Thursday 15 November 2012

বিলাতের সাত সতের [২-৯]

[পূর্ব প্রকাশের পর]
সারাটা দিন একটা কেমন যেন ছটফট ভাবের মধ্যে গেল। কত গুলি দিন পরে খুকুকে দেখতে পাব। কেমন যেন এক মিশ্র অনুভুতি। ওর আসার সম্ভাবনা না হলে হয় তো এমন লাগত না, মনে জমে থাকা কিছু দুঃখ, আনন্দ, অস্থিরতা
এবং মায়া সব কিছু মিলে মিশে কেমন যেন ভাব। ওর জন্য কেনা সব জিনিস পত্র আগে থেকে প্রায় গুছানো ছিল তার পরেও বার বার নামিয়ে দেখছি কিছু ভুলে ফেলে যাচ্ছি নাকি। ফেলে গেলেই আবার লন্ডন থেকে কিনে নিতে হবে। এতো দূর যেতে আসতেই ২০/২৫ ঘন্টা লেগে যায়। একটা ফর্দ করে রেখেছিলাম সে ফর্দটা খুঁজে পাচ্ছি না। কোথায় যে রেখেছি কিছুতেই মনে হচ্ছে না। দুপুরে খাবার কথা ভুলে গেছি। সারা দিন ভরে এই করছি। হঠাত্ মনে হল যাবার টিকিটটা দেখি ঠিক আছে নাকি।
হুকে ঝুলিয়ে রাখা প্যান্টের পকেট থেকে ওয়ালেট বের করে দেখলাম, এইতো টিকেট রয়েছে। ওহ! এই যে টিকিটের ভেতরেই সেই ফর্দ। মনে করেই রেখেছিলাম, টিকেট আর এটা এক সাথে থাকলে হারাবার সুযোগ থাকবে না। অথচ সময় মত ভুলে বসে আছি। যাক বের করে আবার মিলিয়ে দেখলাম, হ্যা সবই ঠিক আছে যা যা কিনেছি। ওভার কোট, গরম হ্যান্ড গ্লভস, গরম মুজা, থার্মাল ইনার, কিছু হাড়ি পাতিল, বাসন পেয়ালা, গ্লাস, কাপ, বিছানার চাদর থেকে বালিশের কভার, ২/৩টা নানা সাইজের তোয়ালে, পায়ের স্যান্ডেল, একটা মোবাইল ফোন এই সব। স্যুটকেস গুছিয়ে রেখে একটু চা খাবার জন্য কিচেনে গেলাম। ইলেক্ট্রিক জগে পানি ভরে সুইচ অন করার পর মনে হোল আমি তো দুপুরে কিছু খাইনি। থাক এখন চা খেতে হবে না আগে কিছু খেয়ে নিই পরে চা খাই। বিকেল চারটা বেজে গেছে। রাত ১০টায় কোচ। বাসা থেকে ৯টায় বের হলেই হবে। মিনিট পাঁচেক হেঁটেই মেট্রো ট্রেনে নিউক্যাসেল সেন্ট্রাল রেল স্টেশনে নেমে গেট দিয়ে বের হলেই সামনে নেভিল স্ট্রিটে মেগা বাস দাঁড়িয়ে থাকে। আবার কিচেনের জানালা দিয়ে বাইরে দেখলাম, না আর স্নো পরছে না।
খাবার কথা মনে না থাকায় কিছু বানানো হয় নি। এখন খাবার কথা মনে হতেই মনে হচ্ছে ক্ষুধায় শরীর কাঁপছে, এখন আর কিছু বানাবার সময় নেই। ফ্রিজ খুলে দেখি এক্ষুণি খাবার মত কিছু নেই। আবার ঘরে গিয়ে প্যান্ট পরে জুতা পায়ে দিয়ে গায়ে কোন রকম জ্যাকেটটা চাপিয়ে বের হলাম পাশের কাশ্মীরি কাবাবের দোকানে দেখি কিছু পাই কিনা। ফুটপাথে জমা কদিনের স্নো জমে বরফ হয়ে গেছে তার উপর দিয়ে সাবধানে হেটে দোকান পর্যন্ত পৌঁছলাম। এক প্যাকেট সাদা ভাত আর এক প্যাকেট ভেড়ার মাংশের কারি নিয়ে আবার পা টিপে টিপে বাসায় এসে খেয়ে নিলাম। খেয়ে চা বানিয়ে এনে বসলাম সকালের ওই টেবিলে। পর্দা সরানোই ছিল। টেবিলের উপর চায়ের কাপ রেখে বসলাম দৃষ্টি চলে গেল সেই দূরে যেখানে সকালে খুকু আর তার মাকে দেখেছিলাম সেখানে। চা শেষ করে অনেকক্ষণ বসেই রইলাম।
