Friday 16 November 2012

সাগর তলে রূপনগর-২[২]



Photobucket
(ছবিঃ তাসমিনা খালিদ, আমার ছোট মেয়ে। গত শীতে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে যাবার পথে) )

[পূর্ব প্রকাশের পর]
ডিঙ্গিতে নেমে পিঠের অক্সিজেনের টিউব, পায়ের ফিনস, হাতের গ্লোভস, ডাইভার্স নাইফ, পানি রোধক চশমা সব কিছু
ঠিক আছে কি না দেখে ডিঙ্গির পাশে বসে পিছনে তাকিয়ে ইশারা দিয়ে ঝুপ করে নেমে গেলাম। নিচে সাগর তলে এগিয়ে যাচ্ছি। সাঁতরে সাঁতরে পাহাড়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি আর নিচে নামছি। কত রকমের মাছ আশেপাশে দিয়ে আসছে যাচ্ছে। কেউ একটু কৌতূহল নিয়ে এগিয়ে আসতে
চাইছে। এরা আবার কারা এলো আমাদের এই স্বর্গ রাজ্যে? এমন একটা ভাব। একটু কাছে এসে ভাল করে দেখে সুরুত করে দিক বদলে চলে যাচ্ছে। নিচে নেমে এসেছি। এবার আর সাঁতার নয় হাঁটছি। পানিতে সাঁতরানো যত সহজ হাঁটা ততটাই কঠিন। হাঁটছি আর দেখছি। ফিনস পরা পায়ের নীচে পাথুরে তল বলে হাঁটা যাচ্ছে না লাফিয়ে সাঁতারের মত করে এগুচ্ছি। ভয় ভয় লাগছে কিন্তু দুর্বার কৌতূহলের কাছে এই ভয় কিছুই নয়।
কত রকমের প্রবাল, মাছ, নানা রকম সামুদ্রিক উদ্ভিদ, বিভিন্ন প্রাণী এর কিছুই আগে দেখিনি। একটা ঝোপের মত মনে হচ্ছে প্রায় মানুষের সমান উঁচু। প্রবাল ঝোপ হবে নিশ্চয়! মার্কিকে খোঁচা দিয়ে ইশারা করলাম চিনেছ? ও তেমনি হাত নেড়ে নিষেধ করল। কি এটা? দেখতে হবে। কাছে গেলাম। নিচে থেকে ঝাঁক ঝাঁক ছোট ছোট সার্ডিন মাছ বের হয়ে গেল। আরো কত কি মাটি ঘেঁষে বসে ছিল তারা সবাই সুরুত সুরুত করে এদিক ওদিক চলে গেল। অবাক হয়ে দেখছি। কত রকমের রঙ্গিন মাছ। অদ্ভুত সব কারুকাজ তাদের গায়ে। লাল, কাল, ধবধবে সাদা, লাল কাল ডোরা কাটা, হলুদের মাঝে সাদা বা কালো ডোরা। কত যে রঙের বাহার তা আমাদের দেশের কাটা বনের একুরিয়ামের মাছের বাজারেও নেই। বিশাল ফিনস, গায়ের চেয়ে ফিনস বড়, বিশাল। কাকচি মাছের চেয়েও ছোট এক রকম মাছের ঝাঁক। সবাই মনের আনন্দে নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মনে হচ্ছে এখানে হাঙ্গর বা ছোট ছোট মাছ খেয়ে ফেলে এমন কেউ নেই তাই এরা এত স্বাধীন। এক রকম ছোট্ট মাছ দেখলাম ঝাঁকে ঝাঁকে সাঁতরে বেড়াচ্ছে যাদের শরীরের এ পাশ থেকে ও পাশ ভেদ করে পানি দেখা যাচ্ছে, কোন রঙ নেই। গায়ের ভিতরে শুধু লাল কিছু রক্তের সরু অস্তিত্ব দেখা যাচ্ছে। সাগর তলের বিছানায় কত রকমের স্টার ফিশ সহ আরো কত নাম না জানা প্রাণী নিশ্চিন্তে শুয়ে আছে। আমাদের সারা পেয়ে ঝট পট এদিক ওদিক নিরাপদ দুরত্বে চলে গেল। একটা প্রবাল ধরে তুলে দেখলাম আমদের কক্সবাজারের দোকানে যেমন দেখা যায় তেমন নয় মোটেই। বিশ্রী শেওলা জড়ান। পানির হালকা স্রোতে শেওলা গুলি একটা ছন্দ তুলে দুলছে। নানা রকম নানা রঙের লতা পাতা স্রোতে দুলছে। এ যেন স্বর্গ রাজ্যের রূপনগর। পানির নিচে এত সুন্দর সে তো শুধু এত দিন টেলিভিশনের পর্দায় দেখেছি কিন্তু আজ নিজে চোখে দেখেও বিশ্বাস হতে চাইছে না। অথচ নিজের চোখকে কি করেইবা অবিশ্বাস করি? আস্তে আস্তে কিনারার দিকে অর্থাৎ পাহাড়ের নিচে যেতে চাইছি এমন সময় মার্কির পায়ের ছোঁয়া লেগে ঝোপের বেশ খানিকটা ভেঙ্গে গেল। পিছনে ঘুড়ে উঠিয়ে হাতে নিলাম। আরে এত প্রবাল! প্রবালের এত বড় ঝোপ? সারি সারি অনেক। হাতে নিয়ে শেওলা সরিয়ে দেখি এগুলি সাদা নয় ভিন্ন রঙ, একটু লালচে ধরনের। দেখতে দেখতে নানা ঝোপ ঝার পার হয়ে একটু দূরে লক্ষ্য করলাম অন্ধকার মনে হচ্ছে। থমকে দাঁড়ালাম। মার্কি ইশারা করল। কি হয়েছে? ওকে ওই অন্ধকার দেখিয়ে বোঝালাম। ইশারায় বলল ওটা পাহাড়ের নিচের দিক।
তাই নাকি?
 
