Friday 7 December 2012

নক্ষত্রের গোধূলি-৫৫ [অধ্যায় ৬]

37727540
ছবিঃ ওবান হারবার, ওই পথে গিয়ে সাগর বেয়ে যেতে হয় বেলফাস্ট কিংবা ডাবলিন।
(পূর্ব প্রকাশের পর)
জ সোমবার, বারোই জানুয়ারি। অনেকক্ষণ আগেই কাউকে কিছু না জানিয়ে ওবান শহরে শীতের আকাশে অন্ধকার ছেয়ে গেছে। চারিদিকে রঙ্গিন নিওন বাতি আর রাস্তার সোডিয়াম
বাতি অনেকক্ষণ থেকেই সন্ধ্যার অন্ধকারের সাথে যুদ্ধ করছে। রাশেদ সাহেবের মনে ওবান শহরের চেয়েও বেশি অন্ধকার কিন্তু, সে অন্ধকারের মধ্যে নিওন বাতি জ্বালাবার মত কোন জ্বালানির সন্ধান তিনি এখনো খুঁজে পাননি। সন্ধ্যা সাতটায় কোচ ছেড়ে দিয়েছে। কি ভাবে কি করলে, কোথায় গেলে তার এই অন্ধকার দূর হবে তাই খুঁজে পাবার জন্য যে লন্ডন থেকে বুকে অনেক গুলি আশা নিয়ে স্কটল্যান্ড এসেছিলেন, অজানা আতঙ্ক, অনিশ্চয়তা আর বেশ বড় ধরনের একটা ভয়ের বোঝা বুকে নিয়ে এই কোচে বসে আবার সেই লন্ডনের পথে ফিরে চলেছেন। রীতা আপা কেন ফোন করলেন সেও জানা হল না। এ আবার আর এক চিন্তা। অন্ধকারের মধ্যে রাস্তার আলোতে কোচের জানালার পর্দা সরিয়ে যতক্ষণ দেখা যায় তিনি দেখলেন দেলু এক দৃষ্টিতে তার চলন্ত কোচের দিকে চেয়ে আছে।
13422117
ওবান হারবারে ভেসে আছে একটি ইয়োট
রাশেদ সাহেবের জীবনে এরকম বিচ্ছেদ অনেক হয়েছে। অনেক জায়গায় অনেক জনের কাছ থেকে বিদায় নিতে হয়েছে। বিদায় সব সময়েই বিষাদে ভরা। বিদায় কখনো মধুর হয় না। তা সে আপন জনের কাছেই হোক কিংবা পরের কাছেই হোক। মানুষ যেখানে যায় সেখানেই তার নিজের অজান্তেই আস্তে আস্তে শিকড় ছড়িয়ে দেয়। সে শিকড় কত খানি গভীরে যাচ্ছে তা আর বুঝে উঠতে পারেনা। তা বুঝে তখন, যখন সে জায়গা ছেড়ে চলে যেতে হয়। মনের গভীর থেকে টেনে শিকর ছিঁড়ে বের হয়ে যাওয়া কত কঠিন। মনটা কেমন যেন হয়ে যায়, মানুষের প্রকৃতিই এমন। দুদিনের পরিচয়েও আপন হয়ে যায়। হয়তো আর কোন দিন দেখা হবে না। কালের চরকায় বসে ছিটকে কে কোথায় চলে যায় তবুও কিসের একটা অদৃশ্য বন্ধন তৈরি হয়। যা ছিঁড়ে দেয়া কঠিন, চাইলেও পারা যায়না। থাক না, যেমন রয়েছে তেমনই থাক। তারপরেও যেতে হয়। অদৃশ্য বন্ধন ছিঁড়ে দিতে হয়। তবে এর মধ্যেও কোন কোন বন্ধন থেকে যায়। দীর্ঘ দিন। সে ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক। থেকে যায়, কখনো সারা জীবনের জন্যেই রয়ে যায়।
1244871
অনেক পুরনো ওবান শহর
269275
রাতের ওবান।
