Saturday 1 December 2012

নক্ষত্রের গোধূলি-৩৯ (অধ্যায় ৪)

(পূর্ব প্রকাশের পর) মা এক হাতে রাশেদের হাত ধরে ভিতরে এলেন। কয়েকজন ডাক্তার বসে। পাশে দাঁড়ানো একজন নার্স বিছানায় শোয়া গায়ের জামা খোলা চোখ বন্ধ পেটে একটা হাত রাখা ভাইকে ধরে রেখেছে। ডাক্তার মাকে বসতে বললেন।
আপনার ছেলের কি হয়েছে আমরা এই মুহূর্তে বুঝতে পারছি না
পরীক্ষা করে দেখতে হবে, এজন্যে তাকে এখানে ভর্তি করে রাখতে হবে।
অতটুক বাচ্চা কি করে থাকবে?
না না আপনিও সাথে থাকবেন।

মা একবার বাবার আর মালেক চাচার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন ঠিক আছে করেন তাহলে যা করতে হয়। আপনারা কি কিছুই বুঝতে পারছেন না?
হ্যাঁ, মনে হয় কৃমি, যদিও ব্যাপারটা সম্পর্কে এখনো নিশ্চিত নই, আশা করি আজ বিকেলের মধ্যেই জানতে পারবো তবে আপনারা আরও আগে আসলে ভাল হত।
মা ভাইকে নিয়ে রয়ে গেলেন। বাবা রাশেদের হাত ধরে বললেন চল রাশেদ। ভাইয়ের মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখে নিয়ে মায়ের দিকে একবার তাকিয়ে বাবার পিছনে বের হয়ে এল। সাথে মালেক চাচা। গেটের কাছে এসে চাচা বললেন আপনি বাসায় যেয়ে খেয়েদেয়ে ওদের কাপড়চোপড় দরকারি জিনিষ পত্র নিয়ে বিকেলে চলে আসেন আমি আছি এখানে। দেখছি, চিন্তা করবেন না। আপনি আসলে এক সাথে বের হব। যাবার সময় আমার বাসায় একটু বলে যাবেন। বাবা রাশেদকে নিয়ে বাসে করে চলে এলেন। বাসায় ঢোকার আগে পাশের খালাম্মার কাছে চাবি আনতে গেলে খালাম্মা ব্যস্ত হয়ে খবর জানতে চাইলেন। সব শুনে খালাম্মা বললেন

আপনি বাসায় যান হাতমুখ ধুয়ে আসেন খেয়ে নেন, আমি রান্না করি ভাবির জন্যে নিয়ে যাবেন ভাবিরতো দুপুরে খাওয়া হয়নি।
না কিছু বিস্কুট দিয়ে এসেছি ওতেই হবে খাওয়ার মত ইচ্ছা নেই।
মজিবরের আব্বাতো এখনো আসেনি। দেখি সে আসুক আমরাও হয়ত যেতে পারি।
খেয়ে দেয়ে বাসায় এসে বাবা একটা বড় ধরনের ব্যাগে মা আর ভাইয়ের জন্যে কাপড়, স্যান্ডেল, আয়না চিরুনি, টুথপেস্ট, ব্রাশ তোয়ালে এইসব টুকিটাকি গুছিয়ে একটু বিশ্রামের জন্যে বিছানায় কাত হলেন। রাশেদকেও টেনে তার সাথে শোয়ালেন। রাশেদ ঘুমিয়ে পরেছিল বাবার ডাকে চোখ মেলে তাকাল। চল রেডি হও তারা তারি, হাসপাতালে যাবেনা ওঠ। বের হয়ে মজিবরদের বাসায় ঢুকলেন।
খালাম্মা রেডি হয়েই ছিলেন একটা টিফিন ক্যারিয়ারে মার জন্যে খাবার নিয়ে বেরিয়ে এলেন সাথে মজিবরের বাবা। হাসপাতালে এসে দেখে ভাইয়ের চোখ খোলা। কতদিন পরে চোখ খোলা দেখে রাশেদের মনে হোল এইতো ভাই ভালো হয়ে গেছে। এগিয়ে এসে মাথায় মুখে হাত বুলিয়ে দিলেন। রাশেদের হাতটা চেপে ধরল,
ভাইজান তুমি আছছ।
তুমি ভালো হয়ে গেছ ভাইয়া! পেটে ব্যথা নেই আর?
আমি বাসায় যাবো না? আমাকে এখানে এনেছে কেন।

হাত না সরিয়ে ভাইয়ের মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। মা বললেন এর মধ্যে দুইবার ওষুধ দিয়ে গেছে এখনো কিছু খাওয়াতে পারিনি, স্যালাইন দিয়েছে, বলেছে কিছু খাওয়াতে হবেনা ভয় নেই। রাতে আবার ওষুধ আছে নার্সরাই খাইয়ে দেয়। খেতে চায়না দুইজনে মিলে জোড় করে খাওয়াতে হয়। ব্যথাটা মনে হয় কমেছে। দুপুরের পর থেকে ওই রকম চিৎকার করেনি। মজিবরের মা টিফিন ক্যারিয়ার থেকে খাবার বের করে মাকে খেতে দিলেন। বাবা বাইরে গেলন। পাউরুটি কলা কিনে দিয়ে এলেন মায়ের সকালের নাস্তার জন্যে। আবার কাল বিকেলে আসবে বললেন। আমি ভাইয়ের সাথে খাবার পাঠিয়ে দিবো।
বেরিয়ে আসার সময় ভাই আর রাশেদকে ছাড়তে চায়না। কান্না, না আমি এখানে থাকব না। নিয়ে চল আমাকে। পরদিন দুপুরে মালেক চাচা অফিস থেকে ফেরার পথে বাসায় এলেন। বাবাও এর মধ্যে চলে এসেছিলেন। কি খবর মালেক সাহেব?
হ্যাঁ, খবর আছে। ভালো খবর।
উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করলেন কি খবর?

