Thursday 15 November 2012

দবীর আলির স্বপ্নভঙ্গ


 

১।
সুখে থাকলে ভুতে কিলায়। এই মহা বাণী নিশ্চয় শুনেছেন। হ্যাঁ আসলে কথাটা একেবারে উড়িয়ে দেবার উপায় নেই। দবীর আলি সাহেব লন্ডনে বেশ সুখেই
ছিলেন। অবশ্য তিনি লন্ডন শহর বলতে যা বোঝায় সেখানে কখনই থাকেনি। তবে পুরো বৃটেনের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত অর্থাৎ কিনা সেই স্কটল্যান্ডের উত্তর প্রান্তের ইনভার্নেস শহর থেকে দক্ষিণে সাউথ ওয়েলস এর সোয়ানসী পর্যন্ত আবার পূবে নরউইচ থেকে পশ্চিমে লিভারপুল পর্যন্ত ঘুরে বেড়িয়েছে। না ভুল বলা হচ্ছে। আসলে ঘুরে বেড়ায়নি, তার কাজের ধরনটাই ছিল এমন। কাজের ছুতা ধরে পকেটের পয়সা খরচ না করে
কোম্পানির টাকায় সমস্ত গ্রেট বৃটেন ঘুরে দেখার সুযোগ পেয়ে বেশ আনন্দের সাথেই তা উপভোগ করেছে। এ দেশের যাতায়াতে যা খরচ, ওরে বাব্বাহ! নিজের পকেটের পাউন্ড খরচ করে কি আর এত ঘোরা যায়?
আজ মানচেস্টারে কাজ করছে। বেশ চলল কয়েক মাস। তারপরে হঠাৎ এক দিন কোম্পানির সুপারভাইজার ডেভিড বা ম্যানেজার জন বিউ বলে বসল এই মিয়া, সঙ্গের গাট্টহি বোঁচকা যা আছে গুছিয়ে প্লিমাউথ চলে যাও। বললেই কি আর সাথে সাথে যাওয়া যায়?
দবীর আলি কি আর পাখী নাকি?
কোথায় যাব তার ঠিকানা দাও, পথের বিবরণ দাও।
হ্যাঁ এই তো ঠিকানা আর কি, পোস্ট কোড সহ যা দরকার সব কিছু তোমার মেইলে পাঠিয়ে দিচ্ছি। জি ম্যাপ দেখে কি ভাবে যেতে হবে দেখে নিও।
বেশ তাই দাও। আর শোন, এখানে কে আসবে?
না কেউ আসবে না।
তা হলে চাবি কার কাছে দিয়ে যাব?
মেইন বিল্ডিঙ্গের নিচে ওই যে চাবি রাখার বাক্স আছে ওখানে চাবি রেখে তুমি কাল সকালে চলে যেও।
আচ্ছা ডেভিড, ঠিক আছে তুমি ভেবো না। আমি সময় মত চলে যাব। এখন তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পার। শুভ রাত্রি।
শুভ রাত্রি।
ফোনটা রেখে ভাবল একটু চা করে নিই। ইলেকট্রিক কেটলিতে চা বানিয়ে এনে বসে ল্যাপটপে মেইলটা খুলে দেখে এর মধ্যেই ডেভিড ঠিকানা পাঠিয়ে দিয়েছে। এবার গুগল ম্যাপে প্লিমাউথের পোস্ট কোড লিখে সার্চ দিয়ে বসে আছে কখন ম্যাপের পাতা খুলবে। এড্রেস বারে গোল চাকতিটা মহাকাশের অলিগলি ঘুরে ঘুরে খুঁজে দেখছে প্লিমাউথের ডেভন কোথায়। ওদেশের ইন্টারনেটের স্পীড যা তাতে কয়েক সেকেন্ডের বেশি লাগার কথা না। এমন সময় আবার ডেভিডের ফোন।
হ্যালো দবীর,
হ্যাঁ ডেভিড, আবার কী হলো?
শোন, তুমি কি কোচের টিকেট করে ফেলেছ?
আরে না আমি তো মাত্র সার্চ দিয়েছি এখনও পেজ ওপেন হয়নি, টিকেট কিনব কি?