কোচ এগিয়ে চলেছে। আজ অন্ধকার, বাইরে কিছু দেখা যাচ্ছে না। ছোট্ট শহর এলাকা ছেড়ে আসতে বেশিক্ষণ লাগেনি। শহরের বাইরে মনে হচ্ছে নিশীথের কোলে সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। সামনে গাড়ির হেড লাইটের আলো ছাড়া আর কোন আলো নেই। শুধু একটু মৃদু নীল আলো গাড়ির ভিতরের ডেক আলোকিত করে রেখেছে। বিদায় ওবান, বিদায় স্কটল্যান্ড। আবার কবে দেখা হবে জানিনা। আদৌ দেখা হবে কিনা তাও জানিনা। তুমি খুব সুন্দর স্কটল্যান্ড, তুমি খুবই সুন্দর। অসাধারণ তোমার রূপ, তোমার সৌন্দর্য, তোমার প্রকৃতি। তোমার কাছে যত দিন ছিলাম অনেক দুখ: ভুলে ছিলাম। কি জানি তোমার কোন মোহে পরে তোমার সম্মোহনী গুনে সব কিছুই ভুলে ছিলাম। অনেক কিছুই ভুলিয়ে রেখেছিলে তুমি। এভাবেই তুমি সবাইকে আনন্দ দিয়ে যেও। সবার মনে সুখের ছবি একে দিও। যেন তোমার সুখ স্মৃতি তাদের কোন অলস সময়ের সঙ্গী হয়ে থাকে। তোমার আকাশে আমার অনিশ্চিতে ভরা দুঃখের তপ্ত নিশ্বাসের বাতাস আর তোমার বুকে শুধু টলমল পায়ের চিহ্ন গুলিই রেখে গেলাম। আমার আর কীইবা আছে? আসবে, তোমার কাছে অনেক মানুষ আসবে, এতো দিন যে ভাবে এসেছে। পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তের অনেক মানুষ আসবে। তারা আমার মত নয়। তারা আসবে আনন্দ পাবার জন্য, আনন্দ দেবার জন্য। তারা আসবে তাদের সুখস্মৃতির বোঝা ভারি করার জন্য। আমার মত কাউকে যেন দুঃখের বোঝা নিয়ে ফিরে যেতে না হয়। তুমি তাদের দেখবে। তাদের সাথে করে নিয়ে আসা পায়ের ধুলোর আস্তরণে আমার রেখে যাওয়া পদচিহ্ন এক সময় মুছে যাবে। তুমিও আমার কথা ভুলে যাবে। কিন্তু, সত্যিই বলছি, আমি তোমার কথা, তোমার মায়া, তোমার মমতা আর তোমার স্মৃতি কখনো ভুলবো না।
550316
গোল দেয়ালে বাঁধান চত্বরটি একটি বাগান এখানে দাঁড়িয়ে সাগরের দিকে তাকিয়ে দেখা যায় অনেক দূরে।
আজ তেমন কুয়াশা নেই। গাড়ি স্বাভাবিক গতিতেই চলছে। ভিতরে হিটার রয়েছে তাই ঠাণ্ডা লাগছে না। নানা এলো মেলো ভাবনা নিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছে। মনে কত কি আসছে যাচ্ছে। আকাশে যেমন উঁচুতে নিচুতে, ছেড়া কাটা ফাটা, টুকরো টুকরো, ছিন্ন ভিন্ন নানা রঙ্গের নানা বর্ণের মেঘ ভেসে যায় রাশেদ সাহেবের মনের আকাশেও তেমন ভাবনার মেঘ ভেসে যাচ্ছে। অনেক কিছু ভাবার চেষ্টা করছে কিন্তু কোনটাই স্থির হতে পারছে না। কেমন যেন সব কিছু তাল গোল পাকিয়ে গেল। কোথা থেকে কোথায় যাচ্ছেন তার কোন ঠিকানা নেই। হটাত মাইকে ড্রাইভারের কণ্ঠে ফিরে এলেন। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে গ্লাসগো টার্মিনালের নির্দিষ্ট গেটের সামনে দাঁড়িয়ে গাড়ির দরজা খুলে ড্রাইভার নিচে নেমে যাত্রীদের লাগেজ বের করছে। রাশেদ সাহেব তার ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে ভিতরে এসে ফোন বুথের কাছে গেলেন। রীতা আপা বা ফিরোজকে ফোন করতে হবে। এখনো রীতা আপার বাসায় কেও ফোন ধরল না। ফিরোজ বাসায় ফেরেনি। এদিকে লন্ডনের কোচ ছাড়তে আর মাত্র বিশ মিনিট বাকি। ফোন রেখে লাউঞ্জে বসলেন। দেখি একটু পর আবার চেষ্টা করে কাওকে পাই কিনা। উঠে গেটের বাইরে গিয়ে একটা সিগারেট জ্বালালেন। ঘড়ি দেখে সিগারেটটা ফেলে দিয়ে আবার ফোন। না এবারেও কাউকে পেলেন না।

