আজ থেকে অনেক অনেক বছর আগে যখন অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরা গাছের ডালে গাছের
পাতা দিয়ে ঘর বানিয়ে বসবাস করত আর ভারত মহাসাগরের সব নোনা পানি ছিল গভীর
নীল রঙের। আবার ওদিকে আরব দেশের মরুভূমিতে ধু ধু করত বালিয়াড়ির উড়ন্ত টিলা
এবং আরব দেশ গুলি যে উপসাগরের তীর
দিয়ে অবস্থিত ছিল সে উপসাগরের নাম ছিল পারস্য উপসাগর যা বর্তমানে আরব্য উপসাগর।
ঠিক তেমনি কোন এক সময়ে আমার দ্বিতীয় ভয়েজে (সমুদ্র যাত্রা) এক বার কুয়েত থেকে জাহাজ লোড করছি, আমি তখন ডেক ক্যাডেট। তখন রমজান চলছে, আরব দেশের মত আনন্দের রমজান আর কোথাও দেখিনি। গরমের তাড়নায় সে দেশের ছেলেমেয়েদের দেখেছি রাতের বেলা খেলা করতে। রোজার দিনে বাইরে প্রকাশ্যে কাউকে খাবার খেতে দেখলে নাকি ঈদ পর্যন্ত জেলখানায় আটকে রাখে। আমরা যেতাম ২/১ দিনের জন্য, জাহাজ লোড হতে যতক্ষণ লাগে। কাজেই সে দেশের সামাজিক, পারিবারিক, শিক্ষা, সংস্কৃতি বা আচার অনুষ্ঠানের তেমন কিছু জানতে পারিনি। জাহাজে পাম্প ম্যান, পাইপ ফিটার বা তেলের নমুনা সংগ্রহের জন্য যারা আসত তাদের কাছে যতটা জানতে পেরেছি ততটুকুই আমার দৌড়। একটা দেশের সার্বিক বিষয় জানতে হলে সে দেশে অন্তত একটা বছর বা বছরের সবগুলি ঋতু থাকতে হয়, না হলে সব কিছু হৃদয় বা মন দিয়ে জানা যায় না।
দুপুর পর্যন্ত সমস্ত লোকজনের চলাচল আর দোকান বাজার সব বন্ধ, বাইরে কাউকে দেখাই যায় না বলা যায়। দুপুরের পর থেকে মোটামুটি সব খুলতে শুরু করে এবং শুরু হয়ে যায় হোটেল রেস্টুরেন্ট গুলির ইফতার আয়োজন। সারা রাত ধরে বাজার দোকান সব কিছু খোলা। যার যা খুশি কিনে খাও কেউ কিছু বলবে না, আবার ফজরের আজানের সাথে সাথে সব বন্ধ। ওই মরুভূমির তেলের দেশে তখন ডানহিল বা রদম্যান সিগারেট টেনে কোন গন্ধ না পেলে কি হবে ইফতারির গন্ধে মন ভরে যেত। দেশের কথা, বাড়ির কথা, মায়ের কথা মনে হত। কিন্তু যে জীবিকা বেছে নিয়েছি তাতে যে প্রবাসেই নিজেকে বিলিয়ে দিতে হবে কাজেই আফসোস করে কোন লাভ নেই। দেশের মায়া করে কি হবে? মনকে প্রবোধ দিতাম এমন করে। লোক জন ঘুরছে, ঈদের কেনাকাটা করছে আবার বাড়ি ফেরার পথে ইফতার কিনে নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের কখনও কিনতে হয়নি কারণ আমাদের ক্যাপ্টেন ইউরোপিয়ান হলে কি হবে আমাদের জন্য যথেষ্ট টান ছিল। তার নির্দেশে জাহাজেই আমাদের ইফতার তৈরী হত। জাহাজটি ছিল ব্রিটিশ পতাকাবাহী। দুইটি মহাদেশের ৮ টি দেশের ২১ জন নাবিক। আমরা বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান এবং ইরান সহ এশিয়ান ছিলাম ৯ জন আর পোল্যান্ড, চেকোস্লাভিয়া, গ্রিস এবং ব্রিটেন মিলে ইউরোপিয়া্নরা ছিল ১২ জন নাবিক। এক দিন ইফতারির সময় জাহাজ লোড হচ্ছে এবং আমরা কয়েক জন মুসলমান জাহাজ লোডিং এর কাজ করছি এবং সেকেন্ড কুকও মুসলমান বলে সে নিজেই বলে দিয়েছে আপনারা কোন চিন্তা করবেন না আমি আপনাদের ইফতার ডেকে এনে দিয়ে যাব। সেদিন ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন ম্যাথিউস ব্রিজের উপরে দাঁড়িয়ে দেখল যে কুক ইফতারির প্লেট নিয়ে ডেকে আসছে আর অমনি সে কয়েকজন ইউরোপিয়ান খ্রিষ্টানকে সঙ্গে নিয়ে ডেকে এসে হাজির। আমাদের ডেকে বলল তোমরা যাও ইফতার করে আধা ঘণ্টার মধ্যে চলে এস আমি লোডিং দেখছি।
এর কয়েকদিন পরে আবার যখন এসেছি তখন লোড নিয়ে সাউথ আফ্রিকার পোর্ট এলিজাবেথ যাব। তার কয়েক দিন পরেই ঈদ উল ফিতর। হিসেব করে দেখলাম ঈদ হবে পথে, আরব সাগরে। এইতো ভাগ্যে আছে, ভেবে কোন লাভ নেই, কোন অবস্থাতেই ঈদের জন্য চার দিন দেরি করা যাবে না। পোর্ট ডিউজ ও জাহাজের ভাড়া মিলিয়ে প্রায় কয়েক হাজার ডলারে পৌঁছে যাবে। ক্যাপ্টেন বা কোম্পানি কেউ রাজী হবে না। বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং ইরানের আমরা আট জনের ঈদ। এর মধ্যা আমরা বাংলাদেশের ছয় জন। আমরা সবাই একই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী। রাতে ওয়াহিদ ভাই এর কেবিনে মিটিং হল। আমি বললাম কুয়েতে ঈদ করা যাবে না বলে কি ঈদ করব না?
না, ঈদ করব ইনশাল্লাহ!
কি ভাবে?
কেন, জাহাজে!
কে জামাত পরাবে?
কেন ইরানি সালামাতুল্লাহ!
হ্যাঁ তা করা যায়।
শুধু নামাজ, আর কিছু হবে না?
আর আবার কি?
চলেন না ওয়াহিদ ভাই আমরা একটু ভিন্ন স্বাদের ঈদ সেলিবরেট করি! এমন সুযোগ আবার কবে আসে কে জানে!
কি ভাবে বল
সেদিন আমরা এরাবিয়ান সি তে থাকব, আমাদের ডাইনে থাকবে কোস্ট এবং বায়ে থাকবে মাদাগাস্কার দ্বীপ, মানে সি যদি খারাপও থাকে তাহলেও রোলিং হবার সম্ভাবনা খুব কম কাজেই আমার মনে হয় আমরা ছোট্ট একটা নাটকের মত করি আর সমস্ত জাহাজটা ফ্ল্যাগ দিয়ে সাজিয়ে ফেলব। সবাইকে ইনভাইট করব। সেকেন্ড অফিসার ওই পার্কারকে বলব সেদিনের জন্য স্পেশাল মেনুর যোগান দিতে। পাকিস্তানি সেকেন্ড কুক সামসু সব রানা করবে বলেছে। পার্কার যদি দিতে রাজি না হয় তাহলে ক্যাপ্টেনকে বলব।
ধুর বোকা তা কি করে করবে? সব কিছুই করা যাবে কিন্তু নাটকের কি দরকার? আর এটা করবেই কেমনে এবং কোথায়?
কেন ওইতো ব্রিজের স্টারবোর্ড সাইডে (ডান দিকে) সকালে রোদ থাকবে না। সেমাই বা মিষ্টি যা রানা করে তাই খেয়ে নামাজ পরে তারপরে সবাই মিলে ব্রেকফাস্ট করব চিকেন পোলাও দিয়ে। খেয়ে তারপরে ওই যে মিজান সেদিন যে কৌতুকটা বলল ওটাকে একটু ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে আমরা কয়েকজন অভিনয় করব।
কি যে বল এরা কি কেউ আমাদের বাংলা বুঝবে?
বাংলায় করব কেন, ইংরেজিতেই করব!