বেশ করেছ। শোন তোমাকে টিকেট করতে হবে না। কাল দুপুরে লিভারপুল থেকে ফ্রাঙ্ক যাবে ওই তোমাকে সাথে নিয়ে যাবে।
বাহ! তাহলে তো বেশ হয়।
বেশ! এই ভাবে ডেভনে কয়েক দিন ডিউটি করে আবার ওখান থেকে চলে গেল কার্ডিফ, তারপর লীডস, তারপর বার্মিংহাম। যাই হোক এই ভাবেই বিলাতের নানা ছোট বড় শহরে ঘুরে ঘুরে কাজ করে কত অজানারে হয়েছে জানা আর কত অদেখারে হয়েছে দেখা। ফাকে ফাকে আরো কত কি! যেখানেই গেছে সেখানেই তার সাথে থাকা একটা ছোট ক্যামেরা টুকে নিয়েছে কিছু টুকরো দৃশ্য। আর একটা ল্যাপটপ তো সাথে আছেই। আরো আছে মোবাইল ইন্টারনেটের একটা মডেম। যে শহরে যাবে সেখানে কোথা থেকে কোথায় কি ভাবে যেতে হবে, সেখানে কি আছে, তার চির চেনা ভারতীয় খাবারের দোকান কোথায় এগুলি খুঁজে পেতে তার সাথে এই সব আধুনিক যোগাযোগ মাধ্যম রাখতে হয়।
এক জায়গায় কয়েক দিন রইল তো কয়েক দিন পরেই আবার হুকুম এলো ওই ওখানে চলে যাও। নিজের গাড়িও নেই যে গাড়িতেই জিপসীদের মত সংসার নিয়ে চলাচল করবে। তাকে চলাচল করতে হয় কোচ কিংবা ট্রেনে। এতে কি আর সংসারের এত কিছু বয়ে নেয়া যায়?
মাঝে মাঝে এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে লন্ডনে মেয়ের বাসা বা অক্সফোর্ড এবং শেফিল্ডে যে দুই ভাই থাকে তাদের বাসায় গিয়ে ইচ্ছে মত মাছ ভাত, এবং দবীর আলির প্রিয় খিচুড়ি, পোলাও মাংস যা ইচ্ছা খেয়ে এসেছে। যাবার আগেই মেয়ে বা ভাইয়ের বৌ’রা জিজ্ঞাসা করে নিত কি খেতে মন চায়। সেই অনুযায়ী বাজার এনে রাখত। দবীর আলি গেলেই তার এই সব সখের রান্না আর এর সাথে পিয়াজু, আলুর চপ, বেগুনি বানিয়ে খাওয়াত। এতেই চলে যেত। ছুটি শেষ হলে আবার তার কাজে জয়েন করে আবার সাবেক বহাল। মানে এতো দিন যা খেয়েছে আবার তাই।
এ দেশের গ্রাম বা শহরের তেমন কোন পার্থক্য বোঝা কঠিন। অজ গ্রামে বিজলী, রাস্তার মোড়ে মোড়ে ফোন বুথ, লাইব্রেরিতে সেই গ্রামের ইতিহাস, ইন্টারনেটের সংযোগ সহ কম্পিউটার, ব্যাঙ্ক, বাস বা ট্রেন স্টেশন কি না আছে?বরংচ শহরের চেয়ে গ্রামেই ভাল লাগে। অন্তত পাহাড়ী পটভূমিকায় সীমাহিন সবুজের বাহার দেখে মন প্রান সব জুড়িয়ে যায়। আর সে জায়গা যদি হয় সমুদ্রের পাড়ে তা হলেতো কথাই নেই।
বাসা থেকে কাজে যেতে বাসে বা লোকাল ট্রেনে যাতায়াতে কোন ধাক্কা ধাক্কি নেই ফাঁকা সীট, দাঁড়িয়ে যেতে হয় না। উঠলেই একটা সীটে বসতে পারে। রাস্তায় কোন ধুলাবালি নেই। হাঁটতে গিয়ে কোথাও হোঁচট খাবার বা ম্যান হোলে পরার ভয় নেই, পকেট মারের ভয়ে পকেট চেপে রাখতে হয় না। চলাচলের সময় রাত বিরাতের ভয় নেই। আহা কি শান্তি। শুধু শান্তি আর শান্তি। ভাবছিল খুকুর মা তো কয়েক মাস পরে পরেই এখানে আসছে তখন এক সাথে কিছু দিন থেকে আবার ফিরে যাচ্ছে। এই সুযোগে কাজের ফাকে ফাকে দুই জনে নানা জায়গায় বেড়াচ্ছে। এভাবেই চলুক না। মন্দ কি? বেশ তো। এমন সুখ কি আর আমার প্রিয় দেশে পাবে কখনো?নাহ! কোন ভাবেই তা সম্ভব নয়। কাজেই দেশে ফিরে আসার তেমন কোন প্রয়োজনই নেই।
