Tuesday 4 December 2012

নক্ষত্রের গোধূলি-৫১ [অধ্যায় ৫]

পূর্ব সূত্রঃ নক্ষত্রের গোধূলি, পর্ব -৫০ [অধ্যায় ৫]
এখানে মনি নেই, কে লেপ উঠিয়ে দিবে? তাই, দুইটা লেপ একত্রে সেলাই করে এক পাশে আর পায়ের দিকে বিছানার ম্যাট্রেসের সাথে ফিতা বানিয়ে বেধে নিয়েছিলেন যাতে পড়ে না যায়। মালিকের ইলেকট্রিক আর গ্যাস বিল বাঁচাবার জন্য হিটার চালানো হয়না। তবে
স্কটল্যান্ডের সবচেয়ে ভালো যেটা রাশেদ সাহেব দেখেছেন তা হোল পানি, এখানকার পানি অতি সুস্বাদু। প্রথম বারে পানি খেয়েই ভেবেছেন এই জন্যেই মনে হয় স্কটল্যান্ডের স্কচ পৃথিবীর বিখ্যাত হুইস্কি।

ক্রিস্টমাসের আর মাত্র দুই সপ্তাহ বাকি। চারিদিকে আনন্দের বন্যা বইছে। যে যত বেশি সুরা পান করতে পারে সেই তত আনন্দ করতে পারে। বিয়ার, বিটার এল, সাইডার, হোয়াইট ওয়াইন, রেড ওয়াইন, রোজ ওয়াইন, আরচার্স, মালিবু, টাবু, ভোদকা, জিন, হুইস্কি, ব্রান্ডি, রাম, পিমস, বেইলিজ, কোইন্ট্রু, টিয়ামারিয়া এছাড়া নানান রকমের ককটেল। এইই না শুধু, এগুলিরও আবার প্রস্তুতকারী দেশ, এলকোহলের মাত্রা ও ব্র্যান্ড অনুযায়ী হরেক প্রকার আছে। যেমন: হোয়াইট ওয়াইনের মধ্যে সেনিন ব্ল্যাংক, স্যারডোনি আবার রেড ওয়াইনের শিরাজ ক্যাবারনেট, সিগলো, কিয়ান্তি ইত্যাদি, এছাড়া বিভিন্ন দেশের যেমন ইটালি, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা, ফ্রান্স, চিলি, পেরু। তবে হুইস্কি যারা খায় তার সাধারণত স্কচ ছারা আর কিছু চায় না। অল্প বয়সের মেয়েরা বিয়ার এবং কোন বিশেষ সময়ে আরচার্স, মালিবু, টাবু এসব খেয়ে থাকে তবে মাঝে মাঝে রোজ ওয়াইনও পছন্দ করে। বয়স্ক লোকেরা বিটার বা এল পছন্দ করে আবার মহিলারা সাদা ওয়াইন কিংবা তার সাথে সোডা ওয়াটার মিশিয়ে স্পিতজা কিংবা অরেঞ্জ জুসের সাথে ভোদকা পছন্দ করে।