রাত ঠিক ৯টায় খুকুর স্যুটকেস আর আমার নিজের ২/১টা কাপড় চোপড়ের ব্যাগ নিয়ে বের হলাম মনে করে এক বোতল পানি নিয়ে নিয়েছি ব্যাগে, নয় তো আবার দুই পাউন্ড দিয়ে কিনতে হবে। বরফের উপর দিয়ে স্যুটকেস টেনে নিয়ে যেতে বেশ কষ্ট হল মনে হচ্ছিল যেন ঘেমে যাচ্ছি। কিন্তু কন্যার মুখ দেখার, তার সান্নিধ্য পাবার আনন্দে সে কষ্ট গায়ে লাগছিল না। সাধারনত মেট্রো স্টেশনে আসতে যে সময় লাগে আজ তার চেয়ে কিছু বেশি লাগল। এতো রাতে টিকেট কাউন্টার খোলা থাকে না। মেশিন থেকে টিকেট নিলাম, সেন্ট্রাল স্টেশনে যাবার বোতামে চাপ দিয়ে পাচ পাউন্ডের নোট দিলাম আর বিলাতের শিক্ষিত মেশিন সাহেব ভাড়া বাবদ দুই পাউন্ড ত্রিশ পেনি রেখে টিকেট বের হবার নির্দিষ্ট জায়গায় টিকেট এবং ভিন্ন একটা পকেট থেকে দুই পাউন্ডের একটা কয়েন আর পঞ্চাশ পেনি এবং বিশ পেনির একটা কয়েন মিলিয়ে দুই পাউন্ড সত্তর পেনি ফেরত দিয়ে দিল। ওগুলি পকেটে নিয়ে ট্রেনে বসলাম। তবুও কোচ ছাড়ার বেশ আগেই পৌছে গেলাম এখনো ১৫ মিনিট বাকি আছে। স্টেশনের বাইরে এসে দেখি নেভিল স্ট্রিটে কোচ দাঁড়িয়ে আছে। ড্রাইভারকে টিকেট দেখাতে সে স্যুটকেস নিয়ে নিচের লাগেজ কম্পার্টমেন্টে রেখে দিল আমি রাতের খাবার কিনে নেয়ার জন্য রাস্তার ওপাশে একটা পাবে ঢুকলাম। দুইটা স্যান্ডউইচ আর কি কি যেন নিয়ে এসে কোচের ভিতরে যেয়ে বসলাম। বেশি কিছু নিলাম না কারন নিশ্চয়ই পথে মোটর ওয়ের পাশে কোন সার্ভিস স্টেশনে থামবে ওখান থেকে কিছু কিনে নিলেই হবে। পুরো কোচ প্রায় খালি বলতে হয়। মাত্র ৩/৪ জন যাত্রি নিয়ে এই কোচ লন্ডন যাবে। সময় হতেই ড্রাইভার যাত্রি গুনে নিয়ে লন্ডনের পথে ছেড়ে দিল।
ফোন বের করে ফিরোজকে ফোন করলাম।
কি খবর কলিম, তোমাদের স্নো কমেছে?
হ্যা ফিরোজ কোচ এই মাত্র ছাড়ল।
লন্ডন পৌঁছাবে কখন?
সকাল ৮টায়, আমি ওখানে পৌছে আগে আরিফের বাসায় যাব শারমিনের বাসা চিনে নেয়ার জন্য, নয়ত ওকে সাথে নিয়ে মালামাল সহ খোজা খুঁজি ঝামেলা হবে।
হ্যা ঠিক আছে তাই ভাল হবে, আমার এখানে আসবে না?
যদি সময় থাকে তা হলে আসব না হলে কাল বা পরশু ওকে নিয়ে একবারে আসব।
আচ্ছা ঠিক আছে।
তা হলে রাখি, ভাল থাকো।
এবার আরিফকে বলা দরকার। আরিফকে ফোনে না পেয়ে ওর বৌকে পেলাম।
কি ভাইয়া, আপনি আসতে পারছেন, আপনাদের স্নো কমেছে?
হ্যা এইতো আমি এখন কোচে, সকাল ৮ টায় ভিক্টোরিয়া পৌঁছেই তোমাদের ওখানে যাব, আরিফকে নিয়ে শারমিনের বাসাটা চিনে লাগেজ টা ওখানে রেখে তারপর হিথ্রো যাব, তুমি আরিফকে বলে রেখ, আমি ওকে পেলাম না।
হ্যা ভাইয়া ও এখন কাজে তাই ফোন সাইলেন্ট করে রেখেছে।
ও, আচ্ছা, ঠিক আছে তাহলে রাখি, সকালে দেখা হচ্ছে।
* চলবে। আগামীর অপেক্ষা!

No comments:

Post a Comment

Thank you very much for your comments.