৃশ্য। সমুদ্রের নিচে যে এত প্রাণী তা এই মাছের জাহাজে কাজ না করলে হয়ত কোন দিনই জানতাম না। এগুলির মধ্যে আবার যা মানুষের খাদ্য নয় সেগুলি পশু খাদ্য তৈরীর জন্য ব্যবহার হতো আর মানুষের খাদ্য যোগ্যগুলি আলাদা গ্রেডিং করতে করতে নাজেহাল অবস্থা। মানুষের খাদ্য বলতে আমাদের দেশে যা বোঝায় এখানে ঠিক তেমন না। এদের সুস্বাদু খাদ্য তালিকায় এক রকম ছোট ছোট মুসেল নামে ঝিনুক আছে যা বেশ দাম দিয়েই এরা কিনে বিশেষ করে ফ্রেঞ্চরা। অবশ্য আমাদের পিটার সামুদ্রিক সাদা কাঁকড়া দিয়ে যে কাটলেট বানাত তা প্রথম দিকে দেখে মোটামুটি নাক সিটকাতাম। কিন্তু এক দিন ওদের সাথে ডাইনিং টেবিলে এক সাথে খেতে বসে নানান পদের সস দিয়ে ওই কাঁকড়ার কাটলেট খাবার ভঙ্গি দেখে একটু মুখে দিয়েই রীতি মত আফসোস হল। এত দিন কেন খাইনি।
সে যাই হোক, সাগরের এসব লিখলে কোন দিন শেষ হবে বলে মনে হয় না। আজ যে কথা বলতে এসেছি সেখানেই ফিরে আসি। এক বার ঝুর ঝুর করে স্নো পরা নীলচে সাদা ধবধবে ওবান হারবারে যখন রাজহাঁসেরা সাঁতরে বেড়াচ্ছিল তেমনি একটা দিনে আমরা ওবানের ছোট্ট হারবার থেকে আঁকাবাঁকা পাহাড়ী পথে এঁকেবেঁকে বের হয়ে প্রায় এক শ মাইল দূরে এসে জাল ফেলেছি। এখানে হারবার থেকে বের হয়েই জাল ফেলা যায় না কারণ পানির নিচে প্রচুর পাহাড়ী এবং এবরো থেবরো সাগর তল। জাল বেধে জাল ছেঁড়া সহ নানা রকম ঘটনা ঘটে যায় বলে নিরাপদ দূরত্বে এসে জাল ফেলতে হয়। বেশ পাঁচ ছয় দিন চলে গেল। জালে ভাল মাছ আসছে। আমাদের আইরিশ স্কিপার (ট্রলার ক্যাপটেন) সাম, আসল নাম স্যামুয়েল কিন্তু সবাই সহজ ভাবে সাম নামেই ডাকে। সে আবার আরো কিছু মাছ বেশি হলে জাল তুলে এক বারে লিভারপুল বা ব্ল্যাকপুল হারবারে পৌঁছে দিয়ে জাহাজ রেখে ফেরিতে পার হয়ে বেলফাস্টে তার বাড়ি যাবে এমন একটা আশা নিয়ে একটু দেরি করতে চাইছে।
সেদিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত তিন বার জাল টানা হয়েছে এবং প্রচুর মাছ ধরা পরছে। সন্ধ্যার একটু আগে দিনের শেষ বারে জাল টানা হচ্ছে, জাল বোঝাই মাছ বোঝা যাচ্ছে। জাহাজের ইঞ্জিন থামিয়ে আস্তে আস্তে উইঞ্চে টেনে জাল কাছে আনা হচ্ছে। মাছ তোলার জন্য ক্রেন রেডি করে রাখা আছে। পাশের উইঞ্চের শব্দ শুনে বোঝা যাচ্ছে বেশ লোড হয়েছে। আইরিশ জেলে নাবিকেরা পিছনের ডেকে দাঁড়িয়ে মাছ দেখে সবাই মনের আনন্দে আইরিশ ভাষায় চিৎকার করে গান গাইছে। ওদের গান শুনে মনে হচ্ছিল যেন ভাটিয়ালি গাইছে তাই আমিও বাংলায় “ও রে নীল দরিয়া” শুরু করে দিলাম। জ়াল কাছে এসে পরেছে। পিছনে দেখছি কয়েকটা কাল হাঙ্গর লেজ দিয়ে বারি