কিছুক্ষণ ভেবে আমাদের পালের সর্দার থার্ড অফিসার ওয়াহিদ ভাই সম্মতি দিল।
ঠিক আছে এমন হলে করা যায়। কিন্তু স্ক্রিপ্ট লিখবে কে? তুমি লিখবে?
আপনি যদি পারমিশন নিতে পারেন তাহলে আমি লিখব এবং যে দুই দিন বাকী আছে এর মধ্যে রিহার্সালও করতে পারব। আমি স্কুলে আর কলেজে অনেক নাটক করেছি। দেখেন ভাই আপনি ক্যাপ্টেনের অনুমতিটা নিয়ে নিন। বাকী যা আছে আমি করতে পারব। আপনি আজ রাতে যখন ক্যাপ্টেনের সাথে ডিউটি করবেন তখনই বলে দেখেন কি বলে!
ঠিক আছে আমি বলব।
সে রাতের মত মিটিং শেষ করে যার যার কেবিনে গিয়ে শুয়ে পরলাম। জাহাজ চলছে, নাইট নেভিগেশন আছে, ঘুমিয়ে মাথা ঠাণ্ডা রেখে ডিউটি করতে হবে।
পরদিন দুপুরে সিঁড়ি দিয়ে উঠছি আর ওয়াহিদ ভাই নামছে এমন সময় দেখি উনি হাসতে হাসতে বলছে তোমার প্রস্তাবে ক্যাপ্টেন রাজী আছে। ঈদ সম্পর্কে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করল। উনি কিছুই জানত না। প্রায় সারা রাত ধরেই আলাপের বিষয় ছিল ঈদ। মুসলমানেরা ঈদ কেমনে করে, ড্রিঙ্ক করে নাকি ইত্যাদি ইত্যাদি নানা কৌতূহল। শেষ পর্যন্ত শুধু রাজী হয়নি সারা দিন ধরে ফিস্ট হবে যে যা খায়, সবই হবে ইন্ডিয়ান মেনু। নো ইউরোপিয়ান মেনু। সকালের ব্রেকফাস্ট থেকে শুরু করে রাতের ডিনার সব হবে এক সাথে বসে। ব্রিজে শুধু ডিউটি অফিসার আর হেলমসম্যান আর ইঞ্জিন রুমে এক জন গ্রিজার আর ডিউটি ইঞ্জিনিয়ার থাকবে। সারাদিনের ড্রিঙ্কস ফ্রি। সে তার নিজের থেকে শুধু আমাদের জন্য এক গ্যালন ড্রাই জিন এর একটা বোতল আর এক কেস বিয়ার দিবে। অনেক দিন যাবত কুয়েত এলাকায় আছি বলে বার এ হুইস্কি নেই। পোর্ট এলিজাবেথ যাবার আগে কিছু পাওয়া যাবে না। তোমার নাটকের কথা শুনে আশ্চর্য হয়ে গেল। বলল,
বল কি? কি ভাবে করবে?
বলেই সেকেন্ড অফিসার পার্কারকে ডেকে পরামর্শ করল, কি ভাবে করবে তার একটা দিক নির্দেশনা দিয়ে দিল। আসলে জাহাজে তো এমন অনুষ্ঠান কেউ কখনও করেনি তাই একটু ভাবতে হয়েছে। তবে হ্যাঁ লোকটার মন আছে। পার্কারকে খাবারের জন্য স্টোর থেকে সব কিছু বের করে দিতে বলে দিল। শুধু তাই না, বারবার করে বলে দিয়েছে দেখ পার্কার দিস ইজ রেলিজিয়াস ফেস্টিভল, সো টেক ইট কেয়ারফুলি।
ক্যাপ্টেনের অনুমতি পেয়ে আমাকে আর পায় কে? সঙ্গে সঙ্গে লেগে গেলাম কাজে। মিজানের ডিউটি ছিল আমার সাথে। ব্রিজে গিয়েই ওর কাছে সেই কৌতুকটা আবার ভাল করে মন দিয়ে শুনে নিলাম। স্ক্রিপ্ট লেখার কাজটা ওই ডিউটি সময়ের মধ্যে সেরে ফেললাম। বিকেলে ডিউটি সেরে নিচে কেবিনে যাবার আগে ওয়াহিদ ভাইকে স্ক্রিপ্ট দেখালাম। ভাই বলল
বেশী ছোট হয়ে যায় না? আধা ঘন্টাওতো লাগবে না!
হ্যাঁ আমিও তাই ভাবছি, আচ্ছা ওয়াহিদ ভাই এক কাজ করব?
কি?
এর সাথে আরও কিছু কৌতুক জুড়ে দিই?
হ্যাঁ তাহলে তো খুবই ভাল হয়। তাই কর।
সেলুন থেকে রাতের খাবার খেয়ে মিজান, জাফর ওদের সবাইকে ডেকে নিজের কেবিনে এসে কাপড় বদলে আবার স্ক্রিপ্ট নিয়ে বসলাম।
স্ক্রিপ্ট লেখা শেষ এবার রিহারসেলের পালা। এই ডিউটির ফাঁকে ফাঁকে সেরে মোটামুটি রেডি হয়ে রইলাম।
দুইদিন পরে রাতে ডিউটির সময় জাহাজ কোন অনুষ্ঠানের সময় যে ভাবে এলফাবেটিক ফ্ল্যাগ দিয়ে সাজায় সে ভাবে রেডি করে রাখলাম যাতে পিছনের আকাশ লাল হবার সাথে সাথেই সামনের মাস্ট থেকে পিছনের মাস্ট পর্যন্ত টানিয়ে দেয়া যায়। ব্রিজের পোর্ট উইংস এ তারপলিনের উপর চাদর বিছিয়ে নামাজের জায়গা করে রাখলাম।
দেশ ছেড়ে, আত্মীয় স্বজন ছেড়ে আসা এই কয়েকজন তরুণের আকুতি জানতে পেরে আরব সাগর নিশ্চুপ হয়ে রয়েছে, একেবারে শান্ত একটুও ঢেউ নেই। এই সময় সামান্য কিছু ঢেউ থাকে কিন্তু মাস্কাটের পাশে দিয়ে ওমান উপসাগর পার হয়ে আরব সাগরে আসার পর থেকেই দেখছি বেশ শান্ত ভাব। আল্লাহর কাছে বলছি কাল সারা দিন যেন এই রকমই থাকে। আমরা তট ভূমি থেকে প্রায় দুইশ মাইল সাগরের ভিতর দিয়ে ঘণ্টায় বার নটিক্যাল মেইল বেগে পোর্ট এলিজাবেথের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। পথে কোথাও থামার প্রয়োজন নেই কারণ খাবার, পানি এবং জ্বালানি যা প্রয়োজন তা কুয়েত থেকেই ট্যাংক ভরে নিয়ে এসেছি। সামনে ডানে রয়েছে ইয়েমেন এর হাদরামুথ পার্বত্য এলাকা এবং তার পরেই এডেন উপসাগরের মুখ। এইটুক পার হলেই বায়ে থাকবে মাদাগাস্কার দ্বিপ আর ডানে থাকবে সোমালিয়া, নাইরোবি, কেনিয়া, তানজানিয়া আর মোজাম্বিক। এই এলাকায় ঢেউ থাকবে না বললেই চলে।
রাতের ডিউটিতে ছিল মিজান আর পার্কার। মিজানকে বলে রেখেছিলাম পুব আকাশে লালিমা দেখার সাথে সাথে আমাকে ডেকে দিবে। ভোর বেলা পার্কারের হাতে স্টিয়ারিং ধরিয়ে আমাকে ডাকতে গেল। মিজানের ডাকে লাফ দিয়ে উঠে সিংকে একটু কুলি করে ওর সাথে ব্রিজে গেলাম। সাজাবার ফ্ল্যাগ গুলি টানিয়ে দিয়ে মিজান আবার গেল স্টিয়ারিং ধরতে আর আমি অন্য সবাইকে ঘুম থেকে জাগিয়ে গোসল করতে গেলাম।
ধোয়া ইস্ত্রি করা কাপড় পরে গ্যালিতে (কিচে্নে) এসে দেখি সামসু সেমাই, জর্দা যা কিছু রানা করে রেখেছিল গত রাতে শোবার আগে সে সব বের করে গোসলে যাবার জন্য বের হচ্ছে। আমাকে দেখে বলল ওই যে ওখানে সব আছে যা ভাল লাগে খেয়ে আস আমি গোসল করে আসছি।