প্রেমিক আর প্রেমিকা এক সাথে এলে খাবার পরে এরা চায় সামবুকা। সামবুকা সার্ভ করার ভিন্ন ছোট্ট গ্লাস আছে, তাতে সা্মবুকা ভরে রোমাঞ্চের প্রতীক তিনটা কফি বীজ ছেড়ে দিয়ে উপরে আগুন জ্বেলে টেবিলে দিতে হয়। সামবুকার উপর ভাসতে থাকা কফি বীজ সহ নীল আগুনের হালকা শিখা জ্বলতে থাকে। ফু দিয়ে আগুনটা নিভিয়ে এক চুমুকে খেয়ে ফেলে কফি বীজগুলি ফেলে দেয়। খাবার পরে ব্রান্ডি চাইলে একটু গরম করে সার্ভ করে। আবার খাবার আগে চাইলে তা সাধারণ তাপের হবে সাথে বরফের কিউব। এরপর আসে শ্যাম্পেন। শ্যাম্পেন হল নামি এবং দামী বনেদি পানীয়। বিশেষ কোন উৎসব আনন্দেই এর ব্যবহার। এটাও একধরনের সাদা ওয়াইন তবে সাধারণ সাদা ওয়াইনের চেয়ে অনেক দামী। খানিকটা কার্বোনেটেড। এক বোতল শ্যাম্পেন ষোল পাউন্ড থেকে দুইশ পাউন্ড পর্যন্ত যার দাম। আবার আছে লিকার কফি। কফির সাথে হুইস্কি মিশিয়ে কড়া করে চিনি সহ গুলিয়ে উপরে ক্রিম ছড়িয়ে দেয় তবে এই ক্রিম কফির সাথে গুলে যায় না উপরে ভাষতে থাকে এর নাম আইরিশ কফি, এর সাথে চকলেট জাতিয় একটা কিছু সার্ভ করে। এই রকম ব্রান্ডি দিয়ে যা হয় সেটা হোল ফ্রেঞ্চ কফি, টিয়া মারিয়ার সাথে হলে নাম হবে ক্যারিবিয়ান কফি। টেবিলে যেমন খাবার উচ্ছিষ্ট হয় তেমন মদও উচ্ছিষ্ট হচ্ছে, তা এনে সিঙ্কে ঢেলে ফেলতে হচ্ছে। গ্লাসে ঢালার সময় কত মদ যে ছিটে এসে হাতে, শরীরে, কাপরে লাগছে তা খেয়াল করা সম্ভব হয়না। সমস্ত শরীর দিয়ে মদের গন্ধ হয়ে যেত। কত হাজার প্রকারের যে মদ আছে, মদ পানের যে কত প্রক্রিয়া আছে আর তা পরিবেশনের জন্য কত গ্লাস আছে তা রাশেদ সাহেব আগে দেখেনি, ভাবতেও পারেনি। এখানে এই সব দেখে তার মনে হচ্ছে শুধু মদ আর মদ পানের ধরনের বিষয় নিয়ে একটা বিশাল বই হতে পারে। সারা জীবন মদের মধ্যে ডুবে থেকেও মদ চেনা এবং জানা কঠিন ব্যাপার।

যার যা খুশি পান করছে, মাতলামি করছে, মারামারি করছে, মারছে মরছে। সিসি ক্যেমেরার কন্ট্রোল রুমে ডিউটি কঠিন হচ্ছে, পুলিশের টহল বাড়ছে, রাস্তা দিয়ে ঘন ঘন এম্বুলেন্সের সাইরেন শোনা যাচ্ছে। দেশ জুড়ে আনন্দ হচ্ছে, আনন্দের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। এইরকম এক দিন দুপুরে হালকা স্নো হচ্ছে রাশেদ সাহেব এসে সবে মাত্র সকালের কাজ সেরে ওই পাশের দেয়ালের সাথে হিটার অন করে ঘুরে দাঁড়িয়েছে অমনি দেখে দরজায় পুলিশ দাঁড়ানো। কি ব্যাপার? ভয় পেয়ে গেলেন। কিন্তু, ভয় পেলে তো চলবে না, বুকে দুরু দুরু নিয়েই এগিয়ে এসে গুড আফটার নুন স্যার। কি ভাবে তোমাকে সাহায্য করতে পারি?তুমি কি কিছু খেতে এসেছ, ভিতরে বসবে?না না আমি কিছু খেতে আসিনি এবং তোমাকে বিরক্ত করার জন্য আমি দুঃখিত। আমি এসেছি তোমার কাছে একটা ইনফরমেশন নিতে। কি ইনফরমেশন বল। তোমাদের এখানে কি রাতে চুরি হয়েছে?না আমাদের এখানে তো তেমন কিছু হয়নি। আচ্ছা এটা কি ওই রেস্টুরেন্ট?বলে একটা রেস্টুরেন্টের নাম বলল। না না, এটা ওটা না, তবে তুমি যেটা খুঁজছ সেটা আমি চিনি, আস আমার সাথে। বলে বাইরে গিয়ে দেখিয়ে দিল ওই যে সামনে বাম পাশে দেখছ ওইটা। ও, আমি দুঃখিত তোমাকে বিরক্ত করার জন্য, তোমাকে অনেক ধন্যবাদ বলে পুলিশ চলে গেল আর রাশেদ সাহেব হাফ ছেড়ে বাঁচলেন।

