Thursday 9 September 2010

সে দিনের ঈদ গুলি

আমার ছেলেবেলার ঈদ নির্দিষ্ট কোন শহর বা এলাকায় কাটেনি। বাবা সরকারি চাকরি করতেন বলে তাকে বিভিন্ন সময় দেশে বিদেশের নানা যায়গায় থাকতে হয়েছে। এই সুবাদে মানিকগঞ্জের ঝিটকার পাশে আমাদের নিজ গ্রামে নিজ বংশের আত্মীয় স্বজনের সাথে এমনকি ধামরাইর পাশেই নানা বাড়িতেও কয়েক বার ঈদ করার সুযোগ পেয়েছি। এ সময়ে নামাজ সেরে ফেরার পথে পূর্ব পুরুষদের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে কবর জিয়ারতের অভ্যেসটা তখন বাবার কাছেই শিখেছিলাম।

তখনকার ঈদ এবং আজকালের ঈদের মধ্যে কোথায় যেন একটু ভিন্নতা লক্ষ করি। তখন ছিল নিছক অনাবিল আনন্দের ঈদ আর আজকাল কেমন যেন পোশাকি একটা অনুষ্ঠানের মত মনে হয়। তখন আমরা যে আনন্দ পেয়েছি তা আজ কাল ছেলে মেয়েরা পায় কিনা বলতে পারব না। তবে এমনও হতে পারে যে আজকাল ঈদের বা অন্য যে কোন আনন্দের সঙ্গা ও বদলে গেছে।

তখন আমার বাবা এমন কোন চাকরী করতেন না যে তিনি প্রতি ঈদেই নতুন জামা কাপড় দিতে পেরেছেন। পুরনো যা আছে দেখেছি মা তাই সুন্দর করে ধুয়ে কয়লার ইস্ত্রি দিয়ে ইস্ত্রি করে তুলে রাখতেন নামাজ পরতে যাবার সময় গায়ে দেবার জন্য। এবং এ নিয়ে আমাদের কখনো মাথা ঘামাতে হবে এমন করে ভাবতে শিখিনি। শীত কালে ঈদ হলে সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখতাম গোসলের জন্য মা পানি গরম করে রেখেছেন। আগেই কিনে আনা সুগন্ধি সাবান নিয়ে বাবা আমাদের ভাই বোনদের একে একে নিয়ে বাথ রুমে ঢুকতেন আর ডলে ডলে গরম পানি সুগন্ধি সাবান দিয়ে গোসল করিয়ে দিতেন। গোসল হলে মা আবার ওই সব কাপড় গায়ে দিয়ে আতর মেখে দিতেন।

ওই সময়ে আমাদের ঈদের আনন্দ শুরু হতো রোজার শুরু যেদিন হতো সে দিন থেকেই। বাড়িতে মায়ের কোন সাহায্যকারী ছিল না এমনকি আমার কোন বড় বোনও ছিল না তাই মাকে সাহায্য করতে হতো আমাকেই। অন্যান্য ভাই বোনেরা বেশ ছোটই ছিল। পেয়াজ রসুন ছেলা বা এটা ওটা ধুয়ে দেয়ার কাজটা আমি বেশ আগ্রহ নিয়েই করে দিতাম।

তখন আবার এখনকার মত চাকুরী জীবী দের উত্সব ভাতা বলে কিছু ছিল না যা দিয়ে ঈদের বাড়তি খরচ মেটাতে পারতেন। তখন যা পেতেন তা হচ্ছে যে মাসে ঈদ হচ্ছে সেই মাসের বা তার পরের মাসের অগ্রীম বেতন। যাই হোক বাবাকে দেখেছি যে বছর আমাদের জন্য নতুন জামা জুতা কিনবেন তখন দাম বেড়ে যাবার আগেই রোজার শুরুতে আমাদের সাথে নিয়ে বাজার থেকে কাপড় কিনে আনতেন আর তাই কেটে মা নিজে সেলাই করে নিতেন। মেশিনে সুতা লাগিয়ে দেয়া বা কোন সেলাই ভুল হলে তা খুলে দেয়ার কাজটা মা আমাকে দিয়েই করাতেন। ফলে যা হবার তাই হোল। আমি নিজেও এক সময় মার মত কেমন করে যেন কাপড় চোপর কাটি কুটি থেকে সেলাই করা সব শিখে ফেললাম। মা যখন ফিতা ধরে গায়ের মাপ নিতেন তখন থেকেই নতুন কাপড়ের গন্ধ মাখা একটা রোমাঞ্চ অনুভব করেছি। আবার কিছুটা সেলাই করে গায়ের সাথে মিলিয়ে মা দেখে নিতেন সেই তখন থেকেই অস্থিরতায় থাকতাম কখন সেলাই শেষ হয়ে জামাটা আমার গায়ে লেগে যাবে। যে দিন মায়ের সেলাই, বোতাম লাগান, বোতামের ঘর কাটা সব শেষ করে গায়ে দিয়ে পরখ করতেন ইস তখন যে কি আনন্দ পেতাম তা আজ এই বার্ধক্যের প্রথম প্রান্তে এসে এখনও ভুলতে পারি না। সেলাইর প্রতিটা ফোঁড়ে মায়ের স্নেহ আর যত্নের ছোঁয়ার কি কোন তুলনা হয়? মায়ের নিজে সদ্য তৈরী করা জামা বা প্যান্ট ঠিক ভাবে গায়ে লেগে গেছে দেখে মায়ের মুখের মধুর তৃপ্তি মাখা মৃদু হাসিটা আজও ভুলতে পারি না।

