Sunday 2 December 2012

নক্ষত্রের গোধূলি-৪১ (অধ্যায় ৪)


Tewkesbury 

(পূর্ব প্রকাশের পর)
রেস্টুরেন্টে ফিরে এসে সন্ধ্যায় যথারীতি কাজের জন্যে নিচে নেমে এল । হাতের কাজ গুছিয়ে নেবার আগেই লন্ডন থেকে সেফ এসে কিচেনে ঢুকেই সরাসরি রাশেদ সাহেবের সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল,
কি ব্যাপার বেয়াই, আপনে নাকি চলে যাবেন? 


ছবিঃ টিউকসবুরি এবের (গির্জা) পাশে  একটি প্রাচীন বৃক্ষ।
হ্যাঁ ভাই।
কেন কি হয়েছে, আমরা কি করেছি কেন যাবেন?
না কিছুই হয়নি এমনিই আমার ভালো লাগছে না তাই, অন্য কিছু না।
না আপনাকে তো আমরা যেতে দিব না, কেন যাবেন, সামনে কাজ করবেন, কিচেনে কষ্ট হচ্ছে? তাহলে বলেন কাল থেকেই আপনাকে সামনে পাঠিয়ে দিব।

এমন সময় আনোয়ার এসে হাজির।
কি ব্যাপার কি হয়েছে?
আরে দেখেন না বেয়াই সাহেব থাকবে না চলে যাবে।
কেন, কি ব্যাপার ভাই সাব কি হইছে যাবেন কেন?
না ভাই তেমন কিছু না উনাকে বলেছি আমার ভালো লাগছে না তাই।
আরে না, বললেই হোল আপনাকে ছাড়া হবেনা, কি ভাবে যাবেন?
না ভাই একথা বলবেন না, আমি কাজ কর্ম পারছি না। আমারও কষ্ট হচ্ছে আপনাদেরও অসুবিধা হচ্ছে। আমি চলে গেলে ভালো লোক পাবেন।
না তা হবে না, আমাদের তো ভালো লোকের দরকার নেই, আমাদের চাই আপনাকে।
না ভাই আমি পারছি না।
তা হলে যাবেনই?
জ্বি ভাই।
তা কবে যাবেন?
এইতো সামনের রবিবার পর্যন্ত আছি।
আচ্ছা, এর মধ্যে দেখেন যদি মনের পরিবর্তন করতে পারেন তাহলে এখানেই থাকেন, আসলে আপনাকে আমাদের ভালো লেগেছে তাই ছাড়তে চাইনা।
রাশেদ সাহেব মনে মনে ভাবলেন এই কথাটা আগে থেকে ভাবলেই হত। তাহলে এত গালাগালি কেন? এখন আর সম্ভব নয়, আমি যে ওখানে কথা দিয়েছি ওই লোক অপেক্ষা করবে।

কাজের শেষে উপরে এসে দেখে প্রবীণ বসে সিগারেট টানছে। নেপালি বলে ওরা কেউ যেমন একে কাছে টানে না তেমনি এও ওদের সাথে তেমন মিশতে চায় না। কাজের শেষে কখনও নিচে যায় শুধু টিভি দেখার জন্যে। কিছুক্ষণের জন্যে যায়, খবর দেখেই চলে আসে। আরে ভাইয়া আইয়ে আইয়ে বলিয়ে কিয়া খবর হ্যাঁয়, আমিতো আপনার জন্যে বসে আছি নিচে যাচ্ছি না, ভাইয়া লন্ডন থেকে কি খবর নিয়ে এলো তাই জানার জন্যে বসে আছি। রাশেদ সাহেব সব কিছু খুলে বলল। শুনে প্রবীণ বলল
বাহ! বহুত আচ্ছা হুয়া ঠিক কাম কিয়া। আমিও নোটিশ দিয়েছি থাকব না এখানে।
কেন তুমি কেন থাকবে না?
না আমারও ভালো লাগছে না, জায়গাটা খুবই নীরব। তাছাড়া এখানকার মানুষ গুলিও কেমন যেন কথা বলতে চায় না, আশেপাশে একটা পাবও নেই।
কেন ওইতো পাব, আর ওদিকে রাস্তার মোড়েওতো আছে দুইটা।

