Friday 11 July 2014

শিম্পাঞ্জির দেশে




রাস্তার দুই পাশে যতদূর দৃষ্টি যায় লাইন ধরে সব সুন্দর সুন্দর বাড়ি ঘর, এলো মেলো ভাবে কোন বাড়ি নেই। অধিকাংশই সিরামিক ইটের রঙের মত দেয়াল, উপরে লাল টালির দোচালা ছাদ। প্রতিটা বাড়ির সামনে সুন্দর করে
কাঠের জাফরি করা বেড়া আর তার ভিতরে চমৎকার সব ফুলের গাছে ফুল ফুটে আছে। রাসেল শুধু একটা বৈশিষ্ট্য লক্ষ করল যে সব বাড়ি এক তলা, কোথাও কোন দোতলা বা এক তলার বেশি উঁচু কোন বাড়ি নেই। সব বাড়ির সুন্দর রঙ
করা দরজা জানালা খোলা কিন্তু কোথাও কোন জন প্রাণীর সারা শব্দ নেই। প্রতিটা বাড়ির পিছনেই নানান ফল গাছে ফল ঝুলছে। রাস্তার দুই পাশে ছোট ছোট সুন্দর ফুলের গাছে নানা রঙ বেরঙ্গের ফুল ফুটে রয়েছে প্রজাপতি আর মৌমাছিরা উড়ে উড়ে এক ফুল থেকে আর এক ফুলের মধু নিচ্ছে। এমনি নির্জন ছিমছাম  রাস্তায় একা একা হাটতে হাটতে  গ্রাম ছেড়ে বেশ অনেক দূরে চলে এসেছে যেখানে আর কোন বাড়ি ঘর নেই। শুরু হয়েছে নানা ফসল এবং শাক সবজির জমি। টমাটো, কলা, গম, ভুট্টা, গাজর, বিট, ফুল কফি, বাঁধা কফি, লেটুস এমনি নানা কিছু সহ অচেনা নানা ফসল বেশ ফলে রয়েছে কিন্তু এখানেও কোন জন প্রাণী নেই। যতই দেখছে ততই অবাক হচ্ছে আর একটু একটু করে এগুচ্ছে। সামনে ডান পাশের ভুট্টা ক্ষেত ছাড়িয়ে যেতেই দেখল বেশ বড় সাইজের কয়েকটা কাল শিম্পাঞ্জি একটা টমাটো ক্ষেত থেকে ঝাঁকায় করে টমাটো তুলছে। একটু দূরে দূরে এমনি আরও অনেক শিম্পাঞ্জি বিভিন্ন ক্ষেতে কাজ করছে। রাসেল অবাক হয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়ল। এ কি দেখছি! নিজের চোখে দেখছে তবুও নিজের কাছেই অবিশ্বাস্য মনে হলো। এও কি সম্ভব? কোন মানুষ নেই শুধু শিম্পাঞ্জি এই জমিতে কাজ করছে?  অবাক হয়ে দাঁড়িয়েই রইল। পা আর সরতে চাইছে না। একটু ভয়ও পেল।
এমনি সময় এক শিম্পাঞ্জি ঝাঁকা নিয়ে এপাশে ঘুরতেই রাসেলকে দেখল। ওকে দেখে ঝাঁকাটা নামিয়ে রেখে  ওর কাছে এসে মানুষের মত জিজ্ঞেস করল
কি দেখছেন?
রাসেলের মুখ দিয়ে কথা আসছে না। দিশাহারা। কি বলবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। প্রায় মানুষ সমান লম্বা লেজ ওয়ালা একটা শিম্পাঞ্জি যদি এই ভাবে সামনে দাঁড়িয়ে মানুষের মত কথা বলে তাহলে কে না অবাক হয়? ঝাঁকা নামিয়ে চার হাত পায়ে এদিকে এগিয়ে এসেছে কিন্তু এখন মানুষের মত দুই পায়ে দাঁড়ান।
শিম্পাঞ্জিটা এবার জিজ্ঞেস করল, কেমন আছেন?
এতক্ষণে রাসেল সম্বিত ফিরে পেয়ে বলল, ভাল আছি কিন্তু............
কিন্তু বলেই থেমে গেল। আর কিছু বলতে পারছে না।
তাই লক্ষ করে শিম্পাঞ্জিটা বলল
আপনি অবাক হয়েছেন তাই না? আমাদের দেখে আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না, এই তো?
হ্যাঁ তাই, কিন্তু..................
