Friday 7 December 2012

নক্ষত্রের গোধূলি -৫৭ [অধ্যায় ৬]

Photobucket
পূর্ব প্রকাশের পরঃ নক্ষত্রের গোধূলি-৫৬ তুমি কিছু মনে করোনা রাশেদ!
না আপা আমি কিছুই মনে করিনি,
মনে মনে ভাবলেন যার কোন সংস্থান নেই তার কিছু মনে করা সাজে না, সে কোন অধিকারে কিছু মনে করবে? রিতা আপার বাড়ির কাছে রেড ব্রিজ টিউব স্টেশনে নেমেছিলেন, সেদিকে এগিয়ে গেলেন।


জানুয়ারি মাসের লন্ডন শহরে শূণ্য ডিগ্রি তাপমাত্রার শীতের মধ্যে রাশেদ সাহেব কাধে ব্যাগটা ঝুলিয়ে উদভ্রান্তের মত হেটে যাচ্ছেন আর ভাবছেন। রীতা আপা! আপনার ভাই আমার বন্ধু শাহিন যখন এডিক্টেড হয়ে গেল আপনার আত্মীয় স্বজনেরা যখন সবাই আপ্রাণ চেষ্টা করে তাকে ভাল করতে পারেনি, তার বৌকে তার ভাইয়েরা নিয়ে গেল তখন তাকে ভালো করার জন্য আমি এনে আমার কাছে রাখলাম। আমার স্ত্রী তাকে নিজের ভাইয়ের মত সেবা যত্ন করে তার জন্য সুপ এটা সেটা রান্না করে সময় মতো খাওয়াত। নামাজের সময় হলে তাগিদ দিত ভাই যান আপনার বন্ধু এখন নামাজ পড়বে আপনি ওজু করে আসেন ওর সাথে নামাজ পরবেন। নিজে তদারকি করে কাপর চোপর ধুয়ে ইস্ত্রি করিয়ে দিত। শাহিন ভাই আপনার সিগারেট আমি কিনে দিব তবে প্যাকেট আমার কাছে থাকবে যখন ইচ্ছা হবে আমার কাছে চেয়ে নিবেন। আমি জিজ্ঞেস করব না কতগুলি খেলেন তবুও প্যাকেট আমার কাছেই থাকবে। তার জন্য আলাদা করে মনি বেনসন সিগারেট কিনে আনাত। রাশেদ সাহেব যখন বিকেলে ব্যাডমিন্টন খেলতে যেতেন তখন মনি তাকেও বলে পাঠিয়ে দিত
শাহিন ভাই আপনার বন্ধু খেলতে যাচ্ছে আপনিও যান। খেলা শেষে ফিরে এলে দুই বন্ধুর জন্যে নিজের গরুর দুধ কিংবা বাগানের তাজা সবজী দিয়ে বানান কাটলেট বা অন্যান্য নাস্তা রেডি করে রাখত। এই ভাবে যখন সে মোটা মুটি ভাল হয়ে আপনাকে চিঠি লিখেছিল সে চিঠির সাথে আমিও দুই লাইন লিখেছিলাম। আপা, চিন্তা করবেন না মনির যত্নে আর আমি ওকে সব সময় আমার সাথে রাখি। এই কড়া শাসনে আশা করছি শাহিন ভাল হয়ে গেছে। সুস্থ হয়ে উঠেছিল। প্রায় দুই মাস সিগারেট ছাড়া আর কিছু নেয়নি। তবে এই ধরনের নেশার আসক্তি কি আর সহজে ছাড়ান যায়? প্রথম দিকে রাশেদ সাহেবই নিজে কিনে এনে দিতেন, চেনা দোকানি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল
এগুলি দিয়ে আপনি কি করবেন?
আছে দরকার আছে
দোকানের চেনা ডাক্তারকে বলেছিল আসল ঘটনা।
আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে আমি নিয়ে এসেছি নেশা ছাড়াব বলে
অনেক টাকা খরচ হয়েছিল। প্রায় ভালো হয়েই গিয়েছিল, রাশেদের সাথে রাশেদের ব্যবসার কাজকর্মে সাহায্য করছিল। মনিই একদিন বলল
ভাই এবার যান একদিন বাড়ি থেকে ঘুরে আসেন দেখেন রুমাকে নিয়ে আসতে পারেন কিনা। রুমা এলে আপনারা, মনি আর রাশেদ যে রুমে থাকে তার পাশের রুম দেখিয়ে বলেছিল এই ঘড়ে থাকবেন। আপনি আপনার বন্ধুর সাথে ব্যবসা দেখে শুনে শিখে নিবেন, আপনারা বাইরে দেখবেন আর ভিতরে আমি আর রুমা দেখব, ওকেও আমি শিখিয়ে নিব। কিছু দিন গেলে এখানে কাছেই আপনাদেরও জায়গা আছে সেখানে আপনিও এই ব্যবসা করবেন, আমি বলেন আর আপনার বন্ধু বলেন সব ধরনের সাহায্য তো পাবেনই।
মনির কথা শুনে শাহিন বলল
হ্যাঁ বাড়ি যাওয়া যায়, ভালই হবে তবে তোমরাও চল না আমার সাথে ওরা খুশি হবে।
আচ্ছা চলেন।
মিতা আপা মানে রীতা আপার বড় বোনকে ফোন করে রাশেদ বলেছিল আপা আমরা আগামী কাল শাহিনকে নিয়ে আসছি আপনি রুমাকে আসার জন্য বলবেন রুমা যেন এখানে থাকে।
তুমি মনিরাকে নিয়ে এসো,
হ্যাঁ আপা ও আসবে।