মনটা আরও অস্থির হোল, কেমন যেন একটা ছটফট ভাব অনুভব করছেন। রিসিভারটা রেখে দেয়ার সময় মনির কথা মনে হল। তার পথের আলো, মেয়েদের কথা মনে হল। একবার চেষ্টা করবো? হাতের ঘড়ি দেখলেন। না এখনো ওরা ঘুম থেকে উঠেনি, থাক লন্ডন গিয়ে কি হয় তাই বুঝে ওখান থেকে কথা বলা যাবে। কিছু করার নেই, লন্ডন নেমে রীতা আপার বাসা পর্যন্ত পৌছার আগে কিছুই বোঝার উপায় নেই। কিন্তু, সেতো সকাল নয়টার আগে সম্ভব না, কারণ কোচ ভিক্টোরিয়া পৌঁছবে সকাল সাড়ে সাতটায়। হয়ত রীতা আপা তার লন্ডন যাবার ব্যাপার কনফার্ম কিনা সে কথা জানার জন্যই ফোন করেছিল। ওই যে কথা বলেছে তার পরেতো আর কথা হয়নি। আর কি হতে পারে?যাই হোক, একটা কিছু হবে এ নিয়ে এতো চিন্তা করার দরকার নেই। বোর্ডিং গেট দিয়ে লোকজনকে এগিয়ে যেতে দেখে রাশেদ সাহেবও এগিয়ে গেলেন। এবারও দোতলা কোচ। কাঁধের ব্যাগটা লাগেজ বক্সে দিয়ে আজ দোতলায় উঠে একেবারে সামনের একটা সীটে বসে পরলেন। পাশে কেও নেই, দুই জনের সীটে সে একা। রাত হোক আর দিনে হোক জার্নিতে তার ঘুম হয় না, হয়তোবা কখনো একটু আধটু চোখ লেগে আসে। ব্যাস, ঐ পর্যন্তই। সামনে বসলে রাতের ব্রিটেন দেখতে দেখতে যাওয়া যাবে। যাত্রী বেশি নেই, বিশ পঁচিশ জন হতে পারে। কোচ ছেড়ে দেবার পর বুঝলেন অনেকক্ষণ আগেই ক্ষুধা লেগেছে এতক্ষণ উৎকণ্ঠার মধ্যে ছিলেন বলে টের পাননি। টেসকো থেকে আইরিশ পটাটো ব্রেড, কলা আর আপেল এনেছিলেন, সাথে এক লিটার অরেঞ্জ জুসের প্যাকেট। রেস্টুরেন্ট থেকে দুই লিটার কোকের বোতল ভরে পানি এনেছেন। ময়না ভাই দেলুকে বলেছিল একটা নান বানিয়ে সাথে কিছু চিকেন টিক্কা দিয়ে দিতে। রাশেদ নিষেধ করেছে। না, আমি টেসকো থেকে কিছু নিয়ে এসেছি তাই আর কিছু লাগবে না। দেরি না করে খেয়ে নিলেন।
42541791
গ্লাসগো বুচানান বাস টার্মিনাল
কোচ অনেকক্ষণ আগেই গ্লাসগো শহর ছেড়ে এসে মটর ওয়েতে চলছে। কোন রাস্তা দিয়ে চলছে তা চলার গতিই বলে দিচ্ছে। এখনো মটর ওয়েতে রোড লাইট আছে আর কিছু দূর গেলে রোড লাইট থাকবে না। এত রাতে এত গাড়ি কোথায় যায়? আচ্ছা লড়ি গুলি যাচ্ছে সে না হয় ঠিক আছে এক শহর থেকে আর এক শহরে কিংবা এক দেশ থেকে আর এক দেশে ভোর হবার আগে তাদের মাল পৌঁছে দিতে হবে। তাদের তাড়া আছে বলে দিন রাত লরি নিয়ে ছুটছে। কিন্তু, কার গুলি?তারা কোথায় যায়?এদেশে কত মানুষ রাস্তায় থাকে?এই জরিপ কি কখনো কেও করেছে?যেমন দেশ তেমন রাস্তা। কত যে রাস্তা জালের মত ছড়িয়ে রয়েছে তার কোন মাথা মুণ্ডু খুঁজে পায়না অথচ সব রাস্তাই এদের সিস্টেমে রয়েছে। সারা দেশের প্রতিটি ইঞ্চি এদের নখদর্পণে। এমন ব্যবস্থা করে রেখেছে। পথে বের হয়ে কাউকে পথের সন্ধান জিজ্ঞেস করতে হয়না। জিপিএসে গন্তব্য সেট করে দিলেই হল, সেই ডান বাম বলে নিয়ে যাবে। কত দূর, কত সময় লাগবে সবই বলে দিচ্ছে। মটর ওয়ের মাঝে মাঝে ইনফরমেশন বোর্ড আছে, তাতে স্পীড লিমিট দেখাচ্ছে। সামনে জ্যাম আছে কিনা তাও দেখাচ্ছে।

