Sunday 14 August 2011

আমরা কি সত্যিই ঈদে পরিপূর্ণ আনন্দ পাই?

ঈদ মানে আনন্দ বা খুশী। নানা ভাবে মানুষ আনন্দ পায়। শুধু মানুষ কেন প্রকৃতির যে কোন প্রাণীই আনন্দ, দুঃখ কষ্ট, ব্যথা বেদনা ইত্যাদি অনুভব করে। এর নির্দিষ্ট কোন সংজ্ঞা নেই। কে কিসে আনন্দ পাবে তা সে নিজেও সঠিক জানে না। স্থান, কাল, পাত্র, সমাজ, সামাজিক অবস্থান, পরিবেশ বা পরিস্থিতির এদিক ওদিকের কারণে নানা জনের আনন্দের সংজ্ঞা ভিন্নতা পেয়ে থাকে। কেউ আনন্দ পায় ভোগ করে কেউ পায় ত্যাগ করে।
কেউ আনন্দ পেতে চায় একা একা কেউ আবার সবাইকে সাথে নিয়ে। যদিও আনন্দ করতে হয় সবাইকে নিয়ে আর দুঃখ করতে হয় নীরবে বা একা একা।
ঈদের আনন্দ মানে রমজানের শেষে সারা মাস সিয়াম সাধনা করে সবাই মিলে ভাল পোশাক পরে ভাল খাবার খেয়ে সুন্দর পরিবেশে সব শত্রুতা, মারামারি, হিংসা বিদ্বেষ ভুলে আনন্দ করা। আত্মীয় স্বজন, বন্ধু-বান্ধব বা পারা প্রতিবেশীর  সাথে কিছু সময় কাটানো থেকে কার বাড়িতে কি রান্না করেছে মজার সে সব খেয়ে এবং তার তারিফ করে। এই তারিফ করার মধ্যেও কিন্তু একটা মেকী ভাব অনেক সময় থেকে যায় যা আমরা অনেক সময় লক্ষ করিই না।
ইদানীং দেখছি রমজানের শুরুতেই বা এর আগে থেকেই শুরু হয় কে কোন কোন ধরনের পোশাক বানাবে এবং কি কি রান্না করবে তার এক বিশাল ফর্দ তৈরি হয়ে যায়। কাকে নিয়ে কোথায় বেড়াতে যাবে, কি করবে এই সব নিয়েই ব্যস্ততা এবং অনেক সময় মান অভিমানের মহড়া চলতে থাকে। অনেকে আবার দেশের বাইরে কোথাও চলে যান বেড়াতে। যেখানে না হয় ঈদের নামাজ আদায় করা, না পাওয়া যায় নিজ দেশের ঈদের চিরাচরিত সনাতনী আবহ বা নিজের আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধব পাড়া প্রতিবেশীর দেখা। ঈদের অর্ধেক আনন্দতো এখানেই নেই হয়ে গেল, তা হলে কি আনন্দ করলাম বুঝি না। অথচ পত্রিকায় নানান ট্রাভেল এজেন্সির নানা রকম চমকদার বিজ্ঞাপন দেখি। সিঙ্গাপুর, নেপাল, থাইল্যান্ড ইত্যাদি নানা জায়গায় যাবার আমন্ত্রণ থাকে তাতে। অবশ্যই অনেকে এমন যেয়ে থাকেন বলেই এই সব বিজ্ঞাপন দেখা যায়। আবার এর বিপরীতে অনেকেই বিদেশ থেকেও তার প্রিয় জনের আসার অপেক্ষায় থাকে। বিদেশেও ওই সময় এয়ারলাইন্সের টিকেটের দাম বেড়ে যায়।
অনেক অমুসলিম দেশে দেখেছি যারা উৎসব বলতে পান করে মাতাল হয়ে পরে থাকাকেই বোঝায়। আমি একবার জরিপ করে দেখেছি কে কতটা পান করেছে। তাতে শুনেছি এক জনে এক ক্রিস্টমাসে ৬৩ পাইন্ট (প্রায় ৩০ লিটার) বিয়ার পান করেছিল। ওদের দেশে এমনটাই হয়ে থাকে। সাধারণ সাপ্তাহিক ছুটির দিনে অর্থাৎ শুক্রবার ও শনিবার রাতে মাতাল হয়ে যখন অসুস্থ হয়ে পরে তখন সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে হয়। সমস্ত দায় যেন সরকারের। ওই দুই দিন পুলিশ এবং এম্বুলেন্সের ডিউটি বেড়ে যায়। ইদানীং এ ধরনের উল্লাস নিরুৎসাহিত করার জন্য আইন করে মাতালের চিকিৎসা বন্ধ করে দিয়েছে বলে শুনেছি। যাই হোক এরা যা ইচ্ছে তাই করুক আমরা যেহেতু ওই ধাঁচের নই কাজেই আমার বক্তব্য ওদের নিয়ে নয়।

