Thursday, 16 August 2012

হল না মোর পটল তোলা এবার এই ঈদে


এইতো কয়েক দিন আগের কথা। তা গত ১০ই আগস্ট হবে মনে হয়, মানে ওই যেদিন ব্লগার্স ফোরামের ইফতার বিতরণের দিন ছিল। ব্লগে এই ইফতার বিতরণ এবং ইফতার পার্টির ঘোষণা দেখেই কোন ভাবে নিজেকে সামলাতে পারছিলাম না। ভীষণ লোভ হচ্ছিল কবে যাব, কবে সবার সাথে দেখা হবে এবং সবার উপরে কবে এই সব দুস্থ পথ
কলিদের সাথে নিয়ে এক সাথে ইফতার করব। গিন্নীর সাথে আলাপ পরামর্শ করতে করতে এক সময় সে একটু বিরক্ত হল। কোন পাঞ্জাবী গায়ে দিয়ে যাব পাঞ্জাবীর সাথে কোন টুপি মানাবে। টুপি মাথায় দিয়েই যাব নাকি পকেটে করে নিয়ে যাব! মাথায় দিয়ে গেলে সবাই কি কাঠ মোল্লা ভাববে? বাড়ি থেকে কখন বের হব, ইনসুলিন বাড়ি থেকে নিয়ে যাব না কি সাথে করে নিয়ে গিয়ে ওখানেই সময় মত নিয়ে নিব, একটু আগে যেতে পারলে সবার সাথেকটু বেশী সময় দিতে পারব কিছু আলাপ বেশী করা যাবে, আড্ডা হবে ষোল কলায় পরিপূর্ণ। ইত্যাদি নানান ভাবে নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছিলাম। সামাজিক ও পারিবারিক ভাবে ওই দিনে যারা নিমন্ত্রণ করতে চেয়েছে সবাইকে বলে দিয়েছি সেদিন আমার নিজের অনুষ্ঠান আছেকারো নিমন্ত্রণ রাখিনি।
আস্তে আস্তে কেলেন্ডারে ২০১২ সালের আগস্ট মাসের পাতায় যেদিন ১০ তারিখ এলো সেদিনের জন্য কোন কাজের বরাদ্দ রাখিনি শুধু বাড়ির দুই একটা ছোট খাট কাজ করে জুম্মা পরব তার একটু পরেই বের হয়ে যাব। বিজয় সরণীর মোড়ের এন্ট্রান্স রেস্টুরেন্ট আমার বাড়ি থেকে আর কতটুকই বা পথ। কাজের মধ্যে যেমন মেঝ মেয়েটার আলমারির তালা নষ্ট হয়ে গেছে বলে আলমারির পাল্লা বন্ধ করতে পারছে না আর ছুঁচো ইঁদুর ইচ্ছে মত আলমারিতে ঢুকে কয়েকটা কাপর কেটে ফেলেছে বলে ওর আলমারির তালাটা বদলে দেব, আর নিজের ঘরে দেয়ালের ঘড়িটা ঝুলানোর জায়গা বদলে দেব যাতে সকালে ঘুম ভাঙলে শুয়ে শুয়ে সময় দেখা যায়।
সকালে ঘুম থেকে একটু দেরিতে উঠে পাড়ার হার্ডওয়ারের দোকান থেকে একটা তালা কিনে আনলাম। হটাত কি মনে হল, না আগে ঘড়ির জায়গাটা ঠিক করে নিই পরে আলমারি ঠিক করব। রমজানের ছুটির দিন বলে বাড়িতে মেয়েরা সবাই ঘুমে, আমার বাবা ছাদে আর বেগম সাহেবা খাটে বসে জানালার দিকে ঘুরে কোরান পড়ছে। সে জানে যে আমি মেয়ের আলমারি ঠিক করব। ঘড়ির জায়গা বদলাব এ কথা তাকে বলিনি বলে সে জানে না।
গ্যারেজে  রাখা টুল বক্স থেকে ড্রিল মেশিন, হাতুড়ি, প্লায়ার, রল প্লাগ, স্ক্রু এসব এনে ড্রেসিং টেবিলে নামিয়ে খালি পায়ে খালি গায়ে গিন্নীর পিছনে খাটের এ পাশে সুইচ বোর্ডের সাথে যেই ড্রিল মেশিনের প্লাগ ঢুকিয়ে সুইচ অন করেছি অমনি কেমন যেন একটা ভয়ংকর অচেনা অনুভূতি উপলব্ধি করলাম।
বাড়ির এই সব টুকি টাকি কাজ সেই ছোট বেলা থেকে নিজেই করি, যতটা প্রয়োজন ততটা সাবধানেই করি। তাছাড়া সেফটির বিষয়ে আমাদের নেভিগেশন স্কুলে একটা সাবজেক্ট ছিল। সেটা পড়েছি, অনেক প্রবন্ধ লিখেছি, অধস্তন কর্মচারীদের ট্রেনিং দিয়েছি এবং নিজেও যখন যেখানে যেমন সাবধানতা মেনে কাজ করতে হয় তার সব করি কিন্তু আজ কি করে যে এই ভাবে খালি পায়ে খালি গায়ে এমনকি ইলেকট্রিকের কাজের জন্য সেফটি গ্লোভসটাও হাতে না পরে এবং সাথে টেঁসটার না নিয়ে এই কাজ শুরু করলাম তা আমি কোন ভাবেই মেলাতে পারছি না। এই ভুল আমি কি ভাবে করলাম?
