যখন
সপ্তম শ্রেণীতে পড়তাম তখন এক বিচিত্রানুষ্ঠানে “শুকনো পাতার নূপুর পায়ে”
গানের সাথে ছোটদের নাচের দৃশ্য দেখে ভাবতে শুরু করেছিলাম এত সুন্দর
গান যিনি লিখেছেন তিনি কে? কে এই বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল
ইসলাম?
আচ্ছা
তিনিতো বিদ্রোহী কবি, তাহলে তিনি এত সুন্দর গান কি করে লিখেছেন? মনের
মধ্যে নানা প্রশ্ন! মাকে জিজ্ঞেস
করলাম, বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম তারা
তাদের জানা সকল ইতিহাস বললেন কিন্তু তাতেও আশ্বস্ত হতে পারছি না। আমার ওই স্কুল
জীবন কেটেছে বাংলার বাইরে কাজেই ইচ্ছে করলেই কোন বাঙালি সম্পর্কে জানতে চাইলেই
জানার উপায় নেই। এখনকার মত তখন ইন্টারনেট, মোবাইল ইত্যাদি
ব্যবহার করে চটজলদি জানার উপায় নেই। রেডিওতে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের
অনুষ্ঠানে খুব মনোযোগ দিয়ে নজরুল গীতি শুনি আর নজরুল সম্পর্কে কোন অনুষ্ঠানের
ইঙ্গিত পেলে খুব আগ্রহ নিয়েই টা শুনতাম। খুঁজে খুঁজে স্কুল থেকে তার সম্পর্কে
কয়েকটা বই এনে পড়লাম। এভাবে ক্রমে সপ্তম থেকে নবম শ্রেণীতে উন্নীত হয়েছে। গুরু
সম্পর্কে ধারনা কিছু প্রসারিত হয়েছে। তার গান গুলিও লক্ষ করে দেখেছি অন্য যে কোন
গানের চেয়ে ভাল লাগতে শুরু হয়েছে। প্রেমের গান মোরা আর জনমে হংস মিথুন ছিলাম,
জনম জনম গেল আশা পথ চেয়ে, মোর প্রিয়া হবে এসো
রানী, দুটি পাখি দুটি, আমায় নহে গো
ভালবাস মোর গান, জাগিতে এসেছি রাতি জাগাতে আসিনি, ওগো প্রিয় তব গান আকাশ গাঙ্গের জোয়ারে, লাইলি তোমার
এসেছে ফিরিয়া এসব গান গুলি বেশি ভাল লাগত। তার পরে আমি যদি আরব হতাম, পুবালি হাওয়া পশ্চিমে যাও কাবার পথে, ত্রি ভুবনে
প্রিয় মোহাম্মদ এসব গানগুলি শুনতাম আর মনের গহীনে গুরুকে দেখার সাধ প্রবল ভাবে
জেগে উঠত। কারার ওই লৌহ কপাট, চল চল চল ঊর্ধ্ব গগনে বাজে
মাদল, সাম্যের গান, সৃস্টি সুখের
উল্লাস এই সব গান শুনে এত ভিন্ন মুখি সুন্দর সুন্দর গান যিনি লিখেন তিনি কত
সুন্দর! তখন জেনেছি তিনি ভারতের কলকাতায় থাকেন। তার দেখা পেতে হলে আমাকে ঢাকায়
আসতে হবে, ভিসা নিতে হবে কোলকাতায় কোথায় থাকব এগুলি নানা
কিছু অনেক বড় বাধা মনে হতো। অনেক টাকার প্রয়োজন। আমি তখন মাত্র নবম শ্রেণীর ছাত্র
এত খরচ এত হাঙ্গামা আমি কি করে মোকাবিলা করব! আমার বাবার যা আয় তাতে বাবা আমার এই
সাধ পূরণের জন্য আমাকে এত টাকা দিতে রাজী হবেন না বা আর এক কথায় বলা যায় তিনি
কুলিয়ে উঠতে পারবেন না।
না, আমার এই সাধ কিছুতেই পূরণ হবার
নয়। কবির প্রতি ভালবাসা এভাবেই একদিন নিঃশেষ হয়ে যাবে। আর তাছাড়া কবি এখন বাকশক্তি
হীন। অন্যের উপর নির্ভরশীল। তিনি ভিন দেশের, ভারতের নাগরিক।
কাজেই আমার জন্য পাকিস্তানে এসে দেখা দেওয়া তার পক্ষে কোন অবস্থাতেই সম্ভব নয়।
