Tuesday 4 December 2012

কে আমি-১ [৩]


১।
সূর্য ওঠার একটু আগে। আকাশের পূর্ব দিগন্তে ছড়িয়ে আছে লাল আভা। পাখিরা কিচির মিচির শব্দ করে বাড়ি ছেড়ে যার যার কাজে যাচ্ছে। দুই একটা কাক কা কা করে কাউকে ডাকছে কিংবা নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। চারিদিকে দুই এক জন করে লোক জন রাস্তায় বের হতে শুরু করেছে, মাঝে মাঝে দুই একটা রিকশার টুং টাং শোনা যাচ্ছে আর ঝাড়ুদারেরা গত সারা দিনের আবর্জনা ঝাড়ু দিয়ে এক পাশে

জমা করে রাখছে। ওদিকে ময়মনসিংহ রেল স্টেশনের সামনে রোডের বায়ে ঝুপড়ি ঘরের এক চায়ের দোকানের কড়াইতে দুধ জ্বাল হচ্ছিল, পাশের আর একটা চুলায় কেটলিতে জ্বালান চায়ের গন্ধে পুরো স্টেশন এলাকা মৌ মৌ করছিল তখন ময়মনসিংহ ডিআইজি (প্রিজন) এর বাংলো থেকে সোজা এসে দাঁড়াল রিক্সাটা। ঢাকা থেকে বড় বোনের বাসায় বেড়াতে এসেছিল হিরণ আর তার বন্ধু নাসির। এখন ঢাকা ফিরে যাচ্ছে।

পিছনের সিটে বসা হিরণ বলে উঠল ওই চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়াও। শেখ মোহাম্মদ রিকশাটা টেনে আর একটু এগিয়ে চায়ের দোকানের সামনে নারকেল গাছটার নিচে দাঁড় করাল। নাসির হিরণের পায়ের নিচে রাখা ব্যাগটা নামিয়ে দাঁড়াল। প্রায় সাথে সাথে হিরণও নেমে পকেট থেকে ওয়ালে্ট বের করে রিকশা ভাড়া দিয়ে হাতের ঘড়িটা দেখল। মাত্র সাড়ে ছয়টা বাজে। ট্রেন ছাড়বে সাতটায়। এই আধা ঘণ্টার মধ্যে ঝুপড়ি ঘরের চায়ের দোকানে গরুর দুধে বানান চা খেয়ে নেয়া যায়। তখনও মফস্বল শহরে কন্ডেন্সড দুধের চা রপ্ত হয়নি তবে ঢাকা শহরে সবে শুরু হয়েছে। ঢাকায় মানুষ তখনও গরুর দুধের চা এর স্বাদ ভুলে যায়নি।
এখানে থামলি কেন?
দেখছিস না দুধ জ্বাল হচ্ছে, আর চায়ের গন্ধ পাসনি?
ও, বুঝেছি। গলা শুকিয়ে গেছে, তা টিকেট নিয়ে এসে বসলে হত না?
ঘড়ি দেখ, যথেষ্ট সময় আছে, টিকেট পরে নিলেও চলবে।
চল।
ঝুপড়ি ঘরের সামনে একটা আধা ভাঙ্গা মানে এক পাশে দুই পায়া আর এক পাশ ইটের উপরে এমন একটা বেঞ্চ পাতা রয়েছে। ভিতরে আরও কয়েকটা চেয়ার বেঞ্চ মিলে মোটামুটি কয়েকজন বসতে পারে এমন ব্যবস্থা আছে। ওগুলির সামনে আবার টেবিলও আছে। ভিতরে একজন বয়স্ক লোক ঝারা মুছা করে দোকান ঠিক ঠাক করছে। দুই বন্ধু মিলে এই সাত সকালে খোলামেলা বাইরের বেঞ্চেই বসল। সাথে সাথেই খালি গায়ে শুধু একটা লুঙ্গি পরা ১০/১২ বছরের এক ছেলে দেখে মনে হল এখানেই কোথাও রাতে ঘুমিয়ে ছিল, এসে জানতে চাইল
মামা, কি খাইবেন?