২।
কিন্তু দবীর আলির এত শান্তি আর ভাল লাগছিল না। এত সুখ আর তার কপালে সইছিল না বা ভিন্ন ভাবে বলতে গেলে দেশে হঠাৎ করেই বাবার ক্যান্সার ধরা পরল। নিতান্ত নিরুপায় বা আর কোন পথ নেই ভেবে শেষ পর্যন্ত দেশে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিতে হলো। যেই ভাবা সেই কাজ। হঠাৎ তরি ঘড়ি করে টিকেট ইত্যাদি সেরে এক দিন শুভ ক্ষণে শুভ লগ্নে দেশেই ফিরে এলো।
প্রথমতঃ যা হবার তাই হলো। এত দিন মানে প্রায় দশটা বছর শীতের দেশে থেকে হঠাৎ গড়মের দেশে এসে মনে হচ্ছিল একেবারে যেন জ্বলন্ত ওভেনের মধ্যে ঢুকে পরেছে। রাস্তা ঘাঁটে হাঁটার উপায় নেই। মহান রিকশা চালক পায়ের উপর দিয়ে নির্ভাবনায় রিকশা উঠিয়ে দিচ্ছে, কোন ভাবে মুখটা একটু খুললেই মুখের ভিতর ফুরুত করে এক ঝাঁক ধুলা ঢুকে যাচ্ছে। রাতে মশার কামড়ে পা চুল্‌কিয়ে ঘা হচ্ছে। আরো কত কি।
কয়েকটা দিন বেশ আরামেই গেল। কিন্তু এখন আর শুয়ে বসে দিন যেতে চায় না, রাত কাটে না, ঘুম হয় না। এ তো মহা জ্বালা। কি করা যায়? পুরনো বন্ধুদের সাথে আলাপ করল। কয়েক জনেই বুদ্ধি দিল, আরে তোমার শরীর স্বাস্থ্যতো এখনো বেশ ভালই আছে। বিলাতে থেকে ভেজাল মুক্ত ভাল খাবার খেয়ে বেশ আছ। কাজেই কিছু একটা চাকরি বাকরি খুঁজে নাও দেখবে সময় কোথা দিয়ে কেটে যাবে টেরও পাবে না। না হলে কিছু একটা ব্যাবসা ফেঁদে বস। হ্যাঁ তা মন্দ বলনি। আচ্ছা দেখি কোথায় কি পাই। দেখতে দেখতে দেশের একটা নামি দামী কোম্পানিতে চাকরি একটা পেয়েই গেল। কোম্পানির এক কর্তা জানাল আপনি যদি আমাদের একটু সংগ দেন তা হলে ভালই হবে। তবে কি ভাই আমাদের ওখানে কাজের ধরন যেমন তাতে আপনাকে অধিকাংশ সময় বাইরে বাইরেই থাকতে হবে। মানে কোথাও স্থায়ী ভাবে বসার মত কোন ব্যবস্থা হবে না। আচ্ছা ঠিক আছে এতে কোন অসুবিধা নেই, আমার সময় কাটলেই হবে।৩।
চাকরিতে জয়েন করেই দেখে এ আবার কি ধরনের কাজরে বাবা! চারি দিকে শুধু বালু আর বালু। সেই বিদেশে চাকরি করার সময় যেমন সাহারা মরুভূমির দেশে দেখেছিল এখানেও তেমন। ড্রেজিং করে বালু দিয়ে ভরাট করে সেখানে এখন দালান কোঠা বানাবে। এই সব দালান কোঠা বিক্রি করে কোম্পানি ব্যবসা করবে। আর যারা এই সব দালান কোঠা কিনবে তারা মহা আনন্দে এই দালানের কোন কোঠায় নরম গদিতে পালকের মত হালকা বিছানায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রুমে শুয়ে শুয়ে সুখ স্বপ্ন দেখবে।