আবার থেমে গেল।
এর মধ্যে ওদের কথার শব্দ পেয়ে অন্য যারা কাজ করছিল তারা সবাই ফিরে দেখল কি হচ্ছে।
আরে সাহেব এটা আপনাদের মানুষের দেশ নয় এটা আমাদের শিম্পাঞ্জির দেশ। এখানে আমরাই বাস করি। আমাদের পূর্ব পুরুষ আপনাদের দেশেই ছিল কিন্তু আপনাদের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে, না খেতে পেয়ে এই দেশে এসে বসতি করেছে। আমরা তাদের বংশধর। আমার নাম কিলা, ভয় পেয়েছেন?
আমতা আমতা করে বলল, না না ভয়ের কি!
না ভয় পাবেন না। আমরা জাতে শিম্পাঞ্জি হলেও আমরা আপনাদের চেয়ে অনেক সভ্য। চলেন আমার বাড়িতে চলেন দেখবেন আমরা কেমন সভ্য।
বাড়িতে যাব?
হ্যাঁ অতিথিকে কি আর রাস্তায় ফেলে চলে যাওয়া যায়? আপনি একটু অপেক্ষা করেন সন্ধ্যা হলেই দেখবেন সবাই কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরবে তখন আপনাকে নিয়ে যাব। ওদের দিকে ঘুরে বলল এই তোমরা কাজ কর অতিথির সাথে পরে আলাপ হবে।
বসেন এই ঘাসের উপরেই বসি।
বলেই শিম্পাঞ্জিটা রাসেলের হাত ধরে টেনে বসে পড়ল।
এবার বলুনতো এতক্ষণে আমাদের দেশ যতটা দেখলেন তাতে আপনার কাছে কেমন লাগল?
রাসেল এতক্ষণে একটু ধাতস্থ হয়ে বলল
খুব ভাল লাগছে, এমন সুন্দর এলাকা আমি আগে কখনও দেখিনি।
হ্যাঁ, চলেন আমাদের বাড়ি চলেন ওখানে গেলে আরও ভাল লাগবে।
আচ্ছা আপনারা কি কি চাষ করেন?
আমরা বানরেরা যা খেতে পারি আমরা তাই চাষ করি, আমরাতো আর আপনাদের দেশে যেতে পারি না যে ওখান থেকে কিনে আনব তাই আমাদের প্রয়োজনীয় খাবার নিজেদেরই করে নিতে হয়।  এইতো চার দিকে যা দেখছেন এই সবই করি, কখনও তরমুজ, চিনাবাদাম, মিষ্টি কুমড়া, মিষ্টি আলু, আখ তবে ধানের চাষ করি না আর দেখেছেনতো আমাদের বাড়িতে নানা ফলের গাছ আছে আমাদের এই এলাকায় সব রকমের ফল পাবেন কারণ আমরাতো ফল আর সবজি খাই তাই। মাঝে মাঝে কেও কেও গম আর ভুট্টার চাষ করে কারণ  মাঝে মাঝে রুটি পরটা খেতে ইচ্ছা করেতো! আমরাতো আবার মাছ মাংস ডিম এগুলিও খাই না।
বেশ ভাল কথা!
আচ্ছা আপনার নামটা কিন্তু এখনও বলেননি!
ও হ্যাঁ আমার নাম রাসেল।
বাহ!, বেশ সুন্দর নাম!
কথা বলতে বলতে সন্ধ্যা হয়ে এলো। যারা বিভিন্ন জমিতে কাজ করছিল তারা সবাই কাজ শেষে যার যার জিনিস পত্র গুটিয়ে আল ধরে বড় রাস্তায় চলে এলো। এবার যার যার বাড়িতে যাবে। কিলার হনুমানেরাও এসে রাস্তায় দাঁড়াল আর কিলা বলল, চল বাড়ি যাই। আসেন রাসেল সাহেব বাড়ি যাই। টমাটোর ঝাঁকা মাথায় করে ওরা কিলাকে অনুসরণ করছে, রাসেলও কিলার পাশে পাশে হাঁটছে। অল্প কিছুক্ষণ হেঁটেই আগের দেখা ওই আবাসিক এলাকায় এসে ডান দিকের একটা গলিতে ঢুকে বাম হাতের প্রথম বাড়িটাই কিলার।
ঘরে ঢুকে রাসেলকে বসার ঘরে বসতে বলে কিলা ভিতরে চলে গেল। সুন্দর সাজান গোছান ঘর তবে ঘরে কোন আসবাব নেই শুধু ভুট্টার পাতা দিয়ে বোনা পুরু সুন্দর গালিচা বিছান। ওতেই বসে পড়ল। একটু পরেই কিলা আর তার পিছনে কিলার স্ত্রী এবং দুই বাচ্চা আসল। কিলার স্ত্রীর হাতে ছোট ট্রেতে একটা বড় গ্লাসে শরবতের মত কি মনে হলো। রাসেলের দিকে বাড়িয়ে বলল নেন শরবত খান। কিলা পরিচয় করিয়ে দিল। এই আমার স্ত্রী যুঁই আর এরা আমার ভবিষ্যৎ তারা আর টুকি। এ হচ্ছে রাসেল। যুঁই হাত বাড়িয়ে হ্যান্ড সেক করে বলল
আপনি বসুন আমি আসছি।
রাসেল ভয়ে ভয়ে শরবতের গ্লাসে চুমুক দিয়ে দেখল দারুণ শরবত। এক চুমুকেই শেষ করে ফেলল।
তাই দেখে কিলা বলল, আর একটু খাবেন?