সে যাই হোক, একটু পরেই সামান্য চেতনা ফিরে এলো। দেখি আমি ফ্লোরে চিত হয়ে পরে রয়েছি আমার স্ত্রী আমাকে ধরে উঠাতে এসে যেই ধরেছে অমনি সেও এক শক খেয়ে আমার হাতে ঝুলন্ত ড্রিল মেশিন দেখে সাথে সাথে বুঝতে পারল এতো চেয়ার থেকে পরে যায়নি, এটা বৈদ্যুতিক শক। এদিকে আমিও দরজা আর ড্রেসিং টেবিলের মাঝে এমন ভাবে পরে রয়েছি যে আমাকে ডিঙ্গিয়ে ঘর থেকে বেরুতে পারছে না। অমনি সে চিৎকার করে তার সহকারিণী রেশমাকে ডাকতে শুরু করল আর ঘর থেকে বেড় হবার পথ খুঁজতে লাগল। রেশমা গ্যারেজ থেকে ওই সব টুলস বের করা পর্যন্ত আমার সাথেই ছিল, আমাকে এই ঘরে ঢুকতে দেখে রান্না ঘরে গিয়েছিল। ভেবেছিল ভাইয়া এখন আর মেঝ আন্টির আলমারি ঠিক করবে না, এ ঘর থেকে বের হলে তখন সাথে যাব।
আমার কিছু চেতনা ফিরে এসেছে। আমি বলছি ডাইনিং রুমে যে সাব ডিস্ট্রিবিউশন বোর্ড আছে ওটার সব সুইচ অফ কর আর সিঁড়ি ঘরের মেইন সুইচ অফ কর। রেশমা রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে এসে আমাকে ওই ভাবে পরে থাকতে দেখে আমার স্ত্রীর মত আমাকে ধরে উঠাতে চেয়ে সেও এক শক খেয়ে ঘাবড়ে গেল। কি হয়েছে? ও ভাবি কি হয়েছে, ভাইয়া এখানে কেন? ওর ভাবি চিৎকার করতে করতে কি করে যেন ঘর থেকে বের হতে পারল।
এর মধ্যে আমি ভাবতে পারছি। নানা কিছু ভাবছি। মনে হচ্ছিল আমার চিন্তা প্রবাহ ঘণ্টায় লক্ষ মাইল বেগে চলছে। আমি ২২ বছরের ডায়াবেটিসের রুগী এবং এখন রোজা করছি স্বাভাবিক ভাবেই দুর্বল শরীর, এভাবে আমি কতক্ষণ থাকতে পারব? আমাকে শক্ত হতে হবে, দেখি আমার শ্বাস বইছে কি না, নাকে হাত দিয়ে দেখলাম স্বাভাবিক, বুকে হাত দিয়ে দেখলাম স্বাভাবিক আছে। ড্রিল মেশিনটা আমার ডান হাতে ঝুলছে এবং হাতটা স্টিল ফ্রেমের চেয়ারের পিছনে কেমনে যেন আটকে আছে। চেয়ারের একটা পা আমার বা পায়ে ছুঁয়ে বিদ্যুতায়িত হয়ে আছে বলে পাটা নারাতে পারছি না। ডান হাত মোটেই নারতে পারছি না। বা হাত দিয়ে ড্রিল মেশিনটা ছাড়াতে চাইলাম কিন্তু পারলাম না। বা হাতে বিদ্যুৎ চলে আসছে। ভাবতে পারছি যে একটা মোটা কাপড় পেলে মেশিনটা ছাড়াতে পারলে হয়ে যেত। ওদের চিৎকারে মেয়েরা জেগে উঠে এমন ভয়ংকর পরিস্থিতি দেখে হতবিহবল হয়ে