অফিসে একটা বিল্ডিং আছে কিন্তু তাতে না আছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের কোন ব্যবস্থা না আছে ঠাণ্ডা পানির কোন আয়োজন। গরমের সময় যে কি সাঙ্ঘাতিক অবস্থা তা যে না দেখেছে তার পক্ষে অনুমান করা অতীব কঠিন কাজ। শ্বাস ফেলার হাস ফাঁস্‌ শব্দ, সমস্ত শরীর ওভেনের ফুলকি ছড়ান আগুনের মত গরম। সারা দিনে দুই থেকে তিন লিটার পানি খেয়েও যখন ছোট টয়লেটে যায় তখন যে কি যন্ত্রণা তা আর বলার প্রয়োজন মনে করলাম না, পাঠক বৃন্দেরা নিজেই বুঝে নিবেন। এদিকে গরম বালু তারপরে চারদিকে নির্মাণ কাজের নানা উপকরণ, ধুলা বালি, নানান মেশিনের ঘেনঘেনানি, ঠক্‌ঠকানিতে কান ঝালাপালা হয়ে নাজেহাল হবার অবস্থা। ওদিকে টয়লেটে গিয়ে দেখে ফ্লাস সিস্টেমের কোন বালাই নেই। টয়লেটের ছোট বা বড় কাজ যাই হোক শেষ করে বালতি ভরে পানি ঢেলে দাও।
সাথের সহকর্মীরা অতি সহজেই এই যাযাবর শ্রেণীর বিশ্ব ভ্রমণ কারিকে সহকর্মী হিসেবে পেয়ে অত্যন্ত আগ্রহের সাথে লুফে নিয়েছে। কাজের ফাকে ফাকে অথবা গাড়িতে বসে আসা যাওয়ার পথে তার সাথে নানা রকম হাসি তামাশা গল্প গুঁজবে মেতে থাকার চেষ্টা করে, নিজেদের হতাশা ঢেকে রাখতে চায়। নিজেদের অপ্রাপ্তির বঞ্চনা ঢেকে রাখার ব্যার্থ চেষ্টা করে। কিন্তু তবুও তার ফাকে বিশ্ব ভ্রমন করা এবং পৃথিবীর নানা জাতির নানা শ্রেণীর মানুষের সাথে মেলামেশা করা অভিজ্ঞ দবীর আলি তার নিজের চোখের কোণের ফাক দিয়ে লক্ষ করে যেন তার সহকর্মীদের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ত কোন হাসি নেই। সবার হাসি কেমন যেন মেকী, ম্লান, করুণ, নিভু নিভু চেহারা। চেহারা দেখে পশ্চিম আকাশের অস্তগামী একাদশীর চাঁদের কথাই শুধু মনে ভাসে।
এ সব কিছু দেখে দবীর আলি থ হয়ে গেল, রীতিমত বাকরুদ্ধ। দবীর আলি তার সহকর্মীদের কোন মুখে বা বলতে গেলে কোন ভাষায় সান্ত্বনা দিবে সে ভাষা খুঁজে পায় না। শুধু ভাবে এ আবার কোথায় চাকরি করতে এলামরে বাবা?এখানকার ব্যবস্থা এমন কেন? লোকজনেরা সব এমন কেন?পরিস্থিতিতে এমন বিভ্রাট কেন?এত বড়, এত নামি কোম্পানি!!! সবার মনে থাকবে রঙ্গীন স্বপ্ন, মনে থাকবে ফুর্তির আমেজ, সুখ চুইয়ে চুইয়ে ননীর মত গলে গলে পরবে। রঙ্গে রঙ্গে ঝিলিমিলি করবে কথার ফুলঝুরি, কিন্তু তার পরিবর্তে এখানে এ সব কি দেখছি?এত দিন শুনেছি কর্পোরেট কোম্পানি গুলিতে নানা রকমের জাঁকজমকের ঝলকানি! কিন্তু এখানে এমন দেখে দবীর আলির মনে একটু ধাক্কা খেল। দেখা যাক সামনে কি আসে! এই ভেবে নিজেকে একটু সামলে নেয়ার সম্ভবত গোপন কোন চেষ্টা করছে।
জয়েন করার পর দিনেই দেখেছে পুরনো যারা তারা কেমন একটু কানা ঘুষা করছে। সে নতুন বলে তার কাছে পুরনরা কিছু প্রকাশ করতে চাইছে না। একটু পীড়া পিঁড়ি করে জানতে পেল কোম্পানির ভিন্ন এক ইউনিটের কে এক জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা টার্মিনেট হয়েছে। পরদিন আরো এক জনের। এই ভাবে জয়েন করার সাত দিনের মধ্যেই পাঁচ জনের এমন ঘটনা কানে এলো। এখন আর অবাক হলো না। ভাবল এই বুঝি এখানকার নিয়ম। এক দিন অফিসে যাবার আগে সকালে নাশতা করতে বসেছে। দবীর আলির বাবাও এসে বসল সাথে। দবীরের স্ত্রী টেবিলে নাশতা বেঁড়ে দিচ্ছে।
কি খবর দবীর নতুন চাকরি কেমন লাগছে?