সেমাই আর জর্দা খেয়ে আবার কেবিনে এসে মাথার টুপি নিয়ে স্টোর থেকে দুইটা চাদর বের করে আবার ব্রিজে গেলাম। গত রাতে ব্রিজের পোর্ট সাইডে (বাম পাশে) বিছান তারপলিনের উপর চাদর বিছিয়ে রেডি করে পার্কারের হাত থেকে স্টিয়ারিং নিয়ে নিলাম। এর মধ্যে পার্কার মিজানকে ছেড়ে দিয়েছে। আধা ঘণ্টার মধ্যে সবাই গোসল সেরে মিষ্টি খেয়ে এসে পরল। এর মধ্যে পুব আকাশের লালিমার মাঝে বিশাল টকটকে লাল রঙের সূর্য আরব সাগরের দিগন্ত রেখা থেকে বেশ কিছুটা উপরে উঠে এসেছে। ইরানি সালামতুল্লাহ আরবি পোশাক পরে এসেছে ইমামতি করবে বলে। স্টিয়ারিং করার সময় পার্কারের সাথে ঈদ সম্পর্কে টুকিটাকি কিছু আলাপ করলাম। সবাই আসার পর পার্কার আমাকে বলল ঠিক আছে তুমি যাও আমি দেখছি।
দেশের মসজিদে বা ঈদগাহে যেমন ঈদের জামাত হয়েছে তেমনি জামাত পড়াল ইরানি সালামতুল্লাহ।
নামাজ হয়ে গেলে সকাল ৬।৩০ মিনিটে সেলুনে (ডাইনিং রুম বা বসার ঘর) এসে দেখি জাহাজের প্রায় সবাই ব্রেকফাস্টের জন্য হাজির। আগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সেদিন চিকেন পোলাও, চিকেন রোস্ট দিয়ে সবাই ব্রেকফাস্ট করলাম। অন্যান্যরা সাথে সেমাই আর জর্দাও টেস্ট করে দেখল। চিকেন পোলাও, রোস্ট সেমাই আর জর্দার গন্ধে সেলুনে একেবারে পুরোপুরি বাড়ির ঈদের ডাইনিং রুমের গন্ধ।
মনটা ভরে গেল। আপন জনের বিরহ ভুলে গেলাম। এই আরব সাগরের বুকে এমন ঈদ আর কে কবে করেছে এমন করে? সম্ভবত আমরাই প্রথম! হয়তবা তাই হবে। এর আগে যদি কেউ করেও থাকে তাহলে সে কথা কোন ইতিহাসে লেখা নেই কেন? এই যেমন আমরা সেদিন মানে ১৯৭৮ সালে ঈদ করেছি আর আজ ৩৪ বছর পরে সেই ইতিহাস লিখে রেখে গেলাম, এমনি করে কি কেউ লিখত না? যাক, আপাতত সে ইতিহাস বা ভূগোলের কোন দরকার নেই।
খাবার পরে ক্যাপ্টেন ম্যাথিউস ছোট খাট একটা বক্তৃতা দিয়ে সবাইকে ঈদ মোবারক জানাল। আমরা জাহাজের খ্রিস্টান হিন্দু সবার সাথে কোলাকুলি করলাম। কোলাকুলি করে আমাদের সর্দার ওয়াহিদ ভাই সবাইকে ব্রিজের স্টারবোর্ড সাইডে (ডান দিকে) আজকের ঈদের বিশেষ অনুষ্ঠান দেখার আমন্ত্রণ জানাল।
আগেই চেয়ার আর চাদর বিছিয়ে রেডি করে রেখেছিলাম। সবাই যাবার আগে আমরা চলে গেলাম।
সবাই আসার পর ক্যাপ্টেন, চিফ ইঞ্জিনিয়ার, চিফ অফিসার এদের জন্য নির্দিষ্ট চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে আমরা শুরু করলাম আমাদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
প্রথমে মিজান একটা বাংলা গান গাইল। তারপরে শুরু হল ছোট্ট কৌতুকাভিনয় (এখানে উল্লেখ করছি যে এই কৌতুকাভিনয় ইংরেজিতে করা হয়েছিল)-
অভিনয়ের পাত্র পাত্রী:
প্রথম কৌতুক:-
বাড়ির কর্তা, ব্রাউন – আমি
কর্তার পরিচারক, ডেভিড - মিজান
প্রথম প্রতিবেশী, এন্ড্রু – মহসীন
দ্বিতীয় প্রতিবেশী, জন – ওয়াহিদ ভাই
তৃতীয় প্রতিবেশী, ক্লিফ – জাফর
পাত্রী – নেই
নাটকের নাম- মনিব ও সাগরেদ
কর্তা – এই ডেভিড শোন, আমি কয়েক দিনের জন্য একটু প্লিমাউথে যাব ফিরে আসতে কয়েকদিন দেরি হবে। সাবধানে থাকবে।
ডেভিড - ঠিক আছে আপনি কোন চিন্তা করবেন না আমি এদিকে সব ঠিকঠাক মত সামলে রাখব।
কর্তা -কি করে সামলে রাখতে হয় জান কিছু? আমি যা বলি মন দিয়ে শোন।
ডেভিড - জী বলুন কর্তা মশাই।
কর্তা – শোন প্রতিবেশীরা সবাই শুধু সুযোগ নিতে চায় কাজেই কেউ কিছু চাইলে দিবে না। এটা সেটা বলে ফিরিয়ে দিবে।
ডেভিড - তা কি করে করব কর্তা?
কর্তা - যেমন কেউ যদি এসে বলে ডেভিড তোমাদের ছাতাটা একটু ধার দিবে? তখন বলবে যে আমাদের ছাতার হ্যান্ডল ভেঙ্গে গেছে আর কাপড় ছিরে গেছে তাই পানিতে সব ভিজে যায়। বুঝেছ? এই ভাবে কিছু একটা বলে দিবে।
ডেভিড - জী কর্তা বুঝেছি, আমি ঠিক এভাবেই বলব।
কর্তা যথা সময়ে গাড়ি বের করে চলে গেল। বিকেলে এক প্রতিবেশী এন্ড্রু এসে বলল, ওহে ডেভিড তোমার কর্তা কোথায়?
ডেভিড - আর বলবেন না, কর্তা ম্যানচেস্টারে গেছে ফিরে আসতে প্রায় এক মাস লাগবে! কেন? কি প্রয়োজন? আমি সাহায্য করতে পারি?
প্রতিবেশী – হ্যাঁ, মানে আজ ছুটির দিনতো তাই আমার বাড়ির সামনের ওই সিডার গাছটা কাটতে চেয়েছিলাম তোমাদের কুড়ালটা একটু দিতে পারবে?
ডেভিড - না না কি যে বলেন আমাদের কুড়াল দিয়ে কাজ হবে না, ওটার হ্যান্ডল ভেঙ্গে গেছে আর কাপড় ছিরে গেছেতো তাই পানি পরে।
প্রতিবেশী – কি বলছ ডেভিড! কুড়ালের কাপড় ছিরে কি করে? কুড়ালে কি কাপড় থাকে? ও বুঝেছি তুমি দিবে না এইতো? তা সরাসরি না বলে দিলেই হয়ে যায়। আচ্ছা ঠিক আছে আমি যাচ্ছি, তোমার কুড়াল লাগবে না।
এর দিন দুয়েক পরে ব্রাউন ফিরে এলো।
কর্তা - কি খবর ডেভিড? সব ঠিক ঠাক আছেতো?
ডেভিড - ঠিক থাকবে না মানে, সব ঠিক আছে ওইতো ওই বাড়ির এন্ড্রু এসেছিল কুড়াল নিতে কিন্তু আমি দিইনি। বলেছি কুড়ালের কাপড় ছিঁড়ে গেছে পানি পরে ওটা নিয়ে কিছু করতে পারবে না বলে তাড়িয়ে দিয়েছি। (বলে একটু বীরত্বের হাসি হাসল)।
কর্তা - আরে করেছ কি? কুড়ালে কি কাপড় থাকে? নাহ! তোমাকে নিয়ে আর পারছি না! শোন, এর পর কেউ কুড়াল চাইলে বলবে কুড়ালে ধার নেই। বুঝেছ?