আরো একটু ভয় ভয় নিয়ে আবার এগিয়ে যাচ্ছি। দুই জনের কোমরে দুইটা আলাদা রশি বাধা। রশির আরেক মাথা ধরে জাহাজের ডেকে দুই জনে সজাগ রয়েছে কোন রকম একটু সিগন্যাল পেলেই টেনে জাহাজের দিকে নিয়ে যাবে। আবার এদিকে দুই জনের সাথে আলাদা যে রশি দুই জনকে বেধে রেখেছে যেন দুই জন একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে না যায়। স্রোত বা অন্য কোন উপায়ে বিচ্ছিন্ন না হতে পারে। এগিয়ে যাচ্ছি আর এই রূপনগরের রূপ দেখে বিস্মিত হচ্ছি। মাটির পৃথিবী এবং সাগর তলের পৃথিবীর মধ্যে যে কত তফাত তা আজ এখানে না এলে কোন দিন জানা হত না। পানির নিচেও বাগান, বন জঙ্গল, নানা জাতের নানা ধরনের প্রাণী রয়েছে। অবশ্য সব প্রাণী যে নিরীহ বা হিংস্র নয় তা আমরা জানি। এখানেও ভয়ঙ্কর, হিংস্র বা বিষাক্ত বিভিন্ন প্রাণীও বাস করে। এ নিয়ে তেমন আনন্দিত বা দু;খিত হবার কিছু নেই।
পাহাড়ের যতই কাছে যাচ্ছি ততই কেমন যেন গা ছম ছম করা একটা ভাব হচ্ছিল। ভয়ের মাত্রা বেড়েই যাচ্ছিল, কিছুতেই সামাল দেয়া যাচ্ছিল না। বারবার হাতের ডাইভিং নাইফ এবং রশির অস্তিত্ব ঠিক আছে কিনা পরখ করছিলাম। কিছু হলেই যাতে জাহাজে সংকেত পাঠাতে পারি নিজেকে সেই ভাবেই রেডি রাখছিলাম। যদিও জানি হাতে যে ছুড়ি আছে ওটা দিয়ে হাঙ্গর বা তেমন কোন সামুদ্রিক হিংস্র মহাশয়কে কাবু করা অন্তত আমার পক্ষে সম্ভব নয় তবুও হাতে রাখা। তবে মার্কি কি ভয় পাচ্ছিল না কি স্বাভাবিক ছিল তা আর জিজ্ঞাসা করিনি। আমি বুদ্ধি করে ওর পিছনেই থাকছি। এর মধ্যে জাহাজের তলা থেকে প্রায় দুইশত মিটার চলে এসেছি। আসার সময় জাহাজের নোঙ্গর দেখেছি। একটা শেওলা জড়ান বিশাল পাথরের ফাকে আট্‌কে আছে।