কিংকর্তব্যবিমুর হয়ে গেল। বড় মেয়েটা আমাকে ধরে উঠাতে গিয়ে সেও এক শক খেল। আমি ওকে বলছি আমাকে ধরবে না কিন্তু বাবাকে এই ভাবে পরে থাকতে দেখে কেইবা মেনে নিতে পারে? ছোট মেয়ে এসেও তার একই অবস্থা। আমি বললাম আমাকে একটা মোটা কাপর দাও আমার ডান পাশেই একটা পাপোষ, খাটের পাশে পাপোষ, বিছানায় জায়নামাজ বিছানো যাতে বসে আমার স্ত্রী তেলাওয়াত করছিল আর ওই পাশেই একটা গায়ে দেয়ার কাঁথা। ও  দিকে কারো দৃষ্টি যাচ্ছে না, ছোট মেয়েটা গলা থেকে ওড়না খুলে দিল। বাম হাতে ওড়না নিয়ে মেশিনটা ছাড়াবার চেষ্টা করলাম কিন্তু পাতলা ওড়না ২২০ ভোল্টের প্রবাহ ঠেকাতে পারল না।
আমি ভাবছি:
মনে হচ্ছে ওরা আমাকে বাচাতে পারছে না, আজ রোজা থেকে জুম্মার দিনে নামাজ না পরেই আমাকে নিয়ে যাবে আল্লাহ! একটু পরেই জুম্মার আজান দিবে, এতো সুখের মৃত্যু কিন্তু আমার স্ত্রীকে যেভাবে চিৎকার আর কান্না কাটি করতে দেখছি, আমার মেয়েরা যে ভাবে কাঁদছে আর ছোটা ছুটি করছে তাতে ওদের কি হবে? মেঝ আর ছোট মেয়ের এখনও যে পড়া লেখা শেষ হয়নি বিয়ে দিতে পারিনি ওদের কি হবে? বিদ্যুতায়িত মানুষ কি এতক্ষণ বেচে থাকতে পারে? যে রক্ত মাংসের দেহে ২২০ ভোল্টএর বিদ্যুৎ ৪/৫ মিনিট ধরে অনবরত প্রবাহিত হচ্ছে সে কি বেচে থাকে? তাহলে কি আমি মরে গেলাম? না! আমি কি তাহলে এখনও মরিনি? তাহলে আমার স্ত্রী সন্তানেরা এমন কাঁদছে কেন? খুকুর মা, তুমি কি এখনও মেইন সুইচটা অফ করে আমাকে বাচাতে পারলে না? মনে হচ্ছে আমি সব কিছুই ঠিকঠাক ভাবতে পারছি তাহলে আমি উঠতে পারছি না কেন? কি হল?
ওদিকে আমার স্ত্রী, রেশমা এবং আমার মেঝ মেয়ে ডাইনিং রুমের সেই সাব ডিস্ট্রিবিউটারের সব সুইচ অফ করেছে সাথে আবার কাট আউট গুলিও খুলে নিয়েছে (আমিই শিখিয়েছিলাম যখন ইলেকট্রিক লাইনে কাজ করবে তখন মেইন কাট আউট খুলে পকেটে নিয়ে বা ভিন্ন কোথাও লুকিয়ে রেখে কাজ করবে যাতে অন্য কেউ না জেনে হটাত করে কাট আউট লাগিয়ে দিতে না পারে)।
এর মধ্যে আব্বা নিচের এই চ্যাঁচামেচি শুনে নিচে এসে সিঁড়ি ঘরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করছে কি হয়েছে? আমার স্ত্রী বলছে মেইন সুইচ অফ করুন তাড়াতাড়ি।
কেন কি হয়েছে?