মার ঐ শিক্ষা থেকে আমিও আমার মেয়েদের জন্য এই ব্যবস্থা করেছি। আমার স্ত্রীও এমনি করে নিজের সন্তানদের জন্য নিজে হাতে পোষাক বানিয়ে দিত যখন ওরা ছোট ছিল। কাপড় সেলাই হলে তাতে নানা রকম হাতে কাজ করা এমব্রয়ডারি বা ফেব্রিক পেইন্ট দিয়ে আবার এক ধাপ সাজ সজ্জা দেখতে বেশ লাগত। সেই রেশ ধরে আমার মেয়েরা সেদিন বলছিল আব্বু যতই যা কিনে দাও না কেন সেই যে তুমি আর মা মিলে আমাদের জামা কাপড় বানিয়ে দিতে সে গুলি গায়ে দিয়ে যে আনন্দ পেতাম আজকাল এত দামের এই সব কাপড় গায়ে দিয়েও আর তেমন আনন্দ লাগে না। মেঝ মেয়ের এই কথা শুনে বড় এবং ছোট মেয়ে এক সাথে তাল মিলিয়ে বলে উঠেছিল হ্যা আব্বু মেঝ ঠিক বলেছে!! শুনে কেন যেন আমার চোখ দুটি ভিজে এসেছিল সাথে সাথে ওদের তিন বোনকেই বুকে জড়িয়ে নিয়েছিলাম।

আজকাল দেখি যুগের পরিবর্তনে বাবা মা ছেলে মেয়েদের সাথে নিয়ে তৈরী পোষাকের দোকান ঘুরে ঘুরে নামি দামি কোম্পানির লেবেল আটা পছন্দের কাপড় বেছে চড়া দামে কিনছে। এতে আর যাই হোক মায়ের ছোয়া মাখা মমতার স্পর্শ কি পায় আজকের এই ছেলে মেয়েরা?আনন্দের প্রথম পশলার ঘাটতি তো এখানেই থেকে যাচ্ছে। এ কথা ভাবার সুযোগ কি হয় যে ঈদের আনন্দের প্রথম অনুভব মায়ের স্পর্শ আমার সাথেই আমার গায়ে লেগে রয়েছে?নাকি দামী ফ্যাশন কোম্পানির লেবেল লাগানো পোষাক মায়ের বিকল্প স্বাদ দিতে পেরেছে জানি না।

এর পর আসছি খাবার দাবারে। রোজার শুরু থেকেই মাকে দেখতাম সামান্য একটু করে ময়দা মেখে হাতে নিয়ে চিমটি কেটে দুই আঙ্গুলে ডলে জিরার আকারে এক রকম সেমাই বানাতেন আমাদের মানিকগঞ্জের ভাষায় এই সেমাইর নাম যব দানা। অবসরে বেশ কয়েক দিন ধরে বানিয়ে জমা করে রোদে শুকিয়ে কাচের বয়াম ভরে রেখে দিতেন। ঈদের দিন সকালে এই যব দানা ঘিয়ে একটু ভেজে সেমাইর মত কি করে যেন রান্না করতেন আমার খুবই প্রিয় সেমাই ছিল এটা। সারা রোজা ভরে পাড়া প্রতিবেশীদের বাড়িতে ইফতার বিলি করতেন আর সেই ইফতার সাজান খঞ্চা বা ট্রে সুন্দর করে মায়ের হাতে কাজ করা একটা পর্দা দিয়ে ঢেকে আমার হাতে দিয়ে বলে দিতেন যা এটা ওদের বাড়ি দিয়ে আয়। এ ভাবে এক এক করে এলাকার প্রতিটা বাড়িতেই দেয়া হতো। মাঝে মাঝে এর মধ্যে আমার বিশেষ বন্ধুর বাড়িতে একটু আগে বা একটু বিশেষ আয়োজন করে দেয়ার জন্য আমি আবার বায়না ধরতাম। আবার ওই সব বাড়ি থেকেও একেক দিন বা কোন দিন এক সাথে কয়েক বাড়ি থেকেও ইফতার আসত।
আবার বাবার কলিগ বা বন্ধুদের বাবা ইফতার করার জন্য দাওয়াত করতেন তাদের বাড়ি যেতাম। আমাদের বাসায় ও তারা আসতেন। এই দিন গুলিতে ছিল আনন্দের আর এক মাত্রা। তবে একটু দূরে কোথাও হলে তারাবীর নামাজে উপস্থিত থাকতে পারবেন না বলে বাবা দূরে কোথাও যেতে চাইতেন না।

