Tuesday 4 December 2012

নক্ষত্রের গোধূলি-৪৮ [অধ্যায় ৪]

পূর্ব সূত্রঃ নক্ষত্রের গোধূলি-৪৭ (অধ্যায় ৪)
মা কতক্ষণ পারে? আমি জিজ্ঞেস করি আমি না থাকলে তুমি এতো এমন কর কেন, নিজে একটু বুঝে চলতে পার না? এখন তুমি বড় হয়েছ, তোমার বৌ আছে, দুদিন পরে বাবা হবে। ও বলে তুমি না থাকলে আমার কিছুই ভালো লাগে না, কাউকে ভালো লাগে না, কিছু করতেও ইচ্ছা করেনা। তুমি আছ আমার সব আছে, তুমি নেই আমার কিছুই নেই। এখন বল এই মানুষকে রেখে আমি কি করে থাকি?
জাহাজের চাকরির ভয়েজে যাবার প্লেনের টিকেট কনফার্মেশনের তারিখ সহ এজেন্টের টেলিগ্রাম পেয়ে সব কিছু গুছিয়ে নির্দিষ্ট তারিখে চিটাগাং যাবার জন্য বের হবে। সকাল দশটায় ট্রেন, আর মাত্র আধা ঘণ্টা বাকি আছে। মা ভাই বোন সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এসেছে। কোলে খুকু সহ মনিকে বুকে নিয়ে কিছুক্ষণ পর বলল
ছাড়ো মনি, আসি এখন, দেরি হয়ে যাচ্ছে।
মনি ছেড়ে দিলো। রাশেদ সাহেব ব্যাগটা হাতে নিয়ে ঘড়ের দরজা দিয়ে বের হচ্ছেন, এক পা দিয়েছেন এমন সময় পিছন থেকে শার্ট টেনে ধরেছে, ঘুরে তাকিয়ে দেখে মা শার্ট টেনে ধরেছে আর তার কোলে মেয়ের ছোট্ট হাত বাবার দিকে বাড়ানো। সাথে সাথে রাশেদকে মনি জড়িয়ে ধড়ে কেমন যেন এক অচেনা কণ্ঠে বলেছিল
আমি তোমাকে যেতে নিষেধ করছি তুমি শুনছ না?
সে কণ্ঠে যে কি ছিল, মিনতি, নাকি অনুরোধ, নাকি নির্দেশ। মনে হচ্ছিলো অনেক দূর থেকে কে যেন কি বলছে, রাশেদ কিছু বুঝে উঠতে পারেনি। অনেকক্ষণ ওই ভাবে থেকে শুধু বলেছিল
যেতে নিষেধ করছ কিন্তু না গেলে চলবে কি ভাবে খাবে কি?আমাদের খুকুকে মানুষ করবে কি দিয়ে?
না তুমি ওখানে আর যাবেনা, তুমি সাতার জানো না আমার ভয় করে।
কি যে বল তুমি, সমুদ্রের মধ্যে সাতার জানলেই কি আর না জানলেই কি। সাতরে কি সাগর পাড়ি দেয়া যায়?
না তুমি যাবেনা।
তা হলে কি করবো?
আমার অত টাকার দরকার নেই, তুমি এখানেই চেষ্টা করে খুঁজে দেখ, এখানেই ভালো চাকরি পাবে। এখানে যা পাবে তাতেই আমি চলতে পারবো, শুধু তুমি আমার বুকে থাকলেই হবে।
সেদিন মনির কথা শুনে রাশেদ সাহেব সেই যে হাতের ব্যাগ নামিয়ে রেখেছিলেন তুলে নিতে পারেন নি।

আর যাওয়া হয়নি। পরের দিন টেলি ফোনে তার না যাবার কথা জানিয়ে দিয়েছিলো। খুকুকে কোলে নিয়ে মার সামনে এসে দাঁড়ালেন। মা জিজ্ঞেস করলো কিরে কি হল গেলি না?
না আম্মা ওখানে যাব না, দেখি এখানেই খুঁজে দেখি একটা কিছু করা যায় কিনা।
মা বাবা কিংবা বাড়ির আর সবাই কে কি ভেবেছিলো তা আর খুঁজে দেখা হয়নি, তবে সেদিন রাশেদ আর কোথাও বের হয়নি। সারা দিন খুকু আর মনিকে বুকে নিয়ে কাটিয়ে দিয়েছিলো। বিকেলে উঠে বলল
চল একটু শাহিনের বাসা থেকে বেড়িয়ে আসি।
চল।
খুকু তার দাদুর কাছে রইলো। শাহিন ওদের দেখে অবাক হয়েছিলো
কি ব্যাপার রাশেদ, তুমি চিটাগাং যাওনি?
আমি চিটাগাং গিয়েছি এ কথা মনে করলে এই গেণ্ডারিয়াকে চিটাগাং বলতে হয়।
হেঁয়ালি করনাতো কি ব্যাপার খুলে বল।