সামনে বৃষ্টি হচ্ছে, স্নো হচ্ছে রাস্তা পিচ্ছিল হয়ে আছে তাও দেখাচ্ছে। বৃস্টলে মটর ওয়ে কন্ট্রোল রুম থেকে সারা দেশের পথ কন্ট্রোল করছে। সিসি ক্যেমেরা দিয়ে ছবি নিয়ে ইন্টারনেটের মাধ্যমে কনট্রোল রুমে বসে দেখছে। কোন জায়গা কত দূর সেখানে যেতে কোথায় মোড় নিতে হবে সব উজ্জ্বল সাইনে লেখা রয়েছে, সামনে কতদূরে সার্ভিস স্টেশন রয়েছে সব তথ্য পথে যেতে যেতে পথেই পাওয়া যাবে কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করতে হয়না আর জিজ্ঞেস করবেই বা কাকে? আসে পাশে দশ পনের মাইলের মধ্যে কোন মানুষের ছায়া পর্যন্ত দেখা গেলে তো জিজ্ঞেস করবে। এরা এদের নিজেদের অবস্থা জানে বলে সে ভাবেই এদের দেশ সাজিয়ে রেখেছে, কাউকে কারো কাছে যেতে হয়না। দূর পথে যাত্রা করে কোন অসুবিধায় পরতে হবে না। রেডিওতে ট্রাফিক চ্যানেল রয়েছে। চব্বিশ ঘণ্টা সারা দেশের যে কোন রাস্তায় ঘটে যাওয়া সর্ব শেষ পরিস্থিতি বলে যাচ্ছে। পথে কারো ইঞ্জিন বিগরে গেছে কোন সমস্যা নেই।
পাশে দাড় করে রেখে সামনে বা পিছনেই ফোন বক্স আছে, শুধু ফোন উঠিয়ে বললেই হবে। প্রতিটা রাস্তার নম্বর আছে। এখন তুমি কোথায়?এম৫ কিংবা এ৪৭ এর ৮ নম্বর রাউন্ড এবাউটের (গোল চক্কর) কাছে আমার গাড়ি বিগরে আছে। দশ মিনিটের মধ্যে পুলিশের গাড়ি, ক্রেন এবং এম্বুলেন্স যা যা লাগে সব এসে হাজির। সকল মটর ওয়ের একেবারে বাম পাশের যে লেন সেটা পুলিশের জন্য নির্ধারিত। ফোনে ৯৯৯ এ ফোন করে নিজের অবস্থান জানিয়ে দিলেই পুলিশ কিংবা এম্বুলেন্স দশ মিনিটের মধ্যে হাজির। যারা প্রি পেইড ফোন ব্যাবহার করে তাদের ফোনে যদি কোন পয়সা নাও থাকে কোন অসুবিধা নেই, ৯৯৯ ডায়াল করলেই পুলিশ কন্ট্রোল রুমে লাইন চলে যাবে। তারপর নিজের অবস্থান জানতে চাইবে সঙ্গে সঙ্গে ওই স্থানীয় এলাকায় সংযোগ দিয়ে দিবে ব্যাস এবার নিশ্চিন্তায় দশ মিনিট অপেক্ষা করুন। আমাদের দেশের পুলিশের মত এসেই, কোথা থেকে এসেছেন, কেন এসেছেন, ওখানে কেন গিয়েছিলেন, এখানে কি করছেন, ঘাস খেয়েছেন কিনা, আমার জন্যে কয়লা আনেন নি কেন আমি এখন কি চিবাব, আপনার ব্যাগে ওটা কি? এই রকম আমার লাগবে, আমাকে কত দিবেন আমার বাড়ি করার টাকা কম পরেছে, সামনে ঈদে আমার বৌয়ের গলার ফাঁসির অর্ডার দিয়েছি ওটার টাকা টান পরেছে তা আপনি কত দিবেন, সরকার যা বেতন দেয় তা দিয়ে তো আমার তিন দিনও চলে না। আচ্ছা কিছু দিতে পারবেন না তাহলে থাকুন এখানে আমরা চললাম।
এধরনের কথা বলা যায় তা এদেশের পুলিশ জানেই না। ডিউটিতে গিয়ে কারো কাছে এক কাপ চা তো দূরের কথা এক গ্লাস পানিও খাবে না। সরকার এদেশের নাগরিক, বসবাসকারী সবার জন্য কত সুবিধা করে রেখেছে, এই জন্যইতো একবার এসব দেশে আসলে কেউ আর আমাদের মত দেশে ফিরে যেতে চায়না।
[রাশেদ সাহেবের সাথে থাকুন আর লক্ষ করুন সে কোথায় যায়, কি করে। কি ভাবে তাকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে জীবনের কঠিন থেকে কঠিনতর অংশ।]

No comments:

Post a Comment

Thank you very much for your comments.