দিয়ে পানি ছিটিয়ে আবার ডুব দিচ্ছে। একটু পরেই ভেসে উঠে আবার লেজের বারি। এ আর এমন কিছু নতুন নয়। প্রায়ই জাল টানার সময় এমন দৃশ্য আমাদের গা সওয়া হয়ে গেছে। প্রথম দিকে একটু একটু ভয় পেতাম এ কথা স্বীকার করতে মোটেও লজ্জা পাচ্ছি না। আমাদের মধ্যে পন্টি ছিল একটু বেশি রকমের সাহসী। পারলে লাফ দিয়েই যেন জাল টেনে তুলে আনে এমন লাফালাফি করছিল। ওর চিৎকারই সবার কানে আসছিল। হঠাৎ করে কি মনে করে সম্ভবত আনন্দের আতিশয্যে জাহাজের রেলিঙ্গের উপরে উঠে নাচতে চেয়েছিল আর অমনিই ঝপাত করে পানিতে পরে গেল। হেই পন্টি!!! বলে সবাই এক সাথে চিৎকার। কিন্তু চিৎকার করে কি আর পন্টিকে তুলে আনা সম্ভব? নিচে তাকিয়ে আর পন্টিকে দেখছি না, তলিয়ে গেছে। সবাই জাহাজের রেলিং ধরে অসহায়ের মত নিচে তাকিয়ে আছে। একটু পরেই ও ভেষে উঠল। ওদিকে পিছনেই হাঙ্গরের ঝাঁক। কি হয়েছে? এমন করল কেন? কি হবে? কি হবে? এই শিগ্গির হিভিং লাইন (এক ধরনের রশি, যার এক মাথা কিনারায় বা পাশের অন্য জাহাজের সাথে ভিড়ার সময় ছুড়ে দেয়া হয় এবং ওরা ওটা ধরতে পারলে এ মাথার সাথে জাহাজ বাধার মোটা রশি টেনে নেয়ার জন্য বেঁধে দেয়া হয়) ফেল। লাইফ বয়া ফেল। তাড়াতাড়ি কর। এমনি হুলস্থূল ব্যাপার। কেও হিভিং লাইন খুঁজছে, কেউবা খুঁজছে লাইফ বয়া। এক হৈ চৈ ব্যাপার। হাতের কাছেই সব নির্দিষ্ট জায়গা মত রয়েছে কিন্তু কেউ খুঁজে পাচ্ছে না।
সবার আগে লুইস একটা লাইফ বয়া পেয়ে পন্টির দিকে ছুড়ে ফেলল। কিন্তু ওটা ওর কাছে পৌঁছায়নি। এতক্ষণে ও হাঙ্গরেরা বুঝতে পারেনি যে ওদের এক মস্ত শিকার ওদের একটু সামনে হাবুডুবু খাচ্ছে। ওরা শুধু জালের ভিতরে থাকা মাছ খাবার পিছনেই ব্যর্থ দৌড় দৌড়াচ্ছিল। তবে হাঙ্গরের যেমন ঘ্রাণ শক্তি তাতে পন্টির গন্ধ ওদের কাছে পৌঁছে যেতে বেশী ক্ষণ লাগবে না। চেঁচামেচির শব্দ শুনে স্কিপার সাম দৌড়ে এসে পরিস্থিতি বুঝে তাড়াতাড়ি উইঞ্চ অফ করে নিজ হাতে একটা হিভিং লাইনের মাথায় একটা বয়া বেধে পন্টির দিকে তার সর্ব শক্তি দিয়ে ছুড়ে দিল। আর পন্টি দুই এক হাত এগিয়ে এসেই খপ করে বয়াটা ধরে ফেলল। এই এতক্ষণে সর্দার হাঙ্গর লাফ দিয়ে পন্টিকে উদ্দেশ্য করে ডুব দিয়েছে, সবাই এক সাথে দেখেছি। তার পিছনের সব হাঙ্গর একই কায়দায় লাফ দিয়ে ডুব দিয়েই সম্ভবত দৌড়। হাঙ্গরেরা কখনোই তার শিকার উপর থেকে ধরে না। ওরা আস্তে করে চুপি চুপি পানির নিচে দিয়ে এসে কামড়ে ধরে।
