Thursday 15 November 2012

প্রবহমাণ-১


(কুকুর চরিত্র)আমাদের চারিদিকে প্রতিটি সেকেন্ডে ঘটে যাচ্ছে অসংখ্য ঘটনা প্রবাহ যা আমাদের পক্ষে নিতান্ত দুই একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা যা সংবাদপত্র, রেডিও, কিংবা টেলিভিশন ছাড়া কিছুই জানা হয় না। কিংবা অগত্যা আমাদের নিজেদের চোখের সামনে ঘটে গেলেই কেবল জানতে পারি। এই বিশাল পৃথিবীর আনাচে কানাচে কত কি রয়েছে।
যেমন, কোন জাতি কি খেয়ে জীবন ধারণ করছে কিংবা কেমন পোশাক পরছে, কেমন ঘরে বসবাস করছে, কে কোন বিচিত্র পেশায় দিন কাটাচ্ছে এগুলির কতটুকু আমরা জানি বা জানতে চাই।
এ ছাড়াও এমন কিছু মানুষ রয়েছে তারা না মানুষ, না রোবট নাকি কোন অবাক করা পূর্বে না দেখা জন্তু তা বোঝা কঠিন। তারপরে কে এক বেলা এক মুঠ ভাতের জন্য দৌড়ে বেড়াচ্ছে আবার কেউ পোলাও বিরিয়ানি ডাস্টবিনে ফেলে দিচ্ছে সে হিসেব রাখাও কঠিন ব্যাপার। খবরের কাগজ খুললে প্রায়ই দেখা যায়, প্রায়ই বলছি কেন এ তো নিত্য দিনের কথা, দুই টাকার জন্য বা এক কাপ চায়ের জন্য কিংবা সামান্য একটা পেন্সিলের জন্য যুবক বা চাচা খুন। পশুর কাছেও কত কি রয়েছে যা আমরা এখনো শিখতে পারিনি। পশুরা যদি আমাদের ভাষা বুঝতে পারত তাহলে ওরা আমাদের কি ভাবত? আমাদের মধ্যে যারা নিজেদের মানুষের বাইরে বড় লোক, ছোট লোক, ভদ্র লোক, চাষা, বস্তিবাসী নামে বিভিন্ন শ্রেণী করে রেখেছে তারা নিজেরা কি তা কি কখনো ভেবে দেখেছে? শুনে খুশী হবেন যে আমিও ভাবিনি। আমি যে ভাবিনি তা কি বিশ্বাস করেছেন? আরে ধুর তাই কি হয়? আমি যদি নাই ভাবতাম তাহলে এই এত আয়োজন করে কি আর এই লেখা ধারাবাহিক ভাবে লিখতে বসতাম? নিশ্চয়ই ভাবছি এবং নিজে ভেবে ভেবে কোন কুল কিনারা পাচ্ছি না বলে আপনাদের সাথে নিয়ে জড়াতে চাইছি। সে কথা হয়তোবা এতক্ষণে আপনাদের বুঝতে বাকি নেই।
আমরা নানা সময়ে বিচ্ছিন্ন ভাবে নানা কিছু প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় কত কিই ভেবে থাকি যা বয়ে যাওয়া নদীর স্রোতের মত আসে আবার কোথা দিয়ে চলে যায়। তারই দুই একটা কথা কখন মনে একটু দাগ কেটে যায় আবার কখনো তার কোন প্রভাব পরে না। বা নিতান্ত হেয়ালী ভেবে উড়িয়ে দিই, মনে রাখার চেষ্টা করি না। তাই বলে কি তার মধ্যে কোন গুরুত্ব পূর্ণ ভাবনা থাকে না? অনেক সময় কি অপ্রয়োজনে প্রয়োজনীয় প্রসংগ ত্যাগ করি না? নিজের অজান্তেই কত কি মানিক রতন এভাবেই হারিয়ে ফেলি।