আরে না না এগুলি কি পাব? জানেন, একটাতেও ডান্স হয়না। ডান্স না হলে কি পাব হয়? এর চেয়ে একটু বড় শহরে থাকে ওইসব পাবে ডান্স করা যায়। ডান্সের জন্যে বারের পাশে আলাদা ফ্লোর থাকে। এরকম ছোট শহরেও থাকে কোথাও, কিন্তু এখানে নেই। এছাড়া আরও আছে যেখানে টিকেট করে ঢুকতে হয়। আবার কোথাও আছে যেখানে আপনাকে আগে থেকে মেম্বার হতে হবে। মেম্বার কার্ড ছারা কাউকে ঢুকতে দিবে না। আমি সব অফ ডেতে পাবে যাই। ড্রিঙ্ক করি ডান্স করি কিন্তু এখানে একদিনও যাই নাই। না ভুল হোল, একদিন গেছিলাম শুধু তিন পাইন্ট বিয়ার খেয়ে চলে এসেছি। ডান্স নাই কে যায় এখানে? এই পাবতো বুড়োদের জন্যে। বড় বড় পাবে দেখবেন গেটে দুই তিন জন বাউন্সার থাকে। কেউ যদি বেশি গিলে মাতলামি করে তখন বাউন্সারেরা ধরে বের করে দেয়।
মাতলামি করে কেউ?
কি যে বলেন! মাতলামি মানে যা করে না দেখলে বুঝবেন না। টানাটানি মারামারি থেকে শুরু করে ভাঙ্গাচুরা সবই হয়। তখন বাউন্সারে কুলায় না রীতিমত পুলিশ ডাকতে হয়। আপনিও চলে যাচ্ছেন আমিও চলে যাচ্ছি নয়তো আপনাকে একদিন অক্সফোর্ড নিয়ে গিয়ে দেখিয়ে আনতাম তখন বুঝতেন।
হ্যাঁ এতক্ষণে বুঝলাম কেন থাকবে না, তা কাজ পাবে?
আরে কি বলেন ভাইয়া, কত কাজ! জানেন এদেশে এই রকম পনের থেকে বিশ হাজার রেস্টুরেন্ট আছে। তার মধ্যে থেকে লন্ডন সিটিতে অথবা আশেপাশে যে কোন একটায় কাজ পেয়ে যাব। হয়তো দুই একদিন বসে থাকতে হবে। আমার জন্যে ভাববেন না। আমি কোথাও স্থির হতে পারি না, কোথাও দুই তিন মাসের বেশি থাকতে পারি না। তবে ভাইয়া আমি যেখানেই যাই আপনার কথা আমার মনে থাকবে। আপনিতো ফোন নেন নাই তাহলে নম্বর নিয়ে আপনার সাথে যোগাযোগ রাখতাম। আচ্ছা আচ্ছা এক কাজ করেন আমার নম্বর রাখেন যোগাযোগ রাখবেন।
হ্যাঁ প্রবীণ তোমার কথাও আমার মনে থাকবে অন্তত যতদিন এদেশে থাকবো তত দিনতো মনে থাকবেই।
প্রবীণ উঠে এসে বলল দেন আপনার নোট বইটা দেন।
নোট বই মানে?
মানে ঐ যে আপনি যে কাল রঙের ছোট্ট বই দেখে ফোন করেন যার মধ্যে সব কিছু লেখা। আমি দেখেছি, ওটা দেন।
পকেট থেকে ঠিকানা আর ফোন নম্বরের ছোট্ট বইটা এগিয়ে দিল। প্রবীণ তার নিজের ফোন নম্বর সহ নেপালের কাঠমুন্ডুর বাড়ির ঠিকানা ফোন নম্বর সব লিখে বইটা ফিরিয়ে দিয়ে বলল

আমি আশা করি অতি অল্প দিনেই আপনার সব সমস্যার সমাধান হলে দেশে ফিরে যাবেন। সেখান থেকে একবার ভাবিজীকে সাথে নিয়ে নেপালে আমার বাড়ি যাবেন। আশা করি তত দিনে আমিও দেশে ফিরে যাব। আবার দেখা হবে আমাদের, সবারই ভালো লাগবে। আপনাকে কাঠমুন্ডুর বিখ্যাত তাতোপানি নিয়ে যাব সেখানে মাটির নীচে থেকে গরম পানি বের হয়, সেখান থেকে চিন দেখা যায়, দেখবেন। এখানে যে যন্ত্রণা সহ্য করছেন দেশে ফিরে ভাবিজীকে সাথে নিয়ে কিছুদিন দূরে কোথাও বেড়ালে সেটা ভুলে যাবেন। আপনার কাল রাত্রি শেষ হবে আবার নতুন করে সানরাইজ হবে আপনি আবার নতুন করে সবকিছু শুরু করবেন, আমার বাবা যেমন করেছিলো। এখান থেকে ফিরে আমার মাকে নিয়ে আপনাদের কক্সবাজার গিয়েছিল। আমরা তখন ছোট, তবুও আমার পরিষ্কার মনে আছে, আমরা দাদার কাছে ছিলাম।