রোজার শেষ দিনে ইফতারি করেই বের হতাম বাসার বাইরে বন্ধুদের সাথে চাঁদ দেখতে। চাঁদ দেখা গেলে সে কি আনন্দ চিতকার উল্লাস! চিতকার করতে করতেই বাসায় আসতাম, “মা মা চাঁদ দেখেছি, কাল ঈদ হবে” কই দেখি বলে মা বাবাও বের হতেন। চাঁদ দেখেই বাবা ব্যাগ নিয়ে বের হতেন বাজারে যাবার সময় সাথে আমার হাত ধরে নিয়ে যেতেন। মাংশ, চাউল, সেমাই, বাদাম ইত্যাদি নানা কিছু যা যা মা একটা লিস্টে লিখে দিয়েছেন তাই দেখে লিস্টের সাথে মিলিয়ে বাবা এক এক করে কিনে নিতেন। ফিরে এসে দেখতাম সারা মহল্লায় মশলা বাটার ধুম। তখন আবার এখনকার মত ঘরে ঘরে ফ্রিজ নামক ঠান্ডা আলমারি ছিল না। আদা, রসুন সহ নানা মশলার গন্ধে বাসায় ঈদ শুরু হয়ে যেত তখন থেকেই। অনেক রাত অবধি মা নানা পদ রান্না করে রাখতেন। আমিও পাশে বসে থাকতাম। মা কে এটা ওটা এগিয়ে দিতাম কিংবা অন্তত ছোট ভাই বোনকে সামলাতাম। রান্নার মাঝে একটা চামচে করে একটু ঝোল বা মাংশের টুকরা উঠিয়ে আমার দিকে বারিয়ে দিতেন, দেখতো লবন হয়েছে না কি? সে যে কি আনন্দ তা কি আর শুধু ভাষায় প্রকাশ করা যায়? এ যে শুধুই অনুভবের, একান্ত হৃদয়ের গভীরের অনুভুতি। মায়ের হাস্যোজ্জ্বল মুখে বিন্দু বিন্দু ঘামের ঝিলি মিলি কি আর কিছুতে পাওয়া যায়? সে যে এক স্বর্গীয় আনন্দ।
ঈদের সকালে সেমাই, ক্ষীর বা পায়েস বা ফিরনি আর গোরুর মাংস এবং খিচুড়ি। নামাজ পরে এসে দেখতাম মা সব রান্না বান্না শেষ করে গোসল করে নতুন শাড়ী থাকলে তাই পরে থাকতেন। এসেই আগে মায়ের পা ছুঁয়ে সালাম করে বাবাকে সালাম করতাম পরে বাবার সাথে ভাইয়ের সাথে কোলা কুলি। এবার বাবা কিছু টাকা দিতেন সারা দিন ধরে ইচ্ছে মত খরচ করার জন্য। নামাজের মাঠে সবার সাথেই কোলাকুলি করে এসেছি।