এইতো গেল ভূমিকা। তাহলে এখন বলবেন কি দিয়ে আজ এই প্রবাহ শুরু করি?
আচ্ছা ঠিক আছে আমি বলছি আজ কেন যেন হটাত করে আমার দেখা এক মহান পুরুষের কথা মনে পরে গেল তাই তার কথা দিয়েই শুরু করছি। তবে একটা কথা যা আপনারা ভাবতেও পারছেন না সেটি হচ্ছে এই মহান পুরুষটি কিন্তু কোন মানুষ নয় ইনি একজন কুকুর। হ্যাঁ সত্যিই বলছি আমরা সবাই এদের প্রজাতিকে এই নামেই চিনি।
আজ থেকে প্রায় বছর ১২ আগে ঢাকা থেকে মাত্র ১৭ কিমি দূরে সাভারে আমাদের একটা বিশাল খামার ছিল। ওখানে পশু পাখি সহ নানা জাতের সবজি, ফুল এবং অনেক কিছু উৎপাদন হতো। উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করে যা অবসিস্ট থাকত তাই আমাদের এবং আমাদের প্রতিবেশীদের জন্য যথেষ্ট ছিল। জানি না কোথা থেকে যেন পাঁচটা কুকুর পালা করে ওখানে থাকত। অর্থাৎ কেউ আসত আবার কেউ চলে যেত কিন্তু তাদের দল থেকে কখনই পাঁচটার কম দেখিনি। তারা রাতে তো পাহারার কাজ অত্যন্ত সতর্কতার সাথে করতই এমনকি আমাদের যে রাতের পাহারাদার ছিল তার সাথে সুশৃঙ্খলিত ভাবে যোগাযোগ রেখে কাজ করত। যে রাতে ঘুম আসতে দেরি হত সে রাতে যতক্ষণ জেগে থাকতাম ওদের সাথেই কাটাতাম। ওরা দুই তিন জনে পুরো খামার এলাকা ঘুরে এসে আমার কাছে বসত আবার অন্যরা যারা আমার সাথে ছিল ওরা চলে যেত। এই ভাবে পালা ক্রমে ওদের পাহারার কাজ চলত। কখনো দেখেছি যারা ঘুরে এসেছে তারা এসেই বসে থাকা দলের সাথে কি যেন আলাপ করত। মানে প্রায় নিরব মিটিং এর মত। যার কিছুই আমি বুঝতাম না কিন্তু ওরা নিজেদের কথা কি বুঝত বা বোঝার ভান করত কিনা তা কখনো জানতে পারিনি। ওদের কথা আমি কিছুই বুঝতে পারতাম না। তবে ওরা যে আমাদের কিছু কথা অন্তত বুঝত তা আমাদের কাছে স্পষ্ট ছিল। ওদের যে সর্দার ছিল তাকে আমি ভোলা বলে ডাকতাম। খামার এলাকায় ঢুকে ভোলা বলে হাঁক দিলেই ও কাছে চলে এসে কুই কুই করে পিছনের দুই পায়ের উপর দাঁড়িয়ে এমন একটা ভাব ধরত জে তখন ওর মুখে কিছু খাবার না দিলে ওর হাত থেকে রেহাই পাওয়া কঠিন ব্যাপার ছিল। এগুলি আমরা জানতাম বলে আগে থেকেই তেমন প্রস্তুতি থাকত। অগত্যা সাথে কিছু না থাকলে রেস্ট হাউজের কিচেন থেকে কিছু না কিছু এনে দিতে হতো। বিশেষ করে আমার ছোট মেয়ে যেদিন যেত সেদিন হতো ওদের ঈদ। ওহ! এই দেখেন গুরুত্বপূর্ণ কথাটাই ভুলে গেছি। এই জে ভোলাকে খাবার দেয়া হতো তা কিন্তু কখনোই ও একা খেত না। অন্তত ওর কাছাকাছি যারা থাকত তারা মিলে ভাগাভাগি করে খেত।