রাশেদ সাহেব অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। আস্তে আস্তে তার অজান্তে দুচোখ টলমল করে উঠল। এইটুকু ছেলে বলে কি? তার কণ্ঠ চেপে আসল। মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছে না। মনি দেখ, এইটুক ছেলে বলে কি? মনে মনে মনিকে ডেকে এনে দেখিয়ে বলল দেখ এই ছেলে আমাকে কিভাবে সান্ত্বনা দিচ্ছে, আশার আলো দেখাচ্ছে, কি সব কথা বলছে! তার চেতনার মনি তার সাধনার মনি তার হৃদয়ের মনি। যে মনি বুক ভরা প্রশান্ত মহাসাগরের সমান নিস্তব্ধ ভালোবাসা নিয়ে তার পথ চেয়ে আছে। দেখ মনি এই এতটুকু ছেলে যখন বলছে তখন নিশ্চয়ই আমাদের একদিন এই অন্ধকার শেষ হয়ে আলোয় ভরা দিন আসবে। আমাদের সব কিছু শেষ হয়ে যায়নি।
কিছু মনে করবেন না, আপকা আসু দেখকে মালুম হোতায় আপ ভাবিজীকো বহত পিয়ার করতায়।
চোখের পানি যে সেই জন্যে তা কি করে বুঝলে?
কেন বুঝব না? যখনই ভাবিজীর কথা বলেছি তখনই আপনার চোখে পানি চলে এসেছে। রাশেদ সাহেব একটু লজ্জা পেয়ে ঘটনা আড়াল করার জন্যে বললেন
আরে না চোখে পানি এসেছে তোমার জ্ঞানের কথা ভেবে। দেখ প্রবীণ তুমি আমার সন্তানের চেয়েও বয়সে ছোট হবে তোমার মত এতটুকু ছেলের মুখে আমাকে সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা শুনে আমি অবাক হয়েছি। তোমার প্রতি আমার মন ভীষণ রকম আবেগময় হয়েছে তাই চোখে পানি এসেছে। অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত তোমার দৃষ্টি, তুমি অনেক বড় হবে, তুমি মানুষের ভালোবাসা পাবে তোমার ঈশ্বর তোমাকে অনেক দূর নিয়ে যাবেন।
আপনি এতো সুন্দর করে কথা বলেন এই জন্যে আপনাকে আমার খুব ভালো লাগে, আপনার এই চাওয়ার জন্যে অনেক ধন্যবাদ। আচ্ছা আমি যদি আপনার সাথে একটু কথা বলি আপনি কি বিরক্ত হবেন?
আরে না না কি যে বল! বল কি বলবে।

না তেমন কিছু না এই প্রেজেন্ট ওয়ার্ল্ড সিচুএশন নিয়ে একটু আলাপ করতাম।
হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই।
এই যে দেখেন আমাদের দেশে বলেন আর আপনাদের দেশে বলেন অর্থাৎ সারা পৃথিবীতেই আজকাল সবাই কেমন আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পরেছে কেউ নিজের কথা ছাড়া অন্যের কথা ভাবে না।
তুমি যে আজকালের কথা বলছ, তুমি কি আগের দিন দেখেছ? তুমি তার সাথে তুলনা করছ কি ভাবে?
না দেখিনি, তবে এটা তো অনুমান করতে পারি যে আগে এরকম ছিল না। আমি রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র পড়েছি, কৃষন চন্দ্র পড়েছি। আমাদের সাহিত্য পড়েছি। বাবা মার কাছে শুনেছি, দাদার কাছে শুনেছি সেই যুগ আর এই যুগের ব্যবধান। সাহিত্য তো সবসময় সেই সময়ের বর্তমানের প্রেক্ষাপটে রচিত হয় কাজেই এই ডিফারেন্স থেকেই অনুমান করা যায়। তাই না?
হ্যাঁ তা যায় কিন্তু তুমি যাদের কথা বলছ তারা কেউ বাঙ্গালি, কেউ পাঞ্জাবি, কেউ তামিল। তুমি কিভাবে পড়েছ?
কেন হিন্দি, নেপালি।
ও আচ্ছা।