হিভিং লাইনের মাথায় বাঁধা লাইফ বয়া ধরতে ধরতে পন্টি বেশ কয়েক গজ পিছিয়ে গেছে তবুও যেই কিনা পন্টি লাইফ বয়া ধরেছে আর অমনি হিভিং লাইন ধরে টেনে কাছে আনা হচ্ছে। লাফ দিয়ে ডুব দেয়ার পর থেকে হাঙ্গরদের আর দেখা যাচ্ছে না। বিষয়টা নিশ্চিত যে ওরা পন্টির গন্ধ পেয়েছে এবং কাছে আসতে আর মাত্র কয়েক মিনিটের বেশি লাগবে না। পন্টিকে একে বারে জাহাজের পিছনের ডেকের নিচ বরাবর আনা হয়েছে। এর মধ্যে কে যেন রশির তৈরী সিঁড়ি এনে নামিয়ে দিয়েছে। ওপর থেকে নানা জনের হাঁকডাক পন্টি সিঁড়ি ধরে উঠে আস, পন্টি তাড়াতাড়ি কর। ও জানেই না যে এক ঝাঁক হাঙ্গর ওর গন্ধ পেয়ে ওর দিকে ধেয়ে আসছে। তবে রক্ষা একটাই যে ওরা সোজা আসতে পারছে না। বিশাল জাল ঘুরে আসতে হচ্ছে। সিঁড়ির নিচের দিকটা সাগরের সমতলে পৌঁছে গেছে। পন্টি ওর লম্বা হাত বাড়িয়ে সিঁড়ির একটা ধাপ ধরে ফেলেছে। বলা যায় না, এখন হাঙ্গরের আক্রমণের ভয় এড়ানো যাবে না যদি কাছে এসে থাকে। পানির নিচে কিছু দেখা যাচ্ছে না। হ্যাঁ এইতো আর একটু উপরে, আর একটু হলেই পন্টি সিঁড়িতে উঠে দাঁড়াতে পারবে। সম্ভবত পায়ের জুতা ভারী হয়ে গেছে বলে পা টেনে আনতে পারছে না। হ্যাঁ এইতো পন্টি এক হাতে সিঁড়ির রশি ধরে আর একটু উপরে তুলে এক পা সিঁড়িতে তুলে দিয়েছে। মোটা মুটি দুই স্টেপ উপরে উঠে এসেছে এমন সময় পন্টির ঠিক নিচে সাগরের পানিতে তুমুল একটা তোলপাড় তুলে পানি ছিটিয়ে একটা হাঙ্গরের মাথা বের হলো। শিকার হাত ছাড়া হয়ে যাচ্ছে। ডলফিন যেমন মনের আনন্দে লাফিয়ে সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে বেশ খানিকটা উঠে আসে তেমনি করে মস্ত হা করা একটা বিশাল হাঙ্গরের মাথা এক লাফ দিয়ে পন্টির ডান পা কামড়ে ধরে ফেলেছে। ঘটনার আকস্মিকতায় পন্টি পরে যাই যাই ভাব। কিন্তু পন্টি সাহস না হারিয়ে বা ভয়ে কাবু না হয়ে এর মধ্যে সিঁড়ির রশি ধরে ওর শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে ডান পা এক ঝারা দিয়ে বাম পা আর এক ধাপ তুলে এনেছে। ঝারি পেয়ে ডান পায়ের জুতা খুলে হাঙ্গরের মুখে আর আমাদের পন্টি খালি পা তুলে সিঁড়ির পরের ধাপে উঠে এক এক করে একেবারে জাহাজের কিনারা ধরে ফেলার আগেই ডেকে দাঁড়ানো দুই জনে ওকে ধরে টেনে ডেকে তুলে ফেলল। নিচে তাকিয়ে দেখি ওরা সবাই চলে এসে মুখ থেকে শিকার ছিনিয়ে নেয়ার আক্রোশে পানিতে প্রচণ্ড ঘূর্ণি ঝড় তুলে ফেলেছে। পন্টিও নিচে তাকিয়ে কিছুক্ষণ তামাশা দেখছিল।
ঘটনার তান্ডবে উইঞ্চ অন করার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম সবাই। সাম আবার উইঞ্চের সুইচ অন করে বলল হে হে পন্টি, এত গুলি হাঙ্গরকে এমন হতাশ করে ওদের এত সুন্দর একটা ডিনার হতে দিলে না? দারুণ বাঁচা বেচে গেছ। এই নিক, যাও একটা শ্যাম্পেনের বোতল নিয়ে এসে পন্টির মঙ্গল কামনা করে ওকে শ্যাম্পেন দিয়ে গোসল দিয়ে দাও।