এই যে এত কিছু, এতে কি সত্যিকারে আনন্দ পাওয়া যায়? ভোগে নয় ত্যাগেই প্রকৃত সুখ। এই মহা বাক্য সামনে রেখে আমরা আনন্দ যাপনের, উৎসব উদযাপনের কোন ভিন্ন সংজ্ঞা রেখে যাতে পারি কি না সেই ভাবনাই ভাবছি। নানা ছল ছুতায় আমার জীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে দেশের বাইরে। এইতো প্রায় দশ বছর একটানা বিদেশে কাটিয়ে গত বছর দেশে ফিরেছি। আর ফেরার দুই এক মাস পরেই রমজানের ঈদ। দেশের অবস্থা দেখে, মানুষের ক্রয় ক্ষমতার সাথে বাজার দরের তারতম্য দেখে মনে একটু দ্বিধা নিয়ে নেহায়েত এত দিন পর নিজের সন্তানদের তাদের বাবার সাথে ঈদের আমেজ নষ্ট করতে না দিয়ে তাদের স্বাভাবিক চাহিদানুযায়ী ঈদের বাজার করতে বাজারে যেয়ে অনেক দিন আগের এক ঈদের কথা মনে পরে গেল। কেনাকাটা বন্ধ রেখে ওখানেই এক পাশে দাঁড়িয়ে সন্তানদের সেই দিনের গল্প বললাম-
বেশ অনেক বছর আগে আমার এক দরিদ্র আত্মীয়ের বাড়িতে তাদের সাথে ঈদ করতে হয়েছিল এবং সেই ঈদে ও বাড়ির সবার তাদের নিজ পছন্দ মত কাপড় চোপর সহ ঈদের দিনের সব রান্নার বাজার আমি করেছিলাম। দুই দিন আগে ওদের নিয়ে ঢাকার এক মার্কেটে এসে ওদের পছন্দের কাপড় কিনেছিলাম। ওরা প্রথমত বুঝতে পারেনি কি হতে যাচ্ছে। ওদের যখন যার যার পোশাক বাছাই করতে বললাম ওরা বেছে বেছে কম দামের কাপড় বাছাই করছিল দেখে ধমক দিয়ে বলেছিলাম ওগুলি দেখছ কেন? তোমার যা ভাল লাগে, যা সুন্দর লাগে তাই দেখ। শুনে ওদের মধ্যে যে বড় সে একটু আমতা আমতা করে বলেছে, এত দাম! দাম তাতে তোমার কি? তোমাদের যার যা পছন্দ হয় তাই দেখ, টাকা আমি দিচ্ছি। মেয়েদের চুলের ফিতা, ক্লিপ, মেক আপ ইত্যাদি সহ জুতা স্যান্ডেল কিছু বাদ দিইনি। সেদিনের সেই ঈদে ওই বাড়ির ছেলে মেয়েদের আনন্দ মাখা চেহারা দেখে আমার মনে এক স্বর্গীয় অনুভূতি এসেছিল যা আমি আমার সারা জীবনে কোন কিছুতেই পাইনি। এই আনন্দ ওরা সমস্ত জীবনেও দেখেনি, ঈদে যে নতুন কাপড় পরতে হয় তা তারা এই প্রথম আবিষ্কার করেছিল এবং ঈদের দিন নিজ বাড়িতে মাংস পোলাও, বিরিয়ানি, সেমাই রান্না করা যায় তাও ওরা ওই প্রথম দেখেছে।  প্রায় ১৫/১৬ বছর আগের হলেও আজও সে কথা মনে এলে সেই অনুভূতি চোখ বেয়ে দু’ফোটা হিরের টুকরোর মত ঝরে পরে। আমার এই গল্প যদিও আমার সন্তানেরা জানে তবুও সময়ের ব্যবধানে সেদিন যেন আবার নতুন করে ওরা অনুভব করতে শিখল। দুই মেয়ে এক সাথেই বলে উঠল “আব্বু আমাদের জন্য কিছু লাগবে না। আমাদের অনেক আছে, তুমি ওদের জন্য কেন”। শুনে আমার চোখ বেয়ে আবার সেই  অনুভূতি ঝরছিল দেখে আমার ছোট মেয়ে ওড়নার আঁচল দিয়ে মুছিয়ে দিয়ে মার্কেটের ভিতরে নিয়ে সেই ওদের জন্য কেনাকাটা করেছিল। নিজ সন্তানদের উপযুক্ত শিক্ষা দিতে পেরেছি দেখে আমার প্রাণটা জুড়িয়ে গেল।
আমাদের মধ্যে যাদের সঙ্গতি আছে সেই আমরা আমাদের জীবনে অন্তত একটিবার কি এমন করতে পারি না? কারো জীবনে যদি অন্তত একটি ঈদের আনন্দ পেতে হাত দুটি বাড়িয়ে দিতে পারি মন্দ কি?

No comments:

Post a Comment

Thank you very much for your comments.