কেমন লাগছে বুঝতে পারছি না আব্বা। তবে এই কয়েক দিনের মধ্যে পাঁচ জনের টার্মিনেশনের খবর পেলাম।
বলিস কি?
হ্যা আব্বা তাই তো দেখছি। এর আগে দেশে যেখানে চাকরি করেছি সেখানে পনের বছরে মাত্র এক জনের এমন ঘটনা দেখেছি কিন্তু এখানে এই অবস্থা। এ এদের কেমন রীতি বুঝতে পারছি না। কেন টার্মিনেট করছে তাও জানায় না।
তার মানে ম্যানেজমেন্টের যা ইচ্ছে তাই করছে?
তাইতো দেখছি আব্বা।
এই সব প্রাইভেট কোম্পানিগুলোতে এমনই হয়, দেখ যে কয় দিন পার চালিয়ে নাও কি আর করবে যেখানে যেমন তেমন করে নিজেকে সাবধানে রেখে চলবে।
হ্যাঁ আব্বা তাই করতে হবে।
দেখতে দেখতে প্রায় মাস দেড়েক কেটে গেল। সামনে রমজানের ঈদ। সে নতুন জয়েন করেছে বলে তার বোনাস পাবার সম্ভাবনা নেই এ কথা সে জানে। কিন্তু যারা আগে থেকে আছে তারাও এক দিন জানাল যে তাদের পুরো বোনাস দিবে না বলে হেড অফিস থেকে অফিস আদেশ এসেছে। মাত্র অর্ধেক বোনাস দিবে। অথচ কোম্পানীর অন্যান্ন অফিসে আগের মত পুরো বোনাস দিচ্ছে। জেনে স্বাভাবিক ভাবেই সবার মুখে মন খারাপের বা হতাশার আরো একটা প্রলেপ দেখতে পেল। মানুষ গুলো কেমন করে যে এসব সহ্য করছে তা দবীর আলি কিছুতেই বুঝতে পারছে না। কেন যে এরা এই এত অনাচার অবিচার অত্যাচার মুখ বন্ধ করে মেনে নিচ্ছে তাও বুঝতে পারল না। মনে মনে শুধু ওই বিলাতের সুখের দিন গুলির কথা ভাবে আর অবাক মনে এদের সহ্য সীমার প্রশংসা করে। এও বুঝতে চায় মানুষ কতটা অসহায় হলে এমন নির্যাতন সহ্য করে নিতে পারে।
সকালে দুই ঘণ্টা এবং বিকালে আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা এই মোট পাঁচ/ ছয় ঘণ্টা জার্ণি করে অফিসে যাতায়াত করে অফিস করে এমন সব অনাচার সহ্য করতে হবে তা ভেবে অবাক হয়। এই যে যাদের সাথে একত্রে গাড়িতে বসে আসে যায় এরাতো সবাই অফিসার। কাজেই এদের অবস্থা যেখানে এই সেখানে যারা শ্রমিক তাদের দুরবস্থা যে কত করুণ, কত ভয়াবহ তা নিজের চোখে দেখেও কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। আজকের এই আধুনিক যুগে এক জন মানুষ কেমন করে আর এক জন মানুষের উপর এমন অত্যাচার করতে পারে ভেবে পায় না। সেই মধ্য যুগীয় ক্রিত দাস ব্যবস্থার সাথেই একমাত্র যার তুলনা করা যায়। যারা আবার এমন করছে অর্থাৎ তাদের পোষাক আসাকের নমুনা, চলন বলনের নমুনা দেখে কিছুতেই কোন সঙ্গতি খুঁজে পায় না। মুখে সবসময়- আল্লার পথে চলুন, আল্লার নামে কাজ করুন, আল্লাকে ভয় করে কাজে ফাঁকি দিবেন না। এই সব কথা