আন্তর্জাতিক সীমা রেখা, ভিন্ন ভূখণ্ড এ সম্পর্কে ভালই ধারনা
আছে। কেউ ইচ্ছা করলেই এক ভূখণ্ড থেকে ভিন্ন ভূখণ্ডে যেতে পারে না বা আন্তর্জাতিক
সীমানা রেখাও অতিক্রম করতে পারে না। কাজেই আমার এই স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে।
তুমি
সুন্দর টাই চেয়ে থাকি, নহে নহে প্রিয় এ নহে আঁখি জল, আকাশে হেলান দিয়ে
পাহাড় ঘুমায় ওই, কুহু কুহু কোয়েলিয়া, যাহা
কিছু মম, মেঘ মিদুর বরষায় এই সব গান শুনতে শুনতেই দিন চলে
যায়।
পৃথিবীর
ভৌগলিক অবস্থার পরিবর্তন হলো। বাংলাদেশ নামের একটা নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হলো। আমার
বাবা আমাদের নিয়ে সেই নতুন রাষ্ট্রে চলে এলেন। আমরা এখন স্বাধীন। ইচ্ছা করলেই
সাধারণ নিয়ম কানুন মেনে যে কোন জায়গায় যেতে পারি। ভাবলাম এবার দেখব চেষ্টা করে। এর
মধ্যে স্কুলের পাট শেষ হয়েছে। আমার পরিধিও একটু বড় হয়েছে। পরিচিতির গণ্ডিও বড়
হয়েছে। এই সুবাদে জানলাম শুধু পাসপোর্ট হলেই কলকাতা যাওয়া যায়। স্থল পথে, বেনাপোল দিয়ে। ভাবলাম এই বুঝি
গুরু দর্শনের পথ সহজ হয়ে এলো। তবুও কি করে যেন দিনগুলি থামিয়ে রাখতে পারলাম না
চলেই যাচ্ছে। গুরু দর্শনের সাধ আমার বেড়েই চলেছে কিন্তু কোন উপায় খুঁজে পাচ্ছি না!
এমনি এক সময় একদিন খবরের কাগজে দেখলাম কোলকাতা থেকে গুরু নিজেই ঢাকায় এসেছেন,
ছেলে মেয়ে সহ। বাংলাদেশ সরকার তাকে জাতীয় কবির মর্যাদা দিয়ে ঢাকায়
নিয়ে এসেছেন। এখন থেকে তিনি ঢাকায়ই থাকবেন। তার জন্য ধানমন্ডিতে একটি বাড়ি দেয়া
হয়েছে। সেই বাড়ির ঠিকানা কাগজে দিয়ে দিয়েছে। ঢাকায় নতুন এসেছি কোথায় ধানমন্ডি চিনি
না, মামাত ভাই মুকুলকে সাথে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে রওয়ানা হলাম।
মিরপুর থেকে আধা ঘণ্টার মধ্যে গুরুর বাড়িতে এসে পৌঁছলাম কিন্তু আমার ধারনাকে ভুল
প্রমাণিত করল জন সমুদ্র। গুরুকে দেখার সাধ শুধু আমার একার নয়। লক্ষ লক্ষ মানুষ
এসেছে তাকে দেখতে, সারাদিন অপেক্ষা করেও বাড়ির কাছে ভিড়তে
পারলাম না। সন্ধ্যায় ফিরে এলাম। মুকুল বলল কয়েকদিন অপেক্ষা কর ভিড় কমলে তারপরে
যাব।
প্রায়
এক সপ্তাহ পর মুকুলকে জিজ্ঞেস করলাম ভাইয়া যাবি? হ্যাঁ আজ চল দুপুরে যাব। আবার
এলাম। সেদিন দর্শনার্থীর ভিড় কমে গেছে। বাড়িটা ফাঁকা পেলাম। দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করে
সোজা চলে এলাম দোতলায়। দেখলাম কবিকে গোসল করিয়ে একজন নার্স মাত্র বারান্দার রোদে শতরঞ্চির
উপর বসিয়ে রাখল। খালি গায়ে শুধু ধুতি পরনে। গলায় সম্ভবত কিসের একটা মালা ছিল।
অনেকদিন আগের কথা মনে করতে পারছি না। তখন আমার কাছে ক্যামেরাও ছিল না। ইন্টারনেট
থেকে পাওয়া উপরের এই ছবিতে যে চেহারা দেখছেন কবির তখন এই চেহারা। নির্বাক কবি