১৯৮০ এর দশকের প্রথম দিকে রবার্টলি নামের যে ফিশিং ট্রলারে কাজ করি সেটা স্কটল্যান্ডের উত্তরে ওবান শহর থেকে আয়ারল্যান্ডের বেলফাস্ট এবং ইংল্যান্ডের ব্ল্যাকপুল কিংবা যদি সী স্ক্যানারে দেখা যায় সাগর তলে মাছের ঝাঁক মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে তখন খুব বেশি হলে লিভারপুল পর্যন্ত আইরিশ সাগরের মধ্যেই মাছ ধরে বেড়াই। স্যালমন বা লাল স্যালমন পেলে সেটা হয় বাড়তি পাওনা। আমাদের সেফ পিটারের ওভেন যেন রেডি হয়েই থাকে কখন গ্রীল করবে। একটা বা দুইটা না মোটা মুটি ৮/১০ টা রেড স্যালমন গ্রীল না হলে যেন হয় না। জাল তুলে ফেরার পথে ব্ল্যাকপুলের একটু পশ্চিমে ‘আইল অফ মান’ দ্বিপে কয়েক ঘন্টার জন্য থেমে কিছু প্রয়োজনীয় জিনিষ পত্র নিয়ে নেই। এই ফাঁকে আবার ওই আইরিশরা যারা এ কয় দিন একটু গলা ভেজাবার জন্য পাবে যেতে পারেনি তারাও একটু সুযোগ পেয়ে জেটির কাছের একটা পাবে গিয়ে দুই এক পাইন্ট লাগার (আমাদের দেশে যাকে বিয়ার বলে) গিলে আসে। জাহাজে বসে গিললে নাকি কোন স্বাদ পায় না!!
আমাদের কোম্পানির অফিস ওবান শহরে। এটা ছোট হলে কি হবে ভীষণ সুন্দর একটা টুরিস্ট শহর। সারা বছর এখানে পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তের নানা দেশের পর্যটকেরা আসছে যাচ্ছে, তবে শীত কালে কিছুটা কম। সারাটা শীতেই হয়ত ছাতা নয়ত রেইন কোট সাথে নিয়ে কি আর টুরিস্টরা বের হতে চায়?
মাছ বোঝাই জাহাজ নিয়ে এসে জেটিতে ভিড়েই মাছ এবং সামুদ্রিক অন্যান্য শামুক, স্টার ফিশ ইত্যাদি সব আনলোড করে শুধু মাত্র জাহাজে ওয়াচ কিপিঙ্গের জন্য দুই চার জন থেকে বাকি সবাই নেমে যেতাম। গত টানা অন্তত এক মাস সাগর বাসের এক একঘেয়েমি কাটাতে নেমে যেতাম। ছোট্ট অথচ ওপাশে পাহাড় ঘেরা মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্যে সাজানো এই ওবান শহরের এখান থেকে ওখানে ঘুরে বেড়াতাম। সাধ মিটত না, অন্তত আমার কখন এক ঘেয়েমি আসেনি। প্রতিবার যখন এসেছি তখনি মনে হতো যেন এই প্রথম এসেছি। এর মধ্যে শহরের উত্তর দিকের সিভিক সেন্টারের টাউন হলে দেখে যেতাম কি নাটক হচ্ছে। মন মত কোন নাটক পেলে পঞ্চাশ পাউন্ড দিয়ে টিকেট করে ঢুকে পরতাম। শেক্সপিয়ারের নাটক গুলি ইংরেজরা যে ভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারে তা মনে হয় আর কেউ পারে না। কাজেই এই লোভ সামলানো কোন বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে করতাম না। নাটক না হলেও অন্তত লাইব্রেরিতে গিয়ে ঘণ্টা