Friday 16 November 2012

আমার দেখা একাত্তরের কয়েক দিন-২[২]

Photobucket
[পূর্ব প্রকাশের পর]
এক দিন রাতে বাবা আমার দাদির নামে মানি অর্ডার করার জন্য কিছু টাকা দিলেন। স্কুল বন্ধ তাই সকালে উঠে নাশতা খেয়ে এলাকার পোস্ট অফিসে গিয়ে কিউতে দাঁড়ালাম। কিউ যখন কাউন্টারের কাছে এগিয়ে গেল তখন কাউন্টার ক্লার্ক
আমার মানি অর্ডার ফর্মে ইস্ট পাকিস্তানের ঠিকানা দেখে ছুড়ে ফেলে দিয়ে একটা গালি দিল। আমিও রক্তের উষ্ণতার জোয়ারে কিছুক্ষণ বাদানুবাদ করলাম।
দেখলাম আমার পক্ষে কয়েক জন এগিয়ে এলো। বলল কেনরে ভাই টাকা পাঠাবে না কেন?এতো একই দেশ। পাঠিয়ে দাও। যাই হোক শেষ পর্যন্ত টাকাটা নিয়ে একটা রশীদ দিয়ে দিল।
কয়েক মাস ধরে অস্ত্র সহ জীবিত সৈন্য আসে আবার মরা, আধ মরা, ভাঙ্গাচোরা সৈন্য ফিরতি ফ্লাইটে ফেরত যায়। ভারত সরকার তার দেশের উপর দিয়ে পাকিস্তানি প্লেন যাতায়াত নিষিদ্ধ করে দিল। এখন কলম্বোর দক্ষিণ দিয়ে ঘুরে প্লেন আসে যায়। এই ভাবে যখন ওদের সৈন্য আনা হোল তখন জুন মাসের শেষ দিকে আবার এক টেলিগ্রামে জানাল ফ্লাইট চালু হয়েছে তোমরা অফিসে এসে টিকেট রিকনফার্ম করে নাও। দেরি না করে বাবা টেলিগ্রাম এবং টিকেট নিয়ে অফিসে গিয়ে জুলাই মাসের ১০ তারিখে রাত ১১টায় আমাদের ফ্লাইট কনফার্ম করে এলেন। বাঁধাছাদা প্রায় সব করাই ছিল আবার নতুন করে কিছু করে রেডি হলাম। বাবার কাছে নগদ কিছু টাকা ছিল। এখন কথা হচ্ছে এই টাকা কি করে নেয়া যায়? যদি কাস্টমে চেক করে পায় তাহলে যদি নিতে না দেয় তো সর্বনাশ হয়ে যাবে। একেবারে খালি হাতে দেশে ফিরতে হবে। মা বুদ্ধি করে বোনের দুধ নেয়ার জন্য যে ফ্লাস্ক ছিল সেটা থেকে ভিতরে টিউব খুলে চতুর্দিকে টাকা পেঁচিয়ে আবার ভিতরে ভরে প্যাচ দিয়ে আটকে দিলেন। মোটামুটি রক্ষা পাবে এমন একটা আশা। মার গয়না টয়না যা ছিল তা কোন রকম লুকিয়ে নেয়া হল।

আমরা জুলাই মাসের ১০ তারিখে রাতে একটা টেক্সি ডেকে এত দিনের বসবাস করা অনেক চেনা করাচি শহর ছেড়ে শুভক্ষণে করাচি এয়ারপোর্টের দিকে রওয়ানা হলাম। যে শহরে কেটেছে নিজের শৈশব, কৈশর তার প্রতি কোন টান অনুভব করিনি। কেমন যেন পর হয়ে গেল এই এত চেনা এত সুখ দূঃখের স্মৃতি, সব কিছু পিছনে ফেলে টেক্সি এগিয়ে চলেছে। আমার সে রাতের কথা আজ এত দিন পরেও স্পস্ট মনে আছে। একটি বারের জন্যেও পিছনে ফিরে তাকাইনি, আমার মা, বাবা বা ছোট ভাই কেউ না।
এয়ারপোর্টে টিকেট চেক ইন হল, সিকিউরিটি চেক হল। এবার বোর্ডিং। বোর্ডিংয়ের ঠিক আগে কোথা থেকে যেন কাস্টম এসে সামনে দাঁড়াল। বাবা জিজ্ঞেস করল কি ব্যাপার? আমরা একটু চেক করব। চেকতো আগেই করেছে, এখন আবার কি? ওটা ছিল সিকিউরিটি চেক আর আমরা করব ভিন্ন চেক। আচ্ছা ঠিক আছে কর। প্রথমেই মায়ের হাতের ব্যাগ। খুলে দেখেই ঠিক ওই ফ্লাক্স। ওটা হাতে নিয়ে নারা চারা করে আর জিজ্ঞ্যেস করে এটায় কি? মা বলল কোলে বাচ্চা দেখছ না ওর দুধ। এ কথায় ওই কাস্টম খুশি হতে পারল না। তার পাশে দাঁড়ান বসের হাতে দিল। বসও একটু নারা চারা করে এদিক ওদিক ঘুড়িয়ে দেখে মার হাতে দিয়ে দিল।
যাক এ যাত্রা বাচা গেল। প্লেনে উঠে বসলাম। আড়াই ঘন্টার পথ ঘুড়ে কলম্বো হয়ে সাড়ে ছয় ঘন্টায় ১৯৭১ সালের ১১ জুলাই ঢাকা এয়ারপোর্টে নামার আগে প্লেনের জানালা দিয়ে দেখি নিচে পাকি সৈন্যরা নানান ভঙ্গিতে নানান অস্ত্র নিয়ে রানওয়ে ঘিরে রেখেছে। প্লেন ল্যান্ড করার পর ভিতরে এসে দেখি মিলিটারি গিজ গিজ করছে। আর সব কিছুই নিরাপদে পেরিয়ে এসে আবার সেই কাস্টম এবং সেই মায়ের ব্যাগের ফ্লাক্স। এখানেও এক নজর দেখেই ফেরত দিয়ে চক দিয়ে লাগেজে ওকে চিহ্ন দিয়ে দিল। আমরা বের হয়ে দেখি বাইরে মেঝ মামা অপেক্ষা করছেন। মালামাল নিয়ে মামার গাড়িতে উঠিয়ে চলে এলাম মামার ধানমন্ডির বাসায়। ওখানে দুই তিন দিন থেকে একেবারে গ্রামের বাড়ি।

*** দেশতো স্বাধীন হয়েছে। এখন একে রক্ষা করার দায়ীত্ব আপনার আমার সবার!

No comments:

Post a Comment

Thank you very much for your comments.