ডেভিড - হ্যাঁ একেবারে পরিষ্কার করেই বুঝেছি।
কর্তা – বেশ, আমি আজ আবার ডেভন যাচ্ছি কেউ এলে কিন্তু আগের মত ঝামেলা বাধাবে না মনে রেখ।
কর্তা চলে যাবার পরপরই আর এক প্রতিবেশী জন এসে হাজির। দরজায় কলিং বেল টিপে দাঁড়িয়ে রইল।
ডেভিড - কে? দরজা খুলে দেখে জন। ও জন! বল বল তোমাকে কি ভাবে সাহায্য করব?
জন – দেখ ডেভিড আমি এসেছি ব্রাউনের কাছে, আমি একটু এক্সিটার যাব তা আমার গাড়িটার ইঞ্জিন স্টার্ট হচ্ছে না তাই ভাবলাম তোমাদের ঘোড়াটা নিয়ে গেলে মন্দ হয় না। ঘোড়াটা কোথায় একটু বলে দাও আমি সেখান থেকে নিয়ে যাই।
ডেভিড - আরে না, কি বলছ তুমি? আমাদের ঘোড়ার ধার নষ্ট হয়ে গেছে কিছুই কাটে না, তুমি ও ঘোড়া দিয়ে কি করবে? আর যাই কর অন্তত এক্সিটারে যেতে পারবে না।
জনও - আরে ডেভিড কি বলছ? ঘোড়ার ধার নষ্ট হয় কি করে? (মাথায় হাত দিয়ে) তুমি কি বলছ আমি কিছুই বুঝতে পারছি না! আচ্ছা ঠিক আছে আমার মনে হয় তোমার মাথায় কোন গণ্ডগোল দেখা দিয়েছে ব্রাউন এলে আমি বলব তোমাকে ছুটি দিতে। (বলে চলে গেল)।
পরদিন বিকেলে ব্রাউন ফিরে এলো।
কর্তা – কি খবর ডেভিড, সব ঠিক আছে?
ডেভিড - হ্যাঁ কর্তা, সব ঠিক আছে ওই বাড়ির জনও এসেছিল ঘোড়া নিতে আমি বলে দিয়েছি আমাদের ঘোড়ার ধার নষ্ট হয়ে গেছে কিছুই কাটেনা, আমার কথা শুনে এটা ওটা কিছুক্ষণ বকবক করে চলে গেছে।
কর্তা – ইস!!!! কি করেছ বেকুব কোথাকার! ঘোড়ার কি ধার নষ্ট হয় না হতে পারে?
ডেভিড - তাহলে কি বলতে হত?
কর্তা – বলতে পারতে যে আমাদের ঘোড়াটার পেটে অসুখ হয়েছে কয়েক দিন যাবত কিছু খেতে পারছে না শুধু পাতলা পায়খানা করছে আর ঘাসও খেতে পারছে না!
ডেভিড - হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক আছে কত্তা আবার যখন আসবে তখন ঠিক এমনি করে বলব, আর ভুল হবে না দেখবেন।
দু এক দিন পরে আবার ব্রাউনের এক মক্কেল কার্ডিফ যেতে বলল। সব কিছু গুছিয়ে নিয়ে ব্রাউন গাড়ি নিয়ে চলে গেল আর যাবার আগে ডেভিডকে ডেকে সাবধানে থাকতে বলে আগের মত উলটাপালটা আবোলতাবোল কিছু যেন না বলে সে ব্যাপারে সাবধান করে দিল।
দুই দিন পরে এক সন্ধ্যায়-
প্রতিবেশী ক্লিফ - ওহে ব্রাউন! বাড়িতে আছ ব্রাউন? চল, অনেক দিন তোমার সাথে পাবে যাই না, আজ তোমাকে যেতেই হবে!
ডেভিড – কি হয়েছে? এত চেঁচাচ্ছেন কেন, কি হয়েছে?
ক্লিফ – কি হে ডেভিড তুমি এমন করে বলছ কেন? ব্রাউনকে একটু ডেকে দাও ওকে নিয়ে আজ পাবে যাব এক সাথে ড্রিঙ্ক করব, অনেক দিন ওর সাথে দেখা হয় না!
ডেভিড – তাকেতো ডাকা যাবে না!
ক্লিফ – কেন?
ডেভিড – তার পেট খারাপ, পাতলা পায়খানা করছে, ঘাস টাস কিচ্ছু খেতে পারছে না বয়স হয়েছেতো দাতেও ধার নেই।
ক্লিফ – কি বললে? ব্রাউন আবার ঘাস খাওয়া শুরু করল কবে থেকে? কি সব আবোল তাবোল বকছ? ডাক ব্রাউনকে! আচ্ছা ঠিক আছে ডাকতে হবে না আমি দেখছি।
এই সীমিত পরিসরে এমন আয়োজন দেখে সবাই ভীষণ খুশী। অভিনেতা আর দর্শক মিলে ১৫/১৬ জন ছিলাম বাকীরা ছিল জাহাজ চলার ডিউটিতে ইঞ্জিন রুমে তবে জাহাজ অটো পাইলটিং এ দিয়ে পার্কারও মাঝে মাঝে এসে ব্রিজের পাশে দাঁড়িয়ে দেখছিল। তুমুল হাততালি। এর পর শুরু হল দ্বিতীয় কৌতুক।
দ্বিতীয় কৌতুক:-
পাখা বিক্রেতা - মহসীন
পাখা ক্রেতা - মিজান
পাখা বিক্রেতা - পাঙ্খা লাগব, পাঙ্খা! গরমে দেহ জুড়াইবেন, মন জুড়াইবেন। পাঙ্খা লাগব পাঙ্খা!
পাখা ক্রেতা - এই পাঙ্খা ওয়ালা, পাঙ্খার দাম কত?
পাখা বিক্রেতা - এইটা দশ পেনি আর এইটা বিশ পেনি
পাখা ক্রেতা - এই এইযে এইটা দাও একটা
পাখা বিক্রেতা - পাখা দিয়ে দাম বুঝে নিল।
পাখা ক্রেতা -পরদিন ক্রেতা ভাঙ্গা পাখা এনে দেখাল, কি পাখা দিয়েছ যে বাতাস নেবার আগেই ভেঙ্গে গেল
পাখা বিক্রেতা - ওহ, ভাইসাব কেমনে বাতাস নিছেন?পাঙ্খা কিনছেন আর বাতাস নেওয়ার কায়দা শিখা যাইবেন না?
পাখা ক্রেতা -কেন যেমনে বাতাস নেয়, এই যে এই ভাবে
পাখা বিক্রেতা - ও বুঝছি, আরে মিয়া দশ পেনি দিয়া পাঙ্খা কিনা আবার এমনে বাতাস নিতে চান? পোলার মায়রে কইবেন পাঙ্খা ধরতে আর আপনে পাঙ্খার সামনে খাড়াইয়া মুখ লারাইবেন। বুঝছেন? যানগা এইবার বাড়ি লইয়া যান।
সবাই বেশ উপভোগ করেছিল। এই সীমিত পরিবেশে যত ছোট আয়োজনই হোক তবুও কিছু একটাতো হয়েছে! এর পরে বেশ কিছুদিন ডেভিডের ওই ডায়লগটা অনেক দিন চালু ছিল, ব্রাউন কয়েক দিন যাবত ঘাস খাচ্ছে না।
এর পর ওয়াহিদ ভাই অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করে লাঞ্চের জন্য সবাইকে আমন্ত্রণ জানাল। ডাইনিং রুমে এসে দেখি এলাহি কারবার। বাটার রাইস উইথ ভেজিটেবল, টার্কি রোস্ট, মাটন লেগ রোস্ট, বিফ কারি (গ্রিক স্টাইল), ভেজিটেবল, সবুজ সালাদ, ফ্রুট কাস্টার্ড, আইসক্রিম এবং ক্যাপ্টেনের পক্ষ থেকে এক গ্যালন ড্রাই জিন আর এক কেস বিয়ার। কোক ফানটা ফ্রি। এই রান্না সব করেছে আমাদের জাহাজের চিফ কুক গ্রিসের মনটি।
দুপুরের খাবার পর সবাই যার যার কাজে চলে গেলাম। জাহাজে এমন অতিরিক্ত মানুষ থাকে না যারা আমাদের ছুটির পরিবর্তে জাহাজ চালিয়ে নিয়ে যাবে। এই ঈদের তিন দিন পরে আমরা সাউথ আফ্রিকার পোর্ট এলিজাবেথে পৌঁছেছিলাম। জীবনের একটা ঐতিহাসিক ঈদের স্মৃতি এখনও মস্তিষ্কের মেমোরি কম্পার্টমেন্টে জমা হয়ে রয়েছে দেখে অবাক লাগছে। কত দিন আগের কথা!