না না অনেক খেয়েছি
একটু পরে  যুঁই একটা সুন্দর নক্সা করা বড় ট্রেতে করে নানা রকম ফল কেটে সাজিয়ে এনে সামনে নামিয়ে রাখল। কিছু চেনা ফল আর বাকি সবই অচেনা। মাঝ খানে ট্রে রেখে চারদিকে গোল হয়ে বসে সবাই এক সাথে ফল খাচ্ছে আর আলাপ করছে। ভীষণ সুস্বাদু ফল।
তারপর বলুন রাসেল সাহেব আপনাদের দেশের কি অবস্থা?
এই চলছে আর কি, কোন ভাবে দিন চলে যাচ্ছে। আমাদের দেশের কথা আর কি বলব আপনাদের এখানকার কথা বলেন শুনি আমার কাছে খুব ভাল লাগছে।
চলেন তাহলে আমার প্রতিবেশীদের সাথে আপনার আলাপ করিয়ে দেই
হ্যাঁ তাহলে ভালই হয়, চলেন
তারা আর টুকি দুইজনে লাফ দিয়ে বাবা মার কাঁধে উঠে বসল। কিলা আর যুঁই অতিথিকে সাথে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে একটু দূরে রাস্তার পাশে আর এক বাড়িতে যেয়ে দেখে ওই বাড়ির সামনের বাগানে কয়েকজন শিম্পাঞ্জি বাঁশের চেয়ারে বসে গল্প করছে।
এই যে মিশা, টাকি, ইগু তোমরা দেখি এখানেই আছ, বেশ হয়েছে দেখ আমাদের এখানে নতুন অতিথি এসেছে তার সাথে আলাপ করিয়ে দেই। ওরা কিলার সাথে একজন মানুষ দেখে উঠে দাঁড়িয়ে হ্যান্ড সেক করে বসতে বলল।
কেমন আছেন অতিথি?
ভাল ভাল বেশ ভাল
আপনারা সবাই ভাল আছেন?
হ্যাঁ হ্যাঁ আমরাও খুব ভাল আছি, বলেন ভাই আমাদের দেশ কেমন লাগছে?
খুউব ভাল লাগছে। যতই দেখছি ততই ভাল লাগছে আর তার সাথে অবাক হচ্ছি। আসলে আপনাদের সম্পর্কে আমার আরও অনেক জানতে ইচ্ছে করছে, কিছু বলুন না ভাই
মিশা বলল কি আর বলব! আমাদের এখানে আপনাদের মত না। আমি ছোট বেলায় বাবার সাথে আপনাদের দেশে গিয়েছিলাম সেখানে ভয়ংকর অবস্থা দেখে তাড়াতাড়ি চলে এসেছি। দেখেছেন আমাদের রাস্তা ঘাট কেমন? আমাদের বাড়ির আশে পাশে দেখেন কেমন সুন্দর সাজান গোছান। এমনকি পথে একটা কাগজের টুকরোও খুঁজে পাবেন না পলিথিনতো দূরের কথা। তারপরে আমাদের জমিগুলাও লক্ষ করেছেন, এখানে কেও কারো জমির আল কাটে না। আমাদের সব কিছুই নিয়মের মধ্যে থাকে কিছুই নিয়মের বাইরে যায় না। আমরা সবাই এই নিয়ম মেনে চলি। ছোটরা কেউ এদিক ওদিক করলে সাথে সাথে বাবা মা বা প্রতিবেশী যেই সামনে থাকে সেই দেখিয়ে দেয়, বুঝিয়ে দেয়।
মিশা থামলে টাকি বলতে শুরু করল
এখানে কেউ কারো গায়ে হাত দেয় না, কেউ নিয়ম ভাঙ্গে না। মারামারি, কাটাকাটি, দাঙ্গা হাঙ্গামা, খুন খারাবি, অন্যায় অবিচার, লুটপাট, চুরি ডাকাতি, এসিড নিক্ষেপ, ঘুষ দুর্নীতি এসব আমাদের এখানে কেও জানেই না।
বাহ! বেশ সুন্দর কথা! আরও বলুন
হ্যাঁ বলছি, আমরা প্রতিবেশীরা প্রতি সপ্তাহে এক  এক দিন এক এক বাড়িতে পার্টি করি।
মানে, বুঝলাম না
এবারে ইগু বলল