ভিতরে এসে একটু বসেছেন এমন সময় উসকো খুসকো চুল, লাল চোখ, এলো মেলো পোশাক, ভারতীয় চেহারার এক চব্বিশ পঁচিশ বছর বয়সী কিছুটা অপ্রকৃতিস্থ এক ছেলে দরজা দিয়ে ঢুকে পড়লো। রাশেদ সাহেব উঠে আসার আগেই ঝড়ের বেগে সরাসরি রাশেদ সাহেবের সামনে দাড়িয়ে, হু আর ইউ? চেনা নেই, জানা নেই হঠাত এই আক্রমণাত্মক প্রশ্ন শুনে একটু ঘাবড়ে গেলেন। যতটা না ভয় পেয়েছিলেন পুলিশ দেখে তার চেয়ে বেশি। আমি রাশেদ এখানকার ওয়েটার। বরাবর স্কটিশ ইংরেজিতেই বলে যাচ্ছে ছেলেটা। তা তুমি এখানে বসে আছ কেন?কক্ষনো এভাবে বসবে না। এটা বসার জায়গা না, ডিউটি টাইমে বসবে না। স্কটিশ ভঙ্গিতে আরও কি কি যেন বলল রাশেদ সাহেব কিছু বুঝলেন কিছু বুঝলেন না। তবে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে কি করবেন কিছু বুঝে উঠতে পারলেন না। এই ছেলেই বা কে তাও বুঝলেন না, দাড়িয়েই রইলেন। রাশেদ সাহেবকে ঝাড়ি দিয়ে সে ছেলে কিচেনে ঢুকল। দশ পনের মিনিট পর একটা টেকএওয়ের প্যাকেট হাতে বের হয়ে বাইরে রাস্তার পাশে রাখা একটা গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চলে গেল।
ছেলেটা চলে যাবার পর রাশেদ সাহেব কিচেনে ঢুকে দেলুকে জিগ্যেস করলো যে
এসেছিলো সে কে?
আরে বলবেন না মালিকের ছেলে।
মালিকের ছেলে?
হ্যাঁ।
এরকম কেন?
লজ্জার কথা, কি ভাবে বলি।

কিছুক্ষণ ইতস্তত করে বলল,
আগে এ ছেলে ভালোই ছিল। ডান্ডি ইউনিভার্সিটিতে পড়াশুনা করতো। যতদিন মা এখানে ছিল তত দিন ভালো ছিল, মা লন্ডন চলে যাবার পর আজে বাজে সংস্পর্শে মিশে এখন এডিক্টেড হয়ে পরেছে। কিছু দিন আগে টাকা চাইতে এসেছিলো, বাবা দিতে চায়নি তাই কিচেনের ছুড়ি নিয়ে বাবাকে মারতে উঠেছিলো। আমি কোন রকম ধরে ঠেকিয়েছি।
এই হোল এই দেশের অবস্থা, অধিকাংশই এইরকম, এতো তবুও ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত গেছে, বেশির ভাগ স্কুল পর্যন্তই শেষ, তারপর বাবার ব্যবসা কিংবা সরকারি ভাতা, এই হল এখানকার জীবন। আবার অনেক আছে যারা স্কুলও শেষ করেনা। এদের কথা হল, লেখাপড়া করে কি হবে? আমি লেখা পড়া না করে ইতো জাগুয়ার, মার্সিডিজ কিংবা বিএমডব্লিউ গাড়ি চালাচ্ছি, তো লেখা পড়া করা এমন কি প্রয়োজন? বাংলাদেশে বড় বড় ডিগ্রি নিয়ে কয়জন লোক গাড়ি চালায়? তারাতো দেখি বাস নয়তো রিকশায় চলাফেরা করে, আমাদের এখানে এসে আমাদের রেস্টুরেন্টে কাজ করে। এখন বলেন তার দাম বেশি নাকি আমার দাম বেশি?লেখাপড়া করা মানে বেহুদা সময় নষ্ট করা। শুনে রাশেদ সাহেব স্তম্ভিত হয়ে গেলেন, এই কি আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম?আমরা যাদের দিকে তাকিয়ে আছি, এরাই কি তারা?ধীরে ধীরে পৃথিবী বদলে যাচ্ছে। না ভুল হোল, পৃথিবী বদলাচ্ছে না। বদলাচ্ছে মান মর্যাদা, সন্মান, ন্যায় নিতি, লজ্জা, মূল্যবোধের সংজ্ঞার ধরন প্রকৃতি, কৃতিত্বের সুখ বোধ, সৃষ্টিসুখের আনন্দ এবং নির্ভেজালের প্রকৃত স্বাদ।

