Sunday 2 December 2012

যারা বানান ভুল করে তাদের জন্য দুটি কথা-১[২]




লেখকঃ সুশান্ত কর। অতিথি লেখক, স্মৃতিকণা ব্লগ।
লেখক পরিচিতিঃ জনাব সুশান্ত কর ভারতের অসমের তিনসুকিয়া কলেজের বাংলা বিভাগীয় প্রধান। ব্লগ করতে গিয়ে তার সাথে প্রথমে পরিচয়, পরে আলাপ এবং তার পরে হৃদ্যতা এবং এখন আমার
ছোট ভাই এর মত একটা সুন্দর সম্পর্ক হয়ে গেছে। সে আমার নক্ষত্রের গোধূলি উপন্যাসের একজন কট্টর সমালোচক যা উক্ত উপন্যাসটি কখনও বই আকারে আলোর মুখ দেখার সুযোগ পেলে আপনারা দেখতে পাবেন। সুশান্ত এবং ঈশান কোণের কাহিনী ব্লগ পরিচালন করছেন ।
আর হ্যাঁ, আমাদের দেশের কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজের বাংলার প্রধান সেও সুশান্ত তবে এ আবার কর নয় এ হচ্ছে বর্মন অর্থাৎ সুশান্ত বর্মন, পাঠাগার ব্লগের এডমিন। এর সাথেও একই সম্পর্ক। ও আমার প্রায় সকল লেখার প্রুফ দেখেছে এবং দেখছে।

বানান আমরা প্রায় সবাই কখনো না কখনো ভুল করি। আমরা বাক্যের গঠনেও ভুল করি। ক্রিয়া –সর্বনামের, সাধু-চলিতের ব্যবহারে আমাদের ভুল কখনো বা রীতিমতো কৌতুক নক্সার বিষয় হতে পারে। সে ঐ পর্যন্তই। সচরাচর তা নিয়ে কেউ বিশেষ চোখ রাঙায় না। কিন্তু বানান ভুল? কিছু স্ব-ঘোষিত মাস্টার মশাই সারাক্ষণ বেত হাতে দাঁড়িয়ে থাকেন, যেন ভুল করলেই বলবেন—দেখি , হাত তোল! মাতৃভাষা পালটে ফেলেও রক্ষে নেই। সব ভাষারই ঘোষিত মাস্টার মশাইরা’ খুব রাগ করেন, এ নিয়ে আমি দীর্ঘদিন ভাববার চেষ্টা করেছি। এ রীতিমত গবেষণার বিষয় হতে পারে। সে গবেষণা করিনি, তবে মনে হয়েছে—বাক্য ভুল নিয়ে হৈচৈ করবার জন্যে যে পরিমাণ ‘মাস্টার-ডিগ্রী’র দরকার আমাদের বেশিরভাগেরই সে পরিমাণ নেই। সে যাক, আমরাও খুব জ্ঞানী গুণী নই, তাই আপাতত বানান নিয়েই বলব। উদ্দেশ্য , বেত-হাতে কড়া মাস্টার মশাইদের মার থেকে আমাদের স্বগোত্রীয় ছাত্রদের তথা অর্ধক্ষম লেখকদের রক্ষা করতে কিছু টিপস দেয়া।

