Sunday 2 December 2012

যারা বানান ভুল করে তাদের জন্য দুটি কথা-২[২]



পূর্ব সূত্রঃ হুজুগের মত সহজে বিদেয় নেবে না। এরকম মেদ ঝরাবার কাজে নিজেকে ব্যস্ত করলে বাংলা ভাষা ও বানান এমনি এমনি শুদ্ধ আর মিষ্টি হতে থাকবে—এ হলো আমাদের দ্বিতীয় টিপ।
শুদ্ধবাদিরা অবশ্য তাতে প্রচন্ড রাগ করবেন, তাদের সে রাগে গুরুত্ব না দিলেই হলো। শুদ্ধবাদিরা অবশ্যি পণ্ডিত মানুষ। কিন্তু পণ্ডিতেরা আর প্রগতি আনলেন কবে? তারাতো কেবল ঐতিহ্য আর পরম্পরা বিপন্ন হবার আতংকে কাল কাটিয়ে গেলেন। ভাগ্যিস, প্রমথ চৌধুরী রবীন্দ্রনাথের মতো বলবানকে সঙ্গে পেয়েছিলেন! নইলে সাধু বাংলাকে বিদায় জানাবার যেরকম প্রয়াস তিনি করেছিলেন, সাধুরা তাঁর প্রাণ বিপন্ন করে তুলতেন। এখনো অসমের বিদ্যালয়গুলো বাংলা প্রশ্নপত্রে সেই সাধুরা অক্ষয় গৌরবে বিরাজ করেন। কাল যত ‘কলি’ হয় তাঁরা ততই কল্কি আসার অপেক্ষাতে সতর্ক আর বিনিদ্র রজনী যাপন করেন! আমরা না সাধু পুরুষ, না শুদ্ধ মানুষ। শুদ্ধ বানান লেখার কথা বলবার মানে যদি এই হয় যে পুরোণো মেদ বহুল ভাষাকে রক্ষা করা, আমরা তার মধ্যে নেই। বরং বলব, চলুন, আমরা ভুল করি। বেশ করি। ভালো করি। চলুন, মেদ আমরা মেদ ঝরাই। ভাষাকে সহজ করি, সরল করি। যত আবর্জনা, সব বিদেয় করি।

আমাদের জটিলতা কোথায় হয়? কোথায় আমরা দিশা হারাই। সব বানানে আমরা জট পাকাই না। ‘আম’ লিখতে গেলে খুব অন্যমনস্ক না হলে কেউ আমরা ‘জাম’ লিখি না। আমাদের সমস্যা হলো ‘সমষ্যা’লিখব কিনা তাই নিয়ে। ‘ভুল’ লিখতে গিয়ে ‘ভূল’ লিখে ফেলি। “বই পরা শেস করে জামা পড়ে ঘড় থেকে বেড়িয়ে বাজার হয়ে এক বন্ধুর বারি দিব্যি বেরিয়ে আশি। টেড়ও পাই না কোথাও একটা বর গণ্ডগোল হয়ে গেছে।” সমোচ্চারিত বা প্রায় সমোচ্চারিত ধ্বনি হলেই সব কেমন তালগোল পাকিয়ে যায়। এছাড়াও জট পাকায় যদি শব্দে যুক্তাক্ষর থাকে। আর যুক্তাক্ষরগুলোই জোর গলায় মেদ ঝরানোর সাক্ষর যোগায়। সপ্ত=সাত, ভক্ত=ভাত হলো বলেই না ভাষা বাংলা জন্মালো। যেখানে তা হলো না, সেখানেও বানানে মূলের বর্ণগুলো অক্ষত থেকেও উচ্চারণে রইল না। বানানে ‘লক্ষণ’ থাকলেও উচ্চারণ আমরা ‘লোক্খন’ করি। আর শেষের অ-স্বরটির ব্যবহার বাংলাতে প্রায় নেই বললেই চলে। ‘বিশ্ব’কে উচ্চারণে আমরা ‘বিশশ’ করে ফেলি। ‘বিস্ময়’কে করি ‘বিশশয়’। এরকম গণ্ডগোলের জন্যে ‘সান্ত্বনা’ লিখতে গিয়ে প্রায়ই আমরা ‘সান্তনা’ বা ‘শান্তনা’ লিখে ফেলি। এগুলো মূলত সংস্কৃত থেকে হুবহু বাংলাতে আসা তৎসম শব্দ নিয়ে হওয়া সমস্যা। এ সমস্যা আছে আর থাকবেও। কারণ, একেতো সংস্কৃত ব্যাকরণ নির্দেশিত ভাষা। দ্বিতীয়তঃ তার উপর একা বাঙালির কোনো অধিকার নেই। সেগুলোতে আমাদের ব্যাকরণের মার সহ্য করতেই হবে। তথাপি, যেগুলো বাংলাতে বহুল ব্যবহৃত হচ্ছে সেগুলোতে রবীন্দ্রনাথের পরেও অনেকেই কাঁচি চালাবার পরামর্শ দিচ্ছেন। যেমন আজকালঃ