দিয়ে অবস্থিত ছিল সে উপসাগরের নাম ছিল পারস্য উপসাগর যা বর্তমানে আরব্য উপসাগর।
ঠিক তেমনি কোন এক সময়ে আমার দ্বিতীয় ভয়েজে (সমুদ্র যাত্রা) এক বার কুয়েত থেকে জাহাজ লোড করছি, আমি তখন ডেক ক্যাডেট। তখন রমজান চলছে, আরব দেশের মত আনন্দের রমজান আর কোথাও দেখিনি। গরমের তাড়নায় সে দেশের ছেলেমেয়েদের দেখেছি রাতের বেলা খেলা করতে। রোজার দিনে বাইরে প্রকাশ্যে কাউকে খাবার খেতে দেখলে নাকি ঈদ পর্যন্ত জেলখানায় আটকে রাখে। আমরা যেতাম ২/১ দিনের জন্য, জাহাজ লোড হতে যতক্ষণ লাগে। কাজেই সে দেশের সামাজিক, পারিবারিক, শিক্ষা, সংস্কৃতি বা আচার অনুষ্ঠানের তেমন কিছু জানতে পারিনি। জাহাজে পাম্প ম্যান, পাইপ ফিটার বা তেলের নমুনা সংগ্রহের জন্য যারা আসত তাদের কাছে যতটা জানতে পেরেছি ততটুকুই আমার দৌড়। একটা দেশের সার্বিক বিষয় জানতে হলে সে দেশে অন্তত একটা বছর বা বছরের সবগুলি ঋতু থাকতে হয়, না হলে সব কিছু হৃদয় বা মন দিয়ে জানা যায় না।
দুপুর পর্যন্ত সমস্ত লোকজনের চলাচল আর দোকান বাজার সব বন্ধ, বাইরে কাউকে দেখাই যায় না বলা যায়। দুপুরের পর থেকে মোটামুটি সব খুলতে শুরু করে এবং শুরু হয়ে যায় হোটেল রেস্টুরেন্ট গুলির ইফতার আয়োজন। সারা রাত ধরে বাজার দোকান সব কিছু খোলা। যার যা খুশি কিনে খাও কেউ কিছু বলবে না, আবার ফজরের আজানের সাথে সাথে সব বন্ধ। ওই মরুভূমির তেলের দেশে তখন ডানহিল বা রদম্যান সিগারেট টেনে কোন গন্ধ না পেলে কি হবে ইফতারির গন্ধে মন ভরে যেত। দেশের কথা, বাড়ির কথা, মায়ের কথা মনে হত। কিন্তু যে জীবিকা বেছে নিয়েছি তাতে যে প্রবাসেই নিজেকে বিলিয়ে দিতে হবে কাজেই আফসোস করে কোন লাভ নেই। দেশের মায়া করে কি হবে? মনকে প্রবোধ দিতাম এমন করে। লোক জন ঘুরছে, ঈদের কেনাকাটা করছে আবার বাড়ি ফেরার পথে ইফতার কিনে নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের কখনও কিনতে হয়নি কারণ আমাদের ক্যাপ্টেন ইউরোপিয়ান হলে কি হবে আমাদের জন্য যথেষ্ট টান ছিল। তার নির্দেশে জাহাজেই আমাদের ইফতার তৈরী হত। জাহাজটি ছিল ব্রিটিশ পতাকাবাহী। দুইটি মহাদেশের ৮ টি দেশের ২১ জন নাবিক। আমরা বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান এবং ইরান সহ এশিয়ান ছিলাম ৯ জন আর পোল্যান্ড, চেকোস্লাভিয়া, গ্রিস এবং ব্রিটেন মিলে ইউরোপিয়া্নরা ছিল ১২ জন নাবিক। এক দিন ইফতারির সময় জাহাজ লোড হচ্ছে এবং আমরা কয়েক জন মুসলমান জাহাজ লোডিং এর কাজ করছি এবং সেকেন্ড কুকও মুসলমান বলে সে নিজেই বলে দিয়েছে আপনারা কোন চিন্তা করবেন না আমি আপনাদের ইফতার ডেকে এনে দিয়ে যাব। সেদিন ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন ম্যাথিউস ব্রিজের উপরে দাঁড়িয়ে দেখল যে কুক ইফতারির প্লেট নিয়ে ডেকে আসছে আর অমনি সে কয়েকজন ইউরোপিয়ান খ্রিষ্টানকে সঙ্গে নিয়ে ডেকে এসে হাজির। আমাদের ডেকে বলল তোমরা যাও ইফতার করে আধা ঘণ্টার মধ্যে চলে এস আমি লোডিং দেখছি।
এর কয়েকদিন পরে আবার যখন এসেছি তখন লোড নিয়ে সাউথ আফ্রিকার পোর্ট এলিজাবেথ যাব। তার কয়েক দিন পরেই ঈদ উল ফিতর। হিসেব করে দেখলাম ঈদ হবে পথে, আরব সাগরে। এইতো ভাগ্যে আছে, ভেবে কোন লাভ নেই, কোন অবস্থাতেই ঈদের জন্য চার দিন দেরি করা যাবে না। পোর্ট ডিউজ ও জাহাজের ভাড়া মিলিয়ে প্রায় কয়েক হাজার ডলারে পৌঁছে যাবে। ক্যাপ্টেন বা কোম্পানি কেউ রাজী হবে না। বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং ইরানের আমরা আট জনের ঈদ। এর মধ্যা আমরা বাংলাদেশের ছয় জন। আমরা সবাই একই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী। রাতে ওয়াহিদ ভাই এর কেবিনে মিটিং হল। আমি বললাম কুয়েতে ঈদ করা যাবে না বলে কি ঈদ করব না?
না, ঈদ করব ইনশাল্লাহ!
কি ভাবে?
কেন, জাহাজে!
কে জামাত পরাবে?
কেন ইরানি সালামাতুল্লাহ!
হ্যাঁ তা করা যায়।
শুধু নামাজ, আর কিছু হবে না?
আর আবার কি?
চলেন না ওয়াহিদ ভাই আমরা একটু ভিন্ন স্বাদের ঈদ সেলিবরেট করি! এমন সুযোগ আবার কবে আসে কে জানে!
কি ভাবে বল
সেদিন আমরা এরাবিয়ান সি তে থাকব, আমাদের ডাইনে থাকবে কোস্ট এবং বায়ে থাকবে মাদাগাস্কার দ্বীপ, মানে সি যদি খারাপও থাকে তাহলেও রোলিং হবার সম্ভাবনা খুব কম কাজেই আমার মনে হয় আমরা ছোট্ট একটা নাটকের মত করি আর সমস্ত জাহাজটা ফ্ল্যাগ দিয়ে সাজিয়ে ফেলব। সবাইকে ইনভাইট করব। সেকেন্ড অফিসার ওই পার্কারকে বলব সেদিনের জন্য স্পেশাল মেনুর যোগান দিতে। পাকিস্তানি সেকেন্ড কুক সামসু সব রানা করবে বলেছে। পার্কার যদি দিতে রাজি না হয় তাহলে ক্যাপ্টেনকে বলব।
ধুর বোকা তা কি করে করবে? সব কিছুই করা যাবে কিন্তু নাটকের কি দরকার? আর এটা করবেই কেমনে এবং কোথায়?
কেন ওইতো ব্রিজের স্টারবোর্ড সাইডে (ডান দিকে) সকালে রোদ থাকবে না। সেমাই বা মিষ্টি যা রানা করে তাই খেয়ে নামাজ পরে তারপরে সবাই মিলে ব্রেকফাস্ট করব চিকেন পোলাও দিয়ে। খেয়ে তারপরে ওই যে মিজান সেদিন যে কৌতুকটা বলল ওটাকে একটু ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে আমরা কয়েকজন অভিনয় করব।
কি যে বল এরা কি কেউ আমাদের বাংলা বুঝবে?
বাংলায় করব কেন, ইংরেজিতেই করব!
কিছুক্ষণ ভেবে আমাদের পালের সর্দার থার্ড অফিসার ওয়াহিদ ভাই সম্মতি দিল।
ঠিক আছে এমন হলে করা যায়। কিন্তু স্ক্রিপ্ট লিখবে কে? তুমি লিখবে?
