Sunday 25 November 2012

নক্ষত্রের গোধূলি-৯ [১ম অধ্যায়]

[পূর্ব সূত্রঃ নক্ষত্রের গোধূলি-৮]
তার বুকটা চিরে তো আর তার এই স্বপ্ন গুলো দেখাতে পারে না, তাকে কে বিশ্বাস করবে, সবার কাছেই যে সে আজ এক চলমান রাহু, তার ছায়া দেখা বা সকালে উঠে তার মুখ দেখাও যে আজ সবার কাছে অশুভ দিনের পূর্বাভাস। এ না বোঝার মত খোকা সে নয়। জীবনের অনেকটা পথ সে পেড়িয়ে এসেছে, অনেক আলো ছায়া, বাতাসের স্পর্শ, জলের তড়ংগ সে দেখেছে, অনুভব করেছে প্রকৃতির
কঠিন কোমল নিস্তব্ধ মুহুর্ত গুলি, পান করেছে নানা ঘাটের জল। আজ তার একমাত্র আশ্রয় মনিরার বিশাল হৃদয় নামক শান্ত নীড়, যেখানে একমাত্র তারই প্রবেশাধিকার। সেখানে তার জন্য সাজানো রয়েছে এক বিশাল কুঞ্জবন, পাতা রয়েছে বরফ নীল রঙের কোমল গালিচা, যেখানে রয়েছে তার স্বর্গ বিশ্ব যার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত যতদূর দৃষ্টি যায় সবটাই তার একার। যেখানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা এমন কঠিন যে আর কোন প্রাণীর ঢোকা অসম্ভব।

যে মনিকে সে অকৃত্রিম ভাবে ভালোবাসে, মনিও তাকে ভালবাসে। মনিকে ছাড়া রাশেদ সাহেব কিছুই ভাবতে পারে না। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে সমস্ত পৃথিবীকে চিৎকার করে বলে দেয় আমি মনিকে খুব বেশি ভালোবাসি। মনিই আমার জীবন, মনি শুধুই আমার, ওই আমার বেচে থাকা, ওই আমার সব, আমার জীয়ন কাঠি মরন কাঠি সবই মনি। কখনো আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে নিমন্ত্রণে গেলে ওদের জন্য ভিন্ন বিছানা দেয়া যাবে না তা সবাই জেনে গেছে।

বিয়ের পর মনির বড় বোনের ছেলের মুসলমানির অনুষ্ঠান গ্রামের বাড়িতে করবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে ওদের যখন নিমন্ত্রণ করতে এলো তখন রাশেদ সাহেব কোন লাজ লজ্জার বালাই না রেখে বলেই ফেললো যে, ওখানে যেতে বলছ বেশ যাব কিন্তু এতো মানুষ দাওয়াত দিয়েছ তারা সবাই এলে আমাদের থাকতে দিবে কোথায়?আমি কিন্তু মনিকে ছাড়া থাকতে পারবো না। এ কথা শুনে ওর বোন বলেছিল আমি সে ব্যবস্থা করে রেখেছি, তোমরা সে চিন্তা কোরনা। তোমরা ওই দক্ষিন ঘরে থাকবে, হয়েছে?হ্যা এবার যেতে আপত্তি নেই। সেই ছাব্বিশ বছর আগে বিয়ের দিনেই রাশেদ সাহেব তার মনির কাছে সব বুঝিয়ে দিয়ে বলেছিলেন আজ থেকে আমি বলে আর কিছু নেই যা আছে সবই তোমার, তুমি তোমার মত করে গড়ে নিও।
দাউদকান্দি ব্রিজের কাছে এসে একটা ঝাঁকুনি খেয়ে ফিল্মের ফিতা ছিড়ে গিয়ে রাশেদ সাহেবের সিনেমা দেখা থেমে গেল। রাশেদ সাহেব চমকে উঠলেন। সুপারভাইজারকে জিজ্ঞেস করলেন
কি ব্যাপার ভাই কি হয়েছে?
না কিছু হয়নি সামনে বিরাট কিউ তাই থেমেছে।
মিনিট পনের পর আবার গাড়ি চলতে শুরু করলেই সিনেমার ফিতা আবার জোড়া লেগে যায়।
একটা পরিবার, একটা সংসার, একটা বংশের উন্নতি ঘটানো কারো একার পক্ষে বা এক পুরুষের পক্ষে সম্ভব নয়। ওরা চার ভাইয়ের মধ্যে রাশেদ সাহেব বাদে সবাই উচ্চ শিক্ষিত। রাশেদ সাহেব পড়াশুনার সুযোগ পেলেন কোথায়?তবুও তার সাথে কথা বলে, তার আচার আচরণ, পোষাক পরিচ্ছদ, চলাফেরা, মানুষের সাথে মেলামেশা দেখে বোঝার উপায় নেই। চমৎকার এক ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন ব্যাক্তি। তাদের বাড়ির একটা সুনাম আছে, পড়া লেখা বাড়ি।