রেশমা মেইন সুইচ বোর্ডের ঢাকনা খুলে সুইচ অফ করে দিয়েছে কিন্তু আমার স্ত্রী ভিতরে ঢুকে দেখে তবুও ডাইনিং স্পেসের পাখা চলছে!!! একি! তাহলে এখন কি করব? হটাত করেই তার মনে হল আরে, সব কিছু অফ করলে কি হবে, সারা বাড়িতে যে IPS এর লাইন দেয়া রয়েছে। তাহলে ওটা থেকেই বিদ্যুৎ নিয়ে সব কিছু যেমন ছিল তেমনই চলছে। দৌড়ে পাশের স্টাডিতে রাখা IPS এর সুইচ অফ করার সাথে সাথে সম্পূর্ণ বাড়ির বিদ্যুৎ অফ হল এবং আমি দেখলাম আমার হাতে লেগে থাকা ড্রিল মেশিনটা ছুটে পরে গেল।
এবার আমি উঠে দাঁড়ালাম। মেয়েরা সবাই এক সাথে জড়িয়ে ধরে সে কি কান্না! এই এতক্ষণ ধরে যার ভিতর দিয়ে চলছিল ২২০ ভোল্টের বিদ্যুৎ প্রবাহ সেই আমি যেন কিছুই হয়নি এমন ভাবে বললাম কি ব্যাপার তোমরা এমন করছ কেন? আজান দিয়েছে? গোসল করতে হবে নামাজে যাব। মেয়েদের পিছনে ওদের মা, রেশমা আর আব্বা দাঁড়িয়ে। শুনে মেয়েরা বলল
আব্বু কি বলছ তুমি? তোমার কি হয়েছিল জান?
কেন, কি হয়েছিল? হ্যাঁ এইতো ড্রিল মেশিনটা লিক ছিল বলে একটু শক লেগেছিল, এইতো আর কি?
আব্বু শোন।
বলেই ওদের মায়ের দিকে ঘুরে বলল আম্মু বল-
ওদের মায়ের বক্তব্য;
আমি জানি তুমি মাঝুর আলমারির তালা বদলাবে তাই তোমাকে বললাম রেশমাকে সাথে নিও আমি আর কয়েক রুকু পড়ে আসছি। হটাত তোমার কণ্ঠের বাবাগো চিৎকার আর তার সাথে ধপাস করে ভারী কিছু পরে যাবার শব্দ শুনে পিছনে তাকিয়ে দেখি তুমি দরজা আর ড্রেসিং টেবিলের পাশে চিত হয়ে কুকরিয়ে পরে রয়েছ পাশে চেয়ারটা পরে আছে। আমি কোরান শরিফ রেখে তোমাকে তোলার জন্য খাট থেকে নেমে যেই ধরেছি আর অমনি মনে হল কেউ যেন আমাকে টেনে ধরছে। তুমি বলছ মেইন সুইচ অফ কর, তোমার এই কথা আর টেনে ধরা বুঝে অনুমান করলাম এটা ইলেকট্রিকের ব্যাপার, তখন পাশে দেখি তোমার হাতে ড্রিল মেশিনটা ঝুলছে। এদিকে আমি যে রুম থেকে বের হব সে উপায় নেই, তুমি সম্পূর্ণ পথ জুরে রয়েছ। তখন রেশমাকে ডাকলাম ও এসে তোমাকে এই অবস্থায় দেখে আমার মত তোমাকে তুলতে গিয়ে আমার মত একই অবস্থা। এর মধ্যেই আমি কি করে যেন ফাঁক খুঁজে রুম থেকে বের হয়ে প্রথমে ডাইনিং রুমের বোর্ডের সব সুইচ অফ করে কাট আউট খুলে ফেলার পরেও দেখি ফ্যান চলছে তখন সিঁড়ির মেইন বোর্ডের সুইচ অফ আর কাট আউট খুলেও যখন দেখলাম ফ্যান চলছে তখন ভাবলাম আর বুঝি আমি তোমাকে বাচাতে পারলাম না।  হটাত করেই মনে হল কে যেন কানে কানে বলল বোকা IPS অফ করও হ্যাঁ তাইতো, ওটা দিয়ে যে পাওয়ার আসছে তা বন্ধ না হলে হবে না। দৌড়ে তাড়াতাড়ি ওটা অফ করতেই সব ডিসকানেক্ট হবার পর আল্লাহর রহমতে তুমি ছাড়া পেলে। মনে হল আল্লাহ তায়ালা নিজে কোন ফেরেশতাকে পাঠিয়ে আমার কানে ওই কথা বলিয়ে দিয়েছে।