তার আগে কিছু কথা বলে নেয়া জরুরি। বানান ভুল নিয়ে ভয় করবার এক্কেবারেই কিছু নেই। মাস্টারমশায়ের বেতের ভয়ে যারা সুবোধ বালকের মতো পড়তে বসে, তারা ছাত্র ভালো হতে পারে, এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার অগ্রগতির ইতিহাসে সে সব ছাত্রদের অবদান প্রায় শূন্য। সে সব কথা নিয়ে আমরা অন্যত্র কোনো এক সময় তর্ক করব। কিন্তু ভাষার অগ্রগতির ইতিহাসে এ কথা একশ পাঁচ আনা সত্যি। পানিনি প্রণম্য ব্যক্তি। মারাত্মক ব্যাকরণ লিখেছিলেন। যাতে কেউ ভাষার ব্যবহারে ভুল না করে তার জন্যে পরবর্তী গুরুদেবেরা তাঁদের আশ্রমে বারো বছর শুধু ব্যাকরণ পড়াবার ব্যবস্থা রেখেছিলেন। তাঁরা এরকম এক মহান ‘আবিষ্কার’ও করেছিলেন যে কোনো ভাষাকে গণ ব্যবহারের জন্য মুক্ত করে দিলে সে আর ‘অক্ষয়’ থাকে না। তাই ব্রাহ্মণ আর ক্ষত্রিয় পুরুষ বাদ দিয়ে—আর সমস্ত লিঙ্গ বর্ণে ‘সংস্কৃতে’র ব্যবহার নিষিদ্ধ করে রেখেছিলেন। তাতে হলোটা কী? সংস্কৃত যেমন ছিল এখনো প্রায় তেমনি আছে বটে । তার ক্ষয় হয়েছে অন্য দিকে । যাদের জন্য ভাষা তারা তার ব্যবহার ছেড়ে দিয়েছে। ব্যবহারিক জীবনে তার আধিপত্য প্রথমে ‘ফারসি’ পরে ‘ইংরাজি’র এবং অতি অবশ্যই নব্য ভারতীয় ভাষাগুলোর প্রত্যাহ্বানের মুখে পড়ে এখন কেবল ‘ঠাকুর ঘরে’ তার প্রাণটা কোনোক্রমে বাঁচিয়ে রেখেছে। ‘বৈদিক আর্য’ ভাষার ভুল ব্যবহারে চিন্তিত হয়ে পানিনি-পতঞ্জলি-কাত্যায়নেরা ব্যাকরণের কড়া শাসন কায়েম করে সে ভাষার থেকেই সংস্কৃতের জন্ম দিলেন। অন্যদিকে প্রাকৃতজনেরা প্রাকৃত উপায়ে পাওয়া প্রাকৃত ভাষা ‘বৈদিকে’র ভুল ব্যবহার করতে করতে , করতে করতে আর পাল্টাতে পাল্টাতে আজকের বাংলা পর্যন্ত পৌঁছে গেলেন। লোকে যদি ভুলই না করত তবে কি আর ‘আহ মরি বাংলা ভাষা’র জন্ম হতো !

সুতরাং ভাষার ভুল ব্যবহার তেমন কোনো গুরুতর অপরাধ নয়। বরং এক পুণ্য কর্ম, এতে ভাষার আয়ু বাড়ে। প্রখ্যাত ভাষাতাত্বিক মুহম্মদ শহীদুল্লাহ লিখেছিলেন, “পাঁচকোটি বাঙালির অধিকাংশই বানান ভুল করে।” তখন সংখ্যাটা পাঁচকোটিই ছিল। এখন প্রায় পঁচিশ কোটি বাঙালি হবে। যারা বানান ভুল করে তাদেরও সংখ্যা সমানুপাতে বেড়েছে বৈ কমেছে বলে কোনো খবর পাওয়া যায় নি। স্কুলের মাস্টার মশাইএর বেত যে তার পরিমাণ কিছু কম করতে পেরেছে, তাতো মনে হয় না। বরং মাস্টার মশাইরাও কী রকম ভুল করেন তার নজির আমাদের অসমে প্রচলিত ‘উচ্চতর মাধ্যমিক বাংলা সাহিত্য সংকলন’ নামের পাঠ্য বইটি। সম্প্রতি সোমা আচার্য নামে এক শিক্ষিকা যুগশঙ্খে এ নিয়ে এক দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছেন। দৈনিক যুগশঙ্খের মতো অসমের জনপ্রিয় কাগজও যে কত ভুল করে কিম্বা ব্যতিক্রমী ব্যবহার করে সুযোগ পেলেই আমি সেগুলো টুকে রাখি। তার কিছু এখানে তুলে দিলে মন্দ হবে না।