১)তদ্ভবতেতো বটেই, তৎসমতেও রেফের পর ব্যঞ্জন বর্ণের দ্বিত্ব হয় না। অর্থাৎ ‘পূর্ব্ব, অর্চ্চনা, কর্ত্তা, কর্ম্ম, ধর্ম্ম ; ইত্যাদি লেখার দায় নেই। সোজা ‘পূর্ব,অর্চনা, কর্তা ‘ ইত্যাদি লিখলেই হল।

২) (ক) যুক্তাক্ষরে নাসিক্য ধ্বনির ব্যবহারে সংস্কৃত এক মজার নিয়ম ছিল। পরের ধ্বনিটি যে বর্গের আগের নাসিক্য ধ্বনিটি সাধারণত সেই বর্গের হতো। যেমনঃ গঙ্গা, পঞ্চম, কণ্টক, সম্মন্ধ ইত্যাদি। বাংলাতেও প্রায় তাই আছে।

(খ) কিন্তু ‘ঙ’ আর ‘ম’ এর জায়গাতে হামলা চালিয়ে ‘ং’ তার সাম্রাজ্যের অনেকটাই বিস্তার ঘটিয়েছে। এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদিদের মত এখন অব্দি থামবার নাম করছে না। বিদ্যাসাগর মশাই লিখতেন ‘বাঙ্গালা’ । আমরা তাকে কত সহজ আর মিষ্টি করে ‘বাংলা’ করে ফেলেছি। কার সাহস, আমাদের ব্যাকরণে ভুল দেখায়? সন্ধিতে ‘ম’কারের জায়গাতে ‘ং’এর বিকল্প বিধান সংস্কৃতেই ছিল। যেমনঃ ভয়ংকর, সংগম বানানগুলো চলত। বিশ্ববিদ্যালয় তার অনুসরণে অলংকার, সংগীত, সংঘ লিখবার বিধান অনেক আগেই দিয়েছিল। আর এতো দিনে আমরা অভ্যস্তও হয়ে গেছি।

(গ) সন্ধি ছাড়া অন্যত্র তৎসম শব্দের বানানে ‘ঙ’বাদ দেবার বিধান কেউ দেননি। কিন্তু আমাদের মতো ব্যাকরণ না মানা অল্প-শিক্ষিতেরা এতো দুর্দণ্ড প্রতাপে ‘ং’র ব্যবহার চালিয়ে অংক,সংগ , গংগা, বাংলা, মংগল, লিখে গেলাম যে প্রবোধচন্দ্র সেনের মতো কেউ কেউ আমাদের পক্ষে দাঁড়িয়ে বললেন, ভালোই হলো ‘এতে ভ্রান্তি কম হবে এবং যুক্তাক্ষরের ব্যবহারও কিছু কম হবে।’ এরকমই হয়, সাধারণে আগে ভাষা পাল্টায়, পণ্ডিতেরা পরে তা নিয়ে মত দাঁড় করান।

(ঘ) কিছু বানানে অবশ্যি আমরা এতোতাই অব্যস্ত যে ‘ং’কে সেখানে নাক গলাতে দিতে রুচিতে বাঁধে। অম্বর,কম্বল,ডিম্ব, সম্বল—এগুলো এখনো পাল্টায়নি।