খানিক ধরে স্থানিয় দুই একটা সংবাদ পত্রের হেডলাইন দেখে আবার জাহাজে ফিরে এসে খেয়ে দেয়ে শুয়ে পরতাম। বেশির ভাগ সময়ে বাইরেই বিশেষ করে গোটা তিনেক বাংলাদেশি রেস্টুরেন্ট আছে তার কোন একটাতে খেয়ে আসতাম। এখানে খেতে আসলে বারতি একটা বোনাস পেতাম। কিছুক্ষণ বাংলায় কথা বলার সুযোগ পেতাম। আমার সাথে যারা আছে তারা সবাই আইরিশ। আর এরা আইরিশ টানে যা ইংরেজি বলে তা প্রথম দিকে প্রায় কিছুই বুঝতাম না। তবে ওরা আমার কথা বুঝত।
একবার নিকির সাথে চলে গিয়েছিলাম বৃটেনের সর্ব্বোচ্চ শহর ফোর্ট উইলিয়ামে। ওবান থেকে বাসে করে উত্তর দিকে প্রায় তিন ঘণ্টার পথ। বাস যখন পাহাড়ী পথ বেয়ে ধীরে ধীরে একে বেঁকে উপরে উঠছিল সে এক মায়া ভরা অপূর্ব দৃশ্য। চারদিকে পাহাড়ী উঁচু নিচু সবুজের তেপান্তর। কোথাও কুয়াশা কুয়াশা ঝাপসা আবার কোথাও ঝিকিমিকি রোদ্দুরের আলোছায়া। প্রকৃতি যে এমন সুন্দর হতে পারে তা এই স্কটল্যান্ডে না এলে দেখা কঠিন। এমনিতে এখানে জন সংখ্যা খুবই কম। অনেক দূরে দূরে পাহাড়ের ঢালু বেয়ে কিছু কিছু জন বসতির ছোঁয়া। দূর থেকে বাড়ির ছাদের লাল রঙের টালি গুলি চোখে পরার মত। ফোর্ট উইলিয়াম পৌঁছে মনে হলো কে যেন মনের মাধূরী মিশিয়ে অনন্ত কালের অলস সময় নিয়ে বসে বসে হাতে এঁকে সাজিয়ে রেখেছে। শহরের এক পাশে এসে যখন দাঁড়িয়ে সামনের দিকে দৃষ্টি মেলে দিলাম আহা! সে কি মন জুড়ানো ছবি! কত দূরে দেখা যাচ্ছে। চারদিকে নিঝুম নিস্তব্ধ, শুধু আঁকাবাঁকা এলো মেলো পাহাড়ী সবুজ আর সবুজ। দূরে ওই উত্তরে এবং পশ্চিমে পাহাড়ের ওপাশে নীল সাগর, দুই চারটা গাং চিল উড়ে বেড়াচ্ছে। চোখের পলক পরতে চায় না। মন প্রাণ চোখ সব এক সাথে বলে উঠেছিল বাকিটা জীবন এখানেই থেকে যাই। খেয়ে না খেয়ে শুধু এই প্রকৃতি দেখে দেখেই জীবন কাটিয়ে দেই।
গরম কালে স্কটল্যান্ডের উত্তর প্রান্তের শহর ইনভার্নেস এর উত্তরে দেড় দুই শত মাইলের মধ্যে যখন যেখানে মাছের ঝাঁক বেশি থাকে ওই এলাকায় জাহাজের পিছনে জাল ফেলে ট্রলিং করতাম একটানা সপ্তাহ খানিক। দিনে অন্তত তিন চার বার জাল টেনে মাছ তুলে বাছাই, গ্রেডিং করে হোল্ডে সাজিয়ে রাখতাম। স্যালমন, রেড স্যালমন, ট্রাউট, কড, হোয়াইট ফিশ, চিংড়ি, লবস্টার, স্নিফার, হেরিং আরো কত ছোট বড় হাজার রকমের মাছের সাথে জেলি ফিশ, স্টারফিশ, কাঁকড়া, নানা জাতের ঝিনুক, শামুক, বাচ্চা হাঙ্গর, বাচ্চা অক্টোপাস্ সহ কত কি যে উঠত সে এক দেখার মত দৃশ্য। সমুদ্রের নিচে যে এত প্রাণী তা এই মাছের জাহাজে কাজ না করলে হয়ত কোন দিনই জানতাম না। এগুলির মধ্যে আবার যা মানুষের খাদ্য নয় সেগুলি পশু