হ্যাঁ যা বলছিলাম, আজকাল প্রতিযোগিতা এতো বেশি যে কেও কারো দিকে তাকাবার সুযোগ পায়না। জনসংখ্যা বেশি হয়েছে, সেই সাথে চাহিদা বেশি হয়েছে। চাহিদার ধরন, মাত্রা, প্রকার সবই বেশি হয়েছে। এমনকি বাবা মাও তার নিজের সন্তানের চাহিদা বুঝতে পারে না। যেমন আজকাল বাবা মা তাদের সন্তানকে নিজের কাছে রাখতে পারছে না। সে শিক্ষার জন্যেই হোক বা রোজগারের জন্যেই হোক, তাকে বিদেশে নয়তো দূরে কোথাও পাঠাতে হচ্ছে। সেখানে যাবার পর সে জায়গায় থাকতে থাকতে সেখানকার আবহাওয়া পরিবেশ, সে দেশের রীতিনীতি, সমাজ ব্যবস্থা ইত্যাদি বিভিন্ন কিছুর প্রেক্ষাপটে তার রুচির পরিবর্তন হচ্ছে, দৃষ্টি ভঙ্গির পরিবর্তন হচ্ছে, ছেলের চাওয়া পাওয়ার ধরন বদলে যাচ্ছে, বিরাট ব্যবধান তৈরি হচ্ছে যা তার বাবা মা কিছু জানতে এমনকি কিছু বুঝতেও পারছে না। এই ছেলে যখন তার মায়ের কাছে ফিরে যাবে তখন মা তার চেনা ছেলেকে ফেরত পায়না। যা পায় তা হোল এক নতুন ছেলে। কয়েক বছর আগে যে ছেলে মায়ের চেনা ছিল সে এখন অচেনা মনে হয়। এতো গেল মা আর বাবা। তারাতো একে জন্ম দিয়েছে কাজেই তারা মানিয়ে নেবার চেষ্টা করবে। কিন্তু বাইরের মানুষ? তারা এটা কেন মেনে নিবে? তৈরি হবে দ্বন্দ্ব, সংঘাত আর প্রতিযোগিতা। শুধু এই না, আরও অনেক কারণ আছে এরকম। একটু দেখেন চারিদিকে, কারণগুলি খুঁজে পাবেন। এইযে দেখেন আমি যখন নেপালে ছিলাম তখন কিন্তু আমি ড্রিঙ্ক করতাম না। কিন্তু এখন সপ্তাহে অন্তত একদিন ড্রিঙ্ক করতেই হয়। পাবে যাই, ড্রিঙ্ক করি নাচি। ভালো লাগে, বাবা মার কথা মনে হয়না, দেশের কথা মনে হয়না বেশ ভালো আছি। যখন দেশে যাব একদিন ড্রিঙ্ক করে এলেই মা কি সেটা মেনে নিবে? কিংবা ধরেন বিয়ে হলে আমাদের দেশের আলো বাতাসে বেড়ে ওঠা বৌ কি সেটা মানতে পারবে? অথচ দেখেন এখানে স্বামী স্ত্রী একসাথে পাবে যাচ্ছে, ড্রিঙ্ক করছে, নাচছে তারপর ট্যাক্সি করে বাড়ি ফিরছে। আবার মদের ঘোড়ে ঝগড়াঝাঁটি করে দুই জনে দুই দিকে চলে যাচ্ছে।
না আমাদের দেশের কোন মেয়ে এটা মেনে নিতে পারবে না।

এইতো অবস্থা তখন আমি কি করবো? এই যে দেখেন আপনি আপনার বাবা মাকে যা দিচ্ছিলেন তাতে আপনি সুখী ছিলেন। ভাবছিলেন আপনার সামর্থ্য অনুযায়ী কর্তব্য ঠিক ভাবে পালন করে যাচ্ছেন কিন্তু তারা আপনার কাছে যেভাবে যা চাচ্ছিলেন তা তারা পাননি বলেই সংঘাতের সৃষ্টি এবং আপনার বিপদের দিনে তারা আপনাকে সাহায্য করেনি। এই যে আপনি আপনার স্ত্রী সন্তানদের ছেড়ে এখানে থাকছেন এজন্যে কি তারা কেও দায়ী নয় ভেবেছেন? এতে যে আপনার কত ক্ষতি হচ্ছে তা কি তারা জানে না? আপনার সন্তানদের মধ্যে এর প্রতিক্রিয়া কিভাবে পরবে তা কি লক্ষ করেছেন? আজকাল বাবা কাছে থেকেও সন্তান মানুষ করতে পারে না, সেখানে আপনি কি ভাবে আশা করেন আপনার সন্তানেরা আপনার অবর্তমানে ঠিক ভাবে মানুষ হবে? আমি অবশ্য জানি না আপনি কোথায় কি ভাবে কি করেছেন বা এখানে কেন এসেছেন এটা আমার অনুমান থেকে বলছি।

No comments:

Post a Comment

Thank you very much for your comments.