(ঙ) আবার ‘ং’ –এর সংগে স্বর যুক্ত করতে না পারার একটা সমস্যা আছে । সেখানে ‘ঙ’ রেখে দেয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। যেমনঃ ‘বাংলা’—কিন্তু ‘বাঙালি’ ।‘বাঙালি’র মতো কিছু শব্দে ‘ঙ্গ’-এর ‘গ’ ধ্বনিটি একেবারেই খসে পড়াটাও লক্ষ্য করবার মতো।

৩. সংগে স্বরধ্বনি নিয়ে তৈরি যুক্তাক্ষরগুলোকে আমরা প্রায়ই যুক্তাক্ষর বলি না। বোধহয় পদান্ত স্বরকে ঝেড়ে ফেলবার আমাদের এক অন্তর্লীন প্রবণতা আছে, তাই। কিন্তু ,’ তুমি গাছ থেকে নাম।’ আর ‘তুই গাছ তেকে নাম।’–এই বাক্যে ‘নাম’ শব্দের উচ্চারণ আর অর্থ কোনতাই এক নয়। শেষেরটিতে ম-এর পরে পদান্ত অ-টি নেই। সে আমরা অভ্যাস বশে বুঝে যাই । কোথাও বুঝবার সমস্যা হলে, বিশেষ করে যদি স্বল্প পরিচিত বিদেশী শব্দ হয় একটা হস (্ ) চিহ্ন দিয়ে দেওয়া হয়। যেমনঃ তখ্ ত, জেম্ স বণ্ড্ ইত্যাদি । অন্যত্র এর ব্যবহার জট পাকায় বৈ কমায় না। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় অ-সংস্কৃত শব্দে শুধু হস (্) বাদ দেবার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু লোকে তৎসমতেও তা আজকাল ব্যবহার করছে না। আকাদেমি বলে দিয়েছেন, “শব্দান্তে হস্ চিহ্ন দেওয়ার প্রয়োজন নেই। ‘বিদ্বান্’ না লিখে ‘বিদ্বান’ লেখাই সংগত।”

৪. ব্যঞ্জনের সাথে যুক্ত ‘ই,ঈ,উ,ঊ’কারের ব্যবহার অত্যন্ত পীড়াদায়ক। কোথায় যে কোনটা বসবে তা সারা জীবনেও স্থির করা সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।

(ক) আকাদেমি বলছেন, তদ্ভব শব্দে প্রায় সর্বত্র দীর্ঘ ধ্বনি দুটোকে (ঈ,ঊ) বাদ দেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। পাখি, বাড়ি, শাড়ি, উনিশ, উর্বর, কুমির, শ্রেণি চলবে। পাখী , বাড়ী, ঊনিশ ইত্যাদি না লিখলেও চলবে।

(খ) দেশ জাতি লিঙ্গ বোঝাতে ‘ঈ’ –কার লাগবেই এমন যুক্তির পক্ষেও আকাদেমি কোনো সমর্থণ পাননি। তারা তাই জাপানি,বাঙালি, ইংরাজি, আরবি লিখবার পরামর্শ দিয়েছেন।

(গ) উপযোগিতা, প্রতিযোগিতা, স্বামীস্ত্রী ইত্যাদি বানান লিখতে গিয়ে প্রায়ই আমাদের এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়। মূল শব্দগুলো তৎসম আর সেগুলোর শেষে ‘ঈ’-কার যুক্ত হয় । উপযোগী, প্রতিযোগী, স্বামী ইত্যাদি। কিন্তু প্রত্যয়যুক্ত হলেই বা অন্যে শব্দের সাথে সন্ধি হলেই ‘ই’কার এসে জুড়ে বসে। রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত অনেকেই এ নিয়ম পাল্টাবার কথা ভাবেন নি। আমরা প্রায়ই উপযোগীতা, প্রতিযোগীতা, মনস্বীতা মন্ত্রীসভা লিখবার মতো ভুল করেই বসি। এগুলোর উৎপাত খুব কম নয়। বাংলাতে এমন শব্দ সংখ্যা প্রচুর ।মূল শব্দের ঈ-কারতো পাল্টানো যাবে না। তাই আকাদেমির প্রস্তাব , “ সংস্কৃত –ইন প্রত্যয়যুক্ত পদের শেষে যে দীর্ঘ ‘ঈ’-কার হয় তা ভিন্ন প্রত্যয়যোগে বা সমাসনির্মাণেও হ্রস্ব –কার হবে না, দীর্ঘ ঈ-কারই থাকবে।” এতে শব্দগুলোর বদ্ধ আর স্বতন্ত্র রূপের মধ্যে বৈষাদৃশ্য থাকবে না, জটিলতাও কমবে। সুতরাং নির্বিকার প্রতিযোগীতা, মন্ত্রীসভা, স্বামীস্ত্রী লেখা যাবে।