নিজেদের বাড়ির একটা নাম ঠিক করে রেখেছেন কিন্তু বাড়িটা উপরে উঠার আগে এই নাম বেমানান তাই আর পয়সা খরচ করে নাম লেখা হয়নি। তিনি ভেবেছিলেন তার ব্যবসার উন্নতি হলে আস্তে আস্তে দোতলা, তিন তলা, চারতলা, পাচ তলা করে আকাশের একটু কাছে গিয়ে চার ভাই আর এক বোন মিলে এক বাড়িতেই সুখে দুঃখে মিলে মিশে থাকবে, যাতে করে সবাই সবাইকে কাছে পায় এরকম একটা ইচ্ছে ছিল। সে ইচ্ছে ইচ্ছে পর্যন্তই রয়ে গেল, এ আর কোন দিন হবে বলে মনে হয় না। আরো কত আশা ছিল। মনিরা এবং তার নিজের বাগান করার বেশ ঝোঁক।

চাকরীর উপলক্ষে যেখানে থেকেছে সেখানেই একটা অস্থায়ী বাগান বানিয়ে নিয়েছে। তা এই ঢাকা শহরে এতো জায়গা কোথায় পাবে যেখানে দালানের মাথা উঠে আকাশ ঢেকে ফেলেছে সেখানে বাগানের জায়গা কোথায় তাই ছাদের উপরে টব সাজিয়ে বাগান করবে। দুজনে মিলে এক সাথে পানি দিবে, গাছের যত্ন করবে, টব পরিষ্কার করে নতুন মাটি সার মিশিয়ে আবার নতুন গাছ লাগাবে।

মনিরা এর মধ্যেই ছাদের উপরে একটা ছোট বাগান করেছে যেখানে প্রতিদিন তার নিজের সন্তানদের মত করে ফুল গাছের যত্ন করে। যতক্ষণ বাগানে কজ করা যায় ততক্ষণ মনে কেমন সুন্দর একটা প্রফুল্ল ভাব থাকে, একটা স্বর্গীয় সুবাতাস এসে মনে জমা কালিমা গুলি ঝড়ের মত উড়িয়ে নিয়ে যায়, গাছ গুলি যেন কথা বলে আর ফুল গুলিত হাসতেই থাকে। আজে বাজে দুঃশ্চিন্তা গুলি মনে ঢুকার দরজা খুঁজে পায় না। তার আরো স্বপ্ন ছিল বাড়িটাকে লতায় পাতায় ঘেরা কুঞ্জবন বানাবে। যেখানে থাকবে নানা রঙের বাহার আর মৌ মৌ করা ফুলের গন্ধ। সেবার লন্ডন থেকে দেখে এসেছে কারুকাজ করা অক্ষরে বাড়ির নম্বর লেখা রয়েছে প্রায় বাড়িতে, তেমন করে নক্সা আঁকা বোর্ডের উপর কারুকাজ করা নম্বর প্লেট লাগাবে বাড়ির গেটে।