২৩ জানুয়ারি,১০ এ প্রথম পৃষ্ঠাতে শিরোনাম ‘বরণের দিনেই অন্তর্দ্বন্দ্বের সুর, গড়হাজির সাংসদরা’ হওয়া উচিত ছিল ‘গরহাজির’। এমন ‘র’এর জায়গাতে ‘ড়’ কিম্বা তার বিপরীত ব্যবহারতো আখছার চোখে পড়ে। কিন্তু স্থানীয় উপভাষা বা অসমিয়া সহ অন্যভাষার প্রভাবে ভাষা কী রূপ নিচ্ছে তার উদাহরণ বেশ চিত্তাকর্ষক। যেমন ধরুনঃ ৩০ মার্চ,১০ যুগশঙ্খের তৃতীয় পৃষ্ঠাতে ‘ফন্সেকা আত্মীয় সম্পর্কে তথ্য দিলে পুরস্কার দেবে শ্রীলঙ্কা পুলিশ’ এই সংবাদের একজায়গাতে আছে,”তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ। অবৈধ প্রতিরক্ষা চুক্তি থেকে তিলক রত্নের কোম্পানী অনেক অর্থ কামিয়েছে।‘ , ‘অনেক অর্থ তিলকরত্নে কামিয়েছেন বলে অভিযোগ।’ শুদ্ধ বাংলাতে হওয়া উচিত ছিল ‘উপার্জন করেছেন’। উপার্জন অর্থে ‘কামাই’ শব্দের ব্যবহার সিলেটি-কাছাড়িতে আছে। লেখক তাই দিব্বি কাগজে চালিয়ে দিয়েছেন। অসমিয়া প্রভাবের নজির এই কথাগুলোঃ ৩ ডিসেম্বর,০৯এ “পরেশ বরুয়া ছাড়া ফলপ্রসূ হবে না শান্তি আলোচনা” এই শিরোনামাতে সংবাদে লেখা হয়েছেঃ ১)কিন্তু পরেশ অবিহনে শান্তি আলোচনা অনুষ্ঠিত করলে ফল বিপরীত হতে পারে। ২) মুকুল মহন্ত বলেছেন আলোচনার প্রতি আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হওয়ার ক্ষেত্রে পিসিজি পূর্ণ সহযোগ করবে। প্রথম বাক্যের ‘অবিহনে’ এবং দ্বিতীয় বাক্যের ‘সহযোগ করবে’ অসমিয়া থেকে সরাসরি অনুবাদে চলে এসছে। অথচ শুদ্ধ ও প্রচলিত বাংলাতে হওয়া উচিত ছিল ‘ছাড়াই’ এবং ‘সহযোগিতা করবে’। হিন্দির প্রভাবে ভাষার পরিবর্তনতো আজকাল সবেতেই জলভাতের মতো কথা।