(ঘ) অর্থ যেখানে পালটে যাবে সেখানে সরলীকরণের কোনো নীতিই খাটবে না কূল আর কুল-কে এক করা যাবে না। তেমনি আর কী—এর মধ্যে তালগোল পাকানো যাবে না।

(ঙ) অভ্যাসে আটকালেও কখনো কখনো চাইলেও দীর্ঘ স্বরকে বাদ দেয়া যায় না ‘জিবন’ লিখলে সত্যি ‘জীবন’ নিয়ে টানাটানি পড়ে যেতে পারে।

৫. খুবই নীরবে, বেশ ভালো রকমই মুস্কিলে ফেলে ‘অ’-কার ‘ও’কারের ব্যবহার। “ছেলেটি বড় ভাল, মেয়েটি কী কালগো!” এরকম কথা বললে নারীবাদিরা রাগ করতে পারে , বানানবাদিরা রাগ করবার খুব একটা উদাহরণ নেই। কিন্তু করা উচিত। আমার অভিমত তোমার মত নয়—এবাক্যটার অর্থ কী দাঁড়ালো? এরকম গণ্ডগোল এড়াবার জন্যে শব্দগুলোর যেটির উচ্চারণে পদান্ত ‘অ’-কার আছে তার শেষে স্পষ্ট করেই ‘ও’কার দিয়ে দেওয়াই ভালো। সে অনুযায়ী ছেলেটি ভালো (ভাল –কপাল), মেয়েটি কালো (কাল –সময়), তোমার মতো (মত –অভিমত, চিন্তাধারা) করে ফেলাই সমীচীন। বানান পাল্টালে অর্থ পাল্টে যায় এরকম আর কিছু শব্দ বিশেষ করেই মনে রাখতে হয়।

৬. বাংলা তদ্ভব উচ্চারণে য-এর ব্যবহার নেই। বানানেও প্রায় হয়ই না। এই কথাতা স্পষ্ট জেনে নেওয়া ভালো।

(ক) সংস্কৃত ‘যা’-এর মতো ধাতু থেকে উৎপন্ন কিছু শব্দ আর যখন, যেমন এর মতো অব্যয় ক’টিতেই ‘য’ তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। তা নইলে আমরা যুগল-কে জোড়, যাতৃ-কে জা, কার্য্য-কে কাজ বানিয়ে ‘জ’-কার নিয়ে এসে সহজ করে রেখেছি।

(খ) খুব বাধ্য না হলে ‘য’-ফলার ব্যবহারও অক্ষত রাখিনি। বিশেষ করে পদান্ত ‘য’-এর পর আবার য-ফলাতো আমাদের কাছে অসহ্য মনে হয়েছে। তাই আজকাল আমরা নির্বিকার কার্য্যও আর লিখিনা। কার্য, সূর্য, ভট্টাচার্য ইত্যাদি লিখে চলেছি।

৭. এরকম বাংলাতে ‘ণ’ একটি উপদ্রবী ধ্বনি। এর উচ্চারণ কেউ জানে না। অন্য মূর্ধণ্য ধ্বনির সঙ্গেই এর যৎ সামান্য কিছু উচ্চারণ বেরোয়। ন-এর স্বতন্ত্র উচ্চারণ আছে।

(ক) সুতরাং সর্বত্র ‘ন’-এর ব্যবহারে কাজ চলে যায়। রাণী না লিখে রানি লিখলে তার আভিজাত্য মোটেও খাটো হয়ে যায় না।

(খ) অনেকেতো ঘুণ্টি, ঠাণ্ডা, লণ্ঠন না লিখে ঘুন্টি,ঠান্ডা, লন্ঠন লিখবার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। আমরাও তাতে আপত্তি করবার কারণ দেখি না।