নামাজ সেরে এসে আবার পোলাও মাংশ এবং কোর্মা খেয়ে বের হতাম। মহল্লায় সব বাসায় চাচীদেরকে সালাম করতে গিয়ে সেখানেও কিছু খেতে হতো। সারাটা দিনই বন্ধুদের সাথে ঘোরাঘুরি এটা ওটা দেখা। দিনের শেষে ক্লান্ত হয়ে চোখে ঘুমের রেশ নিয়ে বাসায় ফিরে এলে মায়ের এক পশলা মিষ্টি বকুনি হজম করে বাথরুমে ভরা বালতিতে দাঁড়িয়ে হাত মুখ ধুয়ে এসে মায়ের আচল দিয়ে হাত মুখ মুছতাম। মা আবার আর এক দফা বকে রাতের খাবার আয়োজন করতেন। রাতে সাধারনত বিরিয়ানি হতো। এই ছিল আমাদের বাড়ির ঈদের খাবারের রেওয়াজ যা এখনো আমার স্ত্রী টিকিয়ে রেখেছেন।
সারা দিন বাসায় কে এলো বা মা বাবা কোথায় গেছেন কিছুই জানতাম না। বাবা, ছোট ভাই বোন সবাই মিলে খেয়ে দেয়ে সাথে সাথেই এত কাঙ্খিত মহা আনন্দের ঈদের সমাপ্তি ঘটিয়ে বিছানায় শুয়ে পরতাম। সারা দিনের ফিরিস্তি ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পরতাম কিছুই টের পেতাম না।

আজ এই জীবন সায়াহ্নে এসে ভাবি আহা অমন ঈদ যদি আমাদের ছেলে মেয়েরা দেখতে পেত!!
জীবনে যে কত দেশের কত শহরে ঈদ করেছি সে অনেকের কাছে বিস্ময় বলে মনে হবে। এর মধ্যে একটা মজার ঘটনা বলি। ঈদের আগের দিন জাহাজ দুবাই এসেছে, দুবাই সমুদ্র বন্দরের গেটের বাইরে এসে দেখি কাছেই ঈদ গাহ। বন্ধুরা সিদ্ধান্ত নিলাম কাল তা হলে এখানে ঈদের নামাজ পড়ব। সকালে উঠে যথারীতি গোসল করে কাপড় চোপর পরে চলে এলাম মাঠে কিন্তু কোন প্রাণীর চিহ্ন নেই, নেই, নেই। কি ব্যাপার? অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে মহসীন বলল চল গেটের সিকিউরিটিকে জিজ্ঞেস করে দেখি কখন জামাত হবে। সিকিউরিটি বির দর্পে জানাল আরে তোমরা কোন দেশ থেকে এসেছ? জামাত তো ফজরের নামাজের পরেই হয়ে গেছে এখানে ঈদের নামাজ পড়তে চাইলে কোরবানির ঈদ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে যাও যাও জাহাজে ফিরে যাও। সবাই মনে একটু দুঃখ নিয়ে জাহাজে ফিরে এসেছিলাম। এছাড়া করাচী, বাহরাইন, ইরান, অক্সফোর্ড, গ্লস্টার, বার্মিংহাম, লেস্টার, লন্ডন, কার্ডিফ, নিউক্যাসেল, চট্টগ্রাম, খুলনা, মংলা, ঢাকা অন্তত এই শহর গুলিতে ঈদ করেছি বলে মনে পরছে। এবার প্রায় ১০ বছর পর আবার ঢাকায় ঈদ করব ইনশাল্লাহ.

2 comments:

  1. কী দারুণ লিখেছেন খালিদ দা! স্থানীয় কোনো কাগজে ছাপতে দিয়ে দিন। ঈদের এমন লেখা আমার পড়বার সুযোগ হয় নি। আমাদের এখানকার কাগজেও দু'একটা বেরুবে ঈদের দিনে। কিন্তু সেগুলো শুধু তার ধর্মীয় অনুষঙ্গে। বৌদিকে সহ আপনারা সবাই আমার ঈদের প্রাণ ভরা শুভেচ্ছা জানবেন। আপনার সঙ্গে অনেকদিন আড্ডা হচ্ছে না বলে খালি মনে হয়, আপনি বিদেশে থাকলেই আমার ভালো ছিল।

    ReplyDelete
  2. ধন্যবাদ সুশান্ত।
    আমাদের এখানে পত্রিকায় কিছু ছাপানো কঠিন ব্যাপার বলে অমন করে ভাবি না। এমনি তোমরা দেখছ এই তো বেশ। সত্যি তোমার সাথে আড্ডা হচ্ছে না এটা আমাকেও পীড়া দেয় কিন্তু কিছু বুঝি না কি করব, এখানে নেট স্পিড বড়ই ধীর। মাঝে মাঝে মেজাজ ঠিক রাখতে কষ্ট হয়। চেষ্টা করব মেইলে অন্তত ঈদের কয়েকটা ছবি পাঠাতে
    তোমার শুভেচ্ছা সবাইকে পৌছে দিলাম। সামনে তোমাদের পূজা আসছে তার জন্য তোমাদের সবাইকে আমাদের পক্ষ থেকে অগ্রীম শুভেচ্ছা জানিয়ে রাখলাম।

    ReplyDelete

Thank you very much for your comments.