খাদ্য তৈরীর জন্য ব্যবহার হতো আর মানুষের খাদ্য যোগ্যগুলি আলাদা গ্রেডিং করতে করতে নাজেহাল অবস্থা। মানুষের খাদ্য বলতে আমাদের দেশে যা বোঝায় এখানে ঠিক তেমন না। এদের সুস্বাদু খাদ্য তালিকায় এক রকম ছোট ছোট মুসেল নামে ঝিনুক আছে যা বেশ দাম দিয়েই এরা কিনে বিশেষ করে ফ্রেঞ্চরা। অবশ্য আমাদের পিটার সামুদ্রিক সাদা কাঁকড়া দিয়ে যে কাটলেট বানাত তা প্রথম দিকে দেখে মোটামুটি নাক সিটকাতাম। কিন্তু এক দিন ওদের সাথে ডাইনিং টেবিলে এক সাথে খেতে বসে নানান পদের সস দিয়ে ওই কাঁকড়ার কাটলেট খাবার ভঙ্গি দেখে একটু মুখে দিয়েই রীতি মত আফসোস হল। এত দিন কেন খাইনি।
সে যাই হোক, সাগরের এসব লিখলে কোন দিন শেষ হবে বলে মনে হয় না। আজ যে কথা বলতে এসেছি সেখানেই ফিরে আসি। এক বার ঝুর ঝুর করে স্নো পরা নীলচে সাদা ধবধবে ওবান হারবারে যখন রাজহাঁসেরা সাঁতরে বেড়াচ্ছিল তেমনি একটা দিনে আমরা ওবানের ছোট্ট হারবার থেকে আঁকাবাঁকা পাহাড়ী পথে এঁকেবেঁকে বের হয়ে প্রায় এক শ মাইল দূরে এসে জাল ফেলেছি। এখানে হারবার থেকে বের হয়েই জাল ফেলা যায় না কারণ পানির নিচে প্রচুর পাহাড়ী এবং এবরো থেবরো সাগর তল। জাল বেধে জাল ছেঁড়া সহ নানা রকম ঘটনা ঘটে যায় বলে নিরাপদ দূরত্বে এসে জাল ফেলতে হয়। বেশ পাঁচ ছয় দিন চলে গেল। জালে ভাল মাছ আসছে। আমাদের আইরিশ স্কিপার (ট্রলার ক্যাপটেন) সাম, আসল নাম স্যামুয়েল কিন্তু সবাই সহজ ভাবে সাম নামেই ডাকে। সে আবার আরো কিছু মাছ বেশি হলে জাল তুলে এক বারে লিভারপুল বা ব্ল্যাকপুল হারবারে পৌঁছে দিয়ে জাহাজ রেখে ফেরিতে পার হয়ে বেলফাস্টে তার বাড়ি যাবে এমন একটা আশা নিয়ে একটু দেরি করতে চাইছে।
সেদিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত তিন বার জাল টানা হয়েছে এবং প্রচুর মাছ ধরা পরছে। সন্ধ্যার একটু আগে দিনের শেষ বারে জাল টানা হচ্ছে, জাল বোঝাই মাছ বোঝা যাচ্ছে। জাহাজের ইঞ্জিন থামিয়ে আস্তে আস্তে উইঞ্চে টেনে জাল কাছে আনা হচ্ছে। মাছ তোলার জন্য ক্রেন রেডি করে রাখা আছে। পাশের উইঞ্চের শব্দ শুনে বোঝা যাচ্ছে বেশ লোড হয়েছে। আইরিশ জেলে নাবিকেরা পিছনের ডেকে দাঁড়িয়ে মাছ দেখে সবাই মনের আনন্দে আইরিশ ভাষায় চিৎকার করে গান গাইছে। ওদের গান শুনে মনে হচ্ছিল যেন ভাটিয়ালি গাইছে তাই আমিও বাংলায় “ও রে নীল দরিয়া” শুরু করে দিলাম। জ়াল কাছে এসে পরেছে। পিছনে দেখছি কয়েকটা কাল হাঙ্গর লেজ দিয়ে বারি দিয়ে পানি ছিটিয়ে আবার ডুব দিচ্ছে। একটু পরেই ভেসে উঠে আবার লেজের বারি। এ আর এমন কিছু নতুন নয়। প্রায়ই জাল টানার সময় এমন দৃশ্য আমাদের গা