আপনি যদি পারমিশন নিতে পারেন তাহলে আমি লিখব এবং যে দুই দিন বাকী আছে এর মধ্যে রিহার্সালও করতে পারব। আমি স্কুলে আর কলেজে অনেক নাটক করেছি। দেখেন ভাই আপনি ক্যাপ্টেনের অনুমতিটা নিয়ে নিন। বাকী যা আছে আমি করতে পারব। আপনি আজ রাতে যখন ক্যাপ্টেনের সাথে ডিউটি করবেন তখনই বলে দেখেন কি বলে!
ঠিক আছে আমি বলব।
সে রাতের মত মিটিং শেষ করে যার যার কেবিনে গিয়ে শুয়ে পরলাম। জাহাজ চলছে, নাইট নেভিগেশন আছে, ঘুমিয়ে মাথা ঠাণ্ডা রেখে ডিউটি করতে হবে।
পরদিন দুপুরে সিঁড়ি দিয়ে উঠছি আর ওয়াহিদ ভাই নামছে এমন সময় দেখি উনি হাসতে হাসতে বলছে তোমার প্রস্তাবে ক্যাপ্টেন রাজী আছে। ঈদ সম্পর্কে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করল। উনি কিছুই জানত না। প্রায় সারা রাত ধরেই আলাপের বিষয় ছিল ঈদ। মুসলমানেরা ঈদ কেমনে করে, ড্রিঙ্ক করে নাকি ইত্যাদি ইত্যাদি নানা কৌতূহল। শেষ পর্যন্ত শুধু রাজী হয়নি সারা দিন ধরে ফিস্ট হবে যে যা খায়, সবই হবে ইন্ডিয়ান মেনু। নো ইউরোপিয়ান মেনু। সকালের ব্রেকফাস্ট থেকে শুরু করে রাতের ডিনার সব হবে এক সাথে বসে। ব্রিজে শুধু ডিউটি অফিসার আর হেলমসম্যান আর ইঞ্জিন রুমে এক জন গ্রিজার আর ডিউটি ইঞ্জিনিয়ার থাকবে। সারাদিনের ড্রিঙ্কস ফ্রি। সে তার নিজের থেকে শুধু আমাদের জন্য এক গ্যালন ড্রাই জিন এর একটা বোতল আর এক কেস বিয়ার দিবে। অনেক দিন যাবত কুয়েত এলাকায় আছি বলে বার এ হুইস্কি নেই। পোর্ট এলিজাবেথ যাবার আগে কিছু পাওয়া যাবে না। তোমার নাটকের কথা শুনে আশ্চর্য হয়ে গেল। বলল,
বল কি? কি ভাবে করবে?
বলেই সেকেন্ড অফিসার পার্কারকে ডেকে পরামর্শ করল, কি ভাবে করবে তার একটা দিক নির্দেশনা দিয়ে দিল। আসলে জাহাজে তো এমন অনুষ্ঠান কেউ কখনও করেনি তাই একটু ভাবতে হয়েছে। তবে হ্যাঁ লোকটার মন আছে। পার্কারকে খাবারের জন্য স্টোর থেকে সব কিছু বের করে দিতে বলে দিল। শুধু তাই না, বারবার করে বলে দিয়েছে দেখ পার্কার দিস ইজ রেলিজিয়াস ফেস্টিভল, সো টেক ইট কেয়ারফুলি।
ক্যাপ্টেনের অনুমতি পেয়ে আমাকে আর পায় কে? সঙ্গে সঙ্গে লেগে গেলাম কাজে। মিজানের ডিউটি ছিল আমার সাথে। ব্রিজে গিয়েই ওর কাছে সেই কৌতুকটা আবার ভাল করে মন দিয়ে শুনে নিলাম। স্ক্রিপ্ট লেখার কাজটা ওই ডিউটি সময়ের মধ্যে সেরে ফেললাম। বিকেলে ডিউটি সেরে নিচে কেবিনে যাবার আগে ওয়াহিদ ভাইকে স্ক্রিপ্ট দেখালাম। ভাই বলল
বেশী ছোট হয়ে যায় না? আধা ঘন্টাওতো লাগবে না!
হ্যাঁ আমিও তাই ভাবছি, আচ্ছা ওয়াহিদ ভাই এক কাজ করব?
কি?
এর সাথে আরও কিছু কৌতুক জুড়ে দিই?
হ্যাঁ তাহলে তো খুবই ভাল হয়। তাই কর।
সেলুন থেকে রাতের খাবার খেয়ে মিজান, জাফর ওদের সবাইকে ডেকে নিজের কেবিনে এসে কাপড় বদলে আবার স্ক্রিপ্ট নিয়ে বসলাম।
স্ক্রিপ্ট লেখা শেষ এবার রিহারসেলের পালা। এই ডিউটির ফাঁকে ফাঁকে সেরে মোটামুটি রেডি হয়ে রইলাম।
দুইদিন পরে রাতে ডিউটির সময় জাহাজ কোন অনুষ্ঠানের সময় যে ভাবে এলফাবেটিক ফ্ল্যাগ দিয়ে সাজায় সে ভাবে রেডি করে রাখলাম যাতে পিছনের আকাশ লাল হবার সাথে সাথেই সামনের মাস্ট থেকে পিছনের মাস্ট পর্যন্ত টানিয়ে দেয়া যায়। ব্রিজের পোর্ট উইংস এ তারপলিনের উপর চাদর বিছিয়ে নামাজের জায়গা করে রাখলাম।
দেশ ছেড়ে, আত্মীয় স্বজন ছেড়ে আসা এই কয়েকজন তরুণের আকুতি জানতে পেরে আরব সাগর নিশ্চুপ হয়ে রয়েছে, একেবারে শান্ত একটুও ঢেউ নেই। এই সময় সামান্য কিছু ঢেউ থাকে কিন্তু মাস্কাটের পাশে দিয়ে ওমান উপসাগর পার হয়ে আরব সাগরে আসার পর থেকেই দেখছি বেশ শান্ত ভাব। আল্লাহর কাছে বলছি কাল সারা দিন যেন এই রকমই থাকে। আমরা তট ভূমি থেকে প্রায় দুইশ মাইল সাগরের ভিতর দিয়ে ঘণ্টায় বার নটিক্যাল মেইল বেগে পোর্ট এলিজাবেথের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। পথে কোথাও থামার প্রয়োজন নেই কারণ খাবার, পানি এবং জ্বালানি যা প্রয়োজন তা কুয়েত থেকেই ট্যাংক ভরে নিয়ে এসেছি। সামনে ডানে রয়েছে ইয়েমেন এর হাদরামুথ পার্বত্য এলাকা এবং তার পরেই এডেন উপসাগরের মুখ। এইটুক পার হলেই বায়ে থাকবে মাদাগাস্কার দ্বিপ আর ডানে থাকবে সোমালিয়া, নাইরোবি, কেনিয়া, তানজানিয়া আর মোজাম্বিক। এই এলাকায় ঢেউ থাকবে না বললেই চলে।
রাতের ডিউটিতে ছিল মিজান আর পার্কার। মিজানকে বলে রেখেছিলাম পুব আকাশে লালিমা দেখার সাথে সাথে আমাকে ডেকে দিবে। ভোর বেলা পার্কারের হাতে স্টিয়ারিং ধরিয়ে আমাকে ডাকতে গেল। মিজানের ডাকে লাফ দিয়ে উঠে সিংকে একটু কুলি করে ওর সাথে ব্রিজে গেলাম। সাজাবার ফ্ল্যাগ গুলি টানিয়ে দিয়ে মিজান আবার গেল স্টিয়ারিং ধরতে আর আমি অন্য সবাইকে ঘুম থেকে জাগিয়ে গোসল করতে গেলাম।
ধোয়া ইস্ত্রি করা কাপড় পরে গ্যালিতে (কিচে্নে) এসে দেখি সামসু সেমাই, জর্দা যা কিছু রানা করে রেখেছিল গত রাতে শোবার আগে সে সব বের করে গোসলে যাবার জন্য বের হচ্ছে। আমাকে দেখে বলল ওই যে ওখানে সব আছে যা ভাল লাগে খেয়ে আস আমি গোসল করে আসছি।