সেদিন মনিই রুমার জন্য একটা শাড়ি আর ওর ছেলের জন্য একটা টি শার্ট কিনে শাহিনের হাতে দিয়ে বলেছিল এগুলি নিয়ে চলেন রুমা খুশি হবে। সেদিন একসাথে সবাই গিয়েছিল, ওদের বাড়ির সবাই ভীষণ খুশি, বড় ভাবি তো বললই
আমার মনে হচ্ছে আজ যেন ঈদ, শাহিনকে যে ভাল দেখব এ আশা তো আমরা ছেড়েই দিয়েছিলাম।
মিতা আপা রাশেদকে আর মনিরাকে ধরে সে কি কান্না,
আমরা যা পারিনি তোমরা তাই করলে।
ভাল রান্না বান্নার আয়োজন করেছিল। সবই হয়েছিল কিন্তু যার জন্য এতো আয়োজন সেই রুমা তার ভাইদের বাড়ি থেকে আসেনি। দুপুরে খাবার পর মনিরা রাশেদকে বলল
তুমি যাও রুমাকে বুঝিয়ে বল অন্তত যেন এসে দেখা করে যায়।
তুমিও চল না আমি একা গেলে কেমন দেখায়, চল।
মিতা আপা জিগ্যেস করলেন
কি আলাপ করছ তোমরা?
মনি বলল আপা ওকে বলছি রুমাকে একটুক্ষণের জন্যে হলেও এসে শাহিন ভাইর সাথে দেখা করার জন্য নিয়ে আসতে।
ও তাহলে চল আমিও যাই।
বেশ,
ওরা এক সাথেই গিয়েছিল। রাশেদ সাহেব রুমার হাতে ধরে অনুনয় করে বলেছিল
দেখ রুমা, আমি জানি তুমি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছ, ও যেখানে পৌঁছেছিল সেখান থেকে ফেরান কঠিন ছিল, তোমরা পারনি। আমি শুধু তোমার আর তোমার ছেলের জন্য ওকে আমার কাছে নিয়ে গেছি, এই ভেবে যে দেখি শেষ চেষ্টা করে। আমি দেখছি ও ভাল হয়ে গেছে, আমার সাথে আজ প্রায় তিন মাস হয়ে গেল।
আমাদের কষ্ট হয়েছে, অনেক টাকা খরচ হয়েছে। মনিও কম কষ্ট করেনি। কিন্তু সবার উপরে সুখ পেয়েছি যে তোমার জিনিষ তোমার হাতে ফিরিয়ে দিতে পারছি বলে। তা তুমি যদি ওকে আনতে না যাও তাহলে কেমন হয়? তাহলে ও কার জন্য ভাল হোল বলবে আমাকে? তুমি চল ওর সাথে একটু দেখা করে আস, আমার বিশ্বাস ওকে তুমি দেখলেই ওর পরিবর্তন বুঝতে পারবে। তুমি চল, ওকে একটু নিজের চোখে দেখে অন্তত বলে আস যে রাশেদ ভাই মনিরা ভাবি যে ভাবে বলে সেভাবে থাক আমি আসছি। তারপর মনি যেভাবে বলছে ওখানে গিয়ে কয়েক দিন ওর সাথে থেকে এসো, ওখানে যেতে না পারলে এ বাড়িতেই থেক, ওকে আমি পাঠিয়ে দিব মাঝে মাঝে। তুমি যদি ওকে গ্রহণ না কর তাহলে আমি ওকে কার কাছে পাঠাব? শোন, পুরুষ মানুষের আশ্রয় হোল তার স্ত্রীর বুকে।