সওয়া হয়ে গেছে। প্রথম দিকে একটু একটু ভয় পেতাম এ কথা স্বীকার করতে মোটেও লজ্জা পাচ্ছি না। আমাদের মধ্যে পন্টি ছিল একটু বেশি রকমের সাহসী। পারলে লাফ দিয়েই যেন জাল টেনে তুলে আনে এমন লাফালাফি করছিল। ওর চিৎকারই সবার কানে আসছিল। হঠাৎ করে কি মনে করে সম্ভবত আনন্দের আতিশয্যে জাহাজের রেলিঙ্গের উপরে উঠে নাচতে চেয়েছিল আর অমনিই ঝপাত করে পানিতে পরে গেল। হেই পন্টি!!! বলে সবাই এক সাথে চিৎকার। কিন্তু চিৎকার করে কি আর পন্টিকে তুলে আনা সম্ভব? নিচে তাকিয়ে আর পন্টিকে দেখছি না, তলিয়ে গেছে। সবাই জাহাজের রেলিং ধরে অসহায়ের মত নিচে তাকিয়ে আছে। একটু পরেই ও ভেষে উঠল। ওদিকে পিছনেই হাঙ্গরের ঝাঁক। কি হয়েছে? এমন করল কেন? কি হবে? কি হবে? এই শিগ্গির হিভিং লাইন (এক ধরনের রশি, যার এক মাথা কিনারায় বা পাশের অন্য জাহাজের সাথে ভিড়ার সময় ছুড়ে দেয়া হয় এবং ওরা ওটা ধরতে পারলে এ মাথার সাথে জাহাজ বাধার মোটা রশি টেনে নেয়ার জন্য বেঁধে দেয়া হয়) ফেল। লাইফ বয়া ফেল। তাড়াতাড়ি কর। এমনি হুলস্থূল ব্যাপার। কেও হিভিং লাইন খুঁজছে, কেউবা খুঁজছে লাইফ বয়া। এক হৈ চৈ ব্যাপার। হাতের কাছেই সব নির্দিষ্ট জায়গা মত রয়েছে কিন্তু কেউ খুঁজে পাচ্ছে না।
সবার আগে লুইস একটা লাইফ বয়া পেয়ে পন্টির দিকে ছুড়ে ফেলল। কিন্তু ওটা ওর কাছে পৌঁছায়নি। এতক্ষণে ও হাঙ্গরেরা বুঝতে পারেনি যে ওদের এক মস্ত শিকার ওদের একটু সামনে হাবুডুবু খাচ্ছে। ওরা শুধু জালের ভিতরে থাকা মাছ খাবার পিছনেই ব্যর্থ দৌড় দৌড়াচ্ছিল। তবে হাঙ্গরের যেমন ঘ্রাণ শক্তি তাতে পন্টির গন্ধ ওদের কাছে পৌঁছে যেতে বেশী ক্ষণ লাগবে না। চেঁচামেচির শব্দ শুনে স্কিপার সাম দৌড়ে এসে পরিস্থিতি বুঝে তাড়াতাড়ি উইঞ্চ অফ করে নিজ হাতে একটা হিভিং লাইনের মাথায় একটা বয়া বেধে পন্টির দিকে তার সর্ব শক্তি দিয়ে ছুড়ে দিল। আর পন্টি দুই এক হাত এগিয়ে এসেই খপ করে বয়াটা ধরে ফেলল। এই এতক্ষণে সর্দার হাঙ্গর লাফ দিয়ে পন্টিকে উদ্দেশ্য করে ডুব দিয়েছে, সবাই এক সাথে দেখেছি। তার পিছনের সব হাঙ্গর একই কায়দায় লাফ দিয়ে ডুব দিয়েই সম্ভবত দৌড়। হাঙ্গরেরা কখনোই তার শিকার উপর থেকে ধরে না। ওরা আস্তে করে চুপি চুপি পানির নিচে দিয়ে এসে কামড়ে ধরে।