সেমাই আর জর্দা খেয়ে আবার কেবিনে এসে মাথার টুপি নিয়ে স্টোর থেকে দুইটা চাদর বের করে আবার ব্রিজে গেলাম। গত রাতে ব্রিজের পোর্ট সাইডে (বাম পাশে) বিছান তারপলিনের উপর চাদর বিছিয়ে রেডি করে পার্কারের হাত থেকে স্টিয়ারিং নিয়ে নিলাম। এর মধ্যে পার্কার মিজানকে ছেড়ে দিয়েছে। আধা ঘণ্টার মধ্যে সবাই গোসল সেরে মিষ্টি খেয়ে এসে পরল। এর মধ্যে পুব আকাশের লালিমার মাঝে বিশাল টকটকে লাল রঙের সূর্য আরব সাগরের দিগন্ত রেখা থেকে বেশ কিছুটা উপরে উঠে এসেছে। ইরানি সালামতুল্লাহ আরবি পোশাক পরে এসেছে ইমামতি করবে বলে। স্টিয়ারিং করার সময় পার্কারের সাথে ঈদ সম্পর্কে টুকিটাকি কিছু আলাপ করলাম। সবাই আসার পর পার্কার আমাকে বলল ঠিক আছে তুমি যাও আমি দেখছি।
দেশের মসজিদে বা ঈদগাহে যেমন ঈদের জামাত হয়েছে তেমনি জামাত পড়াল ইরানি সালামতুল্লাহ।
নামাজ হয়ে গেলে সকাল ৬।৩০ মিনিটে সেলুনে (ডাইনিং রুম বা বসার ঘর) এসে দেখি জাহাজের প্রায় সবাই ব্রেকফাস্টের জন্য হাজির। আগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সেদিন চিকেন পোলাও, চিকেন রোস্ট দিয়ে সবাই ব্রেকফাস্ট করলাম। অন্যান্যরা সাথে সেমাই আর জর্দাও টেস্ট করে দেখল। চিকেন পোলাও, রোস্ট সেমাই আর জর্দার গন্ধে সেলুনে একেবারে পুরোপুরি বাড়ির ঈদের ডাইনিং রুমের গন্ধ।
মনটা ভরে গেল। আপন জনের বিরহ ভুলে গেলাম। এই আরব সাগরের বুকে এমন ঈদ আর কে কবে করেছে এমন করে? সম্ভবত আমরাই প্রথম! হয়তবা তাই হবে। এর আগে যদি কেউ করেও থাকে তাহলে সে কথা কোন ইতিহাসে লেখা নেই কেন? এই যেমন আমরা সেদিন মানে ১৯৭৮ সালে ঈদ করেছি আর আজ ৩৪ বছর পরে সেই ইতিহাস লিখে রেখে গেলাম, এমনি করে কি কেউ লিখত না? যাক, আপাতত সে ইতিহাস বা ভূগোলের কোন দরকার নেই।
খাবার পরে ক্যাপ্টেন ম্যাথিউস ছোট খাট একটা বক্তৃতা দিয়ে সবাইকে ঈদ মোবারক জানাল। আমরা জাহাজের খ্রিস্টান হিন্দু সবার সাথে কোলাকুলি করলাম। কোলাকুলি করে আমাদের সর্দার ওয়াহিদ ভাই সবাইকে ব্রিজের স্টারবোর্ড সাইডে (ডান দিকে) আজকের ঈদের বিশেষ অনুষ্ঠান দেখার আমন্ত্রণ জানাল।
আগেই চেয়ার আর চাদর বিছিয়ে রেডি করে রেখেছিলাম। সবাই যাবার আগে আমরা চলে গেলাম।
সবাই আসার পর ক্যাপ্টেন, চিফ ইঞ্জিনিয়ার, চিফ অফিসার এদের জন্য নির্দিষ্ট চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে আমরা শুরু করলাম আমাদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
প্রথমে মিজান একটা বাংলা গান গাইল। তারপরে শুরু হল ছোট্ট কৌতুকাভিনয় (এখানে উল্লেখ করছি যে এই কৌতুকাভিনয় ইংরেজিতে করা হয়েছিল)-
অভিনয়ের পাত্র পাত্রী:
প্রথম কৌতুক:-
বাড়ির কর্তা, ব্রাউন – আমি
কর্তার পরিচারক, ডেভিড - মিজান
প্রথম প্রতিবেশী, এন্ড্রু – মহসীন
দ্বিতীয় প্রতিবেশী, জন – ওয়াহিদ ভাই
তৃতীয় প্রতিবেশী, ক্লিফ – জাফর
পাত্রী – নেই
নাটকের নাম- মনিব ও সাগরেদ
কর্তা – এই ডেভিড শোন, আমি কয়েক দিনের জন্য একটু প্লিমাউথে যাব ফিরে আসতে কয়েকদিন দেরি হবে। সাবধানে থাকবে।
ডেভিড - ঠিক আছে আপনি কোন চিন্তা করবেন না আমি এদিকে সব ঠিকঠাক মত সামলে রাখব।
কর্তা -কি করে সামলে রাখতে হয় জান কিছু? আমি যা বলি মন দিয়ে শোন।
ডেভিড - জী বলুন কর্তা মশাই।
কর্তা – শোন প্রতিবেশীরা সবাই শুধু সুযোগ নিতে চায় কাজেই কেউ কিছু চাইলে দিবে না। এটা সেটা বলে ফিরিয়ে দিবে।
ডেভিড - তা কি করে করব কর্তা?
কর্তা - যেমন কেউ যদি এসে বলে ডেভিড তোমাদের ছাতাটা একটু ধার দিবে? তখন বলবে যে আমাদের ছাতার হ্যান্ডল ভেঙ্গে গেছে আর কাপড় ছিরে গেছে তাই পানিতে সব ভিজে যায়। বুঝেছ? এই ভাবে কিছু একটা বলে দিবে।
ডেভিড - জী কর্তা বুঝেছি, আমি ঠিক এভাবেই বলব।
কর্তা যথা সময়ে গাড়ি বের করে চলে গেল। বিকেলে এক প্রতিবেশী এন্ড্রু এসে বলল, ওহে ডেভিড তোমার কর্তা কোথায়?
ডেভিড - আর বলবেন না, কর্তা ম্যানচেস্টারে গেছে ফিরে আসতে প্রায় এক মাস লাগবে! কেন? কি প্রয়োজন? আমি সাহায্য করতে পারি?
প্রতিবেশী – হ্যাঁ, মানে আজ ছুটির দিনতো তাই আমার বাড়ির সামনের ওই সিডার গাছটা কাটতে চেয়েছিলাম তোমাদের কুড়ালটা একটু দিতে পারবে?
ডেভিড - না না কি যে বলেন আমাদের কুড়াল দিয়ে কাজ হবে না, ওটার হ্যান্ডল ভেঙ্গে গেছে আর কাপড় ছিরে গেছেতো তাই পানি পরে।
প্রতিবেশী – কি বলছ ডেভিড! কুড়ালের কাপড় ছিরে কি করে? কুড়ালে কি কাপড় থাকে? ও বুঝেছি তুমি দিবে না এইতো? তা সরাসরি না বলে দিলেই হয়ে যায়। আচ্ছা ঠিক আছে আমি যাচ্ছি, তোমার কুড়াল লাগবে না।
এর দিন দুয়েক পরে ব্রাউন ফিরে এলো।
কর্তা - কি খবর ডেভিড? সব ঠিক ঠাক আছেতো?
ডেভিড - ঠিক থাকবে না মানে, সব ঠিক আছে ওইতো ওই বাড়ির এন্ড্রু এসেছিল কুড়াল নিতে কিন্তু আমি দিইনি। বলেছি কুড়ালের কাপড় ছিঁড়ে গেছে পানি পরে ওটা নিয়ে কিছু করতে পারবে না বলে তাড়িয়ে দিয়েছি। (বলে একটু বীরত্বের হাসি হাসল)।
কর্তা - আরে করেছ কি? কুড়ালে কি কাপড় থাকে? নাহ! তোমাকে নিয়ে আর পারছি না! শোন, এর পর কেউ কুড়াল চাইলে বলবে কুড়ালে ধার নেই। বুঝেছ?
ডেভিড - হ্যাঁ একেবারে পরিষ্কার করেই বুঝেছি।
কর্তা – বেশ, আমি আজ আবার ডেভন যাচ্ছি কেউ এলে কিন্তু আগের মত ঝামেলা বাধাবে না মনে রেখ।
কর্তা চলে যাবার পরপরই আর এক প্রতিবেশী জন এসে হাজির। দরজায় কলিং বেল টিপে দাঁড়িয়ে রইল।
ডেভিড - কে? দরজা খুলে দেখে জন। ও জন! বল বল তোমাকে কি ভাবে সাহায্য করব?