এগিয়ে যাচ্ছি আর এই নতুন দেখা রূপনগরের রূপের শোভা দেখছি। এক সময় পাহাড়ের নিচে এসে পৌঁছলাম। এতক্ষণ আর কি দেখেছি? এখানে আরও সুন্দর। অসম্ভব রকমের সুন্দর। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি মাটির উপরে এমন কোন সাজানো বাগান নেই যা এখানকার চেয়ে সুন্দর। কিন্তু কথা হচ্ছে এই বাগানের মালী কোথায়? পানির উপর থেকে সূর্যের আলো এসে যেন সমস্ত বাগান আলোকিত করে রেখেছে। এখানেই এত সুন্দর তাহলে লিটল কুইন এবং লার্জ কুইনের নিচে বা বন্দর আব্বাসের পূর্ব দিকে সমুদ্রের পাড়ে যেখানে পাহাড় সাম্রাজ্য বিস্তার শেষ করে সাগরে মিশেছে সেখানে কেমন হবে? ভাবনার সাগরে ডুবে আবার কোথায় হারিয়ে গেলাম জানি না। হঠাৎ মার্কির সাথে ধাক্কা লেগে থেমে গেলাম। অক্সিজেনের মিটারের দিকে চেয়ে দেখি প্রেসার যথেষ্ট আছে। মার্কি দাঁড়িয়ে পরেছে। কি ব্যাপার? ও তখন সামনে একটু বাম দিকে দেখিয়ে দিল। দেখে আমার হৃৎপিণ্ড থেমে গেল শ্বাস নিতে ভুলে গেছি।
বিশাল একটা কি যেন আশেপাশের সব কিছু নিতান্ত তাচ্ছিল্য ভরে মুখ হা করে এগিয়ে আসছে আর তার চার দিকে নানা আকৃতির নানা প্রজাতির মাছ ঘুর ঘুর করছে। কেউ কেউ আবার ওটার গায়ে জমা শেওলা ঠুক্‌রে ঠুক্‌রে খাচ্ছে। ওটা হাঙ্গর নয় চিনতে পেরেছি কারণ হাঙ্গর হলে এই এত গুলি মাছ ওর কাছে থাকার সাহস পেত না। প্রাণীটা যে হিংস্র নয় তা তার চলা ফেরা এবং তার সঙ্গীদের দেখেই বুঝতে পারছি। মাঝে মাঝে ওটা নিজেও আসে পাশের গাছ পালা, লতাপাতা মুখে দিয়ে এবং পাথর আর প্রবাল থেকে একটু আধটু শেওলা চেখে দেখার ভাব করছিল। ওটার আকার প্রায় পাঁচ ছয় মিটার ব্যাসের একটা গোলাকার চাকতির মত, পিছনে প্রায় তিন মিটার লম্বা চিকন লেজ, সামনের অর্ধেকটাই প্রায় মুখ আর পিঠে উপরে ত্রিকোণাকৃতির আইর মাছের মত একটা প্রায় দুই মিটার উচ্চতার কাটা, মুখের দুই পাশে চার পাঁচটা কুলার আকারের ফিনস। সারা গায়ে সবুজ শেওলা জমে রয়েছে আসল রঙ বোঝা যাচ্ছে না।

দেখে ভয়ংকর দর্শন মনে হলেও মোটেও হিংস্র মনে হচ্ছে না। তবুও অচেনা মহাজন বলে মন থেকে ভয় দূর করতে পারছি না। কি করব?মার্কি ইশারা করে বোঝাল এখানেই চুপ করে দাঁড়িয়ে থাক, কোন নড়াচড়া করবে না। এমন বিকট এবং ভীষণ দর্শনের কোন প্রাণী দেখা তো দূরের কথা কোন দিন ছবিও দেখিনি। যাক, আমরা দুই জনেই চুপ করে নিশ্বাস প্রায় বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। শুধু মাত্র অক্সিজেনের বোতল থেকে শ্বাস নেয়ার পর বুদ বুদ বের হচ্ছে অথচ রূপনগরের মহাজন সে দিকে ভ্রুক্ষেপ না করেই আস্তে আস্তে আমাদের কয়েক মিটার সামনে দিয়ে যেমন গতিতে আসছিল তেমনি গজেন্দ্র গতিতে তার হেলাফেলা ভাব নিয়ে চলে গেল । সামনে দিয়ে যাবার সময় লক্ষ করলাম উনার চোখ মাত্র একটা। মুখের সামনের দিকে একটু উপরে এবং গোলাকার পাতা সহ। মানে উনি চোখ বুজে ঘুমাতে পারেন।
আমাদের ছেড়ে কিছু দূর যাবার পরেই মার্কির হাতে চিমটি দিয়ে ইশারা করে হাতের ঘড়ি দেখালাম আধা ঘন্টার বেশি হয়ে গেছে। চল যথেষ্ট হয়েছে, আর না। রশিতে টান দিয়ে জাহাজে সংকেত পাঠিয়ে যে পথে এসেছিলাম সেই পথে যাবার জন্য উপরে ভেসে উঠলাম। আর আমাদের দেখা মাত্র জাহাজ থেকে যারা আমাদের পাহারায় ছিল ওরা রশি টেনে আমাদেরকে জাহাজে ফিরিয়ে নিয়ে এলো।

*** আমাদের এই সুন্দর দেশের জন্য কিছু রেখে যেতে হবে আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই।

No comments:

Post a Comment

Thank you very much for your comments.