তোদের এখানে চা ছাড়া আর কিছু দেখছি না! কি দিবি?
কেন, বিস্কুট আছে, কেক আছে ইকটু বাদে পরটা হইব।
আচ্ছা থাক তোর কেক বিস্কুট বা পরটা কিছুই লাগবে না তুই ভাল করে গরম পানি আর লবণ দিয়ে দুইটা কাপ ধুয়ে চা দে।
চিনি কতটুক দিমু মামা?
দে, দুই চামচ করেই দে।
ইকটু বন আনতাছি।
বলেই ছেলেটা চলে আসছিল।
এই শোন, তোর নাম কি?
ওর কাজের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে উত্তর দিল
বেবাকতে ফইটক্যা কইয়া ডাহে মামা!
ওরা দেখল ওদের কথা মত ছেলেটা কাপ ধুয়ে চা এনে সুন্দর পরিপাটি করে ওরা যে বেঞ্চে বসেছে সেখানে ওদের দুই পাশে কাপ দুইটা নামিয়ে রাখল।
নেন মামা, খাইয়া লন, ঠাণ্ডা হইয়া গেলে মজা পাইবেন না। আপনে গো ঢাহায় এমুন চা পাইবেন না
কে বলল তোকে?
আমি জানি, কত জনে কয়, আমি হুনছি
এই শোন!
আর কিছু লাগব মামা?
গলাটা যতটা সম্ভব নামিয়ে বলল
এই খানে কত দিন যাবত আছিস?
একটু ভেবে
এই এক বছর, কেন মামা?
কত করে পাস?
কত আবার, খাওন দাওন দেয় এইতো, আর কি!
শোন, আর কিছু লাগবে না তবে তুই আমাদের সাথে ঢাকা যাবি?
এদিক ওদিক তাকিয়ে
ঢাহা? আমারে নিবেন?
তুই গেলে নিতাম!

শোনার সাথে সাথে ফইটক্যার চেহারায় একটা আলোর আভা ফুটে উঠল কিন্তু পরক্ষণেই তা মুছে ফেলে একটু ভেবে ফিস ফিস করে বলল
হ যামু! তয় আর কিছু কইয়েন না। আপনেরা গাড়িতে যাইয়া উঠেন আমি সময় মত আইয়া পরুম!

শুনে নাসির আর হিরণ একটু দৃষ্টি বিনিময় করল। দেখা যাক, ও হয়ত যাবে কিন্তু ভিতরে সম্ভবত ওর মালিক আছে বলে জোরে কিছু বলতে পারছে না। ওরা আস্তে আস্তে চা শেষ করে উঠে দাঁড়াল। একটু এগিয়ে ডাকল
এই ফইটক্যা, নে চায়ের দামটা রাখ।
ভিতর থেকেও একই কথা ভেসে এলো,
ওই ফইটক্যা যা চার দাম ল।
ফইটক্যা বেরিয়ে এসে দাঁড়াল
কত’রে?
এক ট্যাহা!
এক টাকার একটা নোট হাতে দিয়ে হিরণ ফইটক্যার মুখের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল। ফইটক্যা আস্তে করে এদিক ওদিক দেখে ঘার কাত করে চোখের ইশারায় ওদের স্টেশনে চলে যেতে বলল। হিরণ আর নাসির রাস্তায় এসে সিগারেট জ্বালিয়ে পায়ে পায়ে সমনের নারকেল গাছের নিচে এসে দাঁড়াল। একটু পরেই ফইটক্যা বেড় হয়ে ওদের দেখে আবার ইশারা করল। সিগারেটে শেষ টান দিয়ে ফেলে দিয়ে পায়ে চেপে আগুন নিভিয়ে ওরা স্টেশনে ঢোকার গেট দিয়ে ঢুকে সোজা টিকেট কাউন্টারে। হিরণ একটু চিন্তা করল টিকেট কয়টা নিবে? নাসির বলল দুইটাই নে ও যদি এসেই পরে তখন দেখা যাবে, দরকার হলে গাড়িতে টিটির কাছে টিকেট করে নিব।
হ্যাঁ তাই ভাল।