সারাক্ষণ বলছে। আবার রীতিমত মেহেদি রাঙ্গা লম্বা দাড়ি রেখে ইসলামী লেবাস পরে অবলীলায় এমন সব নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। ঈদের মাত্র দুই দিন আগে অফিসে দবীর আলির ইউনিটের এক জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার টার্মিনেশনের সংবাদ শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেল। কি সুন্দর হাসি খুশি মানুষটার এমন পরিণতি সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। এই ঈদের দুই দিন আগেও এমন অফিস অর্ডার হয় কি করে? এদের মধ্যে কি বিন্দু মাত্র মানবিকতা নেই?তাও আবার বলে দিয়েছে তাকে ঈদের বোনাস দেয়া যাবে না!
দবীর আলির সাথে সুন্দর স্বাস্থ্যের সুদর্শন চেহারার টগ্‌বগে তরুণ জাহিদ সাহেবও জয়েন করেছে আজ এই বালুভুমিতে ঘুরে ঘুরে কাজ কর্ম তদারকি করতে গিয়ে তার চেহারা পুড়ে পাথর কয়লা না হোক অন্তত কাঠ কয়লার মত যে হয়েছে এতে দবীর আলি কোন সন্দেহ করতে পারছে ন। কি সুন্দর চেহারার মানুষ রাতারাতি এমন বদলে যেতে পারে তা এই প্রথম দেখছে।
৪।
অফিসের সময়ের কোন ঠিক ঠিকানা নেই। শুধু একটা সময়ের ঠিকানা আছে সেটা অফিসে হাজির হবার সময়। সকাল নয়টার আগেই আফিসে আসতে হবে। মেইন গেটে নিরাপত্তা কর্মিরা একটা বাঁধান খাতায় টুকে রাখছে কোন অফিসার কখন অফিসে ঢুকছে। আবার হাজিরা খাতায় সাধারণ শ্রমিকদের মত স্বাক্ষর করে নিজের হাজিরার প্রমাণ রাখতে হচ্ছে। কিন্তু ছুটির একটা নির্দিষ্ট সময় থাকলেও ওই সময় মত কেউ বের হতে পারে না। বড় সাহেব যতক্ষণ বের না হবে ততক্ষণ কেউ বের হতে পারবে না। বাঙালির প্রচলিত প্রথা। অথচ যার জন্য এই দেরি করা সে তার নিজের যা প্রয়োজন তা মালিক পক্ষকে তেল মেখে বা নানা রকম ফন্দি ফিকির করে মাসে পঞ্চাশ ষাট হাজার টাকা নগদ বেতন বৃদ্ধি থেকে দামি মোবাইল ফোন সেট বা এমন যা কিছু হোক তাদের থেকে ঠিক আদায় করে নিচ্ছে। সারা দিন অফিস করে এই যে এত গুলি মানুষ এত দূরে নিজ ঘরে ফিরবে এতে সেই কথিত বড় সাহেবটির কোন বিকার নেই। এদের যে স্ত্রী সন্তান বা সংসার আছে তাতে কার কি আসে যায়?সাপ্তাহিক ছুটিগুলিও মাঝে মাঝে এমনি নানা ছল ছুতা ধরে মেরে দিচ্ছে। চাকচিক্যময় সভ্য এবং অত্যাধুনিক এই কর্পোরেট কালচারের আড়ালে এই নোংরা বীভৎস চেহারা দেখে দবীর আলি কিছুতেই হিসেব মেলাতে পারে না।