(গ) ভারতীয় আর্য ভাষাতে মূর্ধণ্য ধ্বনিগুলো অনেক পরের সংযোজন ।সম্ভবতঃ দ্রাবিড় ভাষার প্রভাবে। কিন্তু তার পর এতো জাঁকিয়ে বসেছে যে সবসময়ই এক স্বতন্ত্র মর্যাদার আব্দার নিয়ে এসে হাজির হয়। বাংলাতেও বিশুদ্ধ মূর্ধণ্য ধ্বনি নেই। এগুলো উত্তর দন্ত মূলীয়। সে যাই হোক মূর্ধণ্য ধ্বনির যোগে তৈরি প্রচুর তৎসম শব্দ বাংলাতে প্রচলিত আছে। সুতরাং এর অত্যাচার সহ্য করা ছাড়া উপায় নেই।

(অ) এ নিয়ে একটি সহজ নিয়ম অবশ্য বহুল প্রচলিত আছে আর আমরা সবাই জানিও। তা এই যে, পরে অন্য মূর্ধণ্য বর্ণ থাকলে বা আগে ‘ঋ,র , ষ ‘ থাকলে নাসিক্য ধ্বনিটি ‘ণ’ হয়। যেমনঃ ঋণ, পরিমাণ,তৃণ, কণ্টক ইত্যাদি। বাদ বাকি নিয়মগুলো বেশ জটিল। একটু কষ্ট করে মনে রাখলেই মান বাঁচানো সহজ হবে।

(আ) পর-,পার-, উত্তর-,চান্দ্র-,নার-,নারা- এবং রাম- শব্দের পরের ‘অয়ন’ শব্দে ‘ন’—‘ণ’ হয়ে যায়। যেমনঃ রামায়ণ, নারায়ণ ইত্যাদি। অন্যত্র যা ছিল তাই থাকে। যেমনঃ রবীন্দ্রায়ন, মূল্যায়ন।

(ই) সে রকমই প্র, পূর্ব, অপর পুরসর্গের পর ‘অহ্ন’ শব্দের ‘ন’ –‘ণ’ হবে। প্রাহ্ণ, পূর্বাহ্ণ, অপরাহ্ণ। কিন্তু মধ্যাহ্ন, সায়াহ্ন। সময় বোঝাবার এই শব্দগুলোর ব্যবহার আজকাল অতি অল্প,তাই রক্ষে।

(ঈ) ত্রিনয়ন, দুর্নাম, এরকম কিছু সমাসবদ্ধ পদের পূর্ব পদে ‘ঋ,র,ষ’ থাকলেও উত্তর পদে ‘ণ’ হবে না।

৮. শিস দেয়াটা খুব ভালো গুণ নয়। মেয়েদের সামনেতো কস্মিন কালেও নয়। এই শিস ধ্বনি কেবল মেয়েদেরই উত্যক্ত করে না, ভাষাকেও বড় বিপাকে ফেলে। বাংলাতে এক ‘শ’ছাড়া আর কারো কোনো স্বতন্ত্র উচ্চারন নেই। ‘সার’ আর ‘ষাঢ়’ না লিখে ‘শার’ লিখলে উচ্চারণে কোনো গোল হবে না। দন্ত্য ধ্বনির সাথে ‘স’ আর মূর্ধণ্য ধ্বনির সাথে ‘ষ’এর কিছু উচ্চারণ শুধু কতকগুলো যুক্তাক্ষরে আছে। সেগুলোও বেশির ভাগ তৎসম। যেমনঃ স্মৃতি ,কষ্ট, ইত্যাদি। তার জন্যে অন্যত্র যেমনটি হয়েছে এখানেও সর্বত্র ‘শ’এর ব্যবহার করলে কাজ সহজ হয়ে পড়ত। কিন্তু অভ্যাস বলেও একটা কথা আছে। যে শব্দগুলো বহুল প্রচলিত তার বানান হঠাৎ পাল্টে ফেললে নিজেক কেমন বোকা বোকা মনে হয়। তাই ‘স,ষ’ বহাল তবিয়তে রাজ করতে পারছে।