পকেট থেকে আবার ওয়ালেট বের করে একশ টাকার একটা নোট কাউন্টারের ওপাশে চোখে ঘুম জড়ান টিকেট বাবুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল-
দুইটা কমলাপুর
কাউন্টার থেকে ভাংতি টাকা আর দুইটা টিকেট নিয়ে সোজা প্ল্যাটফর্ম। ট্রেন প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছে। ঘড়িতে দেখল আর মাত্র ২/৩ মিনিট বাকি। ট্রেনের কাছে গিয়ে নাসির ব্যাগটা নিয়ে একটা বগিতে উঠে সিট খুঁজে বসে পরল। হিরণ ট্রেনের দরজার পাশে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে রইল। একটু পরে। লাস্ট হুইস্যাল দিয়ে দিয়েছে। ইঞ্জিন গিয়ারে দেয়া হয়েছে, ড্রাইভার আস্তে আস্তে থ্রটল টানছে, ট্রেন চলতে শুরু করেছে কিন্তু ফটিকের দেখা নেই। হিরণ গাড়িতে উঠে স্টেশনের দিকে এখনও তাকিয়ে আছে। এখনও নিরাশ হয়নি। এই ছেলে ফাকি দেয়ার ছেলে নয়। ট্রেনের গতি আস্তে আস্তে বাড়ছে। নাহ! ও আসছে না, হয়ত বের হবার সুযোগ পায়নি! এর মধ্যে ট্রেনের চাকা বেশ জোড়েই ঘুরতে শুরু করেছে। ঠিক আছে না আসল। হিরণও ঘুরে সিটের কাছে এগিয়ে যাবার জন্য পা বাড়িয়েছে হটাত প্ল্যাটফর্মের ওপাশে চোখ যেতেই দেখে একটা ছেলে দৌড়ে এগিয়ে আসছে। চিনতে পারল। হিরণ আবার ঘুরে দাঁড়াল। ছেলেটা কাছে আসতেই এক হাত বাড়িয়ে দিল আর ছেলেটা ওর হাত ধরে এক লাফে হাপাঁতে হাঁপাতে ট্রেনে উঠে পরল।
মামা এক্কেবারে সময় মত আইয়া পরছি!
মুখে একটু তৃপ্তির হাসি নিয়ে আবার বলল
কইছিলাম না আপনেরা যান আমি আইতাছি!
আমি ভাবছিলাম তুই বুঝি আর আসবি না।
কি যে কন মামা আমুনা কেন, আমি হেই কবেত্থন সুযুগ খুঁজতাছি! কতজনেরে কইছি আমারে ঢাহা নিয়া যাইবেন? হজ্ঞলেই খালি কইছে আনব কিন্তু কেউ আনে নাই! আমি মনে করছিলাম আফনেও বুঝি হেই রহম!

২।
ট্রেনে উঠে নাসির যেখানে বসেছিল তার পাশে হিরণ বসে একটু চেপে ফইটক্যাকে বলল বস এখানে। ফইটক্যা একটু ইতস্তত করে হিরণের কাছে বসে পরল।
বল দেখি এবার তোর আসল নাম কি?
আসল নাম মাইনে আবার কি? কইলামনা বেবাকতে ফইটক্যা কইয়া ডাহে
আচ্ছা ঠিক আছে, তোর বাড়ি কোথায়?
কইবাম পারতাম না
কেন, তোর মা বাবা কোথায় থাকে?
বাপ মা নাই
একটু জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে নাসির জিজ্ঞেস করল
নাই মানে? কেউ নাই?
নাই মাইনে কুনদিন কেউরে দেহি নাই
বাপের নাম কি?
মামা, কইলামতো কুন দিন দেহি নাই!
ও, তাহলে এই এত বড় হলি কি ভাবে?
এই যে যেমনে দেখলেন এমনে। আইজ এই হানে কাইল ওইহানে, কেউ জাগা দেয় আর কেউ খাউন দেয় কুন দিন কেউর কাছে চাইয়া খাই। যহন কেউ কামের জন্য কয় তহন কাম কইরা দেই। যে কয়দিন কাম করি হেই কয়দিন খাউনের অসুবিধা হয় না
এর আগে কোথায় ছিলি?
ওইযে সামনের যে দোহানডা দেখছুইন, ওইডায় থাকতাম
তা ওখান থেকে এখানে আসলি কেন?
ওরা খাউন দিত না, ট্যাহা দিত, হেই ট্যাহা দিয়া খাউন হইত না।
এই হিরণ বাদ দে, এসব জেনে তুই কি করবি? নিয়ে যাচ্ছিস, চল দেখি কি হয়। এখনও কিছু বুঝতে পারিসনি?
বুঝেছি তবুও একটু আলাপ করলাম
আর আলাপ করতে হবে না এবার থাম।
[চলবে/১-৩]

No comments:

Post a Comment

Thank you very much for your comments.