সরকার বেশ অনেক দিন আগেই বেতন বাড়াবার ঘোষণা করে সব সরকারি অফিস সহ অন্যান্ন কর্পোরেট অফিসে তা বাস্তবায়ন করেছে কিন্তু এই অফিসে দেই দিচ্ছি করেও এখন পর্যন্ত তা করতে দিচ্ছে না। তবে যিনি মালিক তাকে তার উপদেষ্টা নামের মহারথী বা সর্বজ্ঞ্যনীরা নানা চটকদার কিছু বুঝিয়ে ঠেকিয়ে রেখেছে। তারা ওত পেতে আছে যে এমন এক সময় এই সাধারণ অফিসার কর্মচারীদের কথা বলবে যেন মালিক ভদ্র লোক তাদের কথাতেই উদ্বুদ্ধ হয়ে বেতন না বাড়িয়ে কেবল মাত্র ওই সব উচ্চ পদীয় কর্তাদের নিয়েই মেতে থাকেন এমন একটা পরিস্থিতির অপেক্ষা করছে।
সত্যিই এমনি এক সময় এলো। মালিক মহাশয় তার ঊর্ধ্বতন কর্তাদের ডেকে বলে দিল- আপনারা আমার সব অফিসে সবার জন্য বেতন বাড়িয়ে দেয়ার ব্যবস্থা নিন। জিনিষ পত্রের দাম বেড়ে গেছে, সরকার তার কর্মচারীদের বেতন বাড়িয়ে দিয়েছে।
কথা শুনেই এই সব লেবাসি কর্তারা নানা ছল ছুতা করে, ভান ধরে, অভিনয়ের একটা আবহ তৈরি করে এক দিন মালিকের সাথে একান্ত গোপন সভার আয়োজন করে বুঝিয়ে দিল যে শুধু শুধু এই আট কোটি টাকা খরচ করে বেতন বাড়াবার কোন দরকার নেই।
না না আপনারা এ কি বলছেন, দেশের বাজার দর সব বেড়ে গেছে এমন অবস্থায় বেতন না বাড়ালে লোক জন চলবে কেমন করে?
স্যার, আমরা কোম্পানির এই কয়েক জন আপনার পা চাটা কুকুর একটা লাভজনক ভাবনা ভেবেছি।
সেটা আবার কি?
স্যার, আট কোটি টাকা খরচ করে ওদের বেতন না বাড়িয়ে আপনি আমাদের পঞ্চাশ হাজার টাকা করে বাড়িয়ে দিন এতে মাত্র খরচ হবে বার লক্ষ টাকা। কোম্পানির লাভ কত হবে হিসেব করে দেখুন স্যার!
কিন্তু ওদের কি হবে, ওরা কি মেনে নিবে?
সেই জন্যেইতো আমাদের বাড়িয়ে দিতে বলছি স্যার, আমরা দেখব ওদের। ওরা যাতে মাথা চাড়া দিতে না পারে সেটা তো স্যার আমরাই দেখব। আপনি আমাদের উপর ভার দিয়ে পরম নিশ্চিন্তে থাকতে পারবেন স্যার। আমরা আপনার ঘুমের ব্যাঘাত হবার কোন পথই খোলা রাখব না। আমরাতো স্যার আপনার পা চেটে এই এত দূর আসতে পেরেছি। আপনিতো আমাদের ভাল করেই চেনেন স্যার।
কিছুক্ষণ ভেবে স্যার বললেন-
দেখ, তা যদি পার খারাপ কি?
৫।
দবীর আলি প্রতিদিন বালুর উপর দিয়ে নিত্য কাজ করে আর ভাবে, ভাবে আর শুধু ভাবে।
দবীর আলি এই সব কিছু নিজের চোখে দেখে মনে মনে শুধু বির বির করে বলে জীবনে অনেক শেখার বাকী রয়ে গেছে। জীবনে শেখার কোন শেষ নেই। বিলাত ছেড়ে যদি এই সোনার দেশে না আসতাম তাহলে এই সোনার মানুষদের কোন দিনই চেনা হত না। কেন যে স্বর্গ রেখে এই লঙ্কায় এলাম?ঈশশ! যদি বাবার ক্যানসার না হতো!

No comments:

Post a Comment

Thank you very much for your comments.