৫ডিসেম্বরে ,০৯ যুগশঙ্খের তৃতীয় পৃষ্ঠাতে সংবাদ শিরোনাম “মেজাজ হারালেও প্রণবজীর দক্ষতা মানতেই হবেঃ সুষমা’ এই সংবাদে লেখা হয়েছেঃ ইতিমধ্যে সিপিএমের বৃন্দা কারাতের সঙ্গেও তিনি কড়াভাবে পেশ হয়েছেন । ‘প্রণবজী’টা নাহয় মানা গেল, ‘নেতাজী’ যখন আছেন তিনিও থাকতে পারেন। ‘পেশ হয়েছেন’টা কোন দেশের বাংলা? আরো মজার নজির এই সংবাদঃ ১০ফেব্রুয়ারি,’ ১০ তারিখের যুগশঙ্খের পাঁচ পৃষ্ঠার এক সংবাদে লিখেছেঃ ‘দুষ্প্রাপ্য হুদু চড়াইয়ের অস্বাভাবিক মৃত্যু’ এই শিরোনামের সংবাদ শুরু হয়েছে এই বলে,” দু’দুটি দুষ্প্রাপ্য হুদু পাখির অস্বাভাবিক মৃত্যুতে এলাকার মানুষ চিন্তিত হয়ে পড়েছেন…।” চড়াই বাংলাতে এক বিশেষ পাখি ইংরেজিতে যাকে Sparrow বলে। সব পাখিকে ‘চরাই’ বলে অসমিয়াতে। নিশ্চিত যে এখানে তার প্রভাব পড়েছে। শুধু তাই নয়, হুদু হচ্ছে সেই পেঁচা পাখি যে ডাকলে বা যাকে দেখলে অমঙ্গল হয়। বাংলাতে এই অপবাদ আছে ‘লক্ষীপেঁচা’র । হতে পারে হুদু ঐ লক্ষীপেঁচাই। সাংবাদিকটির সে জিজ্ঞাসা নিয়ে ভাববার সময় ছিলনা হয়তো, কলমের ডগাতে যা এসছে লেখে ফেলেছেন। কিন্তু এরকম ভুলই যে একটি সল্প পরিচিত জনগোষ্ঠীর কাছে কতটা অপমানজনক হতে পারে তার নজির এই সংবাদঃ ২০ জানুয়ারি, ১০ তারিখের যুগশঙ্খে ‘এনএসসিএন (আই এম)-এর মদতেই উত্তর কাছেড়ে জঙ্গি তৎপরতা’ শীর্ষক সংবাদে এক জায়গাতে লেখা হয়েছে “ এই জঙ্গি তৎপরতায় এনএসসিএন (আই এম)- ছাড়াও হোমার পিপল কনভেনশনও (এইচপিচি) জড়িত।” ইংরেজি Hmar এই সংবাদে হয়েছে ‘হোমার’ । হওয়া উচিৎ ‘মাড়’ । বাঙালিরা যে শুধু নিজের জাতি ও ভাষা সম্পর্কেই কতটা অজ্ঞ তাই নয় পূর্বোত্তরের অন্য জনগোষ্ঠিদের সম্পর্কে কত অজ্ঞ, এটা একটা নজির। অথচ কাছাড়, উত্তর কাছাড়ে মাড়েরা বেশ সুপরিচিত জনগোষ্ঠী।

এই লেখকেরা যখন বাংলাতে স্কুলপাঠ্য বই লেখার বরাত পান তখন সেখানেও তাঁরা এমন ‘ভাষা বদলের’ সুমহান কীর্তি অনায়াসে করে ফেলেন। সেই বই বরাক উপত্যকাতে পৌঁছুলে যখন কেউ কেউ ‘অসমিয়া আগ্রাসনে’র নজির দেখে পথে নেমে প্রতিবাদের ধ্বজা তুলেন তখন আমার ভীষণ হাসি পায়। একেই বলে উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে। হয়, সেই বাঙালি লেখকদের কাজের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলুন নতুবা এসব পরিবর্তনকে অসমের মতো বহুভাষিক রাজ্যে এক স্বাভাবিক স্বাস্থ্যের লক্ষণ বলে গ্রহণ করুন। বস্তুত ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বহু কবি লেখকেরা সে কাজটাই সজ্ঞানে করে চলেছেন। যেমন প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ও কবি অমলেন্দু গুহের এক কবিতার ক’টি পংক্তি এরকম, “…সাদা ধবধবে লুইতের পার কাছিমেরা ডিম পাড়ে/আমার ভায়ের মুখে চমকায় মিতালির ভালোবাসা,/দিঘলিদিঘির কোণটায় বসে গান গায় বারে বারে,/ও মোর অসম দেশ মরমিয়া, আ মরি বাংলা ভাষা।…” এতে ‘ লুইত, দিঘলি,মরমিয়া’ এমন কি ‘মোর’ শব্দটিও অসমিয়াই, কেননা শব্দটি এখন আর বাংলাতে কেউ লেখে না।