চারিদিকে অবাক দৃষ্টি নিয়ে দেখছে আর বির বির করছে কিছু বলতে চাইছে। গোল বড় বড় চোখ,
দব দবে ফর্সা গায়ের রঙ, সাদা চুল একজন সুবোধ
শিশুর মত লাগছে দেখতে। একটু পরে আবার নার্স এলো খাবারের প্লেট নিয়ে। নির্বাক কবির
পাশে বসল। পটল দিয়ে ইলিশ মাছের ঝোল আর ভাত। ১০/১২ বছরের একজন ছেলে যে পরিমাণ ভাত
খায় সেই পরিমাণ ভাত। মাছের কাটা বেছে নার্স তাকে খাওয়ায়ে দিল। প্রায় শেষ হলে কবি
আর মুখে নিতে চাইছিল না। মুখ বন্ধ করে হাত দিয়ে ফিরিয়ে দিচ্ছিল, মানে-আর খাব না। দুই তিনবার এমন করলে নার্সও বুঝল। পাশে রাখা পেয়ালার পানি
দিয়ে মুখ ধুয়ে সবুজ রঙের একটা গামছা দিয়ে মুছিয়ে দিল। দেখছিলাম আর ভাবছিলাম এই
মানুষটি কেমন করে সর্বগ্রাসী বৃটিশের বিরুদ্ধে অমন আগুন ঝরা গান লিখেছিলেন দেশের
মানুশকে জাগাবার জন্য, তাদের রক্তে দেশাত্মবোধ, দেশের প্রতি নেশা জাগাবার জন্য। এই মানুষটি এই উপমহাদেশের কত কি দেখেছেন।
আজ তিনি স্তব্ধ, নির্বাক বোধহীন। তার জীবনের এই অল্প সময়ে
তিনি যা দিতে পেরেছেন সে অশেষ ভান্ডার কোন দিন শেষ হবে না। সালাম তোমায় গুরু,
বেচে থাক মানুষের হৃদয়ে।
পিছনে
তাকিয়ে দেখি অনেক ভিড় হয়ে গেছে। আমাদের ভাগ্য ভাল আমরা একান্ত নার্সিং সময়ে এসে
অনেকক্ষণ ভরে সাধ মিটিয়ে দেখতে পেরেছি। সাধারণত এই সময়ে এখানে কেউকে আসতে দেয় না।
অনেক স্মৃতি, অনেক কল্পনা, অনেক আশা আকাঙ্ক্ষা পিছনে ফিরে কত কি
দেখলাম। কবি কুমিল্লায় এসেছিলেন, নোয়াখালীতে এসেছিলেন আজও
হয়ত তার পায়ের চিহ্ন রয়ে গেছে কোথাও যা অনেকের ভিড়ে মুছে গেছে। তার যৌবনে ঢাকায়ও
এসেছিলেন সে আসা আর এখনকার এই আসার মধ্যে কতখানি পার্থক্য তাই নিয়েই ভাবলাম ওখানে
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। আজ যদি তিনি সুস্থ সবাক থাকতেন তাহলে আমাদের কতই না ভালবাসতেন।
বাংলাদেশকে কতই না ভাল বাসতেন। যেখানে কেটেছে তার শৈশব কৈশর যৌবনের অনেকগুলি দিন।
অনেক ইতিহাস জড়ান এই মাটি। কত কি রচনা করতেন আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য কত গান
কবিতা লিখে দিতেন। আমাদের দুর্ভাগ্য আমরা তাকে পেলাম কিন্তু নির্বাক! প্রাণে কত
দুঃখ। এই দুঃখ নিয়েই ফিরে এসেছিলাম। তিনি যখন আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন তখন আমি দেশের
বাইরে। মসজিদের পাশে আমায় কবর দিও ভাই। তার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে ভেবেছি কতখানি
দূরদর্শিতা থাকলে একজন এমন করে অনুরোধ রেখে যেতে পারেন। শুনেছি বিলাতের অক্সফোর্ড
বিশ্ববিদ্যালয়ে তার লেখা পাঠ্য হিসেবে চলে আসছে উচ্চ ডিগ্রি নেবার জন্য।। আমি আজ
ধন্য, আমার গুরুকে নিজের চোখ দেখতে পেরেছি এবং সবাইকে মুখ
তুলে বলতে পারছি এ কথা। আল্লাহ তা’ লা তাকে বেহেস্ত নসিব
করুন।
No comments:
Post a Comment
Thank you very much for your comments.