সমস্ত পৃথিবী তাকে ত্যাগ করতে পারে কিন্তু স্ত্রী তা পারে না। যে স্ত্রীর বুকে তার স্বামীর জায়গা হয় না তার মত হতভাগা পুরুষের জায়গা আর কোথায় হবে বল! তুমি চল, দেখবে শাহিন একেবারে ভালো হয়ে গেছে। এখন মনি ওকে গুনে গুনে সিগারেট দেয়, ওর জন্য দিনে মাত্র তিন কাপ চা বরাদ্দ। তুমি ওকে কাছে টেনে নাও, তুমি সাথে থাকলে আরও ভালো হবে না? আরও সহজ হবে। দেখবে আগের মত সব ঠিক হয়ে গেছে। তোমার ভয় কি, মনিতো আছেই আমিও আছি, তোমার ভালো লাগবে। তুমি তোমার হারান বিশ্বাস, হারান সম্পদ ফিরে পাবে। শাহিন ভাল হলে কে বেশি খুশি হবে আমি না তুমি? আমার মনে হয় আমার চেষ্টা আমি করেছি এখন যা করার তা তোমার হাতে।
না, এতো অনুনয় বিনয়ে কোন কাজ হয়নি রুমার একই কথা
যেদিন আপনার বন্ধু নিজে রোজগার করে এসে আমাকে নিয়ে যেতে পারবে সেদিনই আমি যাব তার আগে নয়।
কারো কোন কথাই সে মেনে নেয়নি। সেদিন ওখান থেকে ফিরে এসে সে রাতেই শাহিন গেট ডিঙ্গিয়ে বেড় হয়ে কোথা থেকে যেন নেশার বস্তু এনে আবার শুরু করেছিল। গেট ডিঙ্গিয়ে যেতে দেখেছিল রাশেদ সাহেবের নৈশ প্রহরী,
সে রাশেদ সাহেবকে বলল স্যার গতরাতে আপনি শোবার পর শাহিন ভাই গেট ডিঙ্গিয়ে কোথায় যেন গেল প্রায় দুই ঘণ্টা পরে ফিরেছে। কয়েক দিনের মধ্যে রাশেদ সাহেবের নিজের চোখেও পরে যায়। দেরি না করে মিতা আপাকে ফোনে সব জানিয়ে দুখ করে বলল সেদিন যদি রুমা আসত তাহলে হয়ত এমন হত না, আমার সব চেষ্টা বৃথা হয়ে গেল। রুমা যদি এত কঠিন জেদ না করে একটু নমনীয় হত তাহলে ওরই লাভ হত। আপা আমাকে মাফ করবেন, আমি আর পারলাম না। আমি ওকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
এই হল শাহিন আর মিতা আপার বোন রীতা আপা। বন্ধুত্বের দায়িত্ব পালনের বিনিময়ে রাশেদ সাহেব কোন প্রতিদান আশা করেনি তবে দেশ থেকে প্রায় ছয় হাজার মাইল দূরে এই শীতের মধ্যে সৌজন্যটা আশা করা নিছক অমূলক মনে করেনি। এরকমই হয়, অভাগার যা হবার তাহা রুধিবে কে? যাই হোক, আজ এখানে রীতা আপার জায়গায় মিতা আপা হলে এমন হত না।
চলবে, পরবর্তি পর্বের অপেক্ষা

No comments:

Post a Comment

Thank you very much for your comments.