এগুলোকে স্বাস্থ্যের লক্ষণ বললে কারো কারো গোঁসা চড়তে পারে। তাই আরো কিছু প্রতিষ্ঠিত নজির তুলে ধরলে ভালো হবে। আমরা সবাই জানি ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’। এর পেছনে বাংলা ভাষা নিয়ে লড়াইয়ের এক বড় যোগদান রয়েছে। অথচ কেউ কোনোদিন প্রশ্ন করিনি যে পদগুচ্ছটির প্রথম ‘আন্তর্জাতিক’ শব্দটিই সঠিক কিনা। ইংরাজি International এর নকলে শব্দটিকে যে চালিয়ে গেছি তাই নয়, তারই অনুকরণে আবার আন্তঃসম্প্রদায়, আন্তঃমহাবিদ্যালয় ইত্যাদি শব্দও তৈরি করে নিয়েছি। শুদ্ধ অর্থে শব্দটি হওয়া উচিত ছিল ‘সর্বজাতিক’ । মাস্টার মশাইরা ভুল লেখেন এবং লিখতে বলেন এরকম আরো কিছু বিখ্যাত শব্দ হলোঃ জীবনী, প্রাগৈতিহাসিক, সমসাময়িক, বার্ষিকী, মণ্ডলী, শতাব্দী ইত্যাদি। সুতরাং আমাদের পরামর্শ হলো—ছাত্ররা ইচ্ছে মতো ভুল বানান, ভুল ভাষা লিখে যেতে পারে। ভুল করবার সাহস না করতে পারলে কে আর কবে শুদ্ধটা রপ্ত করতে পেরেছে? এ নিয়ে অহেতুক রাতের ঘুম বারোটা বাজাবার কারণ দেখি না।

কেউ কেউ যে আমাদের সে ঘুমে ব্যাঘাত ঘটান তার অনেক সঙ্গত কারণ আছে বটে, কিন্তু একটা কারণতো এই যে তাঁদের সংস্কৃতের ঐতিহ্য সূত্রে পাওয়া পণ্ডিতি অভিমান প্রচণ্ড। দুই সহস্রাধিক বছর সংস্কৃত ব্যাকরণের শাসনে থেকে আমাদেরও সেই শাসন-রোগে পেয়ে বসে আছে। একেতো সংস্কৃত ব্যাকরণের নকলে বাংলা ব্যাকরণ টিকিয়ে রেখে দিব্যি ছাত্র পড়াচ্ছি। তায় আবার অন্যত্র নীরব থাকলেও বানান ভুল করলেই সেই নকল মোটা-ব্যাকরণ মাথায় ছূঁড়ে মারবার জন্যে সংস্কৃতায়িত হাত আমাদের নিসপিস করে। বিদ্যাসাগর যখন বাংলা বর্ণমালা থেকে ঋৃ ( দীর্ঘ ঋ) আর ৯৯ (দীর্ঘ ৯) কে বাদ দিয়েছিলেন তখনো সে পণ্ডিতদের হাত কম নিশপিশ করেনি। ভাগ্যিস! তিনি তাতে বিচলিত হননি।