মনি গিয়েছে দেখে শাহিনের মা আর বড় ভাবি খুব খুশি।
আরে মনিরা! এস এস, তুমি তো আসই না, রাশেদ এলেই ওকে বলি বৌকে নিয়ে আসলে না কেন? চল,
বলে ওকে উপরে নিয়ে গিয়েছিলো। ওরা মনিকে খুব পছন্দ করে। শাহিনের মা বৌ দেখে রাশেদের মাকে বলেছিল আপা একটু তারা হুড়ো করলেও বৌ পেয়েছেন একজন মনের মত, এরকম বৌ পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। মনি উপরে চলে গেলে রাশেদ শাহিনকে খুলে বলল।
ও এই ব্যাপার, মনিরা যখন যেতে দিবে না তাহলে ভালোই করেছ। এখন দেখ, পেপার দেখতে থাক, এখানেই কোথাও না কোথাও পেয়ে যাবে। চিন্তা কর না প্রায়ই বিজ্ঞাপন দেখা যায়, পাবে। আরে বৌ ভাগ্য বলেও একটা কথা আছেন?
এই ঘটনার দেড় দুই মাসের মধ্যে সত্যিই একটা ভালো চাকরি পেয়েছিলেন। একটা সরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রথম শ্রেণির অফিসার পদে। যেদিন জয়েন করতে যাবেন সেদিন বাবা বলেছিলেন,
আমার ছেলে অফিসার পদে চাকরি পেয়েছে বলে আমি খুশি কিন্তু বাবা, জীবনের প্রথম থেকে বিদেশের চাকরিতে হাজার হাজার টাকা রোজগার করে এসে হাত বড় করে ফেলেছ। এখন দেশের সরকারি চাকরির সামান্য বেতনে কুলাবে কিভাবে? তার পরে আবার এখানে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আর অধস্তনদের সাথে তাল মিলিয়ে চলা যে কত কঠিন তুমি তা জানো না। আমার ভয় হল তুমি কি তা পারবে? বিদেশে থেকে, বিদেশিদের সাথে চলাফেরা করে তোমাদের মন মানসিকতা বদলে গেছে। জয়েন করার আগে ভালো করে ভেবে দেখ।
আমি পারবো আব্বা, আপনারা শুধু দোয়া করেন, আমাকে যে পারতেই হবে।

মনে মনে বললেন, আমার মনির জন্যই আমাকে পারতে হবে। যেখানে আমার মনি আছে সেখানে আমার কাছে বাকি সব তুচ্ছ। আমাজনের গভীর অরণ্য বলেন, আর সাহারা মরুভূমি বলেন, কিংবা হিমালয়ের বরফ ঢাকা চূড়া থেকে কারাকোরামের দুর্গম পাহাড়ি এলাকা বলেন, যত গহীন প্রতিকুল অবস্থাই হোক শুধু আমার মনিকে বুকে নিয়েই আমি সারা জীবন কাটাতে পারবো। জয়েন করার জন্য খুলনা গিয়েছিলেন, সেখানে তার এক বন্ধু, ভিন্ন আর একটি প্রতিষ্ঠানের সহকারী পরিচালক পদে চাকরিরত এমরানের বাসায় উঠেছিলেন। কম্পাউন্ডার মধ্যে বাসা খালি নেই বলে পাঁচটা পর্যন্ত অফিস করে বের হতেন বাসা খুঁজতে। অফিসের সব সহ কর্মীদের বলেছিলেন তার জন্য ছোট একটা বাসা দেখতে। মাস খানিকের মধ্যে রাজীব সাহেব একটা বাসা ঠিক করে দিয়েছিলেন, বাসা পেয়ে মনিকে চিঠি লিখেছিলেন:
মনি,
তোমার স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে। একটা বাসা পেয়েছি, যদিও ছোট তবে আমার মনে হয় আমাদের খুকু আর তার বাবাকে নিয়ে তোমার স্বপ্নের সংসার পাতার জন্য যথেষ্ট। সামনে খোলা আকাশ, ছোট্ট একটু খালি যায়গা আছে ওখানে বাগান করা যাবে। ওই বাগানে খুকু খেলবে আর পাশে বারান্দায় বসে বিকেল বেলা আমরা আকাশ দেখবো আর চা খাবো। আমাদের অফিস কম্পাউন্ডার ভিতরেই স্কুল আছে খুকু বড় হলে ওখানে ভর্তি করা যাবে। আর একটা সবচেয়ে বড় সুবিধা হোল আমার অফিসের এক্কেবারে কাছে মেইন গেটের বাইরে রাস্তার ওপাড়ে। অফিসে যখন তোমার কথা মনে হবে তখন এসে চুমু খেয়ে যেতে পারবো। তুমি আগামী শুক্রবারের পরের শুক্রবার চলে আসার ব্যবস্থা কর এর মধ্যে আমি এখানে সব কিছু গুছিয়ে নিচ্ছি।
তোমার পাগল।
সাথে মাকেও একটু লিখেছিলেন:
আম্মা,
এখানে বাসা পেয়েছি, নতুন অবস্থায় ছুটি পাব না। আপনি জাহিদের সাথে মনি আর খুকুকে পাঠিয়ে দিবেন, ঢাকার কোচ এখানে নিউ মার্কেটের সামনে থামে, আমি ওখান থেকে রিসিভ করবো।
ইতি, আপনার রাশেদ।
চিঠি পাঠিয়ে দিয়ে শুরু করেছিলেন বাসা গোছানো। অফিস থেকে সুইপার ডেকে এনে সারা বাসা ধুইয়ে নিয়েছিলেন। অফিস সেরে নিউমার্কেট আর বড়বাজার ঘুরে জানালা দরজার পর্দা, বিছানাপত্র, ফার্নিচার, রান্না ঘড়ের হাড়ি পাতিল চুলা সব কিনেছিলেন। শুধু সংসারের টুকিটাকি যা মেয়েদের নিজস্ব পছন্দের না হলে হয় না সেগুলি বাদ রেখেছিলেন, মনি এলে তাকে সঙ্গে নিয়ে কিনবেন বলে। সেই শুক্রবারেই মেঝ ভাই জাহিদের সাথে মনি এসেছিলো সাথে মার একটা চিঠি নিয়ে।