ওদের মায়ের এই কথা শুনতে শুনতে আমি ক্লান্তি বোধ করছিলাম বলে বিছানার পাশে বসেছি কিন্তু কখন যে শুয়ে পরেছি জানি না। মেয়েরা আমার সমস্ত শরীর মেসেজ করে দিচ্ছে। মাঝু আবার নিউট্রিসনিস্ট, ও সমস্ত শরীর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল কোথাও কোন মাংসপেশি শক্ত হয়ে আছে কি না। বড় মেয়ে ব্লাড প্রেশার, পালস রেট, ব্লাড ফ্লো আর সুগার দেখে নিয়ে আমার ফিজিশিয়ানকে ফোন করে জেনে নিল কি করতে হবে। জামাইকে সাথে সাথে দোকানে পাঠিয়ে ওষুধ আনিয়ে নিল। আমি এই কয়েক দিনে ডাক্তার দাউদের সাথে যে হৃদ্যতা হয়েছে সেই সুত্র ধরে তাকে জানাবার জন্য মেয়েদের বললাম আমার ফোনটা এনে দাও। ফোন করলাম কিন্তু কি বললাম না বললাম কিছু না বুঝে ফোনটা আমার গিন্নীর কাছে দিয়ে জড়ান কণ্ঠে বললাম কথা বল তোমার নাতির সাথে।
মেঝ মেয়ে এক গ্লাস গরম দুধ এনে বলল খেয়ে নাও সমস্ত শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গেছে
আমি রোজা না?
হ্যাঁ রোজা আছ ঠিক আছে কিন্তু এখন এই দুধ খেলে রোজা ভাঙবে না, নাও খাও
বলে আমার মাথাটা দুই বোনে মিলে বালিশ থেকে উঠিয়ে ঠোটের কাছে গ্লাসটা ধরল আর আমিও কেমন যেন সম্মোহনের ঘোরে খেয়ে ফেললাম, এমনিতেও ভীষণ পিপাসা পাচ্ছিল কিন্তু রোজা আছি আবার ইফতারির অনুষ্ঠানে যাব বলে কিছু বলছিলাম না।
আব্বু তোমাকে আবার নতুন করে পেলাম আমরা!
হেয়ার ড্রাইয়ার আর এস্ত্রি এনে তোয়ালে গরম করে আমাকে গরম রাখার চেষ্টা করছিল

ডাক্তার দাউদের সাথে কথা বলে আরও কার কার সাথে যেন কথা বলল, সবাইকে বলল দোয়া করতে বলবেন। পরে সম্পূর্ণ চেতনা ফিরে পাবার পর জানলাম শিবলি ভাই আর লুবনা আপাকে ফোন করে আমাদের ইফতারে যাওয়া হচ্ছে না এই কথা জানিয়ে দিলাম আর দোয়া করতে বললাম। এদিকে বড় মেয়েটাও দেশে বিদেশে সব আত্মীয় স্বজনদের কাছে এই সংবাদ পৌঁছাবার চেষ্টা করছে। এক ফাকে বলল আমি গত কয়েক দিন ধরে আব্বুকে নিয়ে নানান হাবিজাবি দুঃস্বপ্ন দেখছিলাম, মাঝুও তাই বলল এ কথা শুনে ওদের মাও একই কথা বলল। আমার বোন বলল আজ কেন যেন হটাত করে আমার হাত থেকে বালতি পরে ভেঙ্গে গেল। সময় হিসেব করে ও বলল হ্যাঁ ফুপি ঠিক একই সময়ে ঘটেছে এই ঘটনা। ইংল্যান্ডে ওদের সেঝ চাচী বলল তোমার চাচা আজ সেহেরী খেয়ে বলছিল আমার এমন অস্থির লাগছে কেন? ওদের এই সব কথা ঘোরের মধ্যে থেকে কিছু কিছু শুনছিলাম।