তা, ভুল করা যেতেই পারে। কিন্তু মুস্কিল হলো, পঁচিশ কোটি বাঙালি যদি পঁচিশ কোটি রকমের বাংলা লিখতে শুরু করে তা হলেতো হয়েই গেল। সে ভাষা নিয়ে আর কাজ কী? কেউতো আর কারো কথা বুঝবে না যে যার নিজের সাতকাহন লিখে যাবে, পড়বার কেউ থাকবে না। ভাগ্যিস! বাস্তবে এরকমটা হয় না। ভাষা তার আপন সামঞ্জস্য নিজেই অনেকটা বাঁচিয়ে রাখে। অথবা বোধহয় বলা ভালো ব্যক্তি মানুষ ভাষার ব্যবহারের বিশৃঙ্খলা বাড়ালেও সমষ্টি মানুষ একটা শৃঙ্খলা নিয়েই আসে। বিচিত্র সব কারক কাজ করে তার পেছনে। তবুও রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “এমন একটা অনুশাসন দরকার যাতে প্রকৃত বাংলার লিখনে বানানের সাম্য সর্বত্র রক্ষিত হতে পারে।” আমরাও তাঁর এ পরামর্শে দ্বিরুক্তি করি না। নিজের ঘরে যা হোক একটা কিছু ডাল-ভাতে রোজকার খাবার চলে যায়। কিন্তু ঘরে দু’জন অতিথি এলেই মাছ-মাংস কিছু একটা ভালো ব্যবস্থা করতে হয়। আর ‘বিয়াপার’ কিছু হলেতো কথাই নেই। সেদিন পাচক থেকে শুরু করে রান্নার উপকরণ, পদের রূপ রস গন্ধ স্বাদ সবই মোটের উপর সর্বমান্য হওয়া চাই। হয় না, কিন্তু চেষ্টাটা সেরকমই থাকা চাই। অনুশাসনটা অতিথি সেবার জন্য হওয়া চাই। সে অনুশাসন যদি গায়ে পড়ে খাবারকে রক্ষা করবার দায় নিতে চায় তবে আর হয়েই গেল। অতিথি অভুক্ত থাকাটা আর কেউ আটকাতে পারবে না। ভাষা ব্যবহারের কথাও তাই।

সংস্কৃত স্বতন্ত্র ভাষাই নয়। ব্যাকরণ প্রভুর নির্দেশে সে ওঠ বস করে। বাংলা সচল –স্বতন্ত্র ভাষা, ব্যাকরণকে সে বরং কখনো সখনো কাজে সহায় হবে বলে অনুচরের মতো কাজে লাগায়। লোকে যখন ‘গাড়ি’ চড়ে ‘বাড়ি’ যাবার কথা বলে তখন অনুশাসন তাদের ‘গাড়ী’ করতে ‘বাড়ী’ বয়ে নিয়ে যেতে চাইলেই মুস্কিল। সুজ্যি যখন পূব আকাশে পাড়ি জমায়, পাখি যখন দিনের প্রথম গানটি গেয়ে উঠে তখন ‘সুজ্যি’ নয় ‘সূর্য’; পূব নয় ‘পূর্ব নয় ‘পূর্ব্ব’ ; পাখি নয় ‘পাখী’ এসব মরা কথার কড়া সুর শুনতে কারই বা ভালো লাগে অনুশাসনের বুড়ো ঠাকুরদাকে তখন সবিনয়ে বলা যেতেই পারে , “মহাশয়, বৃদ্ধ হইয়াছেন। আপাততঃ বিশ্রাম গ্রহণ করিলে আপনার এবং আমাদের উভয় পক্ষের স্বাস্থ্যর পক্ষে তাহা অতীব সুখের বিষয় বলিয়া বিবেচিত হইবে।” এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের এক উক্তি মনে পড়ছেঃ “সংস্কৃত সব্দ বাংলায় অনেক আছে, এবং চিরদিনই থাকিবেই—সেখানে সংকৃতের রূপ ও প্রকৃতি আমাদের মানিতেই হইবে—কিন্তু যেখানে বাংলা শব্দ বাংলাই সেখানেও শাসন যদি আমরা টানিয়া আনি, তবে রাস্তা যে পুলিশ আছে ঘরের ব্যবস্থার জন্যেও তাহার গুঁতো ডাকিয়া আনার মতো হয়। সংস্কৃতে কর্ণ লিখিবার সময় মূর্ধণ্য ণ ব্যবহার করিতে আমরা বাধ্য, কিন্তু কান লিখিবার বেলাও যদি সংস্কৃত অভিধানের কানমলা খাইতে হয় তবে এ পীড়ন সহিব কেন?”