কাল রাতে ওষুধ দেয়ার পর আবার পেটের ব্যথাটা বেড়েছিল কিছু খাওয়াতে পারেনি শুধু পানি ছাড়া আর কিছু খায়নি। আজ সকালে হটাত বমি আর বমির সাথে বিরাট এক ক্রিমি। বিকট চেহারা। প্রায় ছয় ইঞ্চির মত হবে লম্বা। জীবিত, নাড়াচাড়া করছিল সাপের মত। বমি হবার পরে ও তো নেতিয়ে পরে সাথে সাথেই ঘুম। আমি আসার সময়ও ঘুমে দেখে এলাম । ডাক্তার বলল বিপদ শেষ। ওরা ওটা রেখে দিয়েছে। এমন নাকি হয় না। অস্বাভাবিক ব্যাপার, এই জন্যেই এরকম হয়েছিল। ওটা যখন কামড়াত তখন যন্ত্রণায় চিৎকার করতো। ডাক্তার বলেছে যদিও বিপদ শেষ তবুও কয়েকদিন ওরা ওকে রেখে দিবে। পেটে কোন ক্ষত হয়েছে কিনা দেখবে। ভাবি বলেছে আজ যাবার সময় একটা শাড়ী নিয়ে যাবেন।
সারাদিনে রাশেদ ঘুরে ঘুরে তার ভাইয়ের পছন্দ মত খেলনা সংগ্রহ করেছে। ওপাশের লাইলিদের বাসার সামনের গাছ থেকে ফুল পেড়ে এনেছে, আর তার জমানো এক আনা দিয়ে মারবেল কিনে এনেছে। আজ হাসপাতালে যেতে নিয়ে যাবে। ভাইকে দিয়ে আসবে খেলার জন্য। বিছানায় বসেই মারবেল খেলবে। দুপুরে একটু তারা তারি খেয়ে আজ বেরিয়ে গেলেন। হাসপাতালে গিয়ে দেখে এখনো ঘুমে, মা পাশে বসে। অস্থির হয়ে ঘুরা ঘুরি করছে কখন ভাইয়ের ঘুম ভাঙ্গে। মাকে বলল
ওকে ডাক আমি এগুলি নিয়ে এসেছি ও দেখবে খেলবে
ডাকতে হল না। একটু পরেই কথার শব্দে ঘুম ভেঙ্গে উঠে চোখ খুলে ভাই আর বাবাকে দেখে মনে হচ্ছিল অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। রাশেদ এগিয়ে ভাইয়ের হাত ধরে জিজ্ঞেস করলো কি ভাই কেমন আছ? এই যে দেখ তোমার জন্যে কি এনেছি!

বলেই ওকে ধরে উঠিয়ে বসিয়ে দিয়ে হাতের ব্যাগটা বের করে খুলে বিছানায় ঢেলে দিতেই তা দেখে ভাইয়ের মুখের যে হাসি সেদিন দেখেছিল সে হাসি তার জীবনে কারো মুখে দেখেনি। সেই ভাই আজ কি ভাবে তাকে এখানে রেখে তার বাসা থেকে যে জায়গা মাত্র এক ঘন্টার ড্রাইভ সে ঈদ করবে? নিশ্চয় তাকে নিয়ে যেতে আসবে। যদিও আসলেই যে রাশেদ তার সাথে যাবে তা নয়। তার সমস্ত অন্তর মন হৃদয় জুড়ে যে মনি সেই মনির যেখানে জায়গা হয়নি সেখানে সে কিভাবে যেতে পারে? তবুও ভাবছে হয়ত এমন হতে পারে। কখন যে ঘুমিয়ে পরেছে বুঝতে পারেনি। তবে পৌনে পাঁচটার দিকে একবার ঘড়ি দেখেছিল মনে আছে। ঘুম ভাঙল দুপুর প্রায় একটার পরে। শরীরের ক্লান্তি, মনের ভার বিষণ্ণতায় নির্জীবের মত অনেকক্ষণ শুয়ে রইলো। উঠতে ইচ্ছে হচ্ছে না। না আর না, চারটা বেজে গেছে। কবির এসে ডাকছে। উঠে পরল।
কি ব্যাপার ভাই নামাজে গিয়েছিলেন আমাকে ডাকলেন না?
না নামাজে যাইতে পারি নাই ঘুম ভাংছে বারোটায়, এসে দেখি আপনেও ঘুমে তাই আর ডাকি নাই। আমি আবার শুইলাম এইতো এখন উঠলাম।
তাই নাকি? খাবার মত কিছু আছে? ক্ষুধা লেগেছে চলেন খেয়ে আসি।
কি খাবেন কিছুতো নেই শুধু রাইস আছে।
কেন ডিম আছে না ডিম ভেজে নিলেই তো হয়। চলেন।

[আমাদের মুক্তি যুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি, আসুন এই যুদ্ধ শেষ করি!]

No comments:

Post a Comment

Thank you very much for your comments.