যে মানুষটাকে নিয়ে জীবনের সুদীর্ঘ ৩৬ টি বছর পার করে দিলাম এর মধ্যে কত ঈদ আনন্দ দুঃখ কেটেছে কিন্তু কোন দিন যার মুখ থেকে এ কথা শুনিনি যে এবার ঈদে বা এই অনুষ্ঠানে আমাকে এটা ওটা কিনে দিবে সেই মানুষ এবার রমজানের শুরু থেকেই বলছিল এবার আমাকে খুব দামী একটা শাড়ি দিবে আর শাড়ির সাথে ম্যাচ করে সব কিছু কিনে দিবে। আমি শুনে ভাবছিলাম এ কি শুনছি? জীবনে কোন যা শুনিনি! এত কাল প্রতিবার জিজ্ঞেস করে বরাবরের মত এক উত্তর (যা আমার মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল) পেয়ে আমার পছন্দ ও সাধ্য মত যা কিনেছি তাতেই খুশী দেখে অভ্যাস হয়ে গেছে কিন্তু সেই খুকুর মা এবার এমন করে কেন বলছে??? খুকুর মা কি আমার সাথে রসিকতা করছে! মনে কেমন যেন একটা খটকা লাগল। কেন এমন করে বলছে? এই কি তাহলে আমার শেষ দেয়া??? অবাক হয়ে শুনেছি। এইতো কয়েক দিন আগে বাজারে গিয়ে একটা VISA কার্ড হাতে দিয়ে বললাম তোমার যা ইচ্ছা দেখে পছন্দ করে নিয়ে চল, আনলিমিটেড। কিচ্ছু ভাববে না শুধু দেখবে পছন্দ করবে আর ট্রলিতে ভরবে। বড় জামাই শাড়ি দিয়েছে বলে শাড়ি কিনেনি। শুধু এক জোড়া স্যান্ডেল আর একটা পাথরের কানের ফুল ব্যাস এই! আমি দেখে অবাক! কি ব্যাপার, শাড়ি??
শাড়ি দিয়ে কি করব?
অন্য কিছু?
অন্য আবার কি?
এ কয়দিন ধরে যে বললে!
যখন বলেছি তখন বলেছি, তাই বলে কি সত্যিই কিনতে হবে?
বাহ! নিজেই বললে আবার কি হল?
আরে না আমি এমনিই বলেছি চল, এই নাও কার্ড।
পকেট থেকে পেমেন্ট দিয়ে চলে এসেছি।

সে রাত কোন ভাবে কেটে গেল। সেহেরীতে ডাকেনি। সব টের পেলাম পরদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গার পর। সমস্ত শরীরে ব্যথা আর যেখানে যেখানে আঘাত লেগেছে সে সব জায়গা নীল হয়ে গেছে। যে হাতে মেশিনটা ধরা ছিল ওই হাতে কেমন যেন আগুনে স্যাকা লাগা ভাব, পরে যাবার সময় ড্রেসিং টেবিলের কোনায় লেগে ডান হাতের বাহুতে, ডান হিপ জয়েন্টের নিচে যেখানে ফ্লোরে পরেছিলাম সেখানে আর বা পায়ের হাঁটুতে কি করে যেন আঘাত লেগে নীল হয়ে আছে আর পরার ঝাঁকুনিতে কোমরে যে আঘাত লেগেছে তার ব্যথায় দাড়াতে পারছি না।

যখন সম্পূর্ণ চেতনা ফিরে পেলাম তখন ভাবলাম, ভেবে দেখলাম কেউ মানুক বা না মানুক এই পৃথিবীতে যত শক্তি আর ক্ষমতা আছে তার সব কিছুর একচ্ছত্র অধিপতি আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং। তিনি যখন যা ইচ্ছে তাই করতে পারেন। এই আমারই কত কি হতে পারত! ফাইনাল স্টেজে পটল তুলতে পারতাম, যে হাতে মেশিনটা ধরে ছিলাম সেটা পুরে যেতে পারত কিংবা সারা জীবনের জন্য অবশ হয়ে যেতে পারত, শরীরের ভিন্ন কোন অঙ্গ প্যারালাইজড হতে পারত, স্মরণ শক্তি বিলুপ্ত হতে পারত। কিন্তু কিছুই হয়নি। অর্থাৎ তিনি চাননি কিছু হোক। আলহামদুলিল্লাহ। বাড়িতে এখনও একটা আতংকের ঝর বইছে। কি হয়ে গেল! আত্মিয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব আর পাড়া প্রতিবেশিরা এসে দেখে যাচ্ছে।
দেখে এলাম ওপাড়ে যাবার দরজা। সত্যিই নব জীবন।



No comments:

Post a Comment

Thank you very much for your comments.