জন – দেখ ডেভিড আমি এসেছি ব্রাউনের কাছে, আমি একটু এক্সিটার যাব তা আমার গাড়িটার ইঞ্জিন স্টার্ট হচ্ছে না তাই ভাবলাম তোমাদের ঘোড়াটা নিয়ে গেলে মন্দ হয় না। ঘোড়াটা কোথায় একটু বলে দাও আমি সেখান থেকে নিয়ে যাই।
ডেভিড - আরে না, কি বলছ তুমি? আমাদের ঘোড়ার ধার নষ্ট হয়ে গেছে কিছুই কাটে না, তুমি ও ঘোড়া দিয়ে কি করবে? আর যাই কর অন্তত এক্সিটারে যেতে পারবে না।
জনও - আরে ডেভিড কি বলছ? ঘোড়ার ধার নষ্ট হয় কি করে? (মাথায় হাত দিয়ে) তুমি কি বলছ আমি কিছুই বুঝতে পারছি না! আচ্ছা ঠিক আছে আমার মনে হয় তোমার মাথায় কোন গণ্ডগোল দেখা দিয়েছে ব্রাউন এলে আমি বলব তোমাকে ছুটি দিতে। (বলে চলে গেল)।
পরদিন বিকেলে ব্রাউন ফিরে এলো।
কর্তা – কি খবর ডেভিড, সব ঠিক আছে?
ডেভিড - হ্যাঁ কর্তা, সব ঠিক আছে ওই বাড়ির জনও এসেছিল ঘোড়া নিতে আমি বলে দিয়েছি আমাদের ঘোড়ার ধার নষ্ট হয়ে গেছে কিছুই কাটেনা, আমার কথা শুনে এটা ওটা কিছুক্ষণ বকবক করে চলে গেছে।
কর্তা – ইস!!!! কি করেছ বেকুব কোথাকার! ঘোড়ার কি ধার নষ্ট হয় না হতে পারে?
ডেভিড - তাহলে কি বলতে হত?
কর্তা – বলতে পারতে যে আমাদের ঘোড়াটার পেটে অসুখ হয়েছে কয়েক দিন যাবত কিছু খেতে পারছে না শুধু পাতলা পায়খানা করছে আর ঘাসও খেতে পারছে না!
ডেভিড - হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক আছে কত্তা আবার যখন আসবে তখন ঠিক এমনি করে বলব, আর ভুল হবে না দেখবেন।
দু এক দিন পরে আবার ব্রাউনের এক মক্কেল কার্ডিফ যেতে বলল। সব কিছু গুছিয়ে নিয়ে ব্রাউন গাড়ি নিয়ে চলে গেল আর যাবার আগে ডেভিডকে ডেকে সাবধানে থাকতে বলে আগের মত উলটাপালটা আবোলতাবোল কিছু যেন না বলে সে ব্যাপারে সাবধান করে দিল।
দুই দিন পরে এক সন্ধ্যায়-
প্রতিবেশী ক্লিফ - ওহে ব্রাউন! বাড়িতে আছ ব্রাউন? চল, অনেক দিন তোমার সাথে পাবে যাই না, আজ তোমাকে যেতেই হবে!
ডেভিড – কি হয়েছে? এত চেঁচাচ্ছেন কেন, কি হয়েছে?
ক্লিফ – কি হে ডেভিড তুমি এমন করে বলছ কেন? ব্রাউনকে একটু ডেকে দাও ওকে নিয়ে আজ পাবে যাব এক সাথে ড্রিঙ্ক করব, অনেক দিন ওর সাথে দেখা হয় না!
ডেভিড – তাকেতো ডাকা যাবে না!
ক্লিফ – কেন?
ডেভিড – তার পেট খারাপ, পাতলা পায়খানা করছে, ঘাস টাস কিচ্ছু খেতে পারছে না বয়স হয়েছেতো দাতেও ধার নেই।
ক্লিফ – কি বললে? ব্রাউন আবার ঘাস খাওয়া শুরু করল কবে থেকে? কি সব আবোল তাবোল বকছ? ডাক ব্রাউনকে! আচ্ছা ঠিক আছে ডাকতে হবে না আমি দেখছি।
এই সীমিত পরিসরে এমন আয়োজন দেখে সবাই ভীষণ খুশী। অভিনেতা আর দর্শক মিলে ১৫/১৬ জন ছিলাম বাকীরা ছিল জাহাজ চলার ডিউটিতে ইঞ্জিন রুমে তবে জাহাজ অটো পাইলটিং এ দিয়ে পার্কারও মাঝে মাঝে এসে ব্রিজের পাশে দাঁড়িয়ে দেখছিল। তুমুল হাততালি। এর পর শুরু হল দ্বিতীয় কৌতুক।
দ্বিতীয় কৌতুক:-
পাখা বিক্রেতা - মহসীন
পাখা ক্রেতা - মিজান
পাখা বিক্রেতা - পাঙ্খা লাগব, পাঙ্খা! গরমে দেহ জুড়াইবেন, মন জুড়াইবেন। পাঙ্খা লাগব পাঙ্খা!
পাখা ক্রেতা - এই পাঙ্খা ওয়ালা, পাঙ্খার দাম কত?
পাখা বিক্রেতা - এইটা দশ পেনি আর এইটা বিশ পেনি
পাখা ক্রেতা - এই এইযে এইটা দাও একটা
পাখা বিক্রেতা - পাখা দিয়ে দাম বুঝে নিল।
পাখা ক্রেতা -পরদিন ক্রেতা ভাঙ্গা পাখা এনে দেখাল, কি পাখা দিয়েছ যে বাতাস নেবার আগেই ভেঙ্গে গেল
পাখা বিক্রেতা - ওহ, ভাইসাব কেমনে বাতাস নিছেন?পাঙ্খা কিনছেন আর বাতাস নেওয়ার কায়দা শিখা যাইবেন না?
পাখা ক্রেতা -কেন যেমনে বাতাস নেয়, এই যে এই ভাবে
পাখা বিক্রেতা - ও বুঝছি, আরে মিয়া দশ পেনি দিয়া পাঙ্খা কিনা আবার এমনে বাতাস নিতে চান? পোলার মায়রে কইবেন পাঙ্খা ধরতে আর আপনে পাঙ্খার সামনে খাড়াইয়া মুখ লারাইবেন। বুঝছেন? যানগা এইবার বাড়ি লইয়া যান।
সবাই বেশ উপভোগ করেছিল। এই সীমিত পরিবেশে যত ছোট আয়োজনই হোক তবুও কিছু একটাতো হয়েছে! এর পরে বেশ কিছুদিন ডেভিডের ওই ডায়লগটা অনেক দিন চালু ছিল, ব্রাউন কয়েক দিন যাবত ঘাস খাচ্ছে না।
এর পর ওয়াহিদ ভাই অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করে লাঞ্চের জন্য সবাইকে আমন্ত্রণ জানাল। ডাইনিং রুমে এসে দেখি এলাহি কারবার। বাটার রাইস উইথ ভেজিটেবল, টার্কি রোস্ট, মাটন লেগ রোস্ট, বিফ কারি (গ্রিক স্টাইল), ভেজিটেবল, সবুজ সালাদ, ফ্রুট কাস্টার্ড, আইসক্রিম এবং ক্যাপ্টেনের পক্ষ থেকে এক গ্যালন ড্রাই জিন আর এক কেস বিয়ার। কোক ফানটা ফ্রি। এই রান্না সব করেছে আমাদের জাহাজের চিফ কুক গ্রিসের মনটি।
দুপুরের খাবার পর সবাই যার যার কাজে চলে গেলাম। জাহাজে এমন অতিরিক্ত মানুষ থাকে না যারা আমাদের ছুটির পরিবর্তে জাহাজ চালিয়ে নিয়ে যাবে। এই ঈদের তিন দিন পরে আমরা সাউথ আফ্রিকার পোর্ট এলিজাবেথে পৌঁছেছিলাম। জীবনের একটা ঐতিহাসিক ঈদের স্মৃতি এখনও মস্তিষ্কের মেমোরি কম্পার্টমেন্টে জমা হয়ে রয়েছে দেখে অবাক লাগছে। কত দিন আগের কথা!
No comments:
Post a Comment
Thank you very much for your comments.