মানে হলো প্রতি সপ্তাহের মঙ্গল বারে আমরা কোন কাজ করি না সেদিন সবাই নিজের বাড়ি ঘর, বাগান, পাশের রাস্তা এগুলি পরিষ্কার করি। আগে থেকেই ঠিক করা থাকে কবে কার বাড়িতে এই পার্টি হবে সেদিন সন্ধ্যা হলে সবাই ওই বাড়িতে চলে যাই। সবার সাথে গল্প হয়, কার ছেলে মেয়ে বড় হয়েছে এগুলি দেখে বিয়েশাদীর জন্য পাত্র পাত্রী নির্বাচন করা হয়। তবে ছেলে মেয়েদের কারো কোন পছন্দ অপছন্দ থাকলে আমরা তা বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকি। এলাকার সমস্যা নিয়ে সমাধানের সিদ্ধান্ত হয় আনন্দ হয়, হৈ চৈ হয়, খাওয়া দাওয়া হয় তারপর আমরা সবাই এক সাথে সৃষ্টি কর্তার প্রার্থনা করি এবং প্রার্থনা শেষ করে রাত হলে আগামী মঙ্গল বারে কার বাড়িতে যাব সেটাও ওই সময় সবাইকে জানিয়ে দিয়ে যার যার বাড়ি ফিরে এসে ঘুমিয়ে পরি।
বাহ! দারুণ!
আমাদের আরও কিছু নিয়ম আছে
সেগুলি আবার কেমন?
আমাদের বাচ্চাদের স্কুলে কোন শিক্ষক নেই
তাহলে কে পড়ায়?
আমরা পালা করে বাচ্চাদের স্কুলে পড়াই, প্রতি মাসে একটা শিডিউল করে সবাইকে জানিয়ে দেয়া হয় সেই অনুযায়ী ক্লাসে চলে যাই। ওই যে দেখুন ওটাই আমাদের স্কুল। স্কুল থেকে একটু এগিয়ে গেলেই আমাদের হাসপাতাল, বাজার এবং অনেক কিছু আছে। আজকে থাকুন কাল আমাদের ছুটির দিন সব দেখিয়ে আনব আবার বিকেলে আমাদের সাথে পার্টিতেও নিয়ে  যাব কাল আমার বাড়িতে পার্টি হবে।
আপনার বাড়ি কোথায়?
ওই স্কুলের পাশে।
আচ্ছা, তখন দেখলাম সব বাড়ির দরজা জানালা খোলা কিন্তু কোন প্রাণী দেখলাম না এর মানে কি?
কিলা প্রচন্ড অট্টহাসি হেসে বলল কি করে দেখবেন বলুন সবাই যে কাজে গিয়েছিল।
তা এই খোলা পথে যদি কেও ঢুকে পরে?
কে আসবে? বলল না এখানে কেও অমন কিছু জানেই না। আর তা ছাড়া আমাদেরতো আর আপনাদের মত রান্না করতে হয় না কাজেই বাড়ির মহিলারাও জমিতেই কাজ করে সাথে বাচ্চাদেরও নিয়ে যায় না হলে ওরা শিখবে কি করে?
আপনাদের এখানে কোর্ট কাচারি নেই? পুলিশ, সেনা বাহিনী?
মিশা বলল, আরে ভাই এতক্ষণ বললাম কি! আমাদের এখানে কেও কোন অপরাধই করে না কেও জানেই না অপরাধ কি, তো কোর্ট কাচারি থাকার দরকারটা কি? আর পুলিশ বা সেনাবাহিনীর কথা বলছেন, হ্যাঁ সেনাবাহিনী আছে তবে সেটা শুধু আমাদের দেশের নিরাপত্তার জন্য যাতে করে বাইরে থেকে কেও এসে কোন হাঙ্গামা করতে না পারে তবে আপনাদের মত কোন পুলিশ নেই। আমাদের সেনা বাহিনীর লোকেরা শুধু আমাদের দেশের সীমানা পাহারা দেয় ওদের আর কোন কাজ নেই।
বাহ! কি সুন্দর দেশ! রাসেল বলল ঈশ আমিও যদি আপনাদের মত শিম্পাঞ্জি হয়ে এই দেশে আসতে পারতাম!
এমন সময় রাসেল শুনল মা ডাকছে কিরে রাসেল অফিসে যাবি না?  আর কত ঘুমাবি? এবার ওঠ!

No comments:

Post a Comment

Thank you very much for your comments.