বিকেলে বা বৃষ্টির সময় সবাই মিলে বারান্দায় বসে চা পিঁয়াজু খেতে খেতে বৃষ্টি দেখবে, নয়তো জোসনা দেখবে, গল্প করবে। এর মধ্যেই সাভার হর্টাস নার্সারি থেকে ওয়াল কার্পেটের চাড়া এনে বাড়ির সীমানা দেয়ালে লাগিয়েছে, একটা মহুয়া গাছ লাগিয়েছে বাড়ির পিছনে দক্ষিন পশ্চিম কোনায়, সামনের উত্তর পূর্ব কোনায় লাগিয়েছে একটা স্বর্ন চাপা গাছ। বাড়ির নির্মান কাজ শেষ হলে সিঁড়ির এক পাশে একটা মাধবী লতা আর অন্য পাশে হলুদ আলমন্ডা গাছ লাগিয়ে একেবারে ছাঁদ পর্যন্ত উঠিয়ে দিতে চেয়েছিল।
আর সামনের দিকে পূর্ব দক্ষিন কোনায় যে বারান্দায় সবাই মিলে বসবে বলে ভেবে রেখেছে সেই বারান্দার নিচে গ্যারেজের পাশে একটা চামেলি গাছ থাকবে এটাও ছাঁদ পর্যন্ত উঠিয়ে নিতে চেয়েছিল যাতে সবাই বসলে সারা বছরেই চামেলি বা মাধবী লতার পাগল করা গন্ধে মনে কোন কলুষতা আসতে না পারে। নানা ফুলের গন্ধে পুরো বাড়িটা হয়ে উঠবে একটা স্বপ্ন পুরী বা মায়া কুঞ্জ কিংবা কুঞ্জবন।

নাম যেটা ঠিক করে রেখেছে তা হচ্ছে ‘পান্থ নীড়’ বাড়িটা তো কয়েক পুরুষ ধরে টিকে থাকবে কিন্তু এ বাড়িতে যারা বাস করবে তারাতো আর বাড়ির মত ইট বা লোহার তৈরী নয় যে বাড়ির সমান বয়স পাবে। বাড়ির বাসিন্দারা পুরুষানুক্রমে যখন এক এক করে আসবে তখন আনন্দের মেলা বসবে আবার যখন প্রকৃতির ডাকে চলে যাবে তখন তেমনি তার উলটো কান্না কাটির ঝড় বয়ে যাবে। এই যে আসা যাওয়া এই নিয়েই তো সংসার, সবাইত সংসারের পথিক। ক্ষণকালের জন্য আসবে আবার চলেও যাবে।
যারা এই বাড়িতে থাকবে তারা না জানি কে কি পেশা নিয়ে থাকবে। হয়ত কেউ শিক্ষক হবে, কেউ ডাক্তার হবে, কেউবা উকিল ব্যারিস্টার বা কেউ হয়ত নিতান্ত সাধারন জীবন যাপনই করবে। এরাই হয়ত পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকবে আবার কোন বিশেষ দিনে প্রিয় জনের সাথে মিলিত হবার আগ্রহে আধীর প্রতীক্ষা নিয়ে অপেক্ষা করবে। ও আসছে কে কি পছন্দ করে আহা বিদেশে থাকে কি খায় না খায় তার কি কোন ঠিক আছে?কি কি বাজার করতে হবে, কে কে এয়ার পোর্টে যাবে এই আয়োজনে ব্যস্ত থাকবে। যারা আসবে তারাও কার জন্য কি নিয়ে যাবে তাই নিয়ে মাস ধরে কেনা কাটার ধুম চলবে। সবাই এসে একত্র হবে।

বিশাল হৈ চৈ আনন্দ উত্সবে মেতে উঠবে ক্ষণিকের জন্য, আবার সবাই সুখের একটা স্মৃতি নিয়ে আবার তারা তারি ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে মন ভার করে যার যার কর্মস্থলে ফিরে যাবে। যারা থাকবে তাদের কাছে কিছু দিন বাড়িটা ফাকা মনে হবে। এক সময় আবার তা সয়ে যাবে। সবাই তো পথিক, এটাতো পথিকের ঘর, ক্ষণিকের জন্য আসা আর যাওয়া তাই এর নাম ‘পান্থ নীড়’। রাশেদ সাহেবের এই স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে। এখনো যে তা বাস্তবায়নের কোন আভাস সে খুঁজে পায়নি, আজ চট্টগ্রাম থেকেও তেমন কোন আশার বাণী শুনে আসতে পারেনি।

[আবার দেখা হবে পৌষের হিম ঝরা রাতে আমাদের এই রাশেদ সাহেবের রূপকথার গল্পের আসরে। যে যেখানে আছেন সবাই এ পর্যন্ত সুস্থ থাকুন, ভাল থাকুন এবং পরবর্তী পর্বের অপেক্ষা করুন। ধন্যবাদ]

No comments:

Post a Comment

Thank you very much for your comments.