রবীন্দ্রনাথের অনুরোধে অনুশাসন তৈরির একটা শুরুয়াত ত্রিশের দশকে করেছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়।শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় তখন উপাচার্য ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় একটা সমিতি তৈরি করেছিল। আর সে সমিতি কেবল অ-তৎসম শব্দগুলোর বানান রীতি নির্দেশিকা স্থির করে একটি পুস্তিকা ১৯৩৬এর মে মাসে বের করেছিল। পরবর্তী জুন মাসের মধ্যে সে পুস্তিকার তৃতীয় সংস্করণও বেরিয়ে গেছিল। কিন্তু হলে হবে কি? বানান পণ্ডিতেরা কখনো নির্বিরোধ কিছু মেনেছেন কি? সে সমিতি কিছু বিকল্প বানান প্রস্তাবও দিয়েছিল। তাতে এতো প্রবল ঝড় উঠেছিল যে বহুদিন এরপর আর কেউ তেমন চেষ্টা করবার মতো উৎসাহ জোটাতে পারেন নি। স্বাধীন বাংলাদেশে কিছু হয়ে থাকলে আমরা তেমন খবর জানি না। সাতের দশকের শেষে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় দ্বিতীয় আরেক বানান সংস্কার সমিতি তৈরি করেছিল। কিন্তু সেটি তার কাজ করেই উঠতে পারেনি। শেষে আশির দশকের মাঝামাঝি পশ্চিম বঙ্গ বাংলা আকাদেমি একটি ‘বানান সংস্কার উপ-সমিতি’ গঠন করে। তার পরামর্শ সবাই মেনে নেয় নি। আনন্দ বাজার পত্রিকাও তাদের নিজেদের মতো করে এক প্রয়াস করেছিল। সে দু’টির মধ্যে বহু ঐক্য থাকলেও অনৈক্যও কম নেই কিছু। রবীন্দ্রনাথের সেই ‘সর্বত্র সাম্য রক্ষা’ করবার মতো অনুশাসন এখনো গড়া যায় নি। কোনোদিন যাবেও না। ‘বিশৃঙ্খলার তত্ব’ যারা বোঝেন তাঁরা এ নিয়ে কোনো গোঁ ধরেনো না আর। এখনকার শিক্ষিত জন মোটা মোটি এই দুই উদ্যোগের দ্বারাই কমবেশি প্রভাবিত । অধিকাংশই আকাদেমির বানান বিধি অনুসরণ করে থাকেন। বিধি মাত্রেই অনুসরণ করা খুবই কঠিন। ‘আইন জানি না’ বললে আদালত শোনে না বটে, তবু বাস্তব এই যে লোকে আইনের বিষয়ে খুবই কম জানে। ধর্মবিধি যাতে লোকে ভুলে না যায় তার জন্য দৈনন্দিন ধর্মগ্রন্থ পাঠের প্রস্তাব প্রায় সব ধর্মেই আছে। যারা সে নির্দেশ অনুসরণ করে তারা যে কী রকম বিধির বাঁধনে ধর্মকেই ফেলে সে আমরা হররোজ দেখে আসছি। সুতরাং বিধি মুখস্থ করবার পরামর্শ আমরা কিছুতেই দেব না। এ হলো আমাদের প্রথম টিপ।