হিভিং লাইনের মাথায় বাঁধা লাইফ বয়া ধরতে ধরতে পন্টি বেশ কয়েক গজ পিছিয়ে গেছে তবুও যেই কিনা পন্টি লাইফ বয়া ধরেছে আর অমনি হিভিং লাইন ধরে টেনে কাছে আনা হচ্ছে। লাফ দিয়ে ডুব দেয়ার পর থেকে হাঙ্গরদের আর দেখা যাচ্ছে না। বিষয়টা নিশ্চিত যে ওরা পন্টির গন্ধ পেয়েছে এবং কাছে আসতে আর মাত্র কয়েক মিনিটের বেশি লাগবে না। পন্টিকে একে বারে জাহাজের পিছনের ডেকের নিচ বরাবর আনা হয়েছে। এর মধ্যে কে যেন রশির তৈরী সিঁড়ি এনে নামিয়ে দিয়েছে। ওপর থেকে নানা জনের হাঁকডাক পন্টি সিঁড়ি ধরে উঠে আস, পন্টি তাড়াতাড়ি কর। ও জানেই না যে এক ঝাঁক হাঙ্গর ওর গন্ধ পেয়ে ওর দিকে ধেয়ে আসছে। তবে রক্ষা একটাই যে ওরা সোজা আসতে পারছে না। বিশাল জাল ঘুরে আসতে হচ্ছে। সিঁড়ির নিচের দিকটা সাগরের সমতলে পৌঁছে গেছে। পন্টি ওর লম্বা হাত বাড়িয়ে সিঁড়ির একটা ধাপ ধরে ফেলেছে। বলা যায় না, এখন হাঙ্গরের আক্রমণের ভয় এড়ানো যাবে না যদি কাছে এসে থাকে। পানির নিচে কিছু দেখা যাচ্ছে না। হ্যাঁ এইতো আর একটু উপরে, আর একটু হলেই পন্টি সিঁড়িতে উঠে দাঁড়াতে পারবে। সম্ভবত পায়ের জুতা ভারী হয়ে গেছে বলে পা টেনে আনতে পারছে না। হ্যাঁ এইতো পন্টি এক হাতে সিঁড়ির রশি ধরে আর একটু উপরে তুলে এক পা সিঁড়িতে তুলে দিয়েছে। মোটা মুটি দুই স্টেপ উপরে উঠে এসেছে এমন সময় পন্টির ঠিক নিচে সাগরের পানিতে তুমুল একটা তোলপাড় তুলে পানি ছিটিয়ে একটা হাঙ্গরের মাথা বের হলো। শিকার হাত ছাড়া হয়ে যাচ্ছে। ডলফিন যেমন মনের আনন্দে লাফিয়ে সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে বেশ খানিকটা উঠে আসে তেমনি করে মস্ত হা করা একটা বিশাল হাঙ্গরের মাথা এক লাফ দিয়ে পন্টির ডান পা কামড়ে ধরে ফেলেছে। ঘটনার আকস্মিকতায় পন্টি পরে যাই যাই ভাব। কিন্তু পন্টি সাহস না হারিয়ে বা ভয়ে কাবু না হয়ে এর মধ্যে সিঁড়ির রশি ধরে ওর শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে ডান পা এক ঝারা দিয়ে বাম পা আর এক ধাপ তুলে এনেছে। ঝারি পেয়ে ডান পায়ের জুতা খুলে হাঙ্গরের মুখে আর আমাদের পন্টি খালি পা তুলে সিঁড়ির পরের ধাপে উঠে এক এক করে একেবারে জাহাজের কিনারা ধরে ফেলার আগেই ডেকে দাঁড়ানো দুই জনে ওকে ধরে টেনে ডেকে তুলে ফেলল। নিচে তাকিয়ে দেখি ওরা সবাই চলে এসে মুখ থেকে শিকার ছিনিয়ে নেয়ার আক্রোশে পানিতে প্রচণ্ড ঘূর্ণি ঝড় তুলে ফেলেছে। পন্টিও নিচে তাকিয়ে কিছুক্ষণ তামাশা দেখছিল।
ঘটনার তান্ডবে উইঞ্চ অন করার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম সবাই। সাম আবার উইঞ্চের সুইচ অন করে বলল হে হে পন্টি, এত গুলি হাঙ্গরকে এমন হতাশ করে ওদের এত সুন্দর একটা ডিনার হতে দিলে না? দারুণ বাঁচা বেচে গেছ। এই নিক, যাও একটা শ্যাম্পেনের বোতল নিয়ে এসে পন্টির মঙ্গল কামনা করে ওকে শ্যাম্পেন দিয়ে গোসল দিয়ে দাও।
No comments:
Post a Comment
Thank you very much for your comments.