(ক) মূলতঃ শিস ধ্বনি তিনটি থাকা শব্দের বানানেই তৎসম শব্দের রীতি দু’একটি ছোটখাটো ব্যতক্রম বাদ দিলে ( মনুষ্য-মিনসে, শ্রদ্ধা-সাধ ) তদ্ভতেও থেকে গেছে। যেমনঃ মশক—মশা, পিতুঃস্বসা—পিসি, শস্য—শাঁস, সর্ষপ—সরিষা ইত্যাদি।

(খ) তা হলে সমস্যা রইল বিদেশি শব্দে। সেগুলোতে সাধারণত মূলের উচ্চারণ অনুসরণ করা হয়। আর তাই পুলিশ, পেনসিল, শয়তান, পোশাক, জিনিস, এরকম বানানই প্রচলিত। এসবে মোটের উপর আমরা অভ্যস্ত।

(গ) কিন্তু বিদেশি শব্দগুলোর মূলের উচ্চারণ আমরা জানব কী করে? বিদেশি ভাষাতে যেগুলো তেমন শোনা যায় না, অথচ বাংলাতে বহুল প্রচলিত সেগুলো বাংলার স্বাভাবিক প্রবণতা অনুসারে ‘শ’ উচ্চারিত হয়। এবং বানানে একটা বিভ্রান্তি থেকেই যায়। তাই সহর, সয়তান, পুলিস বানানগুলোকেও দিব্বি ভিসা বাড়িয়ে ঠাই দিতে হয়। অর্থাৎ অভ্যাসই এই ক্ষেত্রে বিধিবদ্ধ নিয়ম।

(ঘ) আকাদেমি এ জটিলতার কথাও মনে রেখেছেন। এক সহজ নিয়মে তাঁর একেও সরল করে দিয়েছেন। ইঊরোপিয় শব্দের সাথে আমাদের যোগ সমকালীন, এ কথা মনে রেখে বোধহয় তাঁরা উচ্চারণ অনুযায়ী বানান তথা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রহণ করা প্রতিবর্ণীকরণ নীতি মেনে নিয়েছেন। আরবি-ফারসি মূল শব্দের বেলা তাঁরা বলেছেন, মূলে শিস ধ্বনি তিনটির যেটিই থাকুক না কেন বাংলা বানানে সর্বত্র ‘শ’ ব্যবহৃত হবে। যেমনঃ মাশুল, হিশেব, শাদা ইত্যাদি। প্রচলিত নাম শব্দে ‘স’কে রাখবার পরামর্শ দিয়েছেন। যেমনঃ ইসলাম, মুসলমান, সুফি, সোফিয়া ইত্যাদি।

৯. ‘র,ড়,ঢ়’ নিয়েও একই রকম সমস্যা আছে। তবে ষাঢ়, আষাঢ়-এর মতো দু’একটি শব্দ ছাড়া ‘ঢ়’ এর ব্যবহার নেইই প্রায়। শব্দক’টা মনে রাখলেই হলো। জায়গা দখল নিয়ে জোর লড়াই করে অন্য দু’টি। দু’টোরই জোর বড় কম নয়। এ ক্ষেত্রে অর্থ মনে রাখলেই কাজ চলে যায়। আগে উল্লেখ করা বাক্য-“বই পরা শেস করে জামা পড়ে ঘড় থেকে বেড়িয়ে বাজার হয়ে এক বন্ধুর বারি দিব্যি বেরিয়ে আশি। টেড়ও পাই না কোথাও একটা বর গণ্ডগোল হয়ে গেছে।” এরকম লিখলে মহাভারত অশুদ্ধ হয় না অবশ্য। আমাদের অসমের বাংলা সংবাদ পত্র গুলো যে আখছার এমন লিখে তার নজির আগেই দিয়েছি। কিন্তু এরকম বাক্য পড়ে অনেকেই কিছু বুঝে উঠতে পারবে না। তাই পাঠকের কথা মনে রাখলে একটু সুবিধে হয় কথাটা এই মাত্র। বাক্যটির শুদ্ধ রূপ হবে—“ বই পড়া শেষ করে জামা পরে ঘর থেকে বেরিয়ে বাজার হয়ে এক বন্ধুর বাড়ি দিব্যি বেরিয়ে আসি। টেরও পাই না কোথাও একটা বড় গণ্ডগোল হয়ে গেছে।” প্রায় সমোচ্চারিত শব্দগুলোর তালিকা মনে রাখা এসব শব্দের জটিলতা এড়াবার কোনো উপায় নেই।