রবীন্দ্রনাথ ছাড়াও সুনীতি চট্টপাধ্যায় থেকে রামেশ্বর শ্ব হয়ে পবিত্র সরকারদের মতো ভারত বিখ্যাত ভাষাবিদদের গেল এক শতাব্দি জোড়া সাধনার একটা লাভ হয়েছে এই যে আমরা একটা কথা সহজ করে বুঝে গেছি—বাংলা এতো মিষ্টি ভাষা কেন সে প্রশ্ন যদি কেউ করে, তার প্রশ্নের জবাবটা জেনে গেছি। মেদ কমালে কাকেই বা মিষ্টি না দেখায়! সংস্কৃত একটি মেদবহুল ভাষা, বাংলা তার উল্টোটা। ছিল না, এরকমটা ছিল না। তারও মেদ প্রচুর ছিল। রীতিমতো ঘাম ঝরিয়ে মেদ কমাতে হয়েছে, আর এখনো সে চেষ্টাতে তার কোনো কার্পণ্য নেই। যিনি এই কথাটি না বুঝবেন, তিনি বাংলা ভাষার মর্ম কথাটিই বুঝবেন না। ‘অদ্য বিকাল তিন ঘটিকায় বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে এক মহতী সভা অনুষ্ঠিত হইবে… ।’ এধরণের বাংলা উনিশ শতকে শিক্ষিত লোকেরাই গড়ে তুলেছিলেন, কিন্তু একুশ শতকে কেবল অশিক্ষিত লোকেই ব্যবহার করে যার ভাষাটির মর্মধর্মের সম্পর্কে কোনো সাধারণ জ্ঞানই নেই।

মেদ ঝরাবার চেষ্টাতে আকাদেমি বাংলা লিপিকে নিয়েও পড়েছিল। আর খুব ভালো কাজ করেছিল। কী অদ্ভূৎ না, আমরা বর্ণমালাতে ঋ-র পর ৯, য-এর পর ব পড়ে এসছি, অথচ ব্যবহার বিশেষ করিনি। কখনো প্রশ্ন করিনি ণ, ঞ, য, ঢ়, ষ এগুলোর উচ্চারণ কী রকম? এগুলো বর্ণমালাতে আছে কী করতে? আর যুক্তাক্ষর ক্ষ, ঙ্গ, হু, হ্ম, ণ্ড, ত্থ, ক্র,ত্রু, রূ, গু, শু-ইত্যাদির কী চেহারা! এগুলোর মানেটা কী? অথচ ঠিক করে না লিখতে পারবার জন্যে মাস্টার মশায়ের কতনা বেতের মার নীরবে সহ্য করে গেছি! হলহেড সাহেব ছাত্রদের জন্য বাংলার প্রথম যে ব্যাকরণ লিখেছিলেন সেটি ছাপবার বেলা বাংলা প্রাচীন পুথির আদর্শে উইলকিনসন সাহেব পঞ্চানন কর্মকারের হাত দিয়ে লিপিগুলো তৈরি করে দিয়েছিলেন।


সেই লিপি এখনো চলছে। রাজা রামমোহন রায় তাঁর গৌড়ীয় ব্যাকরণে সেই তখনই (১৮৩৩) এগুলোর যৌক্তিকতা নিয়ে সংশয় জানিয়ে রেখেছিলেন। সেই লিপি শতাব্দি ধরে এই কিম্ভূতকিমাকার যুক্তাক্ষরগুলো বেমালুম চলে আসছে। কিছু কিছু অবশ্য আমাদের অভ্যাসে এতো দৃঢ়মূল হয়ে গেছে যে চট জলদি স্বভাব পালটানো মুসকিল আছে। যেমনঃ ক্ষ না লিখে /ক্ ষ/, হ্ম না লিখে /হ্ ম/ লেখার সমস্যা আছে। কিন্তু ক্র না লিখে ক-এর নিচে র-ফলা , ত্রু না লিখে ত-এর নিচে র-ফলা এবং তাতে উ-কার কিম্বা , গুরু না লিখে গ এবং র-এর নিচে উ-কার ( ইউনিকোডে ঠিক নতুন প্রস্তাবটা লিখে দেখানো যাচ্ছে না বলে দুঃখিত। ) লিখলে শেখা এবং বোঝা দুটোই কী সহজ হয়ে যায় না? এগুলো আজকাল চলছে। এবং চলবে। [চলবে, ২য় পর্ব]

No comments:

Post a Comment

Thank you very much for your comments.