আধুনিক হয়ে জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চা করে মানুষ উন্নত হচ্ছে না কি হচ্ছে? কোন আধুনিক কি চিরস্থায়ী?আজ যেটা আধুনিক কিছু দিন পরেই তো সেটা সেকেলে হয়ে যাচ্ছে। আবার তখন যারা নিজেকে আধুনিক ভাবছে সেই তো আবার তার সন্তানের কাছে সেকেলে হচ্ছে। যেমন আমি যখন আমার মা বাবার কাছে আধুনিক ছিলাম বাড়িতে যখন কোন নতুন যন্ত্রপাতি কেনা হত বাবা আমাকে দেখাতেন দেখত এটা কি ভাবে চালাতে হবে। আর আজ সেই আমাকে ক্লাস ফাইভে পড়া আমার নিজের মেয়ের কাছে কম্পিউটার শিখতে হয়েছে। কি দাঁড়াচ্ছে শেষ পর্যন্ত?কোথায় চলেছি আমরা?বাবা যেমন বলেছেন আমরা তোমাদেরকে যেভাবে মানুষ করেছি তোমরা তোমাদের সন্তানদের সে ভাবে মানুষ করতে পারবেনা। তাই বলে মানুষের বোধ শক্তি গুলি এভাবে পরিবর্তন হচ্ছে কেন? কই, শীত গরম, স্পর্শ আঘাত এগুলির বোধের তো কোন পরিবর্তন হচ্ছেনা। তবে যা দিয়ে আমরা সৃষ্টির সেরা বলে দাবি করি, নিজেকে পশু নয় মানুষ বলে দাবি করি সেই অনুভূতি গুলি পরিবর্তন হচ্ছে। হতে পারে, মানুষের চাহিদা রুচি পরিবর্তন হতে পারে। কিন্তু, ধ্যান ধারনা, মানসিকতা, প্রবৃত্তি কেন পরিবর্তন হচ্ছে?

শহরের কথা না হয় নাই বা ধরলাম মানুষের প্রয়োজনে শহর খুব দ্রুত রূপ বদলায়। আমার গ্রামে যেখানে ইছামতী নদী বয়ে যাচ্ছে, নয়াবাড়ির তালগাছটা এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে, গ্রাম গুলি সেই ভাবে ছড়িয়ে আছে, গ্রামের হালট বা সড়ক গুলি সেই ভাবে বিছানো রয়েছে যে ভাবে আমার দাদা দেখেছেন, আমার বাবা দেখেছেন, আমি দেখছি আমার সন্তানেরা দেখবে। যে নদীর পাড় দিয়ে হেটে আমার দাদা পাঠশালায় গেছেন আমিও সেই নদীর পাড় দিয়ে হেটে স্কুলে গেছি। যে গাছের তাল কুড়িয়ে এনে আমার দাদা আমার দাদির হাতে দিয়েছে আমিও সেই গাছের তাল কুড়িয়ে এনে আমার স্ত্রীর হাতে দিয়ে পিঠা বানাতে বলেছি। আমার দাদা কিংবা তার দাদা গ্রামের যে হালট দিয়ে হেটে ঝিটকা হাট থেকে ইলিশ মাছ কিনে এনেছেন আমার বাবাও তাই করেছেন আমিও তাই করছি, সেই গ্রাম সেই নদী সেই হালট। বৈশাখের হিজল বকুলের গন্ধ, ঝড়ে আম কুড়ানো, জ্যৈষ্ঠের আম পাকা ভ্যাপসা গরম, আষাঢ়ের ঢল, শ্রাবণের ধারা, কার্তিকের জলজ উদ্ভিদ পচা গন্ধ, অঘ্রানের নতুন ধানের গন্ধ, মাঘের হাড় কাঁপানো শীতে রাতের পিঠা, ফাল্গুনের আম বাগান তলার দখিনা সমীরণ, গাছে গাছে নতুন পাতার কুড়ি, নতুন ফুলের ঘ্রাণ, চৈত্রের সেই কাঠ ফাটা রোদে বুকের ছাতি ফাটা তেষ্টা এর তো কিছুই বদলায়নি।
আমরা বদলে গেছি। আমার সন্তানেরা আজ তালের পিঠা চায় না, নারকেলের লাড়ু চায় না। তারা ক্যাডবেরি, বার্গার, পিজা, ইগলু আর ম্যাকডোনাল খুঁজে। ডাব কিংবা ঘোলের পরিবর্তে চায় কোক। পাঁচ টাকা দিয়ে আড়াই শ এমএল দুধ না খেয়ে দশ টাকায় এক বোতল কোক বা পেপসি খাবে । এটা হতে পারে, অভ্যাস গত রুচির কারণে। পরিবর্তন এটুকের মধ্যেই সীমিত থাকলে যথেষ্ট হতে পারতো। তা না হয়ে এসব কি হচ্ছে?

রাশেদ সাহেবের সাথেই থাকুন আর দেখুন রাশেদ সাহেব কোথায় কি করে! তাকে যে অনেক দূরে এগিয়ে যেতে হবে!

No comments:

Post a Comment

Thank you very much for your comments.