বাবা রাশেদ,
বৌমাকে যেতে দেয়ার ব্যাপারে তোমার বাবা ভীষণ আপত্তি করেছিলেন, নতুন চাকরি এখনই বৌকে নিয়ে গেলে সামাল দিবে কিভাবে এই ভেবে। আমি তোমার সকালে ঘুম থেকে উঠে সময় মতো অফিসে যাওয়া আর খাওয়া দাওয়ার অসুবিধার কথা বলে কোন ভাবে রাজী করিয়েছি। আমি জানি প্রত্যেক মেয়েই তার নিজের সংসারের স্বপ্ন দেখে সেই ছোট বেলা থেকে, যখন সে মিছে মিছি মাটির পুতুল দিয়ে খেলে, হাবিজাবি দিয়ে খেলনা হাড়িতে ভাত তরকারি রান্না করে তখন থেকে। তাই আমি বৌমাকে পাঠিয়ে দিলাম। সে শুধু তোমার সুখের সাথি নয় সে তোমার সারা জীবনের সুখের এবং দুঃখের সাথি, কথাটা মনে রেখ। ওর মা ওদেরকে কখনো গায়ে হাত তুলে মানুষ করেনি। আমাকে যেন কখনো কিছু শুনতে না হয় বাবা। সাবধানে থেকো, দোয়া করি তোমরা সুখী হও। আর একটা কথা বৌকে নিয়ে যেখানেই যাবে সন্ধ্যার অন্ধকার হবার আগেই বাসায় ফিরবে।
ইতি, তোমার মা।

মনে হয় এইতো সেদিনের কথা। কিন্তু কোথা দিয়ে পঁচিশটা বছর কটে গেছে। আজ সেই খুকু এমকম করছে, তার পরে বীথী এসেছে সেও কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ছে। সবার শেষে যূথীও আগামী বছর এসএসসি দিবে। খুকুর পরের দুই বোন আসার আগেও রাশেদ আর মনি সেই একই স্বপ্ন দেখেছে, মনির অবস্থাও সেই একই রকম হয়েছিলো। ওরা তিন বোন কেও কারো চেয়ে কম না। সবাই মা বাবার জন্য অস্থির। মার কাছেই সব মেয়ের হাতে খড়ি, পড়ালেখা, রান্না বান্না, ঘড় গেরস্তি সব কিছুতেই একেবারে যেন মায়ের ছায়া। কিভাবে কোথা দিয়ে দিন চলে যায়। আজ সন্ধ্যায় সূর্য ডুবতে দেখা গেল, দিনের পরে রাত এলো আবার রাত শেষ হবার আগেই আরেকটা সূর্য এসে হাজির, সাথে করে আর একটা দিন নিয়ে এসেছে। আগের রাত আগের দিন কোথায় রেখে এলো? কোন কালো গহ্বরে চলে গেল দিন আর রাত গুলি? কোথায় গেলে সূর্যের ফেলে আসা সেই সব দিনের সন্ধান, রাতের সন্ধান পাবে কাওকে জিগ্যেস করে কোন জবাব পায়নি। শুধু আসা আর যাওয়াই দেখে আসছে চিরদিন। কোথায় যে যায় আর কেনই যে যায় এরও কোন জবাব পায়নি। কেন, একটা দিন হলে ইতো চলতে পারতো, এর মধ্যেই পালা করে কাজ কর্ম, আরাম বিশ্রাম যার যা করার করতো। একের পর এক দিন রাত্রি আসবে যাবে এমন কি দরকার ছিল?

শিগগীরই আসছে পরবর্তি পর্ব।

No comments:

Post a Comment

Thank you very much for your comments.