আমি এবং আমার স্ত্রীকে প্রায়ই ওখানে থাকতে হতো। তেমনি একদিন সকালে নাশতার পর রেস্ট হাউজের বারান্দায় বসে চা খাচ্ছিলাম। তখন গত কয়েক দিন আগে ভোলার দলবলের মধ্যে এক সঙ্গিনী পাঁচটি বাচ্চা প্রসব করে খুব অসুস্থ হয়ে পরেছিল। এমনকি তার বাচ্চারা মায়ের বুকের দুধ ঠিক ভাবে পাচ্ছিল না। আমাদের খামারের এক কর্মী বুদ্ধি করে বাজার থেকে পাঁচটা ফিডার কিনে এনে ওতে গরুর দুধ ভরে খাওয়াত। যা বলছিলাম, আমি বারান্দায় চা খাচ্ছিলাম যেদিন সেদিন কেন যেন বাচ্চাদের ফিডার খাওয়ান হয়নি এবং দলের সবাই খামারের পশ্চিম পাশে কাজ চলছিল বলে ভোলা বাহিনীর সবাই ওখানে ছিল আর এদিকে বাচ্চারা ক্ষুধায় কুহ কুহ করছিল। শব্দটা আমিও শুনছিলাম কিন্তু আমি এর মানে বুঝতে পারিনি। বুঝব কি করে বলুন। আমি যে মানুষ! তাই নিজের নাশতা চা হয়ে গেছে আর কি? সে যাই হোক, এমন সময় কাছেই কাটা তারের বেড়ার পাশ দিয়ে ভিন্ন সাদা কাল রঙের একটা বেশ বলিষ্ঠ কুকুর যাচ্ছিল। ও ওই বাচ্চাদের কুহ কুহ শুনে থমকে দাঁড়াল। একটু মনযোগ দিয়ে ওদের কান্নার ভাষা বুঝতে পেরে জে পথে এসেছিল সেই পথে চলে গেল। ওই পথেই একটু দূরে এক বাড়িতে বিয়ের আয়োজন হচ্ছিল সেখানে আমাদেরও নিমন্ত্রণ ছিল তবে ঐ সাদা কালো কুকুরটার নিমন্ত্রণ ছিল কি না জানি না। সেদিন আমার বিশেষ কোন কাজ ছিলনা বলে সেন্টার টেবিলের উপর পা তুলে চেয়ারে বসে ছিলাম।
একটু পরেই ওই কুকুরটাকে ফিরে আসতে দেখলাম। ও এসে কাটা তার ডিঙ্গিয়ে ওই বাচ্চা গুলির পাশে দাঁড়িয়ে বমি করার মত মুখে করে আনা খাবার উগরে দিল। কিছুক্ষণ অদের দেখে বুঝে নিলো যে এরা এতই ছোট যে একা একা খেতে পারছে না। তখন সে ওই খাবার কিছু কিছু করে নিজ মুখে নিয়ে চিবিয়ে এক এক করে ওই বাচ্চাদের খাইয়ে দিল। এই ঘটনা যখন ঘটে তখন আমার স্ত্রী শসা বাগানের মাচা ঠিক করে দিচ্ছিল। আমি তাকে তাড়াতাড়ি ডেকে এনে দেখালাম। আমরা দুই জনেই অবাক হয়ে ওদের কাণ্ড দেখলাম। এমন সময় ভোলা যেন কি ভাবে এসে হাজির। কিন্তু সে আগন্তুক সাদা কালোকে দেখে কোন উচ্চ বাচ্য করল না। সাদা কালো ভোলাকে দেখে চলে গেল আর ভোলা ওই সাদা কালোর আনা খাবার সে যেমন করে খাইয়ে দিচ্ছিল ভোলাও তেমনি করে খাইয়ে দিতে লাগল। আমি আশরাফকে ডেকে তাড়াতাড়ি ফিডার রেডি করে ওদের খাওয়াবার কথা বলে দায় শেষ করে ভিন্ন কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। এত বছর পরে হলেও সেই ঘটনা কেন যে আমার চোখের সামনে থেকে যায়না বুঝি না। যখনই একা থাকি তখন মাঝে মাঝে চোখের সামনে দিয়ে সিনেমার মত দেখি।
আপনারা কেউ পারবেন আমার এই সিনেমা দেখা থেকে মুক্তির পথ দেখাতে?

No comments:

Post a Comment

Thank you very much for your comments.