১০. বাংলা বর্ণমালাতে দু’টো ‘ব’ কেন আছে এ কৌতুহল অনেকেরই মনে আছে। এ নিয়ে অসমিয়া হিন্দিতে কোনো সমস্যা নেই । তাদের অন্তস্থ-ব এর স্বতন্ত্র ব্যবহার আছে। লিপিতেও বর্ণ দু’টি আলাদা। যেমন অসমিয়াতে ‘ব’ আর ‘ৱ’ । বাংলাতে সর্বত্র বর্গীয়-ব । কিছু তৎসম শব্দের যুক্তাক্ষরে অন্তস্থ-ব এর ব্যবহার আছে, সেগুলোও লিপিসাম্যের জন্যে বোঝা মুস্কিল হয়। ত্বক,স্বাধীনতা, স্বামী, বিল্ব এরকম কিছু শব্দ। ‘বিল্ব’ শব্দের অসমিয়াতে উচ্চারণ শুনেছি অনেকটা ‘বিল্ ব’র মতো বাংলাতে বেশির ভাগ যুক্তাক্ষর সমীভূত হয়। এখানেও তার ব্যতিক্রম হয় না। ‘বিল্ব’ উচ্চারিত হয়’ বিল্ল’ । অথবা দ্বিতীয় ব্যঞ্জন একটা রেশ রেখে যায়, স্পষ্ট উচ্চারিত হয় না , সেখানে উচ্চারণে একটা জোর পড়ে মাত্র। উচ্চারিত হয় , “ ‘ সাধিনতা, ‘ তক, ‘ সামি ইত্যাদি। এসব শব্দের বানান মনে রাখা বেশ একটু কঠিন বটে। অভ্যাসের উপর নির্ভর করা ছাড়া উপায় নেই।

এ পর্যন্ত এসে আমরা বানান সমস্যা নিয়ে সব কথা বললাম বলে দাবি করব না, কিন্তু যে যায়গাগুলো আমাদের বেশি বিভ্রান্ত করে সে নিয়ে কাজ চালিয়ে দেবার মতো কথা বলেছি বলে দাবি করতেই পারি। আগে দু’টো টিপস দিয়েই রেখেছি। এবার আরো চারটি মাত্র সূত্রে ( বা টিপস) আমাদের কথাগুলোকে গুটিয়ে আনতে পারি।

(ক) সংস্কৃত তথা শব্দে বানানের ব্যাকরণ সিদ্ধ নিয়ম মনে রাখার আমাদের এক বাধ্যবাধকতা আছে। নিয়ম মুখস্থ করে এ সব মনে রাখবার উপায় নেই। অনবরত লিখে ভুল-শুদ্ধের দ্বান্দ্বিকতার মধ্যে দিয়ে যাওয়া ছাড়া আর অন্য কোনো উপায় নেই।

(খ) সংস্কৃত তথা তৎসম শব্দো যদি বহুল প্রচলিত হয় তবে অনেক ক্ষেত্রেই এবং অবশ্যই অন্য সমস্ত অ-সংস্কৃত (তদ্ভব, দেশি, বিদেশি,) শব্দের বানানে সাধারণত সমোচ্চারিত ধ্বনিগুলোর মধ্যে বহুল ব্যবহৃত ধ্বনিটির বর্ণই (ই-কার, উ-কার, জ ইত্যাদি) ব্যবহৃত হবে।

(গ) সরলী করণের এই নিয়মটি খাটবে না যদি অর্থ পাল্টে যায়। তীর অর্থে ‘কূল’ শব্দটিকে রাখতেই হবে, ‘কুল’ করে ফেললে তার অর্থ হয়ে যাবে বংশ। ‘নদীর পাড়’ আর ‘নদী পার’ কথা দু’টোর মধ্যে তফাৎ রাখতেই হবে। রঙ্গ-কে রং করে ফেললে সত্যি সত্যি রঙ্গ হয়ে যাবে।

(ঘ) অভ্যাস কথাটা যখন বানান সম্পর্কে ব্যবহার করব তখন বুঝতে হবে সমগ্র জাতির অভ্যাসের কথা বলা হচ্ছে। একটা জাতির অভ্যাসও কালে কালে পাল্টায়। কিন্তু ধাঁ করে দিন কয়েকের মধ্যে পাল্টাতে হলে সে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কাজ নয়। তার জন্যে রবীন্দ্রনাথের মতো বিরাট ব্যক্তিত্বের অথবা জনপ্রিয় সংবাদপত্রের প্রয়াসের দরকার পড়ে। যতদূর জানি, অভ্যাসের বশে ‘শ্রেণী’ শব্দটি অনেকদিন পাল্টাতে চাইছিল না। আকাদেমি প্রস্তাব করেছিল। আনন্দবাজার পত্রিকাগোষ্ঠী তাকেও ‘শ্রেণি’ করে তুলেছিল। অসমের বাংলা দৈনিক ও টিভিগুলো ‘নিবন্ধন’ অর্থে ‘পঞ্জিয়ন’কে প্রচলিত করে ছাড়বেই যেন মনে হচ্ছে। সে অবশ্যি নতুন শব্দ আমদানির কথা। আমাদের মতো সাধারণ ঘরের বৌরা যেমন মন না চাইলেও কপালে এক আধটু সিঁদুর ছুঁইয়ে রাখেন, অভ্যাসে বাঁধা পড়া বানানগুলো ব্যবহার করার একটা অভ্যাস তেমনি না থাকলে গড়ে নেয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই।

ছাত্রদের জন্যে আরেকটি অর্থাৎ সপ্তম কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ টিপস দিয়ে রাখতে পারিঃ তাতে পরীক্ষাতে অন্ততঃ ১০ (দশ) গ্রেস মার্ক্স পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু ভয় হয় ছাত্ররা তা অনুসরণ করবে কিনা তাই নিয়ে। একটা দুটো বই অবশ্যই সারা জীবন সংগে রাখতে হবে, যদি জটিল বিশেষ করে তৎসম শব্দগুলো অহেতুক ভুল করে মানহানি না করতে হয়। বই দুটোর কথা কোনো সিলেবাসে লেখে না। একটির কথাতো কখনোই লেখে না। ছাত্ররা আমাদের বুদ্ধিমান; তারা সিলেবাসের বাইরে বই প্রায় পড়েই না। সিলেবাসেরো ‘বাজে’ বই পড়ে একেবারে সময় নষ্ট করে না। সোজা নোটের সন্ধানে বাজারে যায়। তা, এই দু’টোর নোটও পাওয়া যায় না। পরীক্ষাতেও তার থেকে কমন প্রশ্ন আসে না। তাই খুব কম ছাত্র বই দুটো সংগ্রহ করে পৈত্রিক অর্থের অপচয় করে। অল্পবুদ্ধিরা বুঝে গেছে আমরা ‘অভিধান’ আর ব্যাকরণ’ বইএর কথা বলছি। বুদ্ধিমানদের সুবিধের জন্যে বলে রাখি বানান কিংবা বাক্যের গঠন ‘টুকলিফাই’ করবার জন্যে এ দুটো খুব কাজের বই। যত খুশি নকল করো কেউ তার জন্যে ‘ভেরিফাই’ করে কানমলা দেবে না। আর যদি ‘আকাদেমি বানান অভিধান’ রাখতে পারো তবে তো কোনো কথাই নেই! বহু মাস্টার মশাইর তর্জনও ঠাণ্ডা করা একেবারেই সহজ হয়ে যাবে। চাই কি তারাও আবার বানানের ক্লাস নাম লেখাতে পারেন! আমি নিজে সে ক্লাসের এখনো ফেল করা ছাত্র কিন্তু! কাউকে ভয় করি না, দিব্বি ভুল করি!

(প্রবন্ধটি লিখতে গিয়ে সংসদ প্রকাশিত রমেন ভট্টাচার্যের ‘বাংলা বানান নিয়ম ও অনিয়ম’ থেকে কিছুটা সাহায্য নিয়েছি। লিখেছিলাম বছর দুই আগে আমাদের তিনসুকিয়া কলেজের (অসম, ভারত) বাংলা বিভাগীয় পত্রিকা ‘আশা’র জন্যে। সেটিকেই একটু সম্পাদনা ও সংযোজন করে এখানে তুলে দিলাম